Sufia Kamal: A Memoir

ভারতীয় উপমহাদেশে নারীর স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইতে সুফিয়া কামালের( ১৯১১,২০ শে জুন- ১৯৯৯,২০ শে নভেম্বর) অবদান ঐতিহাসিক। বিশ শতকের সূচনাপর্বে সামাজিক অনগ্রসরতার বাধার পাহাড় অতিক্রম করে নিজের সাহস  মেধা আর ব্যক্তিত্বের জোরে একটা ধারাবাহিকতার ভিতর দিয়ে নারীর স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইকে যে মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করতে শুরু করেছিলেন তিনি, নিজের জীবনের অন্তিম পর্বে সেই লড়াইয়ের একটা পূর্ণতা প্রাপ্তির ভিতর দিয়ে তার যে পরিণতি– তাকে এককথায় ঐতিহাসিক বলে অভিহিত করা যায়।

বরিশালের শায়িস্তাবাদের অভিজাত পরিবারের সন্তান তিনি।পিতা সুফী সাধনার ডাকে তাঁর জন্মের অল্পদিন পরেই গৃহত্যাগ করেছিলেন।বিবি হাজেরার মত ত্যাগ, তিতিক্ষার প্রতিমূর্তিতে গড়া মায়ের কাছেই প্রথম জীবনের শিক্ষা পেয়েছিলেন সুফিয়া।

১৮৮০ সাল, রংপুরের পায়রাবন্দ, বেগম রোকেয়ার জন্মস্থান।প্রথম শৈশবে পারিবারিক আয়মাদারির জেরে নিজের শত ইচ্ছে থাকলেও প্রথাগত শিক্ষার সুযোগ নেওয়া সম্ভব হয় নি রোকেয়ার।আর ১৯১১ সালের বরিশাল।মহাত্মা অশ্বিনীকুমারের বৈপ্লবিক কর্মকান্ডের জোয়ারে তখন বরিশালের প্রতিটি পরিবার ভেসে যাচ্ছে।শায়েস্তাবাদের ‘ নবাববাড়ি’ ও আধুনিক বিদ্যাচর্চার ভিতর দিয়েই অশ্বিনীকুমারের ঔপনিবেশিকতা বিরোধী লড়াইয়ের নিভৃত সাধনার পথ ধরেছে। সেকালের বাংলার সামাজিক ইতিহাসে রংপুরের পায়রাবন্দের ‘ বড়বাড়ি'( রোকেয়ার পরিবার), অবিভক্ত ময়মনসিংহের টাঙ্গাইলের দেলদোয়ারের গজনভী ভাইদের কর্মকান্ড( এই পরিবারেই বিবাহ হয়েছিল রোকেয়ার অগ্রজা করিমুন্নেসার, তাঁর দুই পুত্র হলেন ইতিহাসখ্যাত গজনভী ভাইয়েরা।বঙ্গভঙ্গের কালে ব্রিটিশ বিরোধী লড়াইতে তাঁদের অবদান ঐতিহাসিক) , বরিশালের শায়েস্তাবাদের নবাববাড়ির আধুনিক বিদ্যাচর্চার প্রতি অপরিসীম আগ্রহ– এসব চর্চা আমাদের সামাজিক ইতিহাসে প্রায় অপাঙক্তেয় ই থেকে গিয়েছে।ফলে হিন্দু সাম্প্রদায়িক শিবির মুসলমান সমাজকে আধুনিক শিক্ষায় অনাগ্রহী, কূপমুন্ডক, মৌলবাদী হিসেবে দেখাবার যে রাজনৈতিক প্রয়াস চালায়, সেই অপচেষ্টার মোকাবিলায় ইতিহাসগত উপাদানের দিকে আমাদের বিশেষ নজর নেই।

রোকেয়ার মতই শায়েস্তাবাদের নবাববাড়ির সুফিয়া জেদ ধরলেন পড়াশুনা করবার।দাদাদের সঙ্গে ছেলেদের মতো চোপা চাপকান গায়ে চড়িয়ে পর পর বেশ কয়েকদিন গেলেন গ্রামের পেয়ারিলাল মাস্টারের ইস্কুলে।একটি অভিজাত পরিবারের কন্যাসন্তান গ্রামীণ পরিকাঠেমোকে কার্যত অস্বীকার করে ছেলেদের পোষাকে ইস্কুলে যাচ্ছেন বিশ শতকের দ্বার প্রান্তে জলজঙ্গলে ঘেরা বরিশালে– বাংলার সামাজিক আন্দোলনের ইতিহাসে এই আন্দোলনের গুরুত্ব কোনো অবস্থাতেই অস্বীকার করা যায় না।

