‘এটা তোমার দাদার। সে যা বলতে চায়নি, তুমিও যদি তা না বল, তাহলে আমরা ওর অন্য চোখটিও উপড়ে নেব।’
মুঠো খুলে রক্তমাখা একটি চোখ দেখিয়ে এভাবেই শাসিয়েছিল সেনাকর্তা, পালটা জবাব এল: ‘তোমরা যদি ওর ওই চোখটিও উপড়ে নাও, তাহলেও সে কিছু বলবে না, আমিও কিছু বলব না।’
মিনিটকয়েকের নীরবতা। ভারী বুটের কচকচানি। চাপা আর্তনাদ। গোঙানির শব্দ। ওরা আবার এল। জ্বলন্ত সিগারেটের ছ্যাঁকায় পুড়িয়ে দিতে থাকল হাত, সমস্ত আক্রোশ না মেটা পর্যন্ত, সঙ্গে নতুন ধাক্কা, বরিসের রক্তাক্ত অণ্ডকোষ দেখিয়ে বলল: ‘তোমার প্রেমিক আর নেই। আমরা ওকে হত্যা করেছি।’
‘সে মারা যায়নি, যারা দেশের জন্য শহীদ হয়, তারা অমর, তাঁরা মৃত্যুঞ্জয়ী।’
একরাশ বিরক্তি নিয়ে সার্জেন্ট ছুড়ে ফেলে দিলেন তার সিগার। ক্ষিপ্রবেগে বেরিয়ে গেলেন সেল থেকে। কয়েকজন সেনা ছুটলেন তার পিছনে।
আইদে সান্তামারিয়া, মেলবা হার্নান্দেজ— মনকাডা সেনা ছাউনি অভিযানে যে অল্প ক’জন বেঁচে ছিলেন, তাঁদের মধ্যে দুই বীরঙ্গনা।
আইদের দাদা আবেল সান্তামারিয়ার উপর তখন চলছে অকথ্য অত্যাচার। তার অল্প আগেই জেরার সময় একটি কথাও না বলে মৃত্যুবরণ করেছেন আইদের প্রেমিক বরিস লুইস সান্তা কোলোমা।
আবেল সান্তামারিয়ার শেষ কথাগুলি তখনও প্রতিধনিত্ব হচ্ছে জেলের দেওয়ালে: ‘যেভাবেই পার, নিজেদেরকে বাঁচাও, কাউকে একজন বেঁচে থাকতেই হবে, কী ঘটেছিল তা বলার জন্য।’
সেদিন ২৬ জুলাই, ১৯৫৩। মনকাডা সেনাছাউনি অভিযান।
সেদিন অভিযান ব্যর্থ হলেও, সেদিনই আসলে কিউবা বিপ্লবের জন্ম।
একরত্তি দ্বীপরাষ্ট্রে জাতীয় মুক্তি সংগ্রামে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা। ছাব্বিশে জুলাই, বরাবরের জন্য বদলে দিয়েছিল গোটাদেশের অভিমুখ। উন্মুক্ত করেছিল লাতিন আমেরিকার ইতিহাসের এক নতুন অধ্যায়ের। যার মহত্ত্বকে স্বীকৃতি দিয়েছে গোটা বিশ্ব।
সেদিন বিদ্রোহ ব্যর্থ হলেও সেই অভিযানের ব্যর্থতার মধ্যেই লুকিয়েছিল সাফল্যের বীজ। জন্ম দিয়েছিল একটি বিপ্লবী আন্দোলনের: ‘২৬ জুলাই আন্দোলন’!
‘একটি বিপ্লব একদিনে তৈরি হয় না, কিন্তু তা শুরু হয় এক সেকেন্ডের মধ্যে।’ বলেছিলেন আবেল। মার্চ ১৯৫২, বাতিস্তার সেনা অভ্যুত্থানের ঠিক ছ’দিন বাদে।
সেদিন আদালতে আত্মপক্ষ সমর্থনে ফিদেলের ঐতিহাসিক সওয়াল: ‘ইতিহাস আমাকে মুক্ত করবে।’
মনকাডা অভিযানের পর পাঁচবছর, পাঁচমাস, পাঁচদিন।
১ জানুয়ারি, ১৯৫৯। কিউবায় সফল বিপ্লব।
আজ, কিউবা বিপ্লবের ষাট বছর। কিউবা লড়ছে। বুক চিতিয়ে। দাঁড়িয়ে আছে মাথা উঁচু করে। সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতিকে সময়োপযোগী করে এগিয়ে চলেছে একুশ শতকের অভিমুখে।
মