ফলে ম্যানগ্রোভ ছাঁটা জঙ্গলের ওপর দিয়ে ছুটে আসা ঝড় বাতাসের ধাক্কাকে প্রতিহত করার ক্ষমতা কমছে সুন্দরবনে । তার ফলে সেই অঞ্চলের নদীগুলিতে ঘূর্ণিঝড়ের সময় বেড়ে চলেছে জলোচ্ছ্বাসের বহর । আর ভরা কোটালের সময় এমন ঝড়ের ধাক্কায় নদীর জলের বাড়তি গতি হামেশাই দুর্বল কাদামাটির বাঁধের স্থায়িত্বকে বিঘ্নিত করছে। হল্যান্ডের নগরকেন্দ্রিক অর্থনীতিকে বাঁচিয়ে রাখার ক্ষেত্রে তাঁদের ডাইক রক্ষণাবেক্ষণে যেমন সরবচ্চ পর্যায়ের অগ্রাধিকার রয়েছে ঠিক বিপরীতে প্রান্তিক আয়ের গ্রামীণ মানুষের জনপদ সুন্দরবন হওয়ার কারনে ঐতিহাসিকভাবেই সুন্দরবনে নদীবাঁধের মত পরিকাঠামো নির্মাণ উপেক্ষিত রয়ে গিয়েছে । যে কারনে দেখা যায় ভোটের আগে শহর কোলকাতায় উড়ালপুল দিয়ে মুড়ে ফেলার সরকারি প্রতিশ্রুতি আর সুন্দরবনের প্রান্তিক জনপদের বাঁচার জন্য পোক্ত নদি বাঁধ নির্মাণের কথা চলে যায় বিস্মৃতির অতলে ।
যে নদীবাঁধ দেওয়া হয় নদীর নোনা জলের থেকে চাষের জমি কিংবা বাসের জমি রক্ষা করতে , সেটাই জলোচ্ছ্বাসের কবলে ভেঙে গিয়ে নোনা জল একবার চাষের জমিতে ঢুকে পড়লে সেই মাটির চাষের ক্ষমতা , সেখানকার খাল বিল পুকুরে মাছ চাষ অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ হয়ে যায় যতক্ষণ পর্যন্ত না বৃষ্টির মিষ্টি জলে সেই নোনা জলের প্রভাব ধুয়ে মুছে যায় । তাই এমন প্রান্তিক মানুষের জীবন জীবিকার প্রয়োজনে সুন্দরবনের লাইফ লাইন হয়ে উঠেছে সেখানকার নদীবাঁধ । পাশাপাশি সুন্দরবন অঞ্চলের সিংহভাগ নদীগুলিতে ধারাবাহিক ভাবে পলি পড়ার কারনে সেগুলির জল্ধারন ক্ষমতা উপর্যুপরি কমে চলেছে । ফলে তিন দশক আগেও ভরা কোটালে জলোচ্ছ্বাস যে উচ্চতায় পৌঁছাত এখন সেই উচ্চতাও বেড়ে চলেছে । এই প্রেক্ষিতে এইসমস্ত নদীগুলির জল ধারন ক্ষমতা বাড়ানোর লক্ষ্যে প্রয়োজন নদীবক্ষের পলি কেটে (desiltation) সরিয়ে সেই মাটিকে ( reclaimed earth) নদিবাধ নির্মাণে ব্যাবহার ।
পাশাপাশি, জলোচ্ছ্বাসের হাত থেকে এমন নদীবাঁধ বাঁচাতে চাই বাঁধগুলির উচ্চতা বৃদ্ধি এবং জলোচ্ছ্বাসের ধাক্কা প্রতিহত করার শক্তি বৃদ্ধি । আর সেখানেই প্রয়োজন বিকল্প নির্মাণ সামগ্রী এবং নির্মাণ প্রযুক্তির প্রয়োগ যাতে নদীবাঁধের আয়ু দীর্ঘ হয় । নদীবাঁধের উচ্চতা বাড়াতে গেলে সাধারনভাবে প্রয়োজন চওড়া ভিতের আর যার জন্য প্রয়োজন বাড়তি জমির । আর এই বাড়তি জমি জোগাড়ের কাজটাই করতে হবে পঞ্চায়েতকে যুক্ত করে রাজ্যের সরকারকেই । যেমন গ্রামীণ সড়কের জন্য প্রয়োজনীয় জমি গ্রামের মানুষের পঞ্চায়েতের যৌথ উদ্যোগেই সংগৃহীত হয় কোন ক্ষতিপূরণ ব্যাতিরেকেই তেমনটাই প্রয়োজন নদীবাঁধ নির্মাণের ক্ষেত্রেও । আর এই বাড়তি জমির পরিমান কমিয়ে আনা যায় যদি বিকল্প নির্মাণ সামগ্রীর শক্তি নরম কাদামাটির চেয়ে বেশি হয় । কিন্তু রাজ্যে জমিজটের রাজনৈতিক কারনে আয়লার ক্ষতিতে