সেই সাহসিনী বঙ্গজননীর ছয়ের দশকের ভূমিকা– সেই সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইয়ূব-মোনায়েমের বাহিনী  শিক্ষকের গায়ে হাত তোলার মত চরম অরাজকতা সৃষ্টি করেছিল। আইয়ূব খান ঢাকায় এসে নাগরিক সমাজের সঙ্গে হোটেল ইন্টার কন্টিনালে  আলোচনাকালে তদানিন্তন পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ সম্পর্কে খুব  নিকৃষ্ট ভাষায় কথা বলছিলেন। সুফিয়া কামাল সহ্য করতে না পেরে বলেছিলেন;  “আপনি এতোবড় যুদ্ধের ফয়সালা করে এলেন, ( তখন পাক-ভারত যুদ্ধের তাশখন্দ চুক্তি করে এসেছিলেন) এখানকার সমস্যার একটা সমাধান করেন। আইয়ূব খান বলেছিলেন “ওখানে তো সব মানুষ ছিল, এখানে তো সব জানোয়ার!” সুফিয়া  বলেছিলেন “আপনি তো সেই জানোয়ারদেরই প্রেসিডেন্ট, তাই এইসব সমস্যার সমাধান করা আপনারই দায়িত্ব!” কথোপকথন ঊর্দূতে হচ্ছিল। সুফিয়া যেহেতু ইংরেজী বলেন না। আইয়ূব খান মুখ লাল করে সভা বন্ধ করে উঠে চলে গেছিলেন।

দোর্দন্ড প্রতাপ আইয়ূব সেই বৈঠক থেকে বের হওয়ার আগেই সেনার গুলির ব্রাশ ফায়ারে সুফিয়াকে ছিন্নভিন্ন করে দিতে পারতেন।কিন্তু কি হলে কি হতে পারত, সেই হিসেব নিকেশ করে , নিক্তিতে মেপে কথা বলা সুফিয়া কামালের ধাতে ছিল না।তাই সেই বৈঠকে দোর্দন্ড প্রতাপ আইয়ূব খানের মুখের উপরে কাজী মোতাহার হোসেনের মত মানুষেরা নির্বাক থাকলেও বাঙালির এই চরম অপমান কোনো অবস্থাতেই মেনে নিতে পারেন নি সুফিয়া কামাল।

আজকের ভারতে মোদি- মমতা যে ‘ গণতন্ত্র’ কায়েম করেছেন, তাকে নির্দ্বিধায় আইয়ূব খানের’ বেসিক ডেমক্রেসি’ সঙ্গে তুলনা করা চলে।সেদিন পূর্ব পাকিস্থানে, অর্থাৎ; আজকের বাংলাদেশে ফৌজি শাসক আয়য়ূবের অনুমোদন ছাড়া কোনো রাজনৈতিক দলের একটি কর্মসূচি পালন ও সম্ভব ছিল না।আইয়ূবের বিরোধিতার নামগন্ধ পেলেই ফৌজি শাসকের বশংবদেরা প্রতিবাদীর কন্ঠ রুদ্ধ করে দিতো। সেই রুদ্ধকন্ঠের তালিকায় আইয়ূব ফেলেছিল রবীন্দ্রনাথকেও।রবীন্দ্রনাথ ‘ হিন্দু’ , সেই অপরাধে তাঁর গান, কবিতা নিষিদ্ধ হয়েছিল ঢাকা বেতারে।এই নিষিদ্ধকরণের প্রতিবাদে সাধারণ মানুষের মনে ধর্মনিরপেক্ষবোধ কে সঞ্চারিত করে , রবীন্দ্রনাথকে অর্গল মুক্ত করতে রাজপথে, জনপদে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন সুফিয়া কামাল।এই কাজে তাঁর একান্ত সহযোগী ছিলেন উপমহাদেশের বিশিষ্ট্য বামপন্থী সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব কলিম শরাফী।

