২৬ জুলাই,২০২০
২৬ জুলাই,১৯৫৩। সশস্ত্র সংগ্রামের প্রত্যয় মেখে একদল তরুণ বিপ্লবীর মরণপণ লড়াইয়ের উজ্জ্বল ইতিহাস। সামরিক শাসক বাতিস্তা তখন কিউবার সমস্ত ক্ষমতার অধীশ্বর। ১৯৫২-র ১ জুন আহুত নির্বাচনকে সংগঠিত না হতে দিয়ে সেনা অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে এই ক্ষমতারোহণ। ঐ নির্বাচনেই কিউবান হাউস অব রিপ্রেসেনটেটিভসের অন্যতম প্রার্থী অর্থোডক্স পার্টির তরুণ নেতা ফিদেল কাস্ত্রো। নির্বাচন হলো না। জোর করে ক্ষমতায় আসীন বাতিস্তা প্রথমেই পেলেন মার্কিন সমর্থন। সেই আমেরিকা যারা ১৮৯৮ এর ১০ ডিসেম্বর কিউবার মানুষের রক্তাক্ত স্বাধীনতা সংগ্রামের স্বপ্নকে চুরি করে ওয়াশিংটন থেকে কিউবা পরিচালনার পরিকল্পনা করেছিল।
ওয়ে্স্ট ইন্ডিজের গ্রেটার এ্যান্টিলিজে গ্রুপের সবচাইতে বড় দ্বীপ কিউবা। ক্যারিবিয়ান মুক্তো। কিউবা এবং আইল্যান্ড অব ইয়ুথ, এই দুটি বড় দ্বীপ এবং চার হাজারেরও বেশি ছোট দ্বীপের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা এই ভূখন্ড ৭০০মাইল লম্বা ও ১০০ মাইল চওড়া। মোট আয়তন ১,১৪,৫২০ বর্গ কিলোমিটার। জনসংখ্যা ১কোটি১৫ লক্ষ। মার্কিনীদের সমুদ্রপ্রমোদ ভ্রমণের সবচাইতে আকর্ষনীয় সৌন্দর্যে মোড়া ভূগোল। প্রায় এক তৃতীতাংশ জুড়ে রয়েছে সমুদ্র ছোঁয়া উঁচু পাহাড়, অবশিষ্টাংশে ঢালু উপত্যকা এবং সবুজ তৃণভূমি। সমস্ত উপকূল জুড়ে সমুদ্রের নীল জল ছোঁয়া সোনালি বালিয়াড়ি। দক্ষিণপূর্বে সিয়েরা মায়েস্ত্রার জঙ্গল ঘেরা পাহাড়। অসম্ভবরকমের সবুজ এই দেশে গাছগাছালির সঘন অবস্থান। প্রায় ৭৫হাজার রকমের ফুল ফোটে কিউবায়। স্পেনের দুঃসাহসীক করিৎকর্মা নাবিক ক্রিস্টোফার কলম্বাস ১৪৯২ সালের ৩ অগাষ্ট নিনা,পিন্টা আর সান্টামারিয়া নামের তিনটি জাহাজে অষ্টআশি জন সঙ্গীকে নিয়ে ভেসে পড়েছিলেন পশ্চিমে। ২৭ অক্টোবর ১৪৯২ ডাইরিতে কলম্বাস লিখেছেন ‘আহা ! কি দেখলাম ! আমার দুচোখ আজ সার্থক হলো’ ।
কলম্বাস আবিষ্কৃত কিউবার সম্পদ জড়িপ করতে ১৫০৯ সালে স্পেন পাঠিয়েছিল সেবাস্তিয়ান ডি ওকাম্প নামের এক তরুণ অভিযাত্রীকে। কলম্বাসের স্বপ্ন-সৌন্দর্যের মাটির প্রাকৃতিক আর মানব সম্পদের ব্যালান্সশীটের প্রকৃত তথ্য জেনে আর সময় নষ্ট করেনি স্পেন। ১৫১১-তেই কিউবার পূর্বভাগে বারাকোয়া অঞ্চলে ঔপনিবেশিক ব্যবস্থার পত্তন ঘটান ডিয়েগো ভেলারকুয়েজ। ১৫৩৮-এ হাভানা শহরে পত্তন হয় ঔপনিবেশিক ব্যবস্থার । স্পেনীয়রা তাদের শাসনের সুবিধার জন্য ১৬০৮ সালে কিউবাকে দুভাগে ভাগ করে। রাজধানী হয় সান্তিয়াগো আর হাভানা।
