কৃষি আইন ও কৃষক আন্দোলন সম্পর্কে সিপিআই(এম)- এর নোট
সম্পূর্ণ নোটটি তিনটি পর্বে রাজ্য ওয়েবসাইটে আপলোড করা হল।
পর্ব – ৩
কৃষি আইন সম্পর্কে সরকারের দাবি এবং বাস্তব তথ্য
দাবি: ন্যুনতম সহায়ক মূল্যে খাদ্যশস্য কেনার ব্যবস্থা অব্যাহত থাকবে। এই ব্যাপারে সরকার লিখিত দিতেও রাজি। ন্যূনতম সহায়ক মূল্য সম্পর্কে স্বামিনাথন কমিশনের সুপারিশ সরকার প্রয়োগ করেছে।
বাস্তব: রাজ্যগুলির জি এস টি সংক্রান্ত বকেয়া ক্ষতিপূরণ মেটানোর বিষয়েও সরকারের তরফে লিখিত অঙ্গিকারপত্র ছিল, অথচ সরকার সেই চুক্তি ভঙ্গ করেছে – আর তাই সরকারের তরফে লিখিত বক্তব্যের কোনো মূল্যই নেই। যদি ন্যুনতম সহায়ক মূল্য সম্পর্কে সরকারের সদিচ্ছাই থাকবে তবে নতুন আইনে তাকে অন্তর্ভুক্ত করতে কিসের বাধা রয়েছে? নতুন আইনে এই সংস্কারের দাবীই কৃষকেরা জানিয়ে আসছেন। খাদ্যশস্য কেনার ক্ষেত্রে ন্যুনতম সহায়ক মূল্যের ব্যাপারে লিখিত দেওয়া বাদ দিলে স্বামিনাথন কমিশনের সুপারিশ নিয়ে সরকারের দাবি আদ্যন্ত মিথ্যা। কমিশনের সুপারিশ ছিল উৎপাদন খরচের তুলনায় অন্তত পঞ্চাশ শতাংশ বেশি দাম দিয়ে সরকার যেন কৃষকদের থেকে খাদ্যশস্য কেনে। এরকম কোনো সিদ্ধান্তই সরকার নেয় নি, আইনেও এমন কোনো উল্লেখ নেই।
ফসল উৎপাদনের খরচ পরিমাপের ক্ষেত্রে বিভিন্ন হিসাব রয়েছে। A2 খরচ হলো কেবলমাত্র পরিশোধনের খরচ। A2 এবং FL খরচ একযোগে ধরা হলে তার মানে হয় পরিশোধনের খরচের সাথে কৃষকের পরিবার উৎপাদনের কাজে যে শ্রমব্যয় করেছে তার সম্মিলিত হিসাব। C2 খরচ বলতে বোঝায় উৎপাদনের মোট খরচ যার মধ্যে পরিশোধন ব্যয়, পরিবারের পক্ষ থেকে ব্যয়িত শ্রমের হিসাব, মূলধনী সম্পদের উপরে ধার্যকৃত সুদের পরিমাণ এবং কৃষিকাজে ব্যবহৃত জমির নির্দিষ্ট হারে খাজনার পরিমাণ একত্রে ধরা হবে। স্বামিনাথন কমিশনের সুপারিশ ছিল ফসল কেনার ক্ষেত্রে সরকার নির্ধারিত ন্যুনতম সহায়ক মূল্যের পরিমাণ হতে হবে এই C2 খরচের উপরে আরো পঞ্চাশ শতাংশ বেশি। এমন হারে ন্যুনতম সহায়ক মূল্য নির্ধারিত হলে তার পরিমাণ হবে এখনকার তুলনায় প্রতি কুইন্টাল ফসলে চারশো থেকে পাঁচশো টাকা বেশি। বর্তমানে নিজেদের উৎপাদিত ফসল বিক্রির সময়ে কৃষকরা কুইন্টাল প্রতি এই পরিমাণ অর্থ কম পাচ্ছেন। মোদীর দাবির সত্যতা যাচাই করতে এটুকুই যথেষ্ট।
দাবী: নয়া কৃষি আইনের ফলে সরকারি মান্ডি (APMC) গুলী বন্ধ হবে না। কৃষকদের ফসল বিক্রির ক্ষেত্রে বরং নতুন বিকল্প ক্ষেত্র তৈরি হবে। কৃষকেরা নতুন আইন হবার পরেও সরকারের কাছে ন্যুনতম সহায়ক মূল্যেই ফসল বিক্রি করতে পারবেন।
