November education – Somenath Bhattacharya


১৷ শোষণহীন সমাজ গড়ার দর্শন মার্কসবাদ। এর রচয়িতা কার্ল মার্কস (১৮১৮-১৮৮৩) এবং ফ্রেডরিক এঙ্গেলস (১৮২০-১৮৯৫)। শোষণহীন সমাজ গড়া যে সম্ভব তন্নিষ্ঠ গবেষণা করে তা তারা দেখিয়েছেন। কিন্তু দুঃখের হলেও সত্য বাস্তবের মাটিতে তারা সেই সমাজ প্রতিষ্ঠা করে যেতে পারেননি। তাদের সেই অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করলেন কমরেড লেনিন (১৮৭০-১৯২৪)। রাশিয়ায় ১৯১৭-য় অক্টোবর বিপ্লবের মধ্য দিয়ে আত্মপ্রকাশ করলো পৃথিবীর প্রথম সমাজতান্ত্রিক দেশ। গড়ে উঠলো সোভিয়েত ইউনিয়ন। গোটা জগতের সামনে লেনিন দেখিয়ে দিলেন মার্কস এঙ্গেলস বর্ণিত শোষণহীন সমাজ গড়া সম্ভব। সমাজের একদম নিচু তলার মানুষ, যারা যুগ যুগ ধরে শোষিত-বঞ্চিত লাঞ্ছিত তারাও দেশ চালাতে পারে। এ এমন এক ব্যবস্থা যেখানে দেশের প্রতিটি মানুষের জন্য অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা ও শিক্ষার দায়িত্ব নেবে রাষ্ট্র। এর নাম সমাজতন্ত্র। যেখানে থাকবে না বুভুক্ষের হাহাকার, নিরন্নের কান্না। থাকবে শীতে উষ্ণ পোশাক আর মাথার ওপর এক চিলতে ছাদ। মুছে যাবে অজ্ঞানের অন্ধকার, চিকিৎসাহীন মৃত্যু। এই ব্যবস্থা বলল সমাজকে তুমি তোমার সাধ্যমত দেবে, সমাজ তোমার কাজের হিসেব অনুপাতে তোমাকে প্রতিদান দেবে। সেখানে কোনো বেশি কম হবার জো নেই।
পরিকল্পিত অর্থনীতি সুরক্ষিত করবে দেশের প্রতিটি মানুষের মৌলিক চাহিদা।
পৃথিবীর বুকে এই ব্যবস্থাই প্রতিষ্ঠিত করেছিল নভেম্বর বিপ্লব। এই বিপ্লব রাশিয়ার তৎকালীন ক্যালেন্ডার অনুযায়ী অক্টোবর মাসেই হয়েছিল। তাই এর নাম অক্টোবর বিপ্লব। পরে যখন সারা পৃথিবীতে সার্বজনীন ক্যালেন্ডার চালু হল তখন তার হিসেব অনুযায়ী বিপ্লবের দুনিয়া কাঁপানো দশ দিন ছিল ৭-১৭ নভেম্বর। তাই তার অপর নাম নভেম্বর বিপ্লব।

