বিমলদার আমন্ত্রণটা এড়িয়ে যাবই ভেবেছিলাম। এই ভরভরন্ত গরমে ট্রেন, বাসের ধকল সামলে দুটো চারটে লোকের সামনে বকবক করতে যাওয়ার লোভ চট করে হয় না। শক্তির,’ ভাবছি ঘুরে দাঁড়ানোই ভালো’র মত এসি চালিয়ে দিবানিদ্রাটাই শ্রেয় এবং প্রেয় যখন ধরেই নিচ্ছিলাম, তখন ই হঠাৎ কেন যেন মনে হল, যাইই , একবার ঘুরেই আসি।আর এই ‘ একবার ঘুরে আসার’ সিদ্ধান্তটা চূড়ান্তভাবে নেওয়ার ফলে মন নামক স্থবির , জঙ্গম বস্তুটির খোলে যে পরিমাণ প্রাণবায়ু ভরে আনতে পেরেছি, না যাওয়ার সিদ্ধান্তে অটল থেকে পস্তালে তার কনাটুকু ও ভরতো না।
‘ ছিন্নমূল’ মানুষেরা এখন নিজেদের ‘ ছিন্নমূল’ বলতে অনেক সময়েইএকটু আত্মপ্রবঞ্চনায় ভোগেন। অনেকক্ষেত্রেই দেখেছি ,নিজেদের ‘ উদ্বাস্তু’ এই পরিচয় দিতে বর্তমান প্রজন্মের ছিন্নমূল মানুষদের বেশ অস্বস্তিতে পড়ে যান।’ ছিন্নমূল’ শব্দটির যে রাজনৈতিক ধ্বনি- প্রতিধ্বনি ছিল এতটা কাল ধরে ,সেই ব্যঞ্জনায় কি কোনো অদলবদল ঘটেছে?
এই প্রশ্নটাই আমাকে দুপুরে রোদের তাপ আর এ সি র আরামের হাতছানি, সবকিছুকে অস্বীকার করে টেনে নিয়ে গেল কল্যাণীতে । ইউ সি আর সি র উদ্যোগে কল্যাণী মাঝেরচরে ছিন্নমূল মানুষদের বলতে হবে , তাদের বিভ্রান্ত করতে আর এস এস কি ধরণের কৌশল অবলম্বন করেছে।মাঝেরচর – উচ্চবিত্ত,মধ্যবিত্তের চারণভূমির বাইরে যেন একখন্ড দ্বীপভূমি।স্থানীয় প্রবচন, গঙ্গানদী নাকি এককালে এই এলাকা দিয়েই প্রবাহিত হতো।এখন গতিপথ বদল করে অন্য খাতে বইছে।নদীর চরে এই এলাকার উদ্ভব।তাই এলাকার নাম, মাঝের চর।
গঙ্গার ধারে দাঁড়ালে মনটা কেমন উদাস হয়ে যায় ‘ ভানুমতী’ র জন্যে।সমরেশ বসুর অমর সৃষ্টি ভানুমতী।সেই দেশজকন্যার জীবনের উত্থানপতনের ভিতর দিয়ে অন্তিম পরিণতি’ গঙ্গাবাড়িওয়ালী’ যখন নদীর পার ধরে এই প্রচন্ড দাবদাহে সমরেশের আতপুরের বস্তিজীবন যাপনের বাস্তবতা আর আজকের ছিন্নমূল মানুষদের বেঁচে থাকার লড়াইয়ের এক পরিবর্তিত রূপ কে এক সরলরেখায় এঁকে দেয়, তখন ই যেন শুনতে পাওয়া যায়, সমরেশের ই ,’ যুগ যুগ জীয়ে’ র সেই সুতীক্ষ্ণ ‘ জিগ জিগ’ ধ্বনি।আজ ও তো শিকারীর শিকার কৌশল থামে নি।সেদিন ছিল ব্রিটিশ আর মার্কিন সৈনিক। আর আজ তার জায়গায় শিকারীর ও যেন এক ভুবনায়ন ঘটেছে।
কয়েক প্রজন্মের ছিন্নমূল মানুষদের সামনে যখন প্রথম বাক্যটি উচ্চারণ করলাম; দেশভাগ হিন্দু বাঙালি করে নি, মুসলমান বাঙালি ও করে নি।করেছিল স্বার্থান্বেষী হিন্দু এবং মুসলমান– আর শেষ পর্বে প্রশ্নোত্তরকালে তাঁদের জীবনযন্ত্রণাকে ছাপিয়ে যখন জাতীয় নাগরিক পঞ্জীর মত বিষয় ই সেইসব মানুষদের জিজ্ঞাসার মূল বিষয়বস্তু হল, তখন এই উপলব্ধি নিয়েই ফিরে এলাম; ছিন্নমূল মানুষদের অধিকার প্রতিষ্ঠার ধারাবাহিকতার যে ঐতিহ্য বামপন্থীরা তৈরি করেছিলেন সেই দেশভাগের কালোরাতের দিনটি থেকে, সেই ধারাবাহিকতার পরম্পরা আজ ও সার্বিক যোগ্যতার সঙ্গেই তাঁরা বয়ে নিয়ে যেতে পারছেন বলেই আর এস এস গত কয়েকবছরে রাষ্ট্রযন্ত্র কে পুরোদমে ব্যবহার করেও এই ছিন্নমূল মানুষদের কোনো অবস্থাতেই বিভ্রান্ত করতে পারে নি।নদিয়ার তাহেরপুর থেকে কল্যাণীর মাঝেরচর– সময়ের ব্যবধানে আমার অভিজ্ঞতায় কোনো ফারাক ঘটে নি।