বাস্তব: নয়া কৃষি আইনের উদ্দেশ্যই হল কৃষিক্ষেত্র কে কর্পোরেটদের হাতে তুলে দেওয়া। সুতরাং বিপণনের প্রবণতা পাল্টালে (যা হবেই) ফসলের রক্ষণাবেক্ষণ এবং পরিকাঠামোর উন্নতি সাধনের কারণে সরকারি মান্ডিগুলি বন্ধ হয়ে যাবে। নয়া উদারবাদী জমানায় আমরা দেখেছি কিভাবে লাভজনক রাষ্ট্রায়ত্ত্ব সংস্থাগুলিকে প্রয়োজনীয় মূলধনের অভাবে ক্রমশ নুইয়ে দেওয়া হয়েছে। কিভাবে রাষ্ট্রায়ত্ত্ব সংস্থাগুলির নিজস্ব তহবিলের অপব্যয় করিয়ে তাদের নিঃস্ব করে দেওয়া হয়েছে এবং লাভজনক অবস্থা থেকে সংস্থাগুলি দুর্বল হয়ে পড়েছে। সরকারি মান্ডিগুলিরও এই একই দশা হবে। উপরি হিসাবে কৃষকদের ফসলের দামে কোনো নিশ্চয়তা না থাকার ফলে বিকল্প সুযোগ কৃষকদের কর্পোরেটদের দয়ার উপরে নির্ভরশীল করে তুলবে। বর্তমানে বেশিরভাগ রাজ্যেই সরকারি বাজারের সংখ্যা খুব কম। ফলে সরকারি দামের তুলনায় অনেক কম মূল্যে ফসল বিক্রি করে দিতে কৃষকদের এক বড় অংশকেই বাধ্য হতে হয়। যদিও তেইশটি কৃষিজাত পণ্যের ক্ষেত্রে ন্যুনতম সহায়ক মূল্যের বন্দোবস্ত রয়েছে, সরকার কেবল ধান এবং গমই কৃষকদের থেকে কেনে, তাও সব রাজ্যে সেই ব্যাবস্থা না থাকায় বেশিরভাগ কৃষক কম দামে ফসল বিক্রি করতে বাধ্য হতে হয়।
দাবী: কৃষকদের আয় দ্বিগুণ হবে।
বাস্তব: সরকারের তরফে যে সব দাবি করা হচ্ছে তার মধ্যে এটাই সবচেয়ে হাস্যকর। নয়া কৃষি আইনের কোথাও কৃষকদের রোজগার বৃদ্ধির এমনকি ন্যুনতম সহায়ক মূল্যে ফসল বিক্রির উল্লেখটুকু নেই। চুক্তি চাষ সংক্রান্ত আইনে সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে ফসলের দাম নির্ধারণে সরকারের কোনো ভূমিকা থাকবে না। এই অবস্থায় বৃহৎ সংস্থাগুলির একচেটিয়া কারবারের চাপের কাছে হার মেনে কৃষকদের কোম্পানি নির্ধারিত যে কোনো মূল্যে ফসল বিক্রি করতে বাধ্য হতে হবে।
দাবী: নয়া কৃষি আইন কৃষকদের জমিহারা হওয়ার সংকট থেকে সুরক্ষিত রাখবে।
বাস্তব: চুক্তি চাষের বয়ানে একটি দফায় কৃষিজাত পণ্য বিপণন সংস্থাগুলির পক্ষে কৃষকদের জমি কিনে নেবার কিংবা লিজ নেবার ক্ষেত্রে বাধার উল্লেখ রয়েছে। যদিও এই বয়ানে কৃষকদের জমি হারানোর ভয় কাটে না। জমির মালিকানা হারানোর যে আতংক কৃষকদের বুকে বাজছে তার অন্যতম প্রধান কারণ অর্থনৈতিক দুর্দশা। বানিজ্য সংস্থাগুলির দ্বারা প্রতারিত হলে কৃষকদের হাতে জমি বিক্রি করা ব্যতীত অন্য কোনো উপায় থাকবে না। এই দুর্দশার থেকে মুক্তির একমাত্র উপায় কৃষিকাজে ন্যুনতম নিশ্চয়ক বন্দোবস্ত। এমনটা তখনই হবে যদি ন্যুনতম সহায়ক মূল্য ব্যবস্থাকে চুক্তি চাষে আবশ্যিক আইনে পরিণত করা হয়, যার উল্লেখমাত্রও কোথাও নেই।
দাবী: কৃষিপণ্যের বাজারকে বেসরকারি ক্ষেত্রের হাতে তুলে দেওয়া হলে কৃষিতে বিনিয়োগ তৈরি হবে। বেসরকারি সংস্থা চাষীদের হাতে বিভিন্ন প্রজাতির শস্য বীজ এবং আধুনিক প্রযুক্তি পৌঁছে দেবে।