Lenin-Engels-Marx

২৷ কমরেড লেনিন যখন রাশিয়ায় বিপ্লবের প্রস্তুতি নিচ্ছেন তখন প্রথমেই তাকে একটি বড় প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হল। মার্কস এঙ্গেলস বলে গেছেন উন্নত পুঁজিবাদ দেশে আগে বিপ্লব হবে। সে সব দেশ হল ফ্রান্স, জার্মানি, ইংল্যান্ড প্রভৃতি। আর রাশিয়া তো পিছিয়ে পড়া দেশ। ইউরোপের উঠোন। সেখানে কি করে বিপ্লব সম্ভব? লেনিন বললেন আমরা তো রাশিয়ার মানুষ আমরা অন্য দেশে কি করে বিপ্লবের কাজে নেতৃত্ব দেব? আমরা বরং সেই চেষ্টাই করবো নিজেদের দেশের জন্য। সেটাই আমাদের সামনে বাস্তব। অন্য ভাবনা অবাস্তব।
এই প্রতর্কের মীমাংসা করতে মার্কসীয় দর্শনে লেনিনের অসামান্য অবদান বিপ্লবের বস্তুগত অবস্থা (objective condition) এবং বিষয়গত অবস্থা (subjective condition)-র মেলবন্ধনের ধারণা। এর মাধ্যমে লেনিন অত্যন্ত সহজ ভাবে দুটি বিষয় আমাদের সামনে তুলে ধরলেন। প্রথমত দেশের বেশিরভাগ মানুষ যদি শাসকের দেশ পরিচালনার নীতি তার স্বার্থের বিরুদ্ধে বলে মনে করে এবং সেই শাসকের পরিবর্তন চায়, তার মানে বস্তুগত অবস্থা বা অবজেক্টিভ কন্ডিশন প্রস্তুত। আর যদি শাসক জনবিরোধী নীতি নিয়ে চললেও দেশের বেশিরভাগ মানুষ সেটি উপলব্ধি না করেন সেক্ষেত্রে বুঝতে হবে বস্তুগত অবস্থা প্রস্তুত নয়। তখন সেই কাজটি আগে করতে হবে অর্থাৎ বেশিরভাগ মানুষকে বোঝাতে হবে যে শাসকের নীতি তোমার স্বার্থের পরিপন্থী যা বর্তমান সময়ে আমাদের রাজ্য এবং দেশের ক্ষেত্রে বিশেষভাবে প্রযোজ্য। যদিও তৎকালীন রাশিয়ায় প্রথমটি সত্য ছিল অর্থাৎ বস্তুগত অবস্থা প্রায় প্রস্তুত ছিল।

দ্বিতীয় প্রশ্ন বেশিরভাগ মানুষ চাইলেই শাসক তো আপনি আপনি ক্ষমতা থেকে সরে যাবে না। তার জন্য সচেতন, সুপরিকল্পিত, কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। তাই প্রয়োজন এ কাজে নিঃস্বার্থভাবে নেতৃত্ব দিতে পারার মতো বলিষ্ঠ সংগঠন যা বিপ্লবী চেতনায় শাণিত। যার থাকবে মানুষের স্বার্থকে সব সবার উপরে স্থান দেবার ক্ষমতা। যে প্রতিহত করবে শত্রুর ছুড়ে দেওয়া উদ্যত বর্ষার ফলক কিংবা উত্তপ্ত শিসের বুলেট। যে লক্ষ্য রাখবে এসব যাতে সাধারণ মানুষকে স্পর্শ করতে না পারে। প্রয়োজনে এই সংগঠনের সদস্যরা নিজেরা শহীদ হয়েও জীবনের শেষ প্রাণের স্পন্দন পর্যন্ত মোকাবিলা করে যাবে সাধারণ মানুষের ওপর নেমে আসা শাসকের নির্মম আঘাতগুলিকে। কিন্তু এরকম সংগঠন পাওয়া যাবে কোথায়? কাদের নিয়ে গড়ে উঠবে এই সংগঠন? লেনিন বললেন মার্কসবাদের মতাদর্শে শাণিত কমিউনিস্ট পার্টিই হবে সেই ব্যাতিক্রমী সংগঠন। আর এক একজন খাঁটি সাচ্চা কমিউনিস্টদের নিয়ে সেই সংগঠন গড়ে উঠবে। লেনিন সেভাবেই গড়ে তুলেছিলেন বলশেভিক পার্টিকে।
আমাদের দেশে আমরাও সিপিআই (এম)-কে গড়ে তুলতে চাই গণ লাইন সম্পন্ন বিপ্লবী পার্টি হিসেবে।

যেখানে পার্টির চরিত্র হবে বিপ্লবী। রাস্তা হবে গণলাইন। অর্থাৎ জনগণের জীবন যন্ত্রণার ইস্যু গুলোই হবে পার্টির লড়াইয়ের মূল প্রতিপাদ্য।

৩৷ সঠিক সময়ে সঠিক স্লোগান : শান্তি চাই, রুটি চাই ও জমি চাই।
কেন শান্তি চাই? ১৯১৪-র ৮ জুলাই প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। রাশিয়া এই যুদ্ধে অংশ নিয়েছে। অর্থাৎ রাশিয়ায় যুদ্ধ আছে যার অর্থ শান্তি নেই। তাই শান্তি চাই। যুদ্ধ চাই না, যুদ্ধ বন্ধ হোক। এটাই ছিল বলশেভিকদের দাবী। লেনিন বুঝেছিলেন এটা দেশের অধিকাংশ মানুষের মনের কথা। তাই সে কথাই তিনি স্লোগানে তুলে ধরেন। ব্যাপক সংখ্যক রাশিয়ান মানুষ উপলব্ধি করলেন তাদের কথাই উচ্চারিত হচ্ছে লেনিনের বক্তব্যে, বলশেভিকদের স্লোগানে। দলে দলে মানুষ সমবেত হলেন এই আহ্বানকে সামনে রেখে।

কেন রুটি চাই? যুদ্ধবিধ্বস্ত রাশিয়ায় খাদ্যের জন্য হাহাকার। সাধারণ মানুষের কাছ থেকে জোর করে সংগ্রহ করা হচ্ছে যুদ্ধের খরচ, অতিরিক্ত কর। এই খরচ মেটাতে গিয়ে অনাহারে, অর্ধাহারে দিন কাটছে অসংখ্য মানুষের। তাই রুটি চাই।

কেন জমি চাই? লেনিন উপলব্ধি করেছিলেন রাশিয়াতে বছরের পর বছর রাজতন্ত্র এবং জমিদারতন্ত্রের অত্যাচারে দেশের সাধারন কৃষকরা জমিহারা হয়েছে। ইতিহাসের পাতায় পাতায় সেই অত্যাচারের
বর্ণনা লেনিন পেলেন।। সেইসঙ্গে তিনি কৃষকের এই যন্ত্রণাকে আরো গভীরভাবে উপলব্ধি করলেন রাশিয়ার অসামান্য সাহিত্যিক এবং দার্শনিক তলস্তয় (১৮২৮-১৯১০)-র লেখা পড়ে। তাই কৃষকের হাতে জমি চাই।
এভাবেই নানান প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে খুঁজতে, না চলা পথে চলতে চলতে অবশেষে সম্পন্ন হলো নভেম্বর বিপ্লব। এক নতুন সমাজ।

৪৷ ১৯৮৮ থেকে ১৯৯১ সাল। ক্রেমলিনের ওপর থেকে লাল পতাকা নেমে যেতেই আহ্লাদে আটখানা বিশ্ব পুঁজিবাদ। আর শুধুতো সোভিয়েত ইউনিয়ন নয়! পোল্যান্ড, হাঙ্গেরি, যুগোস্লাভিয়া, চেকোস্লোভাকিয়া, রোমানিয়া, বুলগেরিয়া, পূর্ব জার্মানি…. একের পর এক দেশ। তাই না দেখে আনন্দে আত্মহারা মার্গারেট থ্যাচার সোল্লাসে ঘোষণা করলেন ‘টিনা’। TINA = There is no alternative অর্থাৎ পুঁজিবাদের কোনো বিকল্প নেই।

ফ্রান্সিস ফুকুয়ামা বই লিখলেন, The End of History and the Last Man । মার্কস এঙ্গেলসের ভাবনার মধ্যে দিয়ে বিশ্বজুড়ে নতুন রাস্তায় পথ চলা শুরু হয়েছিল। লেনিন থেকে মাও সে তুং, হো চি মিন থেকে ফিদেল কাস্ত্রো যে পথ ধরে বিশ্বের এক-তৃতীয়াংশ মানুষকে সমাজতন্ত্রের ছত্রছায়ায় এনে তাদের অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান-চিকিৎসা-শিক্ষা সুরক্ষিত করে নিশ্চিন্ত রাত্রিযাপন নিশ্চিত করেছিলেন – সেই ইতিহাসের পরিসমাপ্তি ঘটলো।

একইসঙ্গে পুঁজিবাদ, সাম্রাজ্যবাদ ও আন্তর্জাতিক লগ্নিপুঁজির দুনিয়া ঘোষণা করল, ‘মার্কসবাদ মৃত’! সমাজতন্ত্র বাতিল!
আর তার পর থেকে দু’দিন অন্তর তারা এই ঘোষণা করা অব্যাহত রেখেছে। মাঝে মধ্যেই তারা মনে করিয়ে দেয় ‘মার্কসবাদ মৃত’।

