হেনরি ল্যুইস ভিভিয়ান ডিরোজিও।
পর্তুগিজ পিতা ফ্রান্সিস ডিরোজিও অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান সমাজে সুপরিচিত, মা সফিয়া জনসন (ডিরোজিও) ব্রিটিশ নাগরিক হিসাবে ভারতে বসবাসকারী। ১৮০৯ সালের ১৮ই এপ্রিল কলকাতার এন্টালি-পদ্মপুকুর এলাকায় ডিরোজিওর জন্ম, ছয় বছর বয়সে তৎকালীন ভারতে অন্যতম মুক্তচিন্তক হিসাবে খ্যাত ডেভিড ডার্মন্ড’র ‘ধর্মতলা একাডেমি’তে ভর্তি হন। প্রথম থেকেই মেধাবী ছাত্র হিসাবে পরিচিতি ও পুরস্কারসমূহে ভূষিত হন।
ইংরেজি সাহিত্য ও পাশ্চাত্য দর্শনে বিশেষ ব্যুৎপত্তি সহ পড়াশোনা শেষ করে কিছুদিন পিতার কর্মক্ষেত্রেই যুক্ত ছিলেন পরে ভাগলপুরে নীল ফ্যাক্টরিতে কাজ করতে যান। ততদিনে জন কিটস, পি বি শেলি এবং লর্ড বায়রনের সাহিত্য তার চেতনায় একদিকে নান্দনিক অনুভব আরেকদিকে প্রখর যুক্তিবাদ গেঁথে দিয়েছে। প্রতিভাবান কবি হিসাবেও পরিচিত হয়েছেন।
কাব্যিক প্রতিভার তাড়নাতেই কলকাতায় ফিরে এসে নিজের পরিচালনায় সংবাদপত্র ‘ক্যালকাটা গ্যাজেট’ প্রকাশনায় মনোযোগ দিলেন। মাত্র ১৭ বছর বয়সে হিন্দু কলেজে ইংরেজি সাহিত্য ও ইতিহাসের অধ্যাপক হিসাবে নিযুক্ত হলেন ১৮২৬ সালে। এই সময় কলকাতার গোঁড়া ধর্মান্ধ হিন্দু সমাজে ব্যাপক আলোড়ন চলছে, ডিরোজিও কলেজের ছাত্রদের প্রথাসম্মত শিক্ষাদানের সাথেই বিতর্ক করতে, যুক্তি-প্রতিযুক্তির মাধ্যমে সত্যে পৌঁছানর দীক্ষার্জন শেখাতে শুরু করলেন। কলকাতার শিক্ষিতসমাজে এক নতুন দিশা উন্মোচিত হল, দুই বছর পরে ১৮২৮ সালে যখন রামমোহন রায় ব্রাহ্ম সমাজ প্রতিষ্ঠা করছেন ততদিনে ডিরোজিওর প্রতিষ্ঠিত ‘অ্যাকাডেমিক অ্যাসোসিয়েশন’র খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছে সর্বত্র।
তারই প্রভাবে কলকাতার শিক্ষিত নতুন প্রজন্ম ‘ইয়ং বেঙ্গল’ হিসাবে চিহ্নিত হয়। বহুযুগ ধরে স্থবির, নিরেট কালাপাহাড়ের মতো নিশ্চল বাঙালি হিন্দু সমাজের বুকে হিল্লোল উঠতে শুরু করে। দক্ষিনারঞ্জন মুখোপাধ্যায়, হরচন্দ্র ঘোষ, কৃষ্ণ মোহন বন্দ্যোপাধ্যায়, প্যারিচাঁদ মিত্র, রাধানাথ শিকদার, রামতনু লাহিড়ী, শিবচন্দ্র দেব সহ যেসকল বিশিষ্ট প্রতিভার স্ফুরণে উনবিংশ শতাব্দীতে বাংলার নবজাগরণের সূচনা তারা প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে ডিরোজিওর স্বাধীনতা, সমতা ও মুক্তির শিক্ষাতেই অনুপ্রাণিত ছিলেন, নির্মিত হয়েছিলেন।
গোঁড়া ধর্মান্ধ হিন্দু সমাজ ক্রমশ বুঝতে পারে পায়ের তোলা থেকে মাটি সরছে, ব্যাপক জনপ্রিয়তার মতোই গভীর বিরোধিতার কারনে ডিরোজিও’কে হিন্দু কলেজে অধ্যাপনার কাজ ছাড়তে বাধ্য হতে হয়। তিনি নিজের সাহিত্য কর্মে ব্রতী থাকেন।
মাত্র বাইশ বছর বয়সে, কলেরায় আক্রান্ত হয়ে ১৮৩১ সালের ২৬ ডিসেম্বর ডিরোজিও’র মৃত্যু হয়।
কলকাতার সাউথ পার্ক স্ট্রিট গোরস্থানে তাকে কবর দেওয়া হয়।
হেনরি ল্যুইস ভিভিয়ান ডিরোজিও কে ছিলেন – আজকের ভারতে ছোটদের জন্য সাধারণ জ্ঞানের প্রশ্ন, নিজেদের দেশের ইতিহাসের প্রশ্ন।
আজকের ভারতে প্রাপ্তবয়স্কদেরও মনে রাখতে হবে হেনরি ল্যুইস ভিভিয়ান ডিরোজিও আসলে কে – এক অসামান্য প্রতিভা, নবজাগরণের সূচনাকার, সমাজ বিপ্লবী মহান শিক্ষক – কোনটি তার প্রকৃত পরিচয়?
ইতিহাস কিভাবে মনে রাখবে তাকে?
আমাদের মনে রাখতে হবে যার প্রভাবে মূল্যবোধ নির্মিত হয়, চেতনা প্রশ্ন করতে শেখে –আলোকোজ্জ্বল ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে চলতে অনুপ্রাণিত হয় নতুন প্রজন্ম তিনিই আদর্শ শিক্ষক।