অঞ্জন বসু
রাজা রামমোহন রায়ের জন্ম ১৭৭২ সালের ২২ শে মে। হুগলী জেলার রাধানগর গ্রামে রামমোহন রায় জন্মগ্রহণ করেন ,বাবা ছিলেন রামকান্ত রায় এবং মা ছিলেন তারিণী দেবী, ঘোর বৈষ্ণব পরিবারে জন্ম নেওয়া রামমোহনের মধ্যেও স্বাভাবিকভাবেই ‘ধর্মভাব’ প্রবলভাবেই ছিলো, অসামান্য মেধা ও ধীশক্তির অধিকারী মানুষটি গ্রীক, হিব্রু, ল্যাটিন, ফার্সী, ইংরেজী, সংস্কৃত সহ মোট বারোটি ভাষায় সুপন্ডিত ছিলেন। কোরান, বাইবেল সহ বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ পাঠ করে ‘একেশ্বরবাদ’-র প্রতি রামমোহন গভীর আকর্ষণ অনুভব করেন। পৌত্তলিকতার তীব্র প্রতিবাদ করে রচনা করেন ‘তুহুফাৎ উল মুহাহিদিন’, ফার্সি ভাষায় লেখা গ্রন্থ।
১৮০৩-১৮১৪ খ্রীষ্টাব্দ এই দীর্ঘ ১১ বছর তিনি ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর কর্মচারী ছিলেন ,জন ডিগবির সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা ছিলো বেশি, আবার কোম্পানির কর্মচারী রুপে আসাম সীমান্তে কিছুকাল অতিবাহিত করার কারণে রামমোহন অভিজ্ঞতা অর্জনে সক্ষম হন। এর পাশাপাশি কোম্পানির কর্মচারীদের সঙ্গে মেলামেশার কারণে খুব দ্রুত তিনি ইংরেজী ভাষায় গভীর বুৎপত্তি অর্জন করেন।
ফলে স্বাভাবিক ভাবেই হিন্দু সমাজপতিদের সঙ্গে তার সংঘর্ষ বৃদ্ধি পায়, ১৮১৫ সালে রামমোহন রায় প্রতিষ্ঠা করেন ‘আত্মীয় সভা’। এখানেই তিনি প্রথম তার ‘একেশ্বরবাদ’-র তত্ত্ব প্রচার করেন এবং ১৮১৫ -১৭ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যে বেদান্ত সহ পাঁচটি উপনিষদকে বাংলা ভাষায় অনুবাদ করেন। মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার, রাজা রাধাকান্ত দেব, সুব্রম্মণ্য শাস্ত্রী প্রমুখেরা রামমোহনের একেশ্বরবাদকে ‘অশাস্ত্রীয়’ বলে কটুপূর্ণ ভাষায় তাকে আক্রমণ করেন, কিন্তু রামমোহন এর জবাব দেন যুক্তিপূর্ণ ও শানিত ভাষায়।
‘ভট্টাচার্যের সহিত বিচার ও সম্বাদ কৌমুদী’ পত্রিকায় রামমোহন ক্ষুরধার ভাষায় বিরোধীপক্ষের সব যুক্তিকে খন্ডন করেন |

আবার খ্রীষ্টান মিশনারীদের ধর্মান্তর এবং হিন্দু ধর্মের উপর আক্রমণের বিরুদ্ধেও রামমোহনের কলম ঝলসে ওঠে, তিনি খ্রীষ্টধর্মের আদর্শ ও বক্তব্যকে ভিত্তি করে রচনা করেন ‘percepts of jesus’ নামক পুস্তকটি, যেখানে কঠোর ভাষায় রামমোহন রায় খৃষ্টান মিশনারীদের সমালোচনা করেন। এবার মিশনারীরাও তার প্রতিপক্ষ হয়ে ওঠে।
অন্যদিকে ১৮২৮ সালে রামমোহন প্রথমে ব্রাহ্ম সভা এবং পরে ১৮৩০ সালে ব্রাহ্ম সমাজ প্রতিষ্ঠা করেন, মূলত এখান থেকেই একেশ্বরবাদের প্রচার আরোও জোরদার হয়ে ওঠে, ক্ষুব্ধ সমাজপতিরা ঘোষণা করেন ‘রামমোহন এবং ব্রাহ্ম সভা’ হিন্দুধর্ম বিরোধী এবং বিভিন্ন পত্রিকায় রামমোহনকে উদ্দেশ্য করে বিভিন্ন কটূক্তিপূর্ণ রচনা প্রকাশিত হতে থাকে ,রামমোহন তার সংবাদ কৌমুদী পত্রিকায় জবাব দেন।