বিপর্যস্ত ৭৭৮ কিলোমিটার বাঁধ নির্মাণের কেন্দ্রীয় অনুদানের প্রায় ৪০০০ কোটি টাকা এই সরকারের আমলেই ফেরত গেছে । আর রাজ্যের মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রীকে সাংবাদিক সম্মেলন করে বলতে হচ্ছে বাঁধ নির্মাণে সরকারের টাকা জলে গেছে বলে । সরকারের অপরিকল্পিত পদক্ষেপ আর অগ্রাধিকারে ফি বছর বাঁধ সারাইয়ে কোটি কোটি টাকা খরচ হলেও কাটমানি এবং সিন্ডিকেটের সমস্যায় জর্জরিত হয়ে পড়ছে উপকুলের নদী কিংবা সমুদ্র বাঁধের গুনগত মান ।
এক্ষেত্রে মাটির বাঁধের পরিবর্তে কিছুক্ষেত্রে বাঁধ নির্মানে কংক্রিটের কথা ভাবা যেতে পারে সুন্দরবনের বাস্তুতন্ত্রের ওপর তার প্রভাবের দিকটিকেও গুরুত্ব সহকারে বিবেচনায় রেখেই । ইতিমধ্যে কংক্রিটের তৈরি হওয়া নির্মাণের কিছুক্ষেত্রে বেহাল হওয়ার মুল কারন তার ভিতের তলার মাটিকে শক্তপোক্ত না করেই অপরিকল্পিত নির্মাণ । নদীবাঁধ নির্মাণের ক্ষেত্রে জলের আর ঝড়ের ঝাপটা যেমন বাঁধের উপরিভাগে কাজ করে তেমনটাই বাঁধের ভিতের মাটিতেও জলের চোরা স্রোত প্রবল চাপ তৈরি করে । এই জোড়া চাপের কবলে পড়েই ভাঙতে পারে নদীবাঁধ । এই প্রেক্ষিতেই রাজ্যের সরকারের প্রাথমিক কাজ হওয়া উচিৎ কেন্দ্রীয় এবং রাজ্য সরকারের যৌথ উদ্যোগে সুন্দরবনের স্থায়ী পরিকাঠামো নির্মান । পাশাপাশি প্রয়োজন ঘূর্ণিঝড়ের দাপটে বিপন্ন জেলা এবং ব্লকগুলির দুর্বল কাঁচা বাড়িগুলিকে চিনহিত করে পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন কেন্দ্রীয় এবং রাজ্য প্রকল্পের অধীনে ঐ বিপজ্জনক কাঁচাবাড়িগুলিকে পাকা বাড়িতে পরিনত করা যায় ।
নদীবাঁধ নির্মাণে কংক্রিটের বিকল্প হিসাবে পলি কাদার সাথে চুন মিশিয়ে বাঁশের কঞ্চি এবং খুঁটিকে ব্যাবহার করে বাঁধের শক্তি এবং উচ্চতা বৃদ্ধি করা সম্ভব । চুন মেশানো মাটি দিয়ে তৈরি নদীবাঁধের ঢালে ম্যানগ্রোভ জাতীয় বৃক্ষরোপণ করে জলের তোড়ের বিরুদ্ধে বাঁধের শক্তি বৃদ্ধি করা যেতে পারে । এর পাশাপাশি লম্বাটে চটের বালি ভরা বস্তায় ( geo bag ) কিংবা jute geo textile ব্যাবহার করা যেতে পারে নদী বাঁধ নির্মাণ এবং রক্ষণাবেক্ষণে । এভাবে পরিবেশ বান্দভ উপায়ে কম খরচে সুসংহত সমাধানের উদ্দেশ্যে কিছু পরীক্ষামূলক নদীবাঁধ নির্মাণ করে সেগুলির স্থায়িত্বের মূল্যায়ন দ্রুত শুরু করা উচিত । কারন এটা খেয়ালে রাখতে হবে যে বিকল্প ভাবনার ভিত্তিতে , বিকল্প নির্মাণ সামগ্রীর প্রয়োগে নদীবাঁধ নির্মাণের ক্ষেত্রে ফলিত গবেষণা স্বাধীনতা উত্তরকালে এদেশে কিংবা রাজ্যে যথেষ্ট পরিমানে হয়নি । এখন একদিকে যেমন সুন্দরবন উপকুল অঞ্চলের মাটি ক্রমান্বয়ে বসে যাচ্ছে অন্যদিকে সমুদ্রের জলের উচ্চতা প্রতি বছর বেড়ে চলেছে । এই দুই জোড়া বিপদের মুখোমুখি সুন্দরবনের মানুষের ভবিষ্যৎ । আর এই প্রেক্ষিতে দ্রুত প্রয়োজন নদীবাঁধের বিকল্প নির্মাণ ভাবনার পরীক্ষামূলক প্রয়োগ ।