ওয়েবডেস্ক প্রতিবেদন
ইতিহাস প্রমান করেছে অজেয় সেনাবাহিনী বলে কিছু হয় না – স্তালিন বলেছিলেন। এই হল ইতিহাসের শিক্ষা।
পৃথিবীর ইতিহাসে স্তালিন নামটি যেমন চিরকালের জন্য গুরুত্বপূর্ণ, ঠিক তেমনই আরেকটি নাম – স্তালিনগ্রাদ। রাশিয়ান ভাষায় গ্রাদ শব্দের অর্থ হল স্থান বা জায়গা। দক্ষিণ রাশিয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলের নাম ছিল স্তালিনগ্রাদ। এর পাশে দুটি নদী। একটি ডন আরেকটি উত্তরদিকে, ভলগা। এই নদীপথেই রাশিয়ার অন্যান্য অঞ্চলের সাথে সেনা যোগাযোগের ব্যবস্থা ছিল। এছাড়াও দেশের মধ্যে অন্যতম একটি অর্থনৈতিক অঞ্চল হিসাবে স্তালিনগ্রাদ সর্বদা কর্মব্যস্ত থাকতো। আসলে হিটলারের লক্ষ্য ছিল বাকু, মাইকপ এবং গ্রোঝনি এলাকাগুলির মাটির নিচে থাকা তৈলসম্পদ দখল করা। সেই কাজ করতে হলে রাশিয়ার ফৌজ যে এলাকা থেকে সবেচেয়ে বেশি বাধা দেবে তাই ছিল স্তালিনগ্রাদ। কমরেড স্তালিনের নিজের নামে শহর!
১৯৪২ সালের ২৩শে অগাস্ট মাসে স্তালিনগ্রাদে আক্রমন শুরু করে জার্মান সেনাবাহিনী। শুরুর দিকে সেই আক্রমনের ধাক্কায় রাশিয়ার ক্ষয়ক্ষতি এমন ভয়ানক চেহারা নেয় যে জার্মান সেনাবাহিনীর ধারণা হয়েছিল তারা যুদ্ধ জিতে নিয়েছে। রাশিয়ার সেনাবাহিনীকে পেছিয়ে আসতে বাধ্য করে একেবারে ভলগা নদীর প্রান্তে কোণঠাসা করে ফেলে। এখান থেকেই সারা পৃথিবীতে যুদ্ধের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়ানক এবং বিস্ময়কর লড়াইয়ের ইতিহাস লেখা শুরু হয়। স্তালিনের রেডিও বার্তা ছড়িয়ে পড়ে – “There Is No Land Behind Volga”, পেছিয়ে যাবার জন্য আর জমি নেই, মেনে নিয়ে, মনে নিয়ে প্রতিআক্রমন শুরু করে রাশিয়ার লাল ফৌজ।
সমরবিজ্ঞানের নিজস্ব পরিভাষায় যাকে পোড়ামাটির নীতি বলা হয় সেকথা সেই সময় পাঠ্যক্রমে ছিল – জার্মান সেনাবাহিনীর আক্রমনের সামনে সেই নীতি অনুসরন করেই লাল ফৌজ War Of Retreat চালিয়ে আসছিল এতদিন। ভলগার প্রান্তে বয়ে চলা রক্তের স্রোত তাদের মৃত্যু এবং বীরের মৃত্যুর মধ্যেকার লাইনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল। বিপ্লবের অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ লাল ফৌজ, লেনিনের স্বপ্নকে বাঁচিয়ে রাখার শপথ নেওয়া লাল ফৌজ উপলব্ধি করেছিল এই লড়াই শুধুই দুটি সেনাবাহিনীর মধ্যে নয় – হিটলার আক্রমনের নাম রেখেছিলেন Operation Barbarosa, স্তালিন আহ্বান করলেন এই যুদ্ধ আসলে পৃথিবী জুড়ে মানবতা রক্ষা লড়াই, আগামী পৃথিবী কেমন হবে তার ভবিষ্যৎ নির্ধারিত হবে এই যুদ্ধে। সুতরাং People Be on Your Guard!