প্রান্তিক সমাজের নিজস্ব যে সাংস্কৃতিক পরম্পরা, সেই ঐতিহ্য কে বিনষ্ট করে তাঁদের শেকড় থেকে উপড়ে ফেলবার চেষ্টা র পিছনে আন্তর্জাতিক হাত আছে।সেই চক্রান্তকে প্রতিরোধ করাটাও ছিন্নমূল মানুষের অধিকার রক্ষার আন্দোলনের একটা অঙ্গ হয়ে উঠেছে।সুদুর বরিশালের এক জলজঙ্গল ঘেরা গাঁয়ে কোনো লোকায়ত ব্রত পালনের কথা হয়ত ঠাকুমার কাছে শুনেছিল কিশোরীটি। ঠাকুমার হাত ধরে সেই ব্রতপালনের ভিতরে যে দেশজ সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখবার তাগিদ নীজের অজান্তেই কিশোরীটি সেদিন নিজের মনে স্থাপন করেছিল, সেই লোকসংস্কৃতির ধারা উপরে ফেলবার চেষ্টা কিশোরীটি তার মেয়েবেলা থেকে আজ অস্তগামী সূর্যের পানে নিজেকে সঁপে দেওয়ার কাল পর্যন্ত কম দেখে নি। তবু ও মাটির টানে নিজের কাঁচা চুল পাকা করেও নিজের নাতনীকে সেই ‘বের্ত্য’ র সুলুক সন্ধান দিয়ে যেতে সঁ ভোলে না।
ছিন্নমূলের এই লোকজ সংস্কৃতির গভীরে যে তাঁদের রাজনৈতিক দাবি আদায়ের ও চাবিকাঠি টা গোঁজা আছে সেটা সাম্প্রদায়িক শিবির খুব ভালো করেই জানে।আর জানে বলেই গোটা সীমান্তবর্তী এলাকার উদ্বাস্তু অধ্যুষিত অঞ্চলগুলির আদ্যন্ত নিজস্ব সামাজিক জীবনে তারা ঢুকে যাচ্ছে।লোকজ সংস্কৃতির নিজস্ব আচার অনুষ্ঠানকে নাগপুরের রেশমবাগের ‘ কেশবভবনে’ র অনুমোদিত ‘ হিন্দু’ লেবাসে প্রতিষ্ঠিত করতে তাই তাদের চেষ্টার ত্রুটি নেই।
আজ থেকে কুড়ি বাইশ বছর আগে ও প্রান্তিক মানুষদের ভিতরে নিজেদের রাজনৈতিক চেতনাকে সংক্রমিত করতে আর এস এস বৈদিক দেবদেবতারই আশ্রয় নিতো। আজ আর কিন্তু সেভাবে বৈদিক দেব দেবতা নির্ভর নয় তাদের সামাজিক, রাজনৈতিক আগ্রাসন।লোকজ সমাজকে সংক্রমিত করতে সেই সমাজের মনস্তত্ত্ব অনুযায়ী নিত্য নোতুন ধারায় হিন্দু ধর্মের ব্যখ্যা( যে কাজে আর এস এসে নিজস্ব প্রকাশন সংস্থা ‘ গীতা প্রেস’ কে অত্যন্ত ক্ষিপ্র ভাবে গোটা হিন্দু সাম্প্রদায়িক শিবির ব্যবহার করে।এই সংস্থার সুলভ ধর্মগ্রন্থগুলি বিশেষ ভাবে তুলে দেওয়া হয় উদ্বাস্তু সমাজের হাতে।বলাবাহুল্য , প্রচলিত ধর্ম ভাবনার বাইরে আর এস এসের রাজনৈতিক হিন্দুত্বের লাইনেই ওইসব ধর্মগ্রন্থগুলিতে ব্যাখ্যা থাকে) সাধারণ মানুষের যাপনচিত্রকে প্রভাবিত করবার ক্ষেত্রে অতি নিরীহ আকারের আড়ালে একটা বড় রকমের রাজনৈতিক তাৎপর্য নিয়ে আসে।