বাস্তব: কৃষকদের হাতে শস্য বীজ এবং প্রয়োজনীয় আধুনিক প্রযুক্তি পৌঁছে দেবার দায়িত্ব সরকারের। কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় এবং আই সি এ আর কে স্থাপন করাই হয়েছিল এই উদ্দেশ্যে। কিন্তু সংস্থাগুলি এখন তহবিলের অভাবগ্রস্থ, তাদের সরকারের তরফে প্রয়োজনীয় আর্থিক সহায়তা দেওয়া হয় না। বলা যায় মোদী সরকারের আমলেই কৃষি গবেষণা এবং বিস্তৃতিকরণের কাজকেই ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। বেসরকারি সংস্থা লাগামছাড়া মুনাফার লক্ষ্যে ছুটবে। শস্য বীজ,কীটনাশক, সার এবং কৃষিকাজে প্রয়োজনীয় সামগ্রীর চড়া দামই হলো কৃষিক্ষেত্রে চরম দারিদ্র্যের অন্যতম কারণ। এমনকি সরকারের তরফেই শস্য বীজ সংক্রান্ত দ্বিতীয় সংস্কার আইন করে সেই দুশ্চিন্তা আরো বাড়িয়ে দিয়েছে।
সরকারি এবং বেসরকারি বিনিয়োগের মধ্যে এক ধরনের পরিপূরক সম্পর্ক রয়েছে। যদি সরকার নিয়ন্ত্রিত বাজারে বিনিয়োগ করে তবেই মজুত, পরিবহন এবং যোগান ব্যবস্থায় বেসরকারি বিনিয়োগ উৎসাহিত হবে। বুনিয়াদি পরিকাঠামোর অনুপস্থিতিতে অত্যাল্প বেসরকারি বিনিয়োগ ব্যতীত কিছুই আসবে না।
কৃষি নীতি সম্পর্কে কেরালা সরকারের কর্মসূচি
কেরলের প্রধান অর্থকরী ফসল হল রাবার, কাজু এবং নারকোল। এই ব্যাপারে কেরলের চরিত্র অন্য রাজ্যের তুলনায় অনেকটাই আলাদা। কেরলে রাজ্য সরকারের অধীনে অর্থকরী ফসল সংক্রান্ত বিশেষ বিধিবদ্ধ বোর্ড গঠন করে কাজ করা হয়। অত্যন্ত দুর্ভাগ্যের বিষয় যে আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রী দেশীয় রাজ্যগুলির বৈশিষ্ট সম্পর্কে একেবারেই অজ্ঞ, আর তাই, কৃষি আইন সম্পর্কে বামদল গুলির আন্দোলনকে ব্যাঙ্গ করতে গিয়ে তিনি কেরালায় কোনো এ পি এম সি (APMC) ব্যবস্থা নেই বলেছেন। তিনি যা বলেননি তা হল কৃষকদের চাষের কাজে উৎসাহ দিতে কেরল সরকার কেন্দ্রের ঘোষিত ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের থেকে প্রতি কুইন্টাল ধান কেনায় প্রায় ৯০০ টাকা বেশি দেবার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কেরলের বাম গণতান্ত্রিক সরকার প্রতি কুইন্টাল ধান কেনার জন্য ন্যূনতম সহায়ক মূল্য হিসাবে ২৭৪৮ (দুই হাজার সাতশো আটচল্লিশ) টাকা ধার্য করেছে। কেন্দ্রীয় সরকারের প্রধানমন্ত্রী কিষান প্রকল্পে প্রতি বছর ৬০০০ (ছয় হাজার) টাকা বরাদ্দের বিপরীতে নগদ আর্থিক সহায়তা এবং উৎপাদন সংক্রান্ত উৎসাহ ভাতা হিসাবে কেরল সরকার প্রতি হেক্টর ২২০০০ (বাইশ হাজার) টাকা ব্যায়বরাদ্দ স্থির করেছে। এছাড়াও কেরল সরকার ১৬ টি সবজির ক্ষেত্রে ন্যুনতম