ওয়েবডেস্ক প্রতিবেদন
একটা জাতি নিজেদের শাখাপ্রশাখা সমেত গোটাটাই মাথা নুইয়ে দিয়েছে আপাদমস্তক সাম্রাজ্যবাদী লুঠেরা শক্তির সামনে। নিরবিচ্ছিন্ন আইনি এবং বেআইনি লুঠ চালিয়ে দেশটাকে ক্রমাগত রক্তশূন্য করে দেবার পাশাপাশি আসলে যেটা লুঠ হচ্ছে সেটা মাথা সোজা রেখে বেঁচে থাকতে মানুষের স্বাভাবিক অধিকার। যে অধিকার যে কোন দেশের, যে কোন জাতির যে কোন বর্ণের মানুষের অধিকার। যেটা লুঠ হচ্ছে সেটা মানবজীবনের অবিচ্ছেদ্য ইজ্জত-সংস্কৃতি। এর প্রতিবাদে সক্রিয় হলেই প্রথমে ভয় দেখানো পরে লাঠিপেটা, গ্রেফতার, লক-আপে অমানুষিক অত্যাচার, বিনা বিচারে জেলখাটা, নিরস্ত্র অবস্থায় এমনকি জেলে বন্দি অবস্থায়ও গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যু – ততদিনে এগুলোয় কেউ আর অবাক হতো না। চালাক-চতুর সুবিধাবাদী আর শারীরিক-মানসিক বেনিয়াবৃত্তিতে অভ্যস্ত শহুরে নব্যবাবুরা তখন ইউরোপীয় সংস্কৃতি চর্চার নাম করে টেবিলে বসে শাসকের সাথে আপোষরফা করতে শিখে নিচ্ছেন। বিচ্ছিন্নভাবে এদিক ওদিকে কেউ কেউ গুলি-বোমা চালিয়ে গোরা সাহেব মারছেন, দেশলাই কাঠির সাহায্যে তেপান্তর অবধি আলো জ্বালতে গিয়ে- নিজেরাও মরছেন। কমবয়সী শিক্ষিত যুবক-যুবতীরা লড়ছে-মরছে-হতাশ হয়ে বসে পড়ছে, আঁকড়ে ধরতে চাইছে এমন একটা কিছু যা দিয়ে উঠে দাঁড়ানো যায়।
এই অবস্থায় রোগাপাতলা, মাথায় চুল কম, সাইকেল চালিয়ে এ গ্রাম থেকে সে গ্রাম ঘুরে বেড়ানো একটা নিরীহ চেহারার লোক দল পাকাতে শুরু করলো – দল মানে টেবিলে বসে মিটিং করার দল নয়, Indian Republican Army। সেই আর্মিতে রিক্রুট শুরু হলো বয়ঃসন্ধির মেজাজ, দিনের পর দিন মার খেয়ে ইস্পাতে পরিণত হওয়া পোক্ত অভিজ্ঞতা। বিপ্লবপন্থায় দস্তুর হতে বসা লিঙ্গভেদের ব্যাপারটা চুরমার করে দিয়েই প্রীতিলতারা, কল্পনারা প্রস্তুত হতে শুরু করলেন, কলম থেকে লাঠি হয়ে পিস্তল অবধি মাস্টারদার শিক্ষাক্রম।
মাস্টারদা বুঝেছিলেন সাম্রাজ্যবাদী লুঠেরাশক্তির পরাক্রমের জোরটা মুলত দুটো – প্রথমত তারা বুঝে নিয়েছে এদেশের বেশিরভাগটাই পুরাকাল-পরকালের গল্প বুকে চেপে বাঁচে, ফলে এদের এককাট্টা হওয়াটাই হয়ে ওঠে না। দ্বিতীয়ত কামান কিংবা বন্দুকের সামনে খালি বুক পেতে বীরের মৃত্যুলাভ করার মতো যারা সাহসী, তাদের সম্পর্কে লোকে গল্প করে, শিহরণ অনুভব করে কিন্তু ঐ জীবন অনুসরণ করা যায় না। সিংহসদৃশ হৃদয়ের কাহিনীতে দেশের লোকের মনে পাল্টে দেবার আশা সঞ্চারিত হয় না – কারণ ওভাবে সবাই বুক পাতে না, পাতবে না। এখানেই ভারতে সশস্ত্র বিপ্লবের ইতিহাসে সূর্য সেনের গুরুত্ব, তিনি শুধু পিস্তল ধরতেই শেখান নি, কার্যত মনের কোনে শাসক সম্পর্কে যে ভয় থাকে তাকেই দুরমুশ করে দিয়েছেন।
আঘাত হানতে হবে এমনভাবে যেটাকে কৌশল হিসাবে অন্যত্র কিংবা প্রায় সর্বত্র অনুসরণ করা যায়, স্থানভেদে বারে বারে প্রয়োগ করা যায়। যেটা নিজেরা রপ্ত করে অন্যদের শেখানো যায় – এইজন্যেই সাইকেল চেপে ঘোরা মানুষটি আর শুধু সূর্য সেন থাকেননা – মাস্টারদা হয়ে ওঠেন।
ব্রিটিশরা ভারতীয়দের মানসিক অবস্থা সম্পর্কে এতটাই নিশ্চিত ছিল যে ভাবতেই পারেনি তাদের অস্ত্রাগারে হামলা হতে পারে! ঠিক সেই কারণেই ইংরেজের বিরুদ্ধে বন্দুক হাতে জনগণকে সশস্ত্র করে তুলতে চট্টগ্রামের অস্ত্রাগার হলো লক্ষ্য – সাদা চামড়া আর লুঠেরা সভ্যতার অহমিকায় মত্ত ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের গালে সপাটে চড় মেরে সেদিন গেরিলারা শুধু অস্ত্রাগারই আক্রমন করেননি – চট্টগ্রামকে মুক্তাঞ্চলেও পরিণত করেছিলেন। জালালাবাদের পাহাড়ে মেশিনগানের সামনে ঐ লুঠ করা বন্দুক হাতে নিয়েই ওদেরই অস্ত্রে ওদের সাথে যুদ্ধ করেছিলেন – হারিয়ে দিয়েছিলেন!
এদেশে তখন সবে সাম্যবাদের লাল পতাকা উড়তে শুরু করেছে, মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদের পাতা উল্টে দেখছেন কয়েকজন। সেই জমিতে মাস্টারদা গেরিলা যুদ্ধ প্রয়োগে শত্রুর অস্ত্র ব্যবহার করে ঘাঁটি এলাকা তৈরী করিয়ে একটা গোটা সেনাবাহিনীকে যুদ্ধে হারিয়ে দিয়েছিলেন। এই গোটা ব্যাপারটাকে আধুনিক রাজনীতিতে বা আধুনিক সমরবিদ্যায় গেরিলা ওয়ারফেয়ার বলা হয়। এই হল সেই কৌশল যাকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর পৃথিবীতে মাও সে তুং প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার রূপ দিয়ে গেছেন, লাতিন আমেরিকার এক বিস্তীর্ণ এলাকায় চে গ্যেভারা প্রয়োগ করেছেন।
এদেশে যারা আজকাল নিজেদের মাও সে তুঙের উত্তরাধিকারী বলে পটকা ফাটান তাদের মনে রাখা উচিত সশস্ত্র বিপ্লবপন্থায় সূর্য্য সেন শুধু মাস্টারই নন খোদ হেডমাস্টার। বিশ্বাসঘাতক নেত্র সেনের টাকা-পয়সার লোভ মাষ্টারদাকে ধরিয়ে দিয়েছিল। ইংরেজ তাকে জেলবন্দি অবস্থায় হাত পায়ের নখ উপড়ে নিয়ে, হাতুড়ি পিটে হাত পা – দাঁত ভেঙে দিয়ে এবং সবশেষে ফাঁসি দিয়েও শান্তি পায়নি। মৃতদেহ সৎকার হতে না দিয়ে সাগরের জলে নিক্ষেপ করা হয়। কিন্তু ততদিনে তার ছাত্রছাত্রীরা লড়তে শিখে গিয়েছিল – তাই আন্দামান জেলে থাকতেই মার্কসবাদে দীক্ষিত হয়ে উঠলেন তারা – বাইরে এসে কমিউনিস্ট পার্টির সাথে যুক্ত হয়েছিলেন।
মৃত্যুদিবসে শ্রদ্ধাঞ্জলি জানাতে গিয়ে মনে রাখতে হবে তাঁর দেখানো পথের ব্যাপারটা শুধু রগের শিরায় খুন চাপিয়ে হাতের আঙ্গুল চিপে ট্রিগার চালানো নয়, একেবারেই নয়। সূর্য সেন সম্পর্কে অমন একটা সংকীর্ণ ধারণাই আমাদের চেতনায় গেঁথে দিতে চেয়েছে সাম্রাজ্যবাদ, তাতে লুঠেরা ব্যবস্থারই মুনাফা। সূর্য সেন আসলে একটা প্রতীক, শাসকের নিশ্ছিদ্র বন্দোবস্ত সম্পর্কে যাবতীয় অহংকার চুরমার করে দেবার প্রতীক, নিরীহ অসহায়রা একজোট হলে অতি বড় পরাক্রমী শাসকেরও হার নিশ্চিত এই ঐতিহাসিক শিক্ষার প্রতীক, সবশেষে শত্রুর অস্ত্রাগারই আমাদের অস্ত্রাগার এই উপলব্ধিরও প্রতীক। তাঁর প্রতিকৃতি বা মূর্তিতে নির্দিষ্ট দিনে মালাটুকু চাপিয়ে কর্তব্য সমাধা করার নামে প্রতি বছর তাকে বারংবার খুন করা হচ্ছে কিনা সেকথা ভেবে দেখার সময় এসেছে।
সূর্য্য সেন আজও মাস্টারদাই রয়ে গেছেন – দল পাকাতে আজও লোক খুঁজছেন। আমাদের চিনে নিতে হবে সেই আহ্বান, চিনে নিতে হবে এরা কারা। কিসের উত্তরাধিকার। বিপ্লবী উত্তরাধিকার সম্পর্কে গোল গোল অনুভবের অভিঘাতে জনমানসের চেতনা থেকে এদের ভুলিয়ে দিতে পারলে কার লাভ? কাদের লাভ? সূর্য সেনের বাহিনীর কম্যান্ডার ছিলেন গনেশ ঘোষ, লোকনাথ বল, অনন্ত সিংহ, সুবোধ রায়। ইতিহাসের প্রকৃত শিক্ষা ঘোলা করে দিতে কর্পোরেট ম্যানেজমেন্টের নামে যে শিক্ষাক্রমে ছেলেমেয়েদের জড়ভরতে পরিণত করা হয়, তার মুখোশ খুলে দিতেই অনন্ত সিংহ সেইসব অগ্নিগর্ভ লড়াইয়ের কথা লিখে তার নাম রাখলেন ‘কেউ বলে বিপ্লবী কেউ বলে ডাকাত’। আমাদের মনে রাখতে হয়।
ছবি – সোশ্যাল মিডিয়া
ওয়েবডেস্কের পক্ষে – সৌভিক ঘোষ