আচ্ছা একটা মৃত জিনিসকে কতবার মৃত বলতে হয়? কেন বারংবার মৃত বলতে হয়?
রবীন্দ্রনাথ-নজরুল-জীবনানন্দ মৃত; গান্ধী-নেহরু-আজাদ মৃত; হরেকৃষ্ণ কোঙার-প্রমোদ দাশগুপ্ত- জ্যোতি বসু মৃত; মার্কস-এঙ্গেলস-লেনিন মৃত। আমরা সবাই তা জানি। কই, কাউকে তো রোজ রোজ সে কথা ঘোষণা করতে হয় না! তাহলে মার্কসবাদের বেলায় ওদের এই ঘোষণা করতে হয় কেন? কারণ আমাদের চেয়েও অনেক অনেক ভালো করে ওরা জানে যে মার্কসবাদ মোটেই মৃত নয়, ভীষণভাবে জীবিত। মানবতার বিরুদ্ধে ওদের প্রতিটি অন্যায় পদক্ষেপের সময় মার্কসবাদ চোখ রাঙিয়ে ওদের মনে করিয়ে দেয় : তোমরা অপরাধ করছ। এই অপরাধের হিসেব একদিন মানুষ কড়ায়-গণ্ডায় বুঝে নেবে। এই আতঙ্ক ওদের তাড়িয়ে

বেড়ায় বলেই দু’দিন অন্তর ঘোষণা করতে হয়, মার্কসবাদ মৃত।

ওরা ভীষণ ভয় পায় লন্ডনের হাইগেট সমাধিতে প্রায় ১৪০ বছর ধরে চিরনিদ্রায় শুয়ে থাকা মানুষটিকে আর তার মতবাদকে। কারণ এই মতবাদই কমিউনিস্ট ইস্তেহারের পাতায় প্রথম তুলে ধরেছিল সেই সত্য, “ইউরোপ আজ ভূত দেখছে, কমিউনিজমের ভূত।” আর এই মতবাদই শাসকের চোখে চোখ রেখে বলেছিল, “কমিউনিস্ট বিপ্লবের আতঙ্কে কাঁপুক শাসকশ্রেণী।…… সর্বহারার শৃংখল ছাড়া হারাবার কিছু নেই, জয় করবার জন্য আছে গোটা দুনিয়া।”

এ হেন বলিষ্ঠ উচ্চারণ পুঁজিবাদের বুকে প্রতিনিয়ত হাতুড়ি পেটা করে। পুঁজিবাদ যে তার ব্যবস্থার অন্তর্নিহিত গলদের কারণে নিজেই নিজের কবর খনন করে চলেছে সেকথাও মার্কসবাদই প্রতিদিন মনে করিয়ে দেয় পুঁজিবাদকে; একই সঙ্গে সমগ্র বিশ্বকেও। কারণ পুঁজিবাদের নিজেকে ‘অপরাজেয়’ বলে দাবী করার ঘোষণা যে ডাহা মিথ্যা একথাও সবচেয়ে বলিষ্ঠভাবে মার্কসবাদ-ই দুনিয়ার সামনে উপস্থিত করে।

টেরি ঈগলটন এই বিতর্কে অংশ নিয়ে অত্যন্ত প্রণিধানযোগ্য একটি কথা তুলে ধরেন “Why Marx Was Right” গ্রন্থে। তিনি বললেন, “পুঁজিবাদের এই দাবির একটিমাত্র সমস্যা আছে। মার্কসবাদ হল পুঁজিবাদের সমালোচনা। পুঁজিবাদ সম্পর্কে আজও পর্যন্ত যা যা বলা হয়েছে তার মধ্যে সবচেয়ে অনুসন্ধানী, সর্বাধিক কঠোর এবং সর্বাপেক্ষা ব্যাপক সমালোচনা। এটিই একমাত্র সমালোচনা যা পৃথিবীর বড় বড় ক্ষেত্রকে বদলে দিয়েছে। অতএব যতক্ষণ পুঁজিবাদের কারবার থাকবে ততক্ষণ মার্কসবাদকেও থাকতে হবে। শুধুমাত্র তার প্রতিপক্ষকে রিটায়ার করিয়ে তবেই এই মতাদর্শ রিটায়ার করতে পারে।”
হাওয়া বদলাচ্ছে। বদলাচ্ছে ভাষ্য। বদলাচ্ছে পৃথিবী। লেনিনের নেতৃত্বে ১৯১৭-য় বিপ্লব করে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হল রাশিয়ায়। গড়ে উঠলো সোভিয়েত ইউনিয়ন। আর সেই সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার অবসান ঘটল যার হাত ধরে তিনি মিখাইল গর্বাচভ। এই গর্বাচভ ১৯৯১-র অর্থাৎ সোভিয়েত পতনের ২৫ বছর বাদে ২০১৬ তে বিবিসির সাংবাদিক স্টিভেন রোজেনবার্গকে এক একান্ত সাক্ষাৎকারে বললেন, “সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙ্গা ছিল বিশ্বাসঘাতকতা, অপরাধ।….. পরমাণু অস্ত্রধর একটি দেশে বিপজ্জনক রক্তপাত এড়াতেই সেদিন পদত্যাগ করেছিলাম।”
সেদিন গর্বাচভকে নোবেল শান্তি পুরস্কার দেওয়া হয়েছিল সমাজতন্ত্রের পতন ঘটানোর জন্য। আর তার ২৫ বছর বাদে গভীর অনুশোচনায় দগ্ধ সেই গর্বাচভ। কঠোর সমালোচনা করেছেন পশ্চিমা বিশ্বের। আমৃত্যু (৩০আগস্ট ২০২২) তিনি এই পরিবর্তিত মত নিয়েই চলেছেন।