তবে যে বিষয়টিতে রামমোহন রায়ের অবদান আজোও শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করা হয় সেটি হলো ঘৃণ্য ও বর্বরোচিত কুপ্রথা সতীদাহের নিরসন করা, মূলত উনবিংশ শতকের সেই অন্ধকারাচ্ছন্ন যুগে বাংলার বুকে বিভিন্ন কুপ্রথা ব্যাধির মতো আঁকড়ে বসেছিলো, এর মধ্যে বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ, গঙ্গাসাগরে সন্তান বিসর্জন এবং সতীদাহ প্রথা। সতীদাহ প্রথা ছিলো অত্যন্ত অমানবিক ও বর্বরোচিত বিষয়, সে যুগে অতি অল্প বয়সে মেয়েদের বিয়ে হত কোনো বয়স্ক বা বৃদ্ধ মানুষের সঙ্গে, স্বাভাবিকভাবেই সেই বৃদ্ধ মানুষটি অল্পদিনের মধ্যেই মারা যেতো, ফলে তখন তার চিতায় তার অল্পবয়সী বিধবা মেয়েটিকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হত।
এই চরম ঘৃণ্য ও অমানবিক প্রথার বিরুদ্ধে মুঘল সম্রাট জালালউদ্দিন মহম্মদ আকবর উদ্যোগী হয়েছিলেন। তার উদ্দেশ্য মহৎ হলেও হিন্দুসমাজের বিরুপতার কারণে তিনি বেশি সাফল্য পাননি। পরে ব্রিটিশ সরকার এই কূপ্রথার মূলোৎপাটনে উদ্যত হয়, কিন্তু রক্ষণশীলদের স্বার্থলোলুপতা এবং অসহায় মেয়েদের সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত রাখার বিকৃত মানসিকতা ইংরেজ সরকারকে সাময়িকভাবে এ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে বাধা দেয়। এরপরেই এগিয়ে আসেন রামমোহন রায়, তিনি প্রথমে তৎকালীন ভারতের গভর্ণর জেনারেল লর্ড উইলিয়াম বেন্টিকের সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনা করেন, কিন্তু বেন্টিঙ্ক এ বিষয়ে কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন।
তখন শুরু হলো রামমোহনের নতুন লড়াই, বিভিন্ন শাস্ত্র ঘেঁটে রামমোহন রায় প্রমাণ করেন ‘সতীদাহ অশাস্ত্রীয়’, অবশ্য গোঁড়া ও রক্ষণশীল সমাজপতি এবং বিশেষত ব্রাহ্মণরা তার বিরুদ্ধে কদর্য কবিতা রচনা করত, এর মধ্যে অন্যতম ছিল-
‘ব্যাটা সরাইমেলের কূল, ব্যাটার বাড়ী খানাকূল
ওঁ তৎ সৎ বলে ব্যাটা বানিয়েছে ইস্কুল’।
তার ঘোড়ার গাড়ি বাইরে বেরোলেই পাথর মারা হতো তাকে লক্ষ্য করে ,কিন্তু অকুতোভয় রামমোহন হাসতে হাসতে তার কোচোয়ানকে বলতেন ‘হেঁকে যাও’, শক্তিশালী ও মজবুত চেহারার অধিকারী রামমোহনের সম্মুখীন হতে গুন্ডারাও ভয় পেতো।
