“এতো বিদ্রোহ কখনোও দেখেনি কেউ ,দিকে দিকে ওঠে অবাধ্যতার ঢেউ “
নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর দৃপ্ত আহ্বানে আজাদ হিন্দ ফৌজ যখন ভারতবর্ষে প্রবেশ করে তখন একটি “তথাকথিত অসামরিক” জাতির সশস্ত্র বিদ্রোহ ব্রিটিশ সরকারকে অবশ্যই দুশ্চিন্তায় ফেলে,অবশ্য দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ পর্বে আজাদ হিন্দ ফৌজ পরাজিত ও আত্মসমর্পন করতে বাধ্য হলেও তাদের ত্যাগ,তিতিক্ষা ও দেশপ্রেম দেশবাসীকে বিস্ময়মুগ্ধ করে |
ফলে ১৯৪৫ সালের ৫ ই নভেম্বর দিল্লীর লালকেল্লাতে বন্দী আজাদী সেনাদের বিচার শুরু করে ব্রিটিশ সরকার ,দেশবাসী এই বন্দী বীরেদের নিঃশর্ত মুক্তির দাবিতে সোচ্চার হয়ে ওঠে এবং যথারীতি ইংরেজ সরকার সেই দাবি অগ্রাহ্য করে বিচারকার্য চালিয়ে যায় |
অন্যদিকে আজাদ হিন্দ ফৌজের এই সাহস,দেশপ্রেম ও আত্মবলিদান ইংরেজ সেনাবাহিনীর মধ্যে বিশেষত নৌ ,স্থল এবং সামরিক বাহিনীর মধ্যেও যথেষ্ট পরিমাণে সঞ্চারিত হয় ,কলকাতায় আজাদ হিন্দ বাহিনীর মুক্তির দাবিতে কমিউনিষ্ট পার্টি,মুসলিম লীগ সহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল সোচ্চার হয় ,বহুস্থানে জনতা ও পুলিশে সংঘর্ষ চলতে থাকে ,রশিদ আলি দিবসকে কেন্দ্র করে মুসলিম লীগের ছাত্র শাখা ধর্মঘটের ডাক দেয় এবং ভারতের ছাত্র ফেডারেশন তাতে পূর্ণ সমর্থন জানায় (১২ ই ফেব্রুয়ারি ১৯৪৬ খ্রীঃ)
আবার ওয়েলিংটন স্কোয়ারে ভাষণ দেন গান্ধীবাদী নেতা সতীশচন্দ্র সামন্ত,মুসলিম লীগ নেতা হোসেন সুরাবর্দী এবং কমিউনিষ্ট নেতা সোমনাথ লাহিড়ী |
যাইহোক নৌ বাহিনীর মধ্যে ইংরেজ অফিসারদের ব্যবহার এবং বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রবল ক্ষোভ সঞ্চারিত হচ্ছিলো , বর্ণভেদ ও অখাদ্য পরিবেশনের বিরুদ্ধে এবার নৌ সেনারা বিদ্রোহ ঘোষণা করেন,যার সূচনা ঘটে ১৯৪৬ সালের ১৮ ই ফেব্রুয়ারী বোম্বাইয়ের তলোয়ার নামক জাহাজে এবং বিদ্রোহের আগুন আরোও বাইশটি জাহাজে ছড়িয়ে পড়ে অতি দ্রুত , বিদ্রোহীরা একসঙ্গে জাহাজে কমিউনিষ্টদের কাস্তে হাতুড়ি ,কংগ্রেসের ত্রিবর্ণরন্জিত ও মুসলিম লীগের সবুজ পতাকা একসঙ্গে বেঁধে উড়িয়ে তাদের ঐক্যবোধের পরিচয় দেন ,বিদ্রোহ পরিচালনার জন্য “নেভাল সেন্ট্রাল স্ট্রাইক কমিটি” গঠন করা হয় এবং এর দায়িত্ব গ্রহণ করেন তলোয়ার জাহাজের রেডিও অপারেটর এন এম এস খান |
বিদ্রোহীদের দাবি ছিলো “আজাদী সেনাদের মুক্তি,ইন্দোনেশিয়া থেকে সেনা প্রত্যাহার এবং সম বেতন ও সুষম খাদ্যের ব্যবস্থা ” প্রভৃতি |
ইংরেজ সরকার কঠোর হাতে এই বিদ্রোহ দমনের চেষ্টা করেন,ইংরেজ সেনা বিদ্রোহী জাহাজগুলিকে ঘিরে ফেলে এবং অ্যাডমিরাল গডফ্রে বোমারু বিমানের সাহায্যে জাহাজগুলিকে উড়িয়ে দেবার হুমকি দেন,ফল হলো হিতে বিপরীত ,ভারতীয় নাবিকদের এই বিদ্রোহ বহুস্থানে স্বতঃস্ফূর্ততার সৃষ্টি করলো,করাচী ও কলকাতা বন্দরেও বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে ,জব্বলপুর,মাদ্রাজ,কোচিন,বিশাখাপত্তনম প্রভৃতি স্থানেও বিদ্রোহ শুরু হয় |