সহায়ক মূল্য নির্ধারণ করেছে এবং সেই ব্যবস্থায় স্থানীয় সরকারি প্রতিনিধি এবং সমবায় সমূহকে কাজে লাগানো হয়েছে। আর কোনো রাজ্যেই এমন কোনো ব্যবস্থা নেই। খাদ্যশস্য উৎপাদনে কেরল পিছিয়ে থাকা রাজ্য, তাকে অন্যান্য রাজ্যের উপরে নির্ভর করে চলতে হয়। নয়া তিন কৃষি আইনে যেভাবে খাদ্য প্রক্রিয়াকরণের বিষয়ে এবং গনবন্টন ব্যবস্থাকে দুর্বল করা হয়েছে তার নেতিবাচক প্রভাব কেরলে হবেই। আর ঠিক সেকারণেই কেরলে রাজ্য বিধানসভার পক্ষ থেকে ঐক্যমতের ভিত্তিতে এই সংকটের পরিপ্রেক্ষিতে কেন্দ্রীয় সরকারকে নয়া কৃষি আইন বাতিলের দাবি জানানো হয়েছে। আমরা দাবি জানাই যাতে অন্যান্য সব রাজ্যের তরফেও সংশ্লিষ্ট বিষয়ে অনুরূপ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
উপসংহার
১৯৯১ পরবর্তী আর্থিক সংস্কারের অনুসারী অর্থনৈতিক নীতির প্রভাবে কৃষিতে বেসরকারি কর্পোরেটদের হস্তক্ষেপ ক্রমশ বেড়ে চলেছে। উদারবাদের প্রথম পর্বে বহুজাতিক সংস্থাগুলি কৃষিজ উৎপাদনের চাহিদা যোগানের উপরে নিয়ন্ত্রণ কায়েম করতে বীজ, সার এবং কীটনাশক ইত্যাদিতে নিজেদের বিস্তৃত করেছিল। এখন নয়া কৃষি আইনের জোরে তারা সেই বিস্তৃতির পরিসর আরও বাড়িয়ে গোটা কৃষি বানিজ্য ক্ষেত্রকেই গিলে খেতে চায়। এই আইনে নিয়ন্ত্রিত মান্ডি গুলি দুর্বল হবে, সরকারি শস্যভাণ্ডার বন্ধ হয়ে যাবে। এর ফলে ফুড কর্পোরেশন অফ ইন্ডিয়া (FCI) এবং সরকারি মান্ডির হাত থেকে বেরিয়ে গিয়ে কৃষি ক্ষেত্রের সমস্ত উদ্বৃত্তই জমা হবে বহুজাতিক সংস্থার হাতে। ফলে ধীরে ধীরে কর্পোরেট সংস্থাগুলি খাদ্য সরবরাহের গোটা ব্যবস্থাটাই নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেবে এবং তারাই নির্ধারক হয়ে বসবে।
সরকারের নয়া কৃষি আইন আগাগোড়া ত্রুটিপূর্ণ একথা স্পষ্ট। এই আইন প্রণয়নের সময় কেন্দ্রীয় সরকারের হয়ত খেয়াল ছিল না যে রাজ্য সরকার কৃষি সংক্রান্ত বিষয়ে কেন্দ্রীয় আইনে জরুরী হস্তক্ষেপ করতে পারে। বোঝাই যাচ্ছে কেন্দ্রীয় সরকার এক্ষেত্রে রাজ্য সরকারগুলোর ক্ষমতাকে খাটো করে দেখেছিল। কেন্দ্রীয় আইনে একমাত্র কর্পোরেটদের স্বার্থের কথা ভাবা হয়েছে এবং বহু ক্ষেত্রে দেশের কৃষক এবং জনগণের যাবতীয় স্বার্থকে সরকার এড়িয়ে গেছে। এমন মনোভাবের কারণেই, কোনরকম সংশোধনীর মাধ্যমে এই আইনগুলিকে কিছুতেই কৃষকদের স্বার্থবাহী কানুনে পরিণত করা সম্ভব নয়। সিপিআই(এম) নিজের অবস্থানে স্পষ্ট যে এই সংকট মুক্তিতে কৃষি আইন বাতিল করা ব্যতীত অন্য কোনো সমাধানসূত্র নেই, আর তাই সিপিআই(এম) নিজের সর্বশক্তি প্রয়োগে এই আইনসমূহ বাতিলের পক্ষে লড়াই করবে।
ওয়েবডেস্কের পক্ষে নোটের অনুবাদঃ সৌভিক ঘোষ