[‘গণশক্তি’ ২৩ জানুয়ারি ১৯৯৭ সংখ্যায় প্রকাশিত প্রবন্ধ]
আজ সুভাষচন্দ্র বসুর জন্মশতবর্ষ। তিনি নি:সন্দেহে ভারতের মহত্তম সন্তানদের অন্যতম। রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিতে তিনি ছিলেন ‘দেশনায়ক’। ভরতের স্বাধীনতা সংগ্রামে তাঁর স্বার্থত্যাগ আমাদের উদ্বুদ্ধ করে। সাম্প্রদায়িক ও আঞ্চলিক সীমাকে অতিক্রম করে তাঁর অবদান আজ দেশবাসী শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে। এক অর্থে সুভাষচন্দ্র ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে জাতীয়তাবাদী প্রতিরোধের প্রতীক। ইংরেজ শাসকদের ভারতবর্ষ ছাড়তে বাধ্য করার জন্য তিনি যে কোন উপায় অবলম্বনের পক্ষপাতী ছিলেন। পথ ও লক্ষ্য নিয়ে চুলচেরা বিতর্কে তিনি কালক্ষয় করতে রাজি ছিলেন না। ‘শত্রুর শত্রু আমার বন্ধু’ এই নীতি মেনে তিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় অক্ষ শক্তিবর্গের সঙ্গে হাত মিলিয়ে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে দ্ধিধাবোধ করেননি। এই পন্থা অবলম্বনের জন্যে তাঁকে অনেক বিরূপ সমালোচনার সম্মুখীন হতে হয়। আমাদের ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি সুভাষচন্দ্রের এই রণকৌশল সমর্থন করেনি। তবে, কমিউনিস্টদের দৃষ্টিতে সুভাষচন্দ্র এক শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব। তাঁর আপসহীন দেশপ্রেম, সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সংগ্রাম ও জাতীয়তাবাদ পরবর্তী প্রজন্মকে উধবুদ করে চলেছে। আমরা এই সত্যটি কখনো অস্বীকার করিনি।
সুভাষচন্দ্রের রাজনৈতিক জীবনে যেটাকে আমি সব চাইতে শ্রদ্ধা করি সেটা হচ্ছে, কংগ্রেসের রক্ষণশীল ও দক্ষিণপন্থী অবস্থানের বিরুদ্ধে তাঁর নিরন্তর সংগ্রাম। প্রেসিডেন্সি কলেজে ওটেনের ঘটনাতেই সুভাষচন্দ্রের জাতীয়তাবাদী মানসিকতার প্রথম বহি:প্রকাশ। ইংরেজ শাসকদের দর্পিত জাতিবৈরিতা সুভাষচন্দ্রের মর্যাদাবোধকে আহত করেছিল। ওই ঘটনা তারই প্রতিফলন। পিতার ইচ্ছা মেনে নিয়ে সুভাষচন্দ্র উচ্চতর শিক্ষার জন্যে এবং আই সি এস পরীক্ষায় বসার জন্য ইংল্যান্ডে যান। এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া সত্ত্বেও সুভাষচন্দ্র চাকরিতে যোগ দিলেন না। তিনি যথার্থই মনে করতেন ইংরেজের গোলামি করে দেশভক্ত হওয়া যায় না। ভারতে ফিরে এসে তিনি জাতীয়বাদী আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। জাতীয়তাবাদের বামপন্থী ভাবধারার তিনি ছিলেন প্রতিভু।
ব্যক্তিগতভাবে সুভাষচন্দ্র গান্ধীজীকে শ্রদ্ধা করতেন। গান্ধীজীর আর্বিভাবের পর ভারতের জাতীয়তাবাদী রাজনীতির ভিত্তিমূল যে প্রসারিত হয়েছিল সে সম্পর্কে সুভাষচন্দ্র সচেতন ছিলেন। সুভাষচন্দ্র একাধিকবার স্বীকার করেন যে, গান্ধীজীর সঙ্গে জনগণের ছিল নাড়ির যোগ। কিন্তু একথা সুবিদিত যে, গান্ধীর নেতৃত্বে সংগঠিত আন্দোলনগুলির একটা নিজস্ব চরিত্র ছিল। গান্ধী একদিকে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন তৃণমূলে নিয়ে গিয়েছিলেন, অন্যদিকে সেগুলিকে নিয়ন্ত্রণে রেখেছিলেন নিজের হাতে। এইসব