বোম্বাইয়ের বিদ্রোহী সেনারা “কংগ্রেস ,মুসলিম লীগ ও কমিউনিষ্ট পার্টির পতাকা ” হাতে নিয়ে সারা শহর পরিক্রমণ করে এবং মুখে তাদের স্লোগান ছিলো “জয় হিন্দ,ইনকিলাব জিন্দাবাদ,ইংরেজ ভারত ছাড়ো ” প্রভৃতি |
আসলে বিদ্রোহের এই ব্যাপকতা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ,কংগ্রেস,মুসলিম লীগ সহ ভারতের প্রতিটি রাজনৈতিক দলকে আতঙ্কিত করে তোলে ,যথারীতি গান্ধীজি এবং জিন্না “নৌ বিদ্রোহের নিন্দা করেন ” এবং বল্লভভাই প্যাটেল “শৃঙ্খলাভঙ্গের দৃষ্টান্ত” বলে সমালোচনা করেন ,এই “তথাকথিত ” জাতীয় নেতারা নৌ সেনাদের আত্মসমর্পণের পরামর্শ দেন,ফলে বাধ্য হয়ে নৌ সেনারা আত্মসমর্পণ করেন |
তবে নৌ সেনারা বলে ওঠেন “আমরা আত্মসমর্পণ করছি ইংরেজের কাছে নয়,ভারতের কাছে “,একমাত্র কংগ্রেস সমাজতন্ত্রী দল ও কমিউনিস্ট রা ছাড়া আর কোনোও রাজনৈতিক দল এই বিদ্রোহকে সমর্থন করেনি,মহম্মদ আলি জিন্নার লক্ষ্য ছিলো “ধর্মভিত্তিক পাকিস্তান , এবং হিন্দু মহাসভার লক্ষ্য ছিলো “অখন্ড হিন্দুরাষ্ট্র গঠন করা ” |
ভারতীয় নেতারা আশ্বাস দিয়েছিলেন যে ইংরেজ সরকার বিদ্রোহীদের প্রতি কোনোরকম “প্রতিহিংসামূলক ” আচরণ করবে না,কিন্তু ব্রিটিশ সরকার এই আশ্বাসে কর্ণপাত না করে “রেডিও অপারেটর ও নেভাল সেন্ট্রাল স্ট্রাইক কমিটি”র নেতা এন এম এস খানকে জলে ডুবিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করে |
তবে বিদ্রোহ ব্যর্থ হয়নি,নৌ বিদ্রোহের সূচনা ঘটার সঙ্গে সঙ্গে তার পরেরদিন অর্থাৎ ১৯ শে ফেব্রুয়ারি ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ক্লিমেন্ট অ্যাটলি ভারতে “মন্ত্রীমিশন বা ক্যাবিনেট মিশনকে ” পাঠানোর কথা ঘোষণা করেন তথাকথিত “স্বাধীনতার ” জন্য এবং এ ভি আলেকজান্ডার,স্যর পেথিক লরেন্স এবং স্যর স্ট্যাফোর্ড ক্রিপস ভারতে পা রাখেন স্বাধীনতার দর কষাকষি এবং অখন্ড ভারতবর্ষকে ভেঙ্গে দু টুকরো করবার জন্য |
নৌ বিদ্রোহীদের আত্মবলিদান ব্যর্থ হয়নি,তাদের লড়াই ভারতে ইংরেজ শাসনের অবসানের সূচনা করে |
আজ নৌ বিদ্রোহের ৭৮ তম বর্ষে সমস্ত বিদ্রোহী নৌ সেনাদের জানাই প্রণাম ও শ্রদ্ধান্জলি |
“বিদ্রোহ আজ বিদ্রোহ চারিদিকে বিদ্রোহ আজ ,
আমি যাই তার দিনপঞ্জিকা লিখে বিদ্রোহ আজ ,
এতো বিদ্রোহ কখনোও দেখেনি কেউ,দিকে দিকে ওঠে অবাধ্যতার ঢেউ,
স্বপ্নচূড়ার থেকে নেমো এসো সব,শুনেছো শুনেছো উদ্দাম কলরব শুনেছো,
নয়া ইতিহাস লিখেছে ধর্মঘট লিখেছে নয়া ইতিহাস,রক্তে রক্তে রাঙা প্রচ্ছদপট ,
প্রত্যহ যারা ঘৃণিত আর পদানত দেখো আজ তারা সবেগে সমুদ্যত ,
তাদেরি দলের পিছনে আমিও আছি,তাদেরি মধ্যে আমিও যে মরি,বাঁচি ,
তাইতো চলেছি দিনপন্জিকা লিখে ” |