১৫১০ থেকেই স্পেনীয়রা বার বার প্রতিরোধের মুখে পড়ে। ইতিহাস সাক্ষী দেয় আতুয়ে নামের এক আদিবাসী সর্দারের প্রতিরোধই ছিল স্বাধীনতা বাঁচিয়ে রাখার প্রথম প্রতিরোধ। আতুয়েকে জীবন্ত পুড়িয়ে মেরে নৃশংসতার শুরু।যা চারশো বছর ধরে সাম্রাজ্যবাদী স্পেনের বর্বর অত্যাচার আর শোষণের শৃঙ্খলে কিউবার পিষ্ট হবার ইতিহাসের নির্মমতায় মোড়া। এই বর্বরতার প্রধানতম বৈশিষ্ট ছিল নির্বিচার নরহত্যা। এই নরহত্যার ব্যাপকতা ছিল এতটাই ভীষণ যে মাত্র আড়াই দশকের মধ্যে কিউবার ভূখন্ডের মূল আদিবাসীদের সংখ্যা দুলক্ষ থেকে কমে দাঁড়ায় মাত্র পাঁচ হাজারে। স্পেনীয়দের অত্যাচারে সমূলে ধ্বংস হওয়া আদিবাসীদের প্রাচীন সভ্যতা, সংস্কৃতি ধুলোয় মিশে যায়। তার প্রায় কোন অবশেষ আর টিঁকে থাকে না। কিউবার সমস্ত ভূসম্পত্তিকে স্পেনের রাজার জমি হিসাবে ঘোষণা করে তা বিতরণ করে দেওয়া হয় আগত স্পেনীয়দের মধ্যে। দাস হিসাবে ভাগ করে নেওয়া হয় আদিবাসীদের।
পর্যায়ক্রমে কিউবায় তিন ধরনের সংগ্রাম বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে থাকে।১) দাস ও দাস মালিকেদের মধ্যে লড়াই , ২) সরকার কর্তৃক আরোপিত শোষণমূলক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে কিউবানদের লড়াই , ৩) কিউবা বাসী বনাম স্পেনীয়দের মধ্যে লড়াই। রাজনৈতিক ভাষ্যে স্পেনীয় আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং দাসত্ববিরোধী সংগ্রাম গড়ে উঠতে থাকে ছোট ছোট আকারে। ১৮২০ থেকে ১৮৩০ একটা পর্যায়,১৮৩০ এবং১৮৩৫ থেকে ১৮৩৮ দ্বিতীয় পর্যায়। বিভিন্ন ধরনের যে সংগ্রাম সংঘটিত হয় তা ব্যাপ্তি ও তীব্রতার দিক থেকে অর্জন করে অভূতপূর্ব মাত্রা।১৮৬৮-১৮৭৮ এই দশ বছর কিউবার ইতিহাসে ‘টেন ইয়ার্স ওয়ার’ বিশেষণে ভূষিত। প্রকৃত অর্থে এটাই ছিল কিউবার প্রথম স্বাধীনতার লড়াই। জনতার মনোবল এমন ছিল যে১৮৬৯-এ তারা নিজেরাই নিজেদের স্বাধীনতা ঘোষণা করে। বলা হয় দশকব্যাপী এই সংগ্রাম স্পেনীয় স্বৈরতান্ত্রিক ঔপনিবেশিক প্রভুত্বের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত বিজয়ের পরীক্ষা নিরীক্ষার ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছিল। এবং এই সংগ্রাম কোন বুর্জোয়া শ্রেণীর নেতৃত্বে পরিচালিত হয়নি। সবটাই হয়েছিল কৃষক ও শহুরে মধ্যবিত্ত নেতৃত্বের পরিচালনায়।