হেগেলের শব্দবন্ধ ধার করে নিজের বইয়ের নাম দিয়েছিলেন ‘এন্ড অফ হিস্টরি’। লেখক ফুকুয়ামা এখনও মার্কসবাদকে অপছন্দ করেন।কিন্তু তাকেও লিখতে হল ১৯৯২ সালে আমার লেখা বইয়ে দেখিয়েছিলাম মার্কসবাদী প্রস্তাবনাটি স্পষ্টতই ভুল এবং উদারবাদী গণতন্ত্রের উচ্চতর বিকল্প কিছু আছে বলে মনে হয় না। কিন্তু আমরা বিগত ১৫ বছরে উদারবাদী গণতন্ত্রের ভয়ঙ্কর অধোগামিতা দেখেছি। অবশ্য এর পরেও তিনি পুঁজিবাদের পক্ষ নিয়ে ইনিয়ে বিনিয়ে বলেছিলেন, “অবশ্য কোন বিপর্যয় মানেই এই নয় যে তার ভিত্তিভূমি ভুল।”

এরপর আরও এগারোটা শীত বসন্ত পেরিয়ে গেল। ২০১৮-য় জর্জ ইটনকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে সেই ফুকুয়ামা আবারও তার মত বদলালেন।
ইটন প্রশ্ন করলেন : আপনি কি সমাজতান্ত্রিক বামেদের পুনরুত্থানের কোন সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছেন? উত্তরে ফুকুয়ামা বললেন : এটা নির্ভর করছে সমাজতন্ত্র বলতে তুমি কি বোঝো তার ওপর। যদি এটা আয় ও সম্পদের চূড়ান্ত বৈষম্যের প্রতিকার হয় তবে সেটা অবশ্যই প্রয়োজন।
৪০ বছর বয়সে ফুকুয়ামা লিখেছিলেন ‘এন্ড অফ হিস্টরি’। তখন তিনি পুঁজিবাদের জোরালো সমর্থক ও মার্কসবাদের বিরুদ্ধে। ৫৫ বছর বয়সের লিখলেন, পুঁজিবাদের অধোগামিতার কথা। আর ৬৬ বছর বয়সে অনেকটা পৃথিবীকে দেখার অভিজ্ঞতা ও পরিণত প্রজ্ঞার সমাহারে বললেন সমাজতন্ত্রের প্রয়োজনীয়তার কথা। ভাষ্য বদলাচ্ছে এবং বদলাবে – এটাই বিজ্ঞান।