সেই মুহূর্তেই সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ রূপান্তরিত হল গোটা পৃথিবীর স্বার্থে জনযুদ্ধে।
সেনাবাহিনী ছাড়াও এই অসম যুদ্ধে সক্রিয় হয়ে উঠলেন স্তালিনগ্রাদ সহ গোটা রাশিয়ার সাধারণ মানুষ। জান কবুল লড়াই। লাঠি, কুড়ুল এমনকি ফূটন্ত গরম জল – হাতের কাছে যা কিছু আছে তাকেই হাতিয়ার করে ঝাঁপিয়ে পড়ল ঘরে থাকা মানুষের বাহিনী – জনযুদ্ধ।
লড়াই সহজ ছিল না। কেতাবি বুদ্ধিতে কখনোই এই যুদ্ধে রাশিয়ার জয় সম্ভব ছিল না। কিন্তু স্তালিন বিশ্বাস করতেন একটাই প্রত্যয়ে – “I believe in only one thing,the power of human will.”। সমস্যার মোকাবিলায় জনগণের সক্রিয়তায় কমরেড স্তালিনের চিরকাল আস্থা ছিল – জনগন তাদের নেতার সেই প্রত্যয়কেই সত্যে পরিণত করার শপথ নিয়েছিল সেদিন।
আজকের পৃথিবীতে গনতন্ত্র, স্বাধীনতা, অধিকার এই শব্দগুলি টিকে রয়েছে সেদিনের সেই যুদ্ধের ফলাফল হিসাবে। গোটা পৃথিবীর সম্রাট হবার বাসনা বুকের তলায় আগুনের মতো করে চেপে রেখে হিটলার নামের ব্যাক্তিটি যে অভিযান শুরু করেছিলেন সেই আক্রমনের সামনে গোটা ইউরোপ মুখ থুবড়ে পড়েছিল, কেউ কেউ বিনা বাক্যেই তার বুটের তলায় মাথা পেতে দিয়েছিল। স্তালিনের রাশিয়কে আক্রমন করেই তার সেনাবাহিনী প্রথম সক্রিয় প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়েছিল।
আজকের পৃথিবীতে কোটি কোটি ডলার মূল্যের সরকারী অর্থব্যয় করে নতুন ইতিহাস লিখে সেদিনের সোভিয়েত লাল ফৌজ এবং সোভিয়েত জনতার লড়াইকে ছোট কররে দেখাতে চাইছে পুঁজিবাদ, সাম্রাজ্যবাদ। যুক্তি হাজির করা হচ্ছে স্তালিন হিটলারকে হারিয়ে দিলেন কারন তিনি নিজেও ডিক্টেটর ছিলেন। অর্থের বিনিময়ে মেধা কিনে নিয়ে সেই ভাড়াটে মেধার কলমে সৃষ্টির নামে নিজেদের অপরাধকে জায়েজ বলে প্রমান করা পুঁজিবাদ – সাম্রাজ্যবাদের অনেক পুরানো কৌশল। এই কৌশলে কেউ কেউ বিভ্রান্ত হয়ে যান, সবাই নয়।
গনতন্ত্র, স্বাধীনতা, মানুষের অধিকার এই শব্দগুলো যতদিন মানবসমাজে প্রাসঙ্গিক থাকবে ততদিনই ইতিহাসের পাতায় আজকের পৃথিবীর মানুষের জন্য একটি ঋণের হিসাবও লেখা রয়ে যাবে। সেই ঋণ সেদিন লেখা হয়েছিল যেদিন সোভিয়েত লাল ফৌজের জান কবুল লড়াইয়ের সামনে আত্মসমর্পণ করেছিল হিটলারের অহংকার, জার্মান সেনাবাহিনীর ষষ্ঠ ডিভিশন।
ওয়েবডেস্কের পক্ষে – সৌভিক ঘোষ