আপাতনিরীহ একটা ধর্ম প্রচারের পদ্ধতির ভিতর দিয়ে, হরিনামসংকীর্তনের আসরে চলে গিয়ে ধর্মকথা শোনানোর নাম করে প্রথাগত শিক্ষার বিশেষ সুযোগ না পাওয়া উদ্বাস্তু মানুষদের ভিতরে খুব সুপ্ত ভাবে জাগিয়ে দেওয়া হয় আর এস এসের মূল রাজনৈতিক লক্ষ্য ; মুসলমান বিদ্বেষ। ছিন্নমূল মানুষদের একটা বড় অংশ অনেকক্ষেত্রেই প্রজন্মান্তরিত হয়েও দেশভাগ ঘিরে অনেক সময়েই ইতিহাসের কিছু অপব্যাখ্যার শিকার হয়ে পড়েন। হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তি অভিজাত, উচ্চবর্ণের স্বার্থে মুসলিম জাতীয়তাবাদীদের সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে দেশভাগে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শক্তিকে সহায়তা করেছে।এই কাজে শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় থেকে শুরু করে নির্মলচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়,সেইসময়ের হিন্দু মহাসভার তাবড় নেতাদের ভিতরে কে ছিলেন না এই দেশভাগের ষড়যন্ত্রে? মুসলিম লীগ যেমন সাধারণ খেটে খাওয়া মুসলমানদের স্বার্থের কথা একবিন্দু চিন্তা না করে অভিজাত , উচ্চবর্ণের ,উচ্চবিত্তের মুসলমানদের কথা চিন্তা করেই কেবলমাত্র দেশভাগ চেয়েছিল, ঠিক সেই ভাবেই হিন্দু সাম্প্রদায়িকেরা দেশভাগ চেয়েছিল কেবলমাত্র উচ্চবর্ণের, উচ্চবিত্তের হিন্দুদের স্বার্থের দিকে তাকিয়েই ।নিম্নবর্গীয়, তপশিলি জাতি- উপজাতি, আদিবাসী জনগোষ্ঠীর হিন্দুদের কোনোরকম স্বার্থ ই কি শ্যামাপ্রসাদ, কি হিন্দু মহাসভা,কারোর ই এতটুকু বিবেচনার ভিতরে তখন আসে নি।
শ্যামাপ্রসাদ আর তার সাঙ্গপাঙ্গেরা মুসলিম সাম্প্রদায়িকদের সঙ্গে একযোগে দেশভাগ করে এই ভাগাভাগির পুরো দায়টা চাপিয়ে দিলো মুসলমান সম্প্রদায়ের উপর। বর্ণ হিন্দু অভিজাতদের একটা বড় অংশ সম্পত্তি স্থানান্তর করতে সক্ষম হলেও গরীব মানুষদের পক্ষে সেটা আদৌ সম্ভবপর ছিল না।ফলে গরীব মানুষ, যাঁদের বেশিরভাগ ই হলেন নিম্নবর্গীয় হিন্দু অন্য উপায় না পেয়ে বাধ্য হলেন দেশত্যাগ করতে।আর এই নিম্নবর্গীয়দের দেশত্যাগ ঘিরে উচ্চ বর্গীয় হিন্দু সাম্প্রদায়িক নেতারা অবতারণা করলেন মুসলমানের দ্বারা খুন, ধর্ষণ, লুঠতরাজের নানা রোমহর্ষক কাহিনী। এই কাহিনীর ফাঁদে ফেলে দেশভাগের সময়কালে বা অব্যবহিত পরে, আইয়ূব খানের আমলে নিম্নবর্গের হিন্দুদের ফেলে আসা জমি – জিরেত যে একাংশের উচ্চবর্ণের হিন্দুরা দখল করে নি- তেমনটা মনে করবার কিন্তু আদৌ কোনো কারন নেই। এইসব কথাগুলো ছিন্নমূল মানুষদের সামনে তুলে ধরাটা এখন একান্ত জরুরি।ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িক শক্তি আর প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িক শক্তির সাঁড়াশি আক্রমণে গোটা উদ্ধাস্তু সমাজ আজ বিভ্রান্ত। সেই বিভ্রান্তির সুযোগ নিয়ে কায়েমী শক্তি যাতে ঘোলা জলে মাছ ধরতে না পারে- সেইদিকটা দেখা এখন একটা বড় রাজনৈতিক কাজ।
গৌতম রায়