এই সময় জন্ম কিউবার স্বাধীনতা সংগ্রামের অনন্য চরিত্র হোসে মার্তির। ১৮৫৩-র ২৮ মার্চ হাভানা শহরে জন্মে তিনি এই লড়াইকে দেখেন কৈশোরের আবেগ, যৌবনের স্পর্ধা আর দেশপ্রেমের আর্তি দিয়ে।দশ বছরের যুদ্ধ যে বছর শেষ হয় সে বছরেই স্পেন,প্যারিস,মেক্সিকো,গুয়াতেমালা ঘুরে দেশে ফেরেন মার্তি।তার আগে মাত্র ১৭ বছর বয়সে নিজের প্রকাশিত কাগজে আবদালা নামে একটি রাজনৈতিক নাটক লিখে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে কারাবাস করতে হয় তাকে। দেশে ফিরে আগুনঝরানো অজস্র লেখার অপরাধে নির্বাসিত হন স্পেনে।স্পেন থেকে নিউইয়র্ক গিয়ে যোগ দেন কিউবান রেভোলিউশনারি কাউন্সিলে। মার্কিন পুঁজিবাদের সাম্রাজ্যবাদী রূপ গ্রহণের গোড়ার সময় সেটা।মার্তিই প্রথম উত্তুরে দৈত্য হিসাবে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদকে চিহ্নিত করে গোটা লাতিন আমেরিকায় সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী রাজনৈতিক সচেতনতার ভিত গড়ে দিয়েছিলেন যার উপর দাঁড়িয়ে অগ্রসর হয়েছিলেন ফিদেল সহ কিউবার বিপ্লবীরা।
১৯৫২-র রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রার্থী ছিলেন তিনজন।প্রথিতযশা ইঞ্জিনিয়ার কার্লোস হেভিয়া প্রার্থী হয়েছিলেন অর্থেনটিকো পার্টির পক্ষ থেকে। হাভানা বিশ্ববিদ্যালয়ের সোশিওলজির অধ্যাপক ডঃ রবার্ট এগ্রামন্টি হয়েছিলেন অর্থোডক্স পার্টির পক্ষ থেকে আর বাতিস্তা ছিলেন পার্টিডো ডি এ্যাকশিয়ান পপুলারের তরফ থেকে। প্রচার প্রক্রিয়া চলার সময় স্পষ্ট হতে থাকে বাতিস্তা জিতবেন না। তাই ক্যু দেতার মাধ্যমে ক্ষমতা দখল আর গণতন্ত্রের কুৎসিত মুখ সিআইএ আর মার্কিন বহুজাতিক কোম্পানির কলকাঠিতে আমেরিকার স্বীকৃতি।
এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে মাত্র ২৫ বছর বয়সের হাভানা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট ডিগ্রি নিয়ে সবে আইন ব্যবসায় নামা যে তরুণ আইনজীবী জরুরি আদালতে রাষ্ট্রপ্রধানের বিরুদ্ধে মামলা করেছিলেন তিনিই ফিদেল কাস্ত্রো। আদালতে দাবি করেছিলেন কিউবার গণতন্ত্রকে হত্যা করে বলপূর্বক ক্ষমতা দখলের মাধ্যমে কোড অফ সিভিল ডিফেন্সের ৬ নং ধারা লঙ্ঘনের অপরাধে রাষ্ট্রপতির ১০৮ বছরের শাস্তি। বিচারের প্রহসন এই যুবার কাছে স্পষ্ট করে দেয় যে বিপ্লব ছাড়া কিউবাকে মুক্ত করা যাবে না। সেই বিপ্লবী প্রতিরোধী সংগ্রামের বার্তা নিয়েই একদল তরুণ বিপ্লবী কাস্ত্রোর নেতৃত্বে কিউবার দ্বিতীয় বৃহত্তম সামরিক দুর্গ মনকাডা আক্রমণ করেছিলেন ১৯৫৩-র ২৬ জুলাই।বাতিস্তাকে মুখের মত জবাব দেওয়ার জন্য ওরিয়েন্টি প্রদেশের সান্টিয়াগো শহরের এক প্রান্তে অবস্থিত দুর্গে সেই দিন রাতের নিস্তব্ধতাকে খানখান করে রাইফেল আর স্টেনগানের গুলি বর্ষণে ঘুম ভেঙ্গে জেগে উঠেছিল চারধারের মানুষ। দুর্গ দখল করা খুব সহজ কাজ ছিল না । কারণ তখনকার সময়ের সবচাইতে উন্নত সামরিক অস্ত্রসম্ভারে সজ্জিত ছিল আমেরিকার আশীর্বাদপুষ্ট বাতিস্তার সেনাবাহিনী।২০০ তরুণ যুবার এই বাহিনীর বিদ্রোহ ব্যর্থ হলেও অপরিসীম দেশপ্রেম, অনমনীয় ইচ্ছাশক্তি,অসীম জেদ আর অকল্পনীয় প্রতিরোধের নজিরে সময়ের ঘড়ি বেজে উঠেছিল বিদ্রোহের বার্তা নিয়ে।তারই ছাপ পড়ে থাকল ইতিহাসে- তাড়া করে বেড়াতে লাগল বাতিস্তার সামরিক শাসনকে। মারা গিয়েছিলেন অনেকেই। গ্রেপ্তার হয়েছিলেন আজকের কিউবার রাষ্ট্রপতি সেদিনের অভিযানের অন্যতম নেতা রাউল কাস্ত্রোও।
মনকাডা দিবসের ঘটনা তো এইটুকু। কিন্তু আসলে এটা ঘটনার শুরু। ধৃতদের বিরুদ্ধে যে প্রহসনমূলক বিচার পর্ব সংঘটিত হয় সেখানে তরুণ ফিদেল আত্মপক্ষ সমর্থনে বিচারকদের সামনে যে বক্তব্য পেশ করেছিলেন তা ছিল কার্যত কিউবার ভবিষ্যত বিপ্লবের বুনিয়াদ নির্মাণ।১৯৫৩-র ২১সেপ্টেম্বর শুরু হয় এই বিচার।স্পষ্ট ভাষায় নিজের বিরুদ্ধে অভিযোগ স্বীকার করে নিয়ে ফিদেল বলেন মনকাডা দুর্গ আক্রমণে আমিই নেতৃত্ব দিয়েছি, উদ্বুদ্ধ করেছি অন্যদের।এই কাজকে পবিত্র কাজ হিসেবে ঘোষণা করে গর্ব প্রকাশ করেন পরিষ্কার ভাষায়। বলেন দেশের কল্যাণের জন্যই তিনি রাষ্ট্রশক্তি দখল করতে চেয়েছিলেন। আদালত তাকে প্রশ্ন করে শান্তিপূর্ণ উপায়ে এই চেষ্টা তিনি করেননি কেন ? ফিদেল উত্তর দেন, সংবিধান লঙ্ঘনের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করে বাতিস্তাই অবসান ঘটিয়েছেন কিউবার শান্তির। মনে করিয়ে দেন শান্তিপূর্ণ উপায়ে আদালতের মাধ্যমে প্রতিবাদের তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা।
বিচারের দ্বিতীয় দিনে ফিদেলকে সাক্ষীর কাঠগড়া থেকে বাতিস্তা সরকারকে জেরা করার অধিকার দেওয়া হয়েছিল।নাৎসি আদালতে ডিমিট্রভ যেমন উদঘাটন করেছিলেন ফ্যাসিবাদের কদর্য রূপ তেমনি সেদিনের জেরায় বাতিস্তার সরকারি কর্মচারীদের আর সামরিক অফিসারদের অতিষ্ঠ করে তুলে বাতিস্তার অত্যাচার আর মিথ্যাভাষণকে সর্বসমক্ষে উদঘাটন করে দিয়েছিলেন ফিদেল কাস্ত্রো।তার জেরায় প্রমাণিত হয়ে গিয়েছিল যে গ্রেপ্তারের পর বিচার ছাড়াই হত্যা করা হয়েছে ফিদেলের ৭০ জন অনুগামীকে। আর জীবিত যারা, প্রতিদিন প্রতিরাতে তাদের উপর চালানো হচ্ছে অবর্ণনীয় শারীরিক অত্যাচার।
বিচারের তৃতীয় দিনে আদালতে ফিদেল কাস্ত্রো কে দেখা গেল না। সামরিক বাহিনীর পক্ষ থেকে জানানো হল, ফিদেল অসুস্থ। আদালত কক্ষে যখন ভেসে বেড়াচ্ছে সন্দেহের গুঞ্জন তখনই বিপ্লবীবাহিনীর নিখুঁত পরিকল্পনায় এক অসম সাহসী নারী মাথার চুলের মধ্যে গোপন করা এক টুকরো কাগজ বিচারকের হাতে তুলে দিলেন। এই নারীও ছিলেন দেশদ্রোহীতার অভিযোগে অভিযুক্ত, মনকাডা দুর্গ আক্রমণের অন্যতম বিপ্লবী। নাম ডক্টর মেলবা হার্নান্ডেজ। চিঠিতে লেখা, ফিদেল অসুস্থ না, তাকে আসতে দিচ্ছে না ভয়ার্ত স্বৈরশাসক।
কিন্তু সরকারের মুখোশ উন্মোচন সত্বেও ফিদেলকে আদালতে আনা গেল না।ক্ষিপ্ত সামরিক বাহিনী আর ক্ষমতামদমত্ত বাতিস্তা অস্বীকার করলেন আদালতকেও। অন্য বিপ্লবীদের থেকে অনেক দূরে সরিয়ে এক ছোট্ট,প্রায়ান্ধকার, অস্বাস্থ্যকর কুঠুরিতে ঢুকিয়ে দেওয়া হল ফিদেলকে। বিচারের প্রহসন চলতেই থাকল। পালাসিও দ্য জাস্টিকার প্রকাশ্য বিচার সভা থেকে মামলার শুনানি স্থানান্তরিত হল সাতারনিনো হাসপাতালের নার্সদের লাউঞ্জে। গোপন আদালতে।
ইতিমধ্যেই অনেকটা সফল হয়েছে ফিদেল কাস্ত্রোর উদ্যোগ।গোটা কিউবা জুড়ে বাতিস্তার নির্মম অত্যাচারে বিধ্বস্ত মানুষের সহানুভূতির বাতাস ঢুকেছে তার ছোট্ট কুঠুরিতে।হয়তো বাতিস্তাও বুঝেছিলেন এই ফল্গুস্রোত। তাই প্রায় মাস দুয়েক পরে একদিন ঘোষিত হলো আদালতে ফিদেল কাস্ত্রো কে আত্মপক্ষ সমর্থনের অধিকার দেওয়া হবে।
ইতিহাসে বিরল এই বিচার সভায় ফিদেলকে উপস্থিত করা হয়েছিল ৭৬ দিন কারাগারে রাখার পরে। আত্মপক্ষ সমর্থনে এক টানা ৫ ঘন্টা সওয়াল করেছিলেন তিনি। ৭৬ দিন নির্জন সেলে বসে আইনের কোন বইয়ের সাহায্য ছাড়া, মামলা লড়াইয়ের প্রাথমিক কাগজপত্রের কোনরকম চর্চা ছাড়া যে বক্তৃতা তিনি তৈরি করেছিলেন, বাতিস্তার স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে দেশবাসীর কাছে যে আবেদন জানিয়েছিলেন, ইতিহাসে তা নজিরবিহীন।দেশ বিদেশের ইতিহাস-আইন-অর্থনীতি-রাজনীতি-দর্শনে উৎপীড়কের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের অধিকারকে কিভাবে সোনার অক্ষরে লেখা হয়েছে এবং কেন তা মানুষের চিরন্তন অধিকার, তার ব্যাখ্যা তিনি উপস্থিত করেন।বলেন, স্বৈরাচারী বাতিস্তা এমনই কাপুরুষ যে অভিযুক্তকে বিচারালয়ের উপস্থিত করতে সে ভয় পায়।বাতিস্তাকে অভিযুক্ত করেন রক্তের স্বাদে উন্মত্ত শাসক হিসাবে। আর এরকম শাসকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা যে আদৌ বেআইনি না তা প্রমাণ করার জন্য মধ্যযুগের জন অফ সলসবেরি থেকে মার্টিন লুথার কিং, জন মিল্টন, জন লক,রুশো প্রমুখের চিন্তাধারার কথা উদাহরণ সহযোগে উল্লেখ করেন।বক্তৃতায় ফিদেল পৃথিবীর বহু স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস ও মহান মনীষীদের লেখা অনর্গল মুখস্থ বলে যান। চীন-ভারত-গ্রীস-রোম পৃথিবীর পথে পথে সংগ্রামের ইতিহাস কে ছুঁয়ে যায় তার বিরামহীন বক্তৃতা।
১৯৫৩-র ১৬ অক্টোবরে করা ফিদেল কাস্ত্রোর এই বক্তৃতা কিউবার বিপ্লবের ইতিহাসে এক অসামান্য দলিল। এই বক্তৃতাই পরবর্তীতে সামান্য রদবদলের পর ‘লা হিস্টরিয়া মে অ্যাবজলভেরা’ বা ‘ইতিহাস আমাকে মুক্ত করবেই’ এই শিরোনামে প্রকাশিত হয় যা দেশের মানুষের কাছে অসম্ভব জনপ্রিয়তা অর্জন করে।বক্তৃতায় ফিদেল কিউবার মানুষের জন্য যে ভবিষ্যৎ তার কল্পনায় রাঙানো তা ব্যাখ্যা করেন এবং আদালতের প্রচলিত নিয়মে নিজের মুক্তির জন্য আবেদন না করে ঘোষণা করেন যে একদিন জনসাধারণের আদালতে তার প্রকৃত বিচার হবে। ইতিহাস আমাকে মুক্ত করবে সেদিনই।
কি স্বপ্ন দেখেছিলেন ফিদেল ? কিউবার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে তার ভাবনাযই বা কী ছিল ? এইসব প্রশ্নেরই ব্যাখ্যাসহ জবাব ছিল ফিদেল কাস্ত্রোর এই ঐতিহাসিক বক্তৃতায়। আবেগময় কণ্ঠে বলেছিলেন, যদি কিউবার মানুষ এই বিপ্লবীদের হাতে ক্ষমতা তুলে দেয় তাহলে তারা সমস্ত দুর্নীতিগ্রস্ত সরকারি কর্মচারীদের বিদায় দিয়ে প্রশাসনকে শুধু কলুষমুক্ত করবে না, তাকে ব্যবহার করবে মানুষের স্বার্থ রক্ষায়। জাতীয় ব্যাঙ্ক, শিল্প ব্যাঙ্ক, কৃষি ব্যাঙ্ক, উন্নয়ন ব্যাঙ্ক তৈরি করে তার মাধ্যমে অকেজো পড়ে থাকা দেশের ১৫০০ মিলিয়ন ডলার মূলধন বিনিয়োগ করে ব্যাপক উন্নয়ন ঘটানো হবে শিল্প এবং কৃষির। যে এক লক্ষ ছোট কৃষক জমি ভাড়া নিয়ে চাষ করে তাদেরকেই দিয়ে দেওয়া হবে চাষ করা জমির সত্ত্ব। জমির ঊর্ধ্বসীমা নির্ধারণ করে উদ্বৃত্ত জমি বিলি করে দেওয়া হবে ভূমিহীনদের মধ্যে। কৃষি সমবায় সমিতি তৈরি করে প্রবর্তন করা হবে উন্নত ধরনের চাষের। চালাঘর ভেঙে ফেলে বড় বড় বাড়ি তৈরি করে সমাধান করা হবে গৃহসমস্যা আর শিল্প কৃষি আর গৃহ সমস্যার এহেন সমাধান স্বাভাবিক নিয়মেই কাজের পরিমাণ বাড়িয়ে দূরীভূত করবে দেশের বেকার সমস্যাকে। শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যের সব দায়িত্ব নেবে সরকার।
নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করেছিলেন ফিদেল এতসব সংস্কারের টাকা কোথা থেকে আসবে উত্তর প্রস্তুত ছিল তাঁর নিজের ঠোঁটেই। যদি সংকীর্ণ ব্যক্তিস্বার্থে সরকারি টাকা আত্মসাৎ বন্ধ করা যায়, যদি দেশের সমস্ত ঐশ্বর্য মুষ্টিমেয় কয়েকজনের স্বার্থে ব্যবহার না করে সকলের সম্মিলিত স্বার্থে ব্যবহার করা যায়, তাহলে এটা সম্ভব। আত্মপ্রত্যয় এর সাথে ঘোষণা করেছিলেন স্পেনীয় আর মার্কিনী লুটেরাদের সাড়ে চারশ বছরের লুণ্ঠন সত্বেও যে সম্পদ কিউবার আছে তাতে কিউবার জনসাধারণের তো বটেই, আরো বিশগুণ লোকের উন্নতি করা যায়।
দীর্ঘ পাঁচঘন্টার বক্তৃতার শেষে স্থির আদালত কক্ষে নেমে এল কিছুক্ষণের বিরতি। ঘোষিত হল বিচারকের রায়। ১৫ বছর কারাদন্ড ঘোষিত হল ফিদেল কাস্ত্রোর। রাউল কাস্ত্রোর ১৪ বছর এবং অন্যান্যদের বিভিন্ন মেয়াদে কারাদন্ড ঘোষিত হল। ফিদেল চলে গেলেন কারাগারে। প্রথমে আর সকলের থেকে আলাদা করে তাকে স্থানান্তরিত করা হয়েছিল একটি দ্বীপে। সাত মাস সেখানে নির্জনে থাকার পর তাকে অন্যান্য কয়েদীদের সাথে মিশতে দেওয়া হল। তখন ফিদেল শুরু করলেন স্কুল চালানো। ইতিহাস, দর্শন পড়াতে শুরু করলেন তাঁর তরুণ সহকর্মীদের।
ফিদেল কারাগারে। কিন্তু তার পাঁচঘন্টার ঐতিহাসিক সওয়াল সাতারনিনো হাসপাতালের নার্সদের লাউঞ্জ ভেদ করে ততদিনে পৌঁছে গেছে গোটা কিউবার জনমানসে। মুক্তির এই দর্শন অদ্ভুত উদ্দীপনা এনে দিয়েছে শ্রমিক-কৃষক সহ কিউবার তরুণদের মনে।তারা হাতে পেয়ে গেছে বিপ্লবের ইশতেহার। গোটা দেশ জুড়ে ফিদেল এবং তার সঙ্গীদের মুক্তির দাবিতে লড়াই উত্তাল চেহারা নিতে লাগল। এই উন্মাদনা দেখে চতুর বাতিস্তা কিছু কিছু গণতান্ত্রিক অধিকার মানতে রাজী হলেন এবং নতুন করে নির্বাচনের দিনও নির্ধারণ করলেন। ফিদেল তখন কারাগারের অভ্যন্তরে বসে বিপ্লবী বন্ধুদের সঙ্গে ভবিষ্যতের সংগ্রামের পরিকল্পনা রচনা করে চলেছেন আর গোটা কিউবা জুড়ে আর একটা নির্বাচনের প্রহসনের আশঙ্কায় আশঙ্কিত মানুষ একটাই শ্লোগানে সামিল হচ্ছেন- ফিদেল কাস্ত্রো আর তার অনুগামীদের মুক্তি চাই। এই আন্দোলনে দলে দলে সামিল হতে থাকলেন কিউবার মানুষের শিক্ষিত অংশও। গণতন্ত্রের দোহাই দিয়ে ১৯৫৫-এ নির্বাচন করলেন বাতিস্তা। তার একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী রোমান গ্রাউ নির্বাচনের আগেই দুর্নীতির অভিযোগ তুলে প্রত্যাহার করে নিলেন নিজের প্রার্থীপদ। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আবার চার বছরের জন্য রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হলেন বাতিস্তা।
বাতিস্তা না বুঝলেও এই সাজানো নির্বাচন যে জনমানসকে একটুও আন্দোলিত করেনি তা বুঝেছিলেন তার পরামর্শদাতারা। তারা বাতিস্তাকে বুদ্ধি দিলেন সব রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তি দিতে। ১৯৫৫-র ১৯-এ মে কারাদন্ড দুবছর পেরোনোর আগেই ফিদেল তার সতীর্থদের সাথে মুক্তি পেলেন।
বক্তৃতার শেষ লাইনগুলি ছিল “আমি জানি আমার জন্য কারাবাসে অন্য সবার চাইতে কঠোরতম কাপুরুষোচিত হুমকি আর বিদ্বেষপূর্ণ নিষ্ঠুরতা অপেক্ষা করছে। কিন্তু আমি জেলখানাকে ভয় পাই না, যেমন আমি ভয় পাই না এই হীন স্বৈরাচারী ক্রোধকে যে আমার সত্তর জন বিপ্লবী বন্ধুর জীবন নিয়ে নিয়েছে। আমায় আপনারা সাজা দিন। ইতিহাস আমায় মুক্ত করবে। “
এই ভাষণই পরবর্তীকালে ছাপা হয়েছিল ‘ইতিহাস আমাকে মুক্ত করবেই’ শিরোনামে। গণআন্দোলনের চাপে মুক্তির পরে নিবিড় হয়েছিল বিপ্লব প্রস্তুতি। তিন বছরের মধ্যে ক্ষমতাচ্যুত হয়েছিল বাতিস্তার সরকার। যে ইতিহাস আজকের আলোচনার বিষয় না।
বিপ্লবোত্তর কিউবায় ২৬শে জুলাই পালিত হয় জাতীয় বিদ্রোহ দিবস হিসাবে। বিপ্লবী সরকার ফিদেলের নেতৃত্বে মনকাডা দুর্গে সামরিক ছাউনি তুলে দিয়ে চালু করে স্কুল। পরবর্তীকালে মনকাডা দুর্গের একাংশে নির্মিত হয় ‘২৬ জুলাই মিউজিয়াম’।
মার্কিন অর্থনৈতিক অবরোধের নিষ্ঠুরতায় পড়া বিপ্লবোত্তর সমাজতান্ত্রিক কিউবার প্রতি সংহতি জানাতে প্রতিবছর ২৬শে জুলাই বিশ্বজুড়ে নানান অনুষ্ঠান পালিত হয়। আজ যখন কোভিড-১৯ আক্রমণে বিপর্যস্ত পৃথিবীতে পৃথিবীর সেরা স্বাস্থ্যব্যবস্থার দেশ কিউবার চিকিৎসক আর নার্সরা অবিশ্রান্ত ঘুরে বেড়াচ্ছেন মানুষের পাশে দাঁড়ানোর জন্য, তখন কিউবা বিপ্লবের সূতিকাগার ২৬শে জুলাই পেয়ে যাচ্ছে নতুন মাত্রা। জাগ্রত করে চলেছে লাতিন আমেরিকা সহ পৃথিবীর দেশের পর দেশে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী নিত্যনতুন প্রেক্ষাপট। এই প্রাসঙ্গিকতাই ২৬শে জুলাইয়ের ঐতিহাসিক উত্তরাধিকার।