“Out, out, brief candle.
Life’s but a walking shadow, a poor player
That struts and frets his hour upon the stage,
And then is heard no more…”
সব যখন শেষে শবেই পরিণত হয় তবে অনুতাপের উপযোগিতা কি? এই কি ভারতীয় বস্তুবাদী দর্শনের সেই অবশেষ যার কিছুটা চার্বাক দার্শনিকেরা ব্যখ্যা করেছেন?

লেডি ম্যাকবেথের মৃত্যুর পরে যে উপলব্ধির অনুরণন শেক্সপিয়র লিখে গেছেন, কিছুটা সেই সুরই আমরা খুঁজে পাই মাইকেল মধুসূদন দত্তের জীবনে। ১৮৭৩ সালের ২৬ শে জুন হেনরিয়েটার মৃত্যুতে তিনি জানতে চাইছেন স্ত্রীর সমাধি আয়োজনে বিদ্যাসাগর খবর পেয়েছেন কিনা। এর ঠিক তিনদিন পর ২৯শে জুন (১৮৭৩ সালের ২৯ শে জুন ছিল রবিবার) মাইকেল মধুসূদন দত্তের মৃত্যু হয়। মধুসূদন দত্ত হিসাবে যাত্রা শুরু করে একজন মাইকেল মদুসূদন দত্ত অবধি কিভাবে পৌঁছান সেই মহাজীবনকে তারই জন্মদিবসে (২৫শে জানুয়ারি, ১৮২৪) পুনঃস্মরণে এই নিবন্ধ।
তার জীবনের যে দুটি পর্ব নিয়ে শোরগোল বেশি হয় সেগুলিকে কিছুটা দূরে সরিয়ে রাখাই সঠিক। এর কারন দুটি, প্রথমত মধুসূদন মাইকেল হয়ে ওঠার পরেও এতটুকু বদলান নি, বলা চলে এহেন কোনোরকম বাহ্যিক প্রভাবে মানুষের চরিত্রে বদল আসেনা, এই সত্য প্রতিষ্ঠা করাই মধুসূদনের জীবনসংগ্রামের অন্যতম বৈশিষ্ট। দ্বিতীয়ত, মদ্যপানের প্রতি আসক্তিকে হেতু করে তার কবি প্রতিভাকে পিছনে ঠেলে দেবার যে মোটা দাগের প্রবনতা তা পরিহার করলেই আসল মানুষটা কেমন ছিলেন সেটা চোখের সামনে আসে। আমাদের আগ্রহ, আমাদের অনুসন্ধিৎসা সেই মানুষটিকে পুনরাবিষ্কারেই একনিষ্ঠ।
যশোরের সাগরদাঁড়ি গ্রামের জমিদার পরিবার ছিলেন দত্তেরা। মধুসূদনের উৎস সন্ধানে সেই যুগের ভারতবর্ষে লর্ড কর্নওয়ালিশের কলমের খোঁচায় প্রোথিত সামাজিক – রাজনৈতিক ব্যবস্থা হিসাবে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে উদ্ভিন্ন জমিদার শ্রেণীর বিশেষ অবস্থানকে আলোচনায় রাখতে হবে। এইসব মধ্যবিত্ত নব্য ধনীবৃন্দ জমিদারি সামলাতে গিয়ে কখন সাম্রাজ্যবাদের সাথে আপোষ – মীমাংসায় বুঁদ হলেন তারা নিজেরা বুঝতে পারেন নি, আবার এদেরই পরের প্রজন্ম পারিবারিক সম্পদের জোরে এবং পাশ্চাত্ম্যের আলোকোজ্জ্বল জীবনযাত্রার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে ইংরাজি শিক্ষার সুযোগ পেলেন। তখন এশিয়া তথা ভারতবর্ষের প্রাচীনতম অর্থনৈতিক কাঠামো “স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রাম ব্যবস্থা” ইংরেজি শাসনে চুরমার হয়ে ভেঙ্গে পড়ছে। একদিকে পশ্চাদপদ সামাজিক ঐতিহ্যের পিছুটান আরেকদিকে ইংরেজি শিক্ষার প্রভাবে কিছুটা কর্মযোগ এই দুয়ের ফসল সেকালের বাঙালি মনীষা। মধুসূদনকে এই প্রেক্ষাপটেই বিচার করতে হবে। যে মনীষার ঊষালগ্ন রামমোহন, ডিরোজিওর হাতে শুরু হয় তারই একটি বিশেষ প্রকাশ পরবর্তীকালে মুধুসূদনের কলম হতে ঠিকরে আসে।