আন্দোলন যখন গান্ধী-আরোপিত সীমাকে অতিক্রম করে ব্যাপক চেহারা নিত, তখনই গান্ধী সেগুলিকে একতরফাভাবে বন্ধ করে দিতেন। অসহযোগ আন্দোলনে, আইন অমান্য আন্দোলনে ও ভারত ছাড়ো আন্দোলনে এটা বারংবার দেখা যায়। সুভাচন্দ্রের দৃষ্টিতে এটা ছিল গান্ধীজীর নেতৃত্বের দুর্বলতা। গোড়ার দিকে সুভাষচন্দ্র ছিলেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনের অনুগামী। পরে তিনি হলেন জওহরলালের সতীর্থ।
গান্ধীর সমর্থনপুষ্ট দক্ষিণপন্থী নেতৃত্বের সঙ্গে সুভাষচন্দ্রের মোকাবিলা শুরু হয় মোটামুটি ১৯২৮-র কলকাতা কংগ্রেসে। জওহরলাল ও সুভাষচন্দ্র একযোগে ডোমিনিয়ন স্ট্যাটাস্-র পরিবর্তে পূর্ণ স্বরাজ কংগ্রেসের লক্ষ্য করার দাবি জানান। এই প্রস্তাব কিন্তু নাকচ হয়ে যায়, কারণ গান্ধীজী এতে সায় দিতে রাজি হননি। কিন্তু এই কংগ্রেসে একটা অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটে। প্রায় ৫০,০০০ শ্রমিক কিছুক্ষণের জন্যে কংগ্রেস মন্ডপ দখল করে পূর্ণ স্বরাজের পক্ষে প্রস্তাব গ্রহণ করে। শ্রমিকদের এই পদক্ষেপ ভারতের তদানিন্তন প্রতিবাদী রাজনীতিকে প্রচন্ডভাবে উৎসাহিত করে।
ইতোমধ্যে সুভাষচন্দ্র শ্রমিক ও কৃষক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পরেন । ১৯৩১-এ কমিউনিস্টদের সমর্থনে সুভাষচন্দ্র এ আই টি ইউ সি-র সভাপতি নির্বাচিত হন। অপর দিকে ভলান্টিয়ার আন্দোলনের মাধ্যমে সুভাষচন্দ্র ভারতীয় তরুণ সমাজে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। ১৯৩০-র মাঝামাঝি সময় থেকে সুভাষচন্দ্রের সঙ্গে সি পি আই-র নৈকট্যও বৃদ্ধি পায়। সুভাষচন্দ্র ও পার্টির মধ্যে সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ হয় যখন কমিউনিস্টরা তাঁকে গান্ধীজী সমর্থিত দক্ষিণপন্থী প্রার্থী পট্টভি সীতারামাইয়াকে ত্রিপুরী কংগ্রেসে সভাপতি পদে নির্বাচনে হারাতে সমর্থন করে। আমি এই সময়ে বিলেতে ছিলাম। সুভাচন্দ্রের সাফল্যে আমরা, প্রবাসী ভারতীয় ছাত্র-ছাত্রীরা প্রচন্ড আনন্দিত হয়েছিলাম। সে সময়ে লন্ডন মজলিসের আমি সাধারণ সম্পাদক। ত্রিপুরী ঘটনার ওপর মজলিসে এক সভা করি। সেখানে আমি বক্তৃতা করি। সভা শেষে মজলিসের পক্ষ থেকে সুভাষচন্দ্রকে আমি অভিনন্দন জানিয়ে তারবার্তা পাঠিয়েছিলাম।
আমরা জানি দক্ষিণপন্থী কংগ্রেসীদের ক্রমাগত বাধাদানের জন্যে সুভাষচন্দ্র সভাপতির পদ থেকে ইস্তফা দিতে বাধ্য হন। ১৯৩৯-র মে মাসে উনি একটি বামপন্থী জাতীয়তাবাদী সংগঠন হিসেবে ফরওয়ার্ড ব্লক প্রতিষ্ঠার ঘোষণা করেন। সি পি আই প্রথমে ভীত ছিল যে, এই নতুন পার্টির ফলে বৃহত্তর জাতীয়তাবাদী ঐক্য দুর্বল হয়ে পড়বে। কিন্তু পরবর্তীকালে বিশেষ করে বাংলায় – সি পি আই ও ফরওয়ার্ড ব্লক যুগ্মভাবে রাজনৈতিক আন্দোলন পরিচালনা করে রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তি ও গণতান্ত্রিক অধিকারের দাবিতে। একদিকে যেমন কমিউনিস্ট গোপাল হালদার, বিনয় ঘোষ এবং এস উপাধ্যায় ফরওয়ার্ড ব্লকের মুখপত্রের সম্পাদকীয় বোর্ডের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, অন্যদিকে সুভাষচন্দ্র নিজে সি পি আই-র মুখপত্র National Front এ প্রবন্ধ লেখেন। ১৯৪০-র জুলাই মাসে সুভাষচন্দ্র কলকাতায় তথাকথিত অন্ধক‚প-হত্যায় নিহত ইংরেজদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে নিবেদিত হলওয়েল স্মৃতিস্তম্ভ অপসারণের দাবিতে সফল সত্যাগ্রহ পরিচালানা করেন। এই আন্দোলনের মাধ্যমে বাংলার হিন্দু-মুসলমান ঐক্য প্রতিফলিত হয়।