সুফিয়া কামালের সামাজিক কর্মকান্ড যে কেবল তৎকালীন পূর্ববঙ্গ বা পরবর্তীকালের বাংলাদেশেই সীমাবদ্ধ ছিল,এমনটা ভাবলে ভুল হবে।রবীন্দ্রনাথ থেকে নজরুল, কার তিনি প্রিয়পাত্রী ছিলেন না? স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ কেবল সুফিয়ার লেখা কবিতার ই অনুরাগী ছিলেন তাই নয়, জোড়াসাঁকোর বাড়িতে তিনি নজরুলের ‘ ফুলকবি’ সুফিয়াকে বিশেষ আমন্ত্রণ জানিয়ে নিয়ে এসেছিলেন।সুফিয়ার হাতের রান্নাও খেতে চেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ।

তেতাল্লিশের দুর্ভিক্ষের কালে বর্ধমানে নারী আত্মরক্ষা সমিতির কর্মীদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বর্ধমান শহরে লঙ্গরখানা পরিচালনা করেছিলেন সুফিয়া কামাল। চারের দশকে বর্ধমানে জাত- ধর্মের বেড়া কে অতিক্রম করবার যে কর্মকান্ডের সূচনা এই লঙ্গরখানার ভিতর দিয়ে সুফিয়া কামাল করে গিয়েছিলেন, তা পরবর্তী সময়ে , গোটা রাঢ় বাংলায় প্রগতিশীল সামাজিক, রাজনৈতিক আন্দোলনকে প্রসারিত করবার ক্ষেত্রে একটা উল্লেখযোগ্য ভিত্তিভূমি হয়ে দাঁড়িয়েছিল।

ছেচল্লিশের দাঙ্গার দায় যখন একতরফা ভাবে মুসলমান সম্প্রদায়ের উপর চাপিয়ে দিয়ে ব্রিটিশ- শ্যামাপ্রসাদ- হিন্দু মহাসভার যৌথ কৌশলে দাঙ্গাক্রান্ত মুসলমান সমাজের পাশে কলিম শরাফি, মহঃ জাকারিয়ার মত গুটিকয়েক কমিউনিস্ট কর্মী ছাড়া প্রায় কেউ ই নেই, তখন পার্ক সার্কাস এলাকায় দাঙ্গাক্রান্ত নারী,শিশুদের রক্ষণাবেক্ষণ, পুনর্বাসনের কাজে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছিলেন সুফিয়া কামাল।পটুয়া কামরুল হাসান এই কাজে তাঁর বিশেষ সহযোগী ছিলেন।সুফিয়ার নিকট প্রতিবেশি অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের পিতা সহ তাঁদের সমগ্র পরিবার এই কাজে সুফিয়ার বিশেষ সহকারী হয়ে উঠেছিলেন।