বিশিষ্ট মার্কসবাদী চিন্তক ঐতিহাসিক হবসবম ‘হাউ টু চেঞ্জ দ্য ওয়ার্ল্ড’ গ্রন্থে, ২০০৯ সালে লিখিত একটি প্রবন্ধে ২০০৮-র আর্থিক মন্দা প্রসঙ্গে লিখলেন, “প্রচলিত (পুঁজিবাদী) ব্যবস্থাদির
ক্ষয় এমনকি পতনের সম্ভাবনাও এখন আর উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।” ২০১০ সালে ‘নিউ লেফট রিভিউ’কে একটি সাক্ষাৎকারে হবসবম বললেন, “এঙ্গেলসের প্রতিষ্ঠা করা পার্টিগুলি ইউরোপের সর্বত্র হয় সরকারের মধ্যে এখনও সম্ভাবনাপূর্ণ পার্টি অথবা বিরোধীদের প্রধানতম পার্টি। আমার মনে হয় কোনো এক সময়ে কমিউনিস্টদের পুরনো ঐতিহ্য এমনভাবে পুনরুত্থিত হবে যা আমরা ভাবতেও পারছিনা।
হবসবম পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন এক দশক আগে। এর মধ্যে অনেক উথাল পাথাল হয়েছে। পুঁজিবাদ মারাত্মক আগ্রাসী চেহারা নিয়েছে। তবুও ইউরোপের অতি উন্নত স্ক্যান্ডিনেভিয় দেশ ডেনমার্ক, সুইডেন দক্ষিণপন্থা বর্জন করে বাঁ-দিকে মোড় নিয়েছে। মধ্য বামেরা সরকার চালাচ্ছে। একই চিত্র আইসল্যান্ডে, ফিনল্যান্ডে। লাতিন আমেরিকার দেশে দেশে পালা বদলের পালা। পেরু থেকে মেক্সিকো; আর্জেন্টিনা থেকে বলিভিয়া। কলম্বিয়ার প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ উপরাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হলেন দরিদ্র গৃহপরিচারিকা ফ্রাঁসিয়া মার্কেজ।রাষ্ট্রপতি বাম ঘেঁষা গুস্তাভো পেত্রো।
পুঁজিবাদের সমস্ত চক্রান্ত ব্যর্থ করে আমেরিকার জনগণ হারিয়ে দিল ডোনাল্ড ট্রাম্পকে। ব্রাজিলের জনগণ পরাজিত করল স্বঘোষিত ফ্যাসিস্ট বোলসোনারোকে। জেতালো লুলা দ্য সিলভা-কে। এই প্রতিটি ঘটনাই পুঁজিবাদের শিরদাঁড়ায় শীতল প্রবাহ বইয়ে দেয়। তাই ওরা ভয় পায় মার্কসবাদকে।

পশ্চিমী সংবাদমাধ্যম আমাদের মনে করিয়ে দেয় মার্কসবাদের বাজার এখন খুব খারাপ। আর এই খারাপ বাজারে ১৫৪ কোটি মানুষ (চীন, ভিয়েতনাম, কিউবা লাওস ও উত্তর কোরিয়ার সম্মিলিত জনসংখ্যা) সমাজতন্ত্রের ছত্রছায়ায় বসবাস করে। এই পাঁচটি দেশের সবাই কি সমাজতন্ত্রের সমর্থক? নিশ্চয়ই নয়। আবার এর বাইরে পৃথিবীতে আরো ১৯০ টি দেশ আছে। যেখানে কোটি কোটি মানুষ মার্কসবাদ-লেনিনবাদ, সমাজতন্ত্র ও বামপন্থায় আস্থা রাখেন। তার মানে, খুব খারাপ বাজারেও পৃথিবীর প্রায় ২০০ কোটি মানুষ যে মতবাদে বিশ্বাস করে তার নাম মার্কসবাদ। তাই তাকে যে মানবতার শত্রুরা ভয় পাবে, সেটা তো আর বলার অপেক্ষা রাখে না!

বিশ্ববরেণ্য অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক প্রভাত পট্টনায়েক বললেন, “আমি মনে করি মার্কসবাদ যেভাবে সমসাময়িক বিশ্বকে বিশ্লেষণ করেছে সেভাবে আর কেউ করে নি। লেনিন বলতেন : মার্কসবাদ সত্য, সেটাই তার শক্তি। আসল কথা হলো এটা যথার্থ বিজ্ঞানসম্মত আবিষ্কার।”
সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পরেও কেন তিনি সমাজতন্ত্রে আস্থা রাখেন? সাংবাদিকদের এ প্রশ্নের উত্তরে প্রভাত পট্টনায়ক পাল্টা প্রশ্ন করেন, “প্রেমের সর্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ সৌধ তাজমহল ভেঙে গেলে কি পৃথিবী থেকে প্রেম শেষ হয়ে যাবে?”

এই যুক্তি বোধ, সত্য ও বিজ্ঞানের পথ ধরেই মার্কসবাদ, নভেম্বর বিপ্লবের শিক্ষা ও সমাজতন্ত্রের পথ ধরে শোষণহীন সমাজ গড়ার সংগ্রাম এগিয়ে যাবে। আমরা সেই পথেরই অভিযাত্রী।


Spread the word

Leave a Reply