নেতাজী নিজেকে সমাজতান্ত্রিক মনে করতেন। তবে এক সময়ে ফ্যাসিবাদের নিয়মানুবর্তিতার প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হবার অল্পদিন আগে প্রখ্যাত কমিউনিস্ট তাত্বিক রজনীপাম দত্তের সঙ্গে লন্ডনে আলোচনার পর সুভাষচন্দ্রের ফ্যাসিবাদের প্রতি মোহ কেটে যায়। শোনা যায় সুভাষচন্দ্র রজনীপামকে বলেছিলেন যে, তিনি সন্দেহ করতেন সি পি আই জাতীয় রাজনীতিকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিচ্ছে না। দত্তকে সুভাষচন্দ্র বলেন যে, পরে কমিউনিস্টদের প্রতি তাঁর দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটে।
নেতাজী নিজেকে সমাজতান্ত্রিক মনে করতেন। তবে এক সময়ে ফ্যাসিবাদের নিয়মানুবর্তিতার প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হবার অল্পদিন আগে প্রখ্যাত কমিউনিস্ট তাত্বিক রজনীপাম দত্তের সঙ্গে লন্ডনে আলোচনার পর সুভাষচন্দ্রের ফ্যাসিবাদের প্রতি মোহ কেটে যায়। শোনা যায় সুভাষচন্দ্র রজনীপামকে বলেছিলেন যে, তিনি সন্দেহ করতেন সি পি আই জাতীয় রাজনীতিকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিচ্ছে না। দত্তকে সুভাষচন্দ্র বলেন যে, পরে কমিউনিস্টদের প্রতি তাঁর দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটে।
মনে পড়ছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হবার আগে সুভাষচন্দ্র বসু যখন ইংল্যান্ড যান সে সময়ে আমরা তাঁকে সংবর্ধনা জানাই। সেই সভায় লেবার পার্টির কিছু নেতাও উপস্থিত ছিলেন। সুভাষচন্দ্রের উদ্দেশ্যে তাঁরা বলেন যে, তাঁদের দলও ভারতীয় স্বাধীনতার সপক্ষে। সুভাষচন্দ্র স্পষ্টবাদী ছিলেন। লেবার নেতাদের ধন্যবাদ দিলেন, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে শুনিয়েও দিলেন ‘আপনারা আমাদের সাহায্য না করলেও আমরা স্বাধীন হবই’। সুভাষচন্দ্রের সঙ্গে সেই সময় ইংল্যান্ডে আমার এক সাক্ষাৎকার হয়। তাঁকে আমি বলেছিলাম ‘ঠিক করেছি দেশে ফিরে বামপন্থী রাজনীতি করবো’। সুভাষচন্দ্র উৎসাহ দিয়েছিলেন। কিন্তু সাবধান করেছিলেন, ‘Politics is not a bed of roses’। পরে বুঝেছি কথাটা সত্যি।
১৯৩৮ সালের কংগ্রেসের হরিপুরা সম্মেলনের সুভাষচন্দ্রের সভাপতির অভিভাষণ বিশেষভাবে স্মরণীয়। এই ভাষণে তিনি ভারতের প্রধান জাতীয় সমস্যা হিসেবে তিনটি বিষয়কে চিহ্নিত করেন : দারিদ্র দূরীকরণ, শিক্ষার প্রসার ও উৎপাদন এবং বন্টনের বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি গ্রহণ। প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে তিনি ভূমি সংস্কার এবং জমিদারি প্রথার বিলুপ্ত করার কথা বলেন। কৃষকদের ঋণমুক্ত করার প্রয়োজনীয়তা তিনি উপলব্ধি করেন। সেই সঙ্গে গ্রামীণ জনসাধারণের জন্যে অল্প সুদে ঋণের ব্যবস্থা করার ওপর সুভাষচন্দ্র জোর দেন। উৎপাদক ও ভোক্তা উভয়ের স্বার্থ রক্ষা করার জন্য সমবায় আন্দোলন শক্তিশালী করতে তিনি উপদেশ দেন। রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে শিল্পের ব্যাপক প্রসারের কথাও সুভাষচন্দ্র বলেন। কুটির শিল্পের সঙ্গে ভারি শিল্পের কোন আবশ্যিক বিরোধ আছে বলে তিনি মনে করতেন না। তবে তিনি কয়েকটি মৌলশিল্প যেমন – ইস্পাত ও বিদ্যুতের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছিলেন। কারণ, এগুলি ছাড়া শিল্পের পরিকাঠামো গড়ে তোলা সম্ভব নয়। এ যুগের জাতীয় নেতাদের মধ্যে সুভাষই সম্ভবত প্রথম পরিবার পরিকল্পনার প্রয়োজনীয়তা বিশ্লেষণ করেন। তিনি মন্তব্য করেছিলেন:
If the population goes up by leaps and bounds, as it has done in the recent past, our plans are likely to fall through. It will, therefore, be desirable to restrict our population until we are able to feed, cloth and educate those who already exist.
সুভাষচন্দ্র ভারতের lingua franca হিসেবে হিন্দুস্তানীকে গ্রহণ করার উপদেশ দেন। প্রতিবেশী দেশগুলির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ গড়ে তোলার ওপর তিনি গুরুত্ব দেন। দেশের সাম্প্রদায়িক সমস্যা যে ক্রমেই মাথাচাড়া দিচ্ছে, সে ব্যাপারেও সুভাষচন্দ্র অবহিত ছিলেন। সাম্প্রদায়িকতার জন্যে তিনি ইংরেজ শাসকদের ‘’ নীতিকে প্রধানত দায়ী করেছিলেন। তবে ড. মেঘনাদ সাহার কাছে তিনি স্বীকার করেছিলেন যে, ভারত জাতীয় ঐক্যের সমস্যা মূলত মানসিক। বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে মনের এই দূরত্ব দূর করার জন্য আধুনিক শিক্ষা প্রসারের ওপর সুভাষচন্দ্র গুরুত্ব দেন। শিক্ষার প্রসার ঘটলেই পরস্পরকে উপলব্ধি করা সম্ভব হবে, এটাই ছিল সুভাষচন্দ্রের বিশ্বাস।
জাতীয় অর্থনীতির সুষম বিকাশের জন্য সুভাষচন্দ্র সোভিয়েত ধাঁচের পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনাকে উপযোগী মনে করতেন। সেই সঙ্গে তিনি জাতীয় প্রয়োজনের সাথে সঙ্গতি রেখে জাতির প্রতি দায়বদ্ধ আমলা তৈরি করার ওপর গুরুত্ব দেনে। হরিপুরা কংগ্রেসে অধিবেশন শেষ হবার অব্যবহিত পরেই সুভাষচন্দ্র জওহরলালের সভাপতিত্বে কংগ্রেসের ছত্রচ্ছায়ায় ন্যাশনাল প্ল্যানিং কমিটি গঠন করেন। তখনকার প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ কে টি শাহ ছিলেন এই কমিটির অন্যতম সদস্য। জাতীয় আন্দোলনের অন্তিম পর্যায় শুরু হবার ফলে এ ব্যাপারে বিশেষ অগ্রগতি হয়নি। ১৩ বছর বাদে ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী নেহরু জাতীয় পরিকল্পনার উদ্দেশ্যে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করেন।
জাতীয় অর্থনীতির সুষম বিকাশের জন্য সুভাষচন্দ্র সোভিয়েত ধাঁচের পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনাকে উপযোগী মনে করতেন। সেই সঙ্গে তিনি জাতীয় প্রয়োজনের সাথে সঙ্গতি রেখে জাতির প্রতি দায়বদ্ধ আমলা তৈরি করার ওপর গুরুত্ব দেনে। হরিপুরা কংগ্রেসে অধিবেশন শেষ হবার অব্যবহিত পরেই সুভাষচন্দ্র জওহরলালের সভাপতিত্বে কংগ্রেসের ছত্রচ্ছায়ায় ন্যাশনাল প্ল্যানিং কমিটি গঠন করেন। তখনকার প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ কে টি শাহ ছিলেন এই কমিটির অন্যতম সদস্য। জাতীয় আন্দোলনের অন্তিম পর্যায় শুরু হবার ফলে এ ব্যাপারে বিশেষ অগ্রগতি হয়নি। ১৩ বছর বাদে ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী নেহরু জাতীয় পরিকল্পনার উদ্দেশ্যে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করেন।
জাতিগঠনের ব্যাপারে সুভাষচন্দ্রের এই চিন্তাভাবনার প্রতি সি পি আই-র ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি ছিল। তবে যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে সুভাষচন্দ্র ও পার্টির সম্পর্কের অবনতি ঘটে। ১৯৩৯-র যুদ্ধ শুরু হলে সি পি আই যুদ্ধ বিরোধী আন্দোলন গড়ে তোলে, যাতে ব্রিটিশ সরকার জনগণের ওপর যুদ্ধের ভার না চাপিয়ে দিতে পারে। কিন্তু ১৯৪১-এ সোভিয়েত ইউনিয়নের ওপর নাৎসি জার্মানির আক্রমণ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্বকে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে গণযুদ্ধে পরিণত করে। পৃথিবীর অন্যান্য কমিউনিস্ট পার্টিগুলির ন্যায় সি পি আই-ও অনুভব করে যে, প্রকৃত জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের স্বার্থে সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বে ফ্যাসিবাদ বিরোধী যুদ্ধে যোগ দেওয়াই প্রয়োজন। অপরদিকে যুদ্ধের প্রতি সুভাষচন্দ্রের নীতি ছিল ‘শত্রæর শত্রæ আমার বন্ধু’। তাই বিনা দ্বিধায় সুভাষচন্দ্র অক্ষ শক্তিবর্গের সাহায্যে ভারতের ব্রিটিশরাজ্যের বিরুদ্ধে সশস্ত্র আক্রমণ পরিচালনা করার সিদ্ধান্ত নেন। পুলিসের চোখে ধুলো দিয়ে কলকাতা থেকে পালিয়ে সুভাষচন্দ্র বার্লিন যান। সেখান থেকে তিনি যান দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াতে। সেখানে তৈরি করলেন আজাদ হিন্দ ফৌজ। জাপানীদের সাহায্যে আজাদ হিন্দ ফৌজ দিল্লীর দিকে যাত্রা করে। আজাদ হিন্দ বাহিনীর বীরত্ব ও ত্যাগের কথা আমাদের সবার জানা আছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ইংরেজ সৈন্যবাহিনীর হাতে আজাদ হিন্দ ফৌজ পরাজিত হয়।
এখানে দু’টি কথা মনে রাখা দরকার। প্রথমত, কমিউনিস্ট কর্মীরাই সুভাষচন্দ্রকে ভারত থেকে পলায়ন করতে সাহায্য করে। এ ব্যাপারে অন্যত্র লিখেছি। দ্বিতীয়ত, সুভাষচন্দ্র জার্মানি ও জাপানের হাতের পুতুল কখনোই হননি। তিনি তাঁর ভারতীয় লিজিয়নকে সোভিয়েত রাশিয়ার বিরুদ্ধে বা বার্মায় আং সানের নেতৃত্বে জাপান-বিরোধী অভ‚্যত্থানের বিরুদ্ধে কাজে লাগাতে দেননি। অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন যে, সাভুষচন্দ্র খোলাখুলিভাবেই জার্মানির সোভিয়েত আক্রমণকে নিন্দা করেন খোদ জার্মানিতে বসে। বার্লিনের পররাষ্ট্র মন্ত্রককে তিনি লেখেন :
The Indian people felt definitely that Germany was the aggressor and was for India, therefore, another dangerous imperialist war..
অনেক গবেষক মনে করেন যে, এমনকী জার্মানি বা জাপান কেউই সুভাষচন্দ্রের সামরিক দক্ষতার ওপর ভরসা করেনি। সম্ভবত সুভাষচন্দ্র ও হিটলারের মধ্যে একবারই সাক্ষাৎ হয়। সুভাষচন্দ্রের বন্ধু ফনট্রট সেই বৈঠকে অনুবাদক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। জানা যায়, হিটলার একটা মানচিত্র দেখিয়ে সুভাষচন্দ্রকে বলেন যে, ভারতবর্ষ জার্মানি থেকে অনেক দূরে অবস্থিত এবং জার্মানির পক্ষে আপাতত সুভাষচন্দ্রকে খুব একটা সাহায্য করা সম্ভব নয়। এই মিটিং-র কিছুদিন পরেই সুভাষচন্দ্র সাবমেরিনে পূর্ব প্রচ্যে রওনা হন।
অর্থাৎ ১৯৪০-এ অনেকের মনে একটা যে ধারণা হয়েছিল সুভাষচন্দ্রকে তৎকালীন আন্তর্জাতিক রাজনীতির কিছু শক্তি নিজেদের স্বার্থে কাজে লাগাচ্ছে, সেটা সত্য নয়। বরং, সুভাষই ব্রিটিশ-বিরোধী শক্তিদের ভারতের স্বাধীনতা যুদ্ধের স্বার্থে কাজে লাগাতে সচেষ্ট হন। সুভাষচন্দ্র কখনো কোনো বহিশক্তির কাছে আত্মসমর্পণ করেননি। গান্ধীজীকে আশ্বস্ত করে তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন :
One who has stood for national self respect and served all his life and has suffered considerably in vindicating it, would be the last person in this world to give into any other foreign power.
তা হলেও একটা সন্দেহ কিন্তু থেকে যায়। অক্ষ শক্তির সমর্থনে আজাদ হিন্দ ফৌজ যুদ্ধে জয়ী হলে কি সুভাষচন্দ্র জাপানী বা জার্মান অনুসঙ্গীদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারতেন? এ ক্ষেত্রে দু’টি ঘটনা ইঙ্গিতবাহক। সুভাষচন্দ্রের আপত্তি সত্তে¡ও জাপানীরা আন্দামান দ্বীপপুঞ্জ দখলের পর সেখানে নৃশংস অত্যাচার শুরু করে। অন্য ঘটনা জর্মানি সংক্রান্ত। জাপানের উদ্দেশ্যে বার্লিন ছাড়ার পূর্বে সুভাষচন্দ্র ভারতীয় লিজিয়নের সৈন্যদের নির্দেশ দিয়ে যান যে, তারা যেন কেবল ইংরেজদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরে, সোভিয়েতের বিরুদ্ধে নিশ্চয় নয়। কিন্তু সুভাষচন্দ্রের এই আজ্ঞা মানতে গিয়ে অনেক ভারতীয় নাৎসী সামরিক কোর্টের দ্বারা মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত হয়।
যে কোনো পথ অবলম্বন করেই হোক ভারতকে ব্রিটিশ সা¤্রাজ্যবাদের কবল থেকে মুক্ত করতে সুভাষচন্দ্র বসুর বৃহত্তর আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে যে পরিবর্তন ঘটে ও তার যে তাৎপর্য ছিল তা অনুধাবন করতে অস্বীকার করেন। ফলে একটা রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীন রাজনৈতিক মতবাদ কী ছিল তা মূল্যায়ন না করেই তিনি সে দেশের সাহায্য নিয়েছিলেন। ফলে অনেকের মনেই প্রশ্ন জাগে সুভাষচন্দ্র জাপানীদের সাহায্যে ভারতকে মুক্ত করলে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বদলে জাপানী ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠিত হতো না? অবশ্যই যুদ্ধে জিতলে জাপানীরা তাদের কর্তৃত্ব আমাদের ওপর কায়েম করার প্রচেষ্টা করতে। কিন্তু আমি মনে করি না সুভাষচন্দ্র