অসহায় মানুষদের প্রতি সহযোগিতার হাত কে প্রসারিত করতে সুফিয়া কখন ও জাত- ধর্মের ক্ষুদ্রগন্ডির ভিতরে নিজেকে বাঁধেন নি।দেশভাগের পর তদানীন্তন পূর্ববঙ্গে( দেশভাগের অব্যবহিত পরে নামটি ‘ পূর্ববঙ্গ’ ছিল, ‘পূর্ব পাকিস্থান’ কিছুদিন পরে হয়) চলে গিয়ে সেখানকার সংখ্যালঘু হিন্দুদের ওপর সেদেশের সংখ্যাগুরু সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদীদের আক্রমণৃর প্রতিবাদে পথে নামেন তিনি।লীলা নাগ প্রমুখের সঙ্গে ঢাকা সহ গোটা পূর্ববঙ্গে অসহায় সংখ্যালঘুদের পাশে তিনি যেভাবে দাঁড়িয়েছিলেন, সেদিনের মুসলিম জাতীয়তার ভয়াবহকতার ভিতরে সেই সাহস আর একজনের ও হয় নি। আবার লীলা রায়ের ‘ শ্রীসঙ্গ’ এর সাম্প্রদায়িক ঝোঁক , বিশেষ করে উগ্র জাতীয়তাবাদীদের সঙ্গে ওই সংগঠনের সংশ্রব, এমন কি ওঁদের সংগঠনের ঘনিষ্ঠ  কোনো কোনো মানুষ ঘিরে সোমেন চন্দ হত্যাকান্ডের সঙ্গে সংযুক্ত থাকার অভিযোগ– সেগুলিও নজর এড়িয়ে যায় নি সুফিয়া কামালের। ধর্ম- ভাষা- জাতপাতপাত ভিত্তিক কোনোরকম উগ্রতার সঙ্গে নিজেকে কখনো সম্পৃক্ত করেন নি সুফিয়া কামাল।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব তাঁকে অগ্রজার মর্যাদা দিতেন।তাবলে সদ্য স্বাধীন দেশে যখন নারী কল্যাণ বিষয়ক মন্ত্রকের দায়িত্ব তাঁকে অর্পণ করতে চাইলেন বঙ্গবন্ধু, দলীয় রাজনীতির নিগড়ে কোনো অবস্থাতেই নিজেকে বাঁধলেন না সুফিয়া। মহান মুক্তিযুদ্ধকালে কেবল মুক্তিযোদ্ধাদের পাশে দাঁড়ানোই নয়, সন্তানসম্ভবা মুজিবকন্যার পরিচর্যার ক্ষেত্রেও হানাদার পাক বাহিনীর সবরকমের ভ্রুকুটিকে অস্বীকার করে এগিয়ে এসেছিলেন সুফিয়া কামাল। যেভাবে শিশু হাসিনাকে রাষ্ট্রযন্ত্রের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে ইস্কুলে ভর্তির বিষয়ে বিশেষ ভূমিকা নিয়েছিলেন সুফিয়া, হাসিনা ভর্তি হয়েছিলেন ‘ নারী শিক্ষা মন্দিরে’ , সেভাবেই রাষ্ট্রযন্ত্র কে উপেক্ষা করে, হানাদার পাক বাহিনীর বন্দুকের নলের সামনে দিয়ে গিয়ে সন্তানের জন্মের পর তাঁর স্নেহের ‘ হাসু’ , আজকের বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পাশে দাঁড়িয়েছিলেন সুফিয়া কামাল।

বঙ্গবন্ধুর পরিবারের সঙ্গে সুফিয়া কামালের এই পর্যায়ের সখ্যতা থাকলেও বঙ্গবন্ধুকৃত বাংলাদেশের মহান বাহাত্তরের সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী, বাকশাল গঠন ,কোনো অবস্থাতেই সমর্থন করতে পারেন নি তিনি।প্রকাশ্যে বাকশালের বিরোধিতা করেছিলেন।সাধারণ ক্ষমার সরলীকরণকেও তিনি সমর্থন করতে পারেন নি।বাকশাল ঘিরে প্রকাশ্য বিরোধিতার অল্প কয়েকদিনের ভিতরেই বঙ্গবন্ধু পুত্র শেখ কামালের বিয়ে।ধানমন্ডির বত্রিশ নম্বরের ই আর একটি অংশে থাকেন সুফিয়া,’৬১ সাল থেকে এই পাড়ার বাসিন্দা তিনি। শেখ কামালের বিয়ের রিসেপশন হচ্ছে গণভবনে।

বাকশাল বিরোধিতার পর প্রথম বঙ্গবন্ধুর মুখোমুখি হতে চলেছেন সুফিয়া কামাল।সাংবাদিক মহলের ভিতরেও উত্তেজনা তুঙ্গে। কন্যা সুলতানা কামাল কে নিয়ে বঙ্গবন্ধুর সরকারি বাসায় এলেন সুফিয়া কামাল।বঙ্গবন্ধু তখন বাইরের বারান্দায় বিদেশি দূতাবাসের অতিথিদের সঙ্গে আলাপ করছিলেন। সুফিয়া কামালের রিক্সা থামতেই সেই আলাপপর্ব অসমাপ্ত রেখে ,’ কামাল  ,তোর ফুফু এসেছেন’ বলে নিজেই সুফিয়া কামালকে আপ্যায়ণ করতে সিঁড়ি বেয়ে নেমে এলেন।সেটাই ছিল বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সুফিয়া কামালের শেষ সাক্ষাৎ।তার কদিনের ভিতরেই সপরিবারে শাহাদাত বরণ করেন বঙ্গবন্ধু।

Gautam-Roy

গৌতম রায়

Spread the word

Leave a Reply