মধুসূদন হিন্দু কলেজে ডিরোজিওকে সরাসরি দেখেন নি, তার ছাত্রাবস্থায় হিন্দু কলেজে সাহিত্য বিভাগের মাথায় ক্যাপ্টেন ডেভিড লিস্টার রিচার্ডসন। রিচার্ডসনই সাহিত্য সম্পর্কে আগ্রহী করেন মধুসূদন দত্তকে। হিন্দু কলেজে মোট ছয় বছর পড়াশোনা করেন মধুসূদন দত্ত। এই সময়েই সাহিত্যিক বনাম গণিতজ্ঞের মধ্যে কে শ্রেষ্ঠতর সেই বিতর্কে গণিতের ক্লাসে অমনোযোগী মধুসূদন একদিন সকলের সামনে নিজের গাণিতিক কীর্তি প্রকাশ করেন এবং মন্তব্য করেন – “And so Shakespeare could be Newton, if he tried.” আঁচ পেতে অসুবিধা হয় না তার মনোভাব কোন দিকে মোড় ঘুরছে।
বুদ্ধিবৃত্তি সমৃদ্ধ কলকাতার বাঙালি সমাজ তখন দুইভাগে বিভক্ত। একদিকে ডিরোজিও উত্তর ইয়ং বেঙ্গল ধারার প্রবাহমানতা – এই ধারাকে পরে মধুসূদন সমালোচনা করেছেন “একেই কি বলে সভ্যতা?”-তে, আরেকদিকে ক্ষয়িষ্ণু ঐতিহ্যের বোঝা বয়ে চলা ধনী কর্মবীর বাবু সমাজ যাদের তীক্ষ্ণ বিদ্রুপের উদ্দেশ্যেই তিনি লেখেন “বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ”। নিজের একমাত্র সন্তান (আরও দুই ছেলে মারা যায়) খ্রিস্টান হয়েছে বলে বংশরক্ষার উদ্দেশ্যে পিতা রাজনারায়ন দত্ত মধুসূদনের মাতা জাহ্নবী দেবী বেঁচে থাকতেই আরও কয়েকবার বিবাহ করেন। পিতার এহেন আচরণ মাইকেল মধুসূদন দত্ত কখনো ক্ষমা করতে পারেন নি। মা’র উদ্দেশ্যে তার বক্তব্য ছিল তিনি চিরকাল তার জন্য মধু’ই রয়ে যাবেন, মাইকেল হবার প্রভাবে সেই ‘মধু’ কখনো হারিয়ে যায় নি। এখানেই তার স্বকিয়তা।

মাদ্রাজ থেকে ফিরে এসে বিশপ কলেজে পড়ার সময় ১৮৪৩ সালের ৯ই ফেব্রুয়ারী খৃষ্টীয় মতে দীক্ষা গ্রহণ করলেন, তখন বিশপ’স কলেজ গার্ডেনরিচে – তারই অন্তর্গত চার্চের জমিটি বর্তমানে হাওড়ার শিবপুরে পূর্বতন বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, বর্তমানে আইআইইএসটি’র অধীনস্থ। মধুসূদন কখনো ধর্ম বিষয়ে আগ্রহী ছিলেন না, তার ধর্মান্তরের প্রেক্ষিত একদিকে ব্যাক্তিগত বিদ্রোহী মেজাজের স্ফুলিঙ্গ আরেকদিকে সেই সময়ের কলকাতা কেন্দ্রিক সমাজের চালচিত্র। দিগম্বর মিত্র, প্যারিচাঁদ মিত্র, রামতনু লাহিড়ী থেকে শুরু করে রেভারেন্ড কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়দের সংস্পর্শে এসে মধুসূদন দত্তে কার্যত এমন এক মানুষে পরিণত হয়েছিলেন যাদের আমরা “Free Thinker” বলি। এর সাথে যুক্ত হয় ব্যাক্তিগত নীতিনিষ্ঠতা, অবিচল সৎ ব্যাক্তিত্ব এবং প্রজ্ঞাসমৃদ্ধ জীবন দর্শন। এই তিনের সমবেত তাড়নাই তাকে ছুটিয়ে বেড়িয়েছে সারা জীবন। কলকাতা থেকে মাদ্রাজ, পরে ফ্রান্স, ইংলন্ডসহ ইউরোপের নানা দেশ। এই যাত্রা হল সেই পথ যার স্বপ্ন তিনি দেখতে শুরু করেন ছাত্রাবস্থায় – কবি হবার বাসনা ততদিনে তার হৃদয় কানায় কানায় পূর্ণ করে দিয়েছে। পিতার ইচ্ছানুযায়ী বিবাহে তার অসম্মতি সেই জীবন দর্শনেরই প্রভাবে, যে মানুষ তার জীবনের সঙ্গিনী হবেন তার সাথে পূর্বপরিচিতি থাকবে না, প্রেম থাকবে না – এই কথা তিনি মেনে নিতে পারেন নি। নিজের অনুভব দিয়ে যখন বুঝেছেন তৎকালীন বাঙালি সমাজে এমনটা হতে পারে না, তাই নিজের পথ বদলেছেন – মত বদলান নি। এই সিদ্ধান্ত আসলে এক ব্যক্তিগত যুদ্ধ – বহু যুগের অচলায়তনের বিপরীতে একা অভিমন্যুর মতো লড়াই। তফাত শুধু এইখানে যে মহাভারতের অভিমন্যু মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও লড়ে যান, মধুসূদন মাইকেল হয়ে বেঁচে থাকার লড়াইতে জিততে চেয়েছিলেন। তার নিজস্ব পথের লড়াই আজকের দিনে অনুসরণযোগ্য না মনে হতেই পারে কিন্তু সামাজিক পশ্চাদপদতার বিরুদ্ধে সেই ব্যাক্তিগত সংগ্রামের ইতিহাস যতটা চর্চায় থাকা উচিত ছিল আধুনিক বাঙালি সমাজ তাকে সেই মর্যাদা দেয় নি বললে অত্যুক্তি হয় না।

এই প্রসঙ্গেই আমাদের কাজ আসলে সেই অসমাপ্ত কর্তব্যের প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ। তার কবি প্রতিভা নিয়ে কারোর মনেই কোন সংশয় নেই যদিও তিনি স্বভাবকবি ছিলেন না (তার নিজেরই সেই উপলব্ধি ছিল)। চলমান সমাজের প্রতিটি আধুনিক বাঁক ও মোড়ের সাথে তিনি নিজেকে একাত্ম করতে চেয়েছেন, করেছেন। বলা চলে আগুনে পুড়ে আঁচের সক্ষমতা যাচাই করেছেন। এমন ব্যাক্তিত্বকে শুধু নিছক ধর্মান্তরের ঘেরাটোপে বিচার করার মনোভাব আসলে আমাদের চেতনার পশ্চাদপদতা। মাইকেল মধুসূদন দত্ত নিজের বংশের একটিই গুণ (অথবা দোষ) সারাজীবন বয়ে বেড়িয়েছেন – “দত্তেরা টাকা গুনে খরচ করে না”। প্রায় প্রবাদে পরিণত হওয়া সেই বংশপরিচয়কেই মধুসূদন প্রসারিত করেছেন। টাকা-পয়সা তো বটেই, নিজের প্রতিভার কোনকিছুই তিনি হিসাব করে খরচ করেন নি। তার সাহিত্য কীর্তিও সেই অনুসারেই অকালে থেমে গেছে। এখানেই তার জীবনবোধের অপূর্ণতা – নিজের চারপাশের সবাই, সবকিছু যখন তাকে পর করে দিয়েছে তখন সেই সবকিছুর বিরুদ্ধে তার নিজেকে প্রতিদ্বন্ধি অবস্থানে নিয়ে গেছেন, আর একথা মাথায় রাখলে বুঝতে অসুবিধা হয় না কেন এই মানুষটিই ‘মেঘনাদ বধ’ লেখেন। মধুসূদন হয়ত মেঘনাদের সমব্যাথি হয়ে উঠতে পেরেছিলেন। নিজে এক অসম, এক অন্যায় যুদ্ধের শিকার হয়েছিলেন বলেই কি?
ওয়েবডেস্কের পক্ষে: সৌভিক ঘোষ