রামমোহন রায়ের অক্লান্ত পরিশ্রম, কলকাতার বহু মান্যগণ্য মানুষের সতীদাহের বিরুদ্ধে স্বাক্ষর উইলিয়াম বেন্টিঙ্ককেও স্পর্শ করে, ফলে তিনি ১৮২৯ খ্রীষ্টাব্দের ৪ ঠা ডিসেম্বর ১৭ নং রেগুলেশন আইন দ্বারা সতীদাহ প্রথাকে চিরতরে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন, অবশ্য রক্ষণশীলরা সূদূর ইংল্যান্ডের প্রিভি কাউন্সিলেও আবেদন করে এর বিরুদ্ধে, কিন্তু সেখানেও কাউন্সিল স্পষ্টভাবেই গভর্ণর জেনারেলের আইনকেই অনুমোদন করে।
সংবাদপত্রের স্বাধীনতা রক্ষায় তিনি ছিলেন নিবেদিতপ্রাণ, ‘মিরাৎ উল অখবার’ ও ‘সংবাদ কৌমুদী’ নামক সংবাদপত্র প্রকাশের মাধ্যমে রামমোহন সাংবাদিকতা ও সংবাদপত্রের প্রকাশনার ক্ষেত্রে আলোড়ন সৃষ্টি করেন , আবার ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষা বিস্তারের ক্ষেত্রেও রামমোহন রায় উদ্যোগী ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন, ১৮২৩ সালে তৎকালীন বড়লাট লর্ড আর্মহাস্টকে লেখা তার চিঠি অমূল্য দলিল হিসাবে চিন্হিত হয়ে আছে, তিনি ইংরেজ সরকারকে ভারতে পাশচাত্যের বিজ্ঞান, গণিত প্রভৃতি পড়ানোর বিষয়ে আবেদন করেন।
তৎকালীন অস্থায়ী বড়লাট অ্যাডাম সংবাদপত্রের স্বাধীনতার উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ (১৮২৩) করলে রামমোহন রায় এর বিরুদ্ধেও প্রতিবাদ জানান। অবস্থার গুরুত্ব উপলব্ধি করে চার্লস মেটকাফ ১৮৩৫ খ্রীষ্টাব্দে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নেন।
রামমোহন রায়ের পড়াশোনা এত ব্যাপক ও গভীর ছিল যে সমসাময়িক আন্তর্জাতিক ঘটনাবলী তার উপরে গভীরভাবে প্রভাব বিস্তার করেছিল, ফ্রান্সের ১৮৩০ খ্রীষ্টাব্দের জুলাই বিপ্লবের সাফল্যে তিনি ভোজসভার আয়োজন করেন, আবার ১৮২১ সালে নেপলসের সংবিধান পরিবর্তনের নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন ব্যর্থ হলে তিনি ব্যথিত হন।
কৃষকদের স্বার্থের প্রতিও তিনি সচেতন ছিলেন, ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের’ কুফলগুলির প্রতি তিনি সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।
তৎকালীন মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় আকবরের দাবি দাওয়া নিয়ে তিনি বিলেত যাত্রা করেন, এবং সম্রাট আকবর (২য়) তাকে ‘রাজা’ অভিধায় ভূষিত করেন।
আজ ‘ভারতপথিক’ রাজা রামমোহন রায়ের জন্মদিন, সমাজসংস্কার থেকে শুরু করে রাজনৈতিক এবং ধর্মীয় সংস্কারে তার অবদান অতুলনীয়, আকাশে উজ্জ্বলমান সূর্যের মতোই তিনি আজও আমাদের অন্তরে বিরাজ করছেন, বাংলা গদ্য রচনায় সাবলীল, একাধিক কুপ্রথা বিরুদ্ধে দীর্ঘ আন্দোলন, সম্পত্তির উপর নারীর অধিকারের দাবিতে আন্দোলন তাকে মহাজীবনে পরিণত করেছে |
১৮৩৩ সালের ২৭ শে সেপ্টেম্বর ইংল্যান্ডের ব্রিস্টল শহরে তার জীবনাবসান ঘটে।
ব্রিস্টলের সমাধিক্ষেত্রে আজও ঘুমিয়ে আছেন ‘বাংলার নবজাগরণের অগ্রদূত’ রাজা রামমোহন রায়।