কখনোই জাপানী বা নাৎসী আধিপত্য স্বীকার করে নিতেন। আমাদের পার্টির ত্রুটি হয়েছিল যে, এই সত্যটা আমরা সে সময়ে উপলব্ধি করতে পারিনি। বার্মায় সান যেমন জাপানীদের কাছে থেকে অস্ত্রশিক্ষা গ্রহণ করেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাঁকে জাপানীদের বিরুদ্ধেই সেই প্রযুক্তি ব্যবহার করতে হয়, সুভাষও দরকার হলে বন্দুকের নল জাপানীদের বিরুদ্ধে ঘুরিয়ে দিতেন। আমাদের পার্টির ত্রুটি ছিল এই সত্যটা আমরা তখন উপলব্ধি করতে অসক্ষম হয়েছিলাম।
তবে এটা ঠিক ভারতের কমিউনিস্টরা সঠিকভাবেই বুঝতে পারে যে, ফ্যাসিবাদ বিরোধী গণ-আন্দোলনের তাৎপর্য। তারা বিশ্বাস করেছিল যে, জনবিরোধী বিজয় সমগ্র ঔপনিবেশিক দুনিয়ায় এক সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী বাতাবরণ সৃষ্টি করবে যা থেকে ভারতের মুক্তি সংগ্রাম লাভবান হবে। ঠিক এটাই ঘটল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ফ্যাসিবাদের পরাজয়ের সঙ্গে সঙ্গেই সারা ভারতে প্রতিবাদী রাজনীতির ঝড় বয়ে যায়। এ সময় আই এন এ যুদ্ধবন্দীদের সরকারের প্রকাশ্য বিচারের সিদ্ধান্তে দেশজুড়ে যে গণবিক্ষোভ ঘটে তা সরাসরি এই প্রতিবাদী আন্দোলনকে অনুপ্রাণিত করে। এখনো কলকাতায় সেই ফেব্রুঃ ১৯৪৬-র রশিদ আলি দিবসের কথা পরিষ্কার মনে আছে – কীভাবে ব্রিটিশ পুলিসের বর্বরতার মুখে ছাত্র, যুব ও মেহনতী মানুষ সরকার বিরোধী বিক্ষোভে শামিল হয়। একই সময় বোম্বাইতে নৌ-বিদ্রোহ ঘটে এবং সেখানেও নেতাজী এবং আই এন এ-র আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়েছিল বিপ্লবী রেটিংরা। কর্নেল সাইগলের কাছে শুনেছি বিদ্রোহী রেটিংদের সঙ্গে সর্বদা নেতাজীর ছবি থাকত। আর্থাৎ, ১৯৪৬-৪৭-এ নানাদিক থেকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী গণ-আন্দোলনের চাপে জর্জরিত হয় এবং এই প্রতিবাদী আবহাওয়া তৈরি করায় আই এন এ-র অবদান অনস্বীকার্য। জনগণের এই বিদ্রোহী মনোভাবই ব্রিটিশরাজের পতন তরান্বিত করে।
নেতাজী ছিলেন একজন কল্পনাপ্রবণ দেশভক্ত। তাঁর রাজনৈতিক নীতি সর্বক্ষেত্রে আমাদের পার্টির কাছে গ্রহণযোগ্য না হলেও, যতদিন তিনি ভারতে ছিলেন পার্টির সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক পারস্পরিক আত্মমর্যাদাবোধের ওপর ভিত্তি করেই ছিল। সুভাষচন্দ্রের বামপন্থী জাতীয়তাবাদ আমাদের কাছে সর্বদা মর্যাদা লাভ করে। তাঁর সাম্প্রদায়িকতা-বিরোধী মনোভাব আমাদের উদ্বুদ্ধ করেছে। আজ আমরা যখন নতুন করে জাতি গঠনের কাজে ব্যস্ত তখন সুভাষচন্দ্রের জাতীয়তাবাদের প্রতি নি:স্বার্থ অবদান ও জনগণের প্রতি তাঁর ভালোবাসা আমাদের অনুপ্রেরণা যোগায়। কিন্তু যেটা আশ্চার্য লাগে, এমনকী বিজেপি – যাদের রাজনীতির ভিত্তি হচ্ছে সাম্প্রদায়িকতা ও বিচ্ছিন্নতাবাদ – তারাও আজ নেতাজীর জন্মশতবর্ষ পালন করছে।
[সুভাষচন্দ্র বসুর জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে ১৯৯৭ সালের ২৩ জানুয়ারি ‘গণশক্তি’যে ক্রোড়পত্র প্রকাশ করেছিল তাতেই এই প্রবন্ধ প্রথম প্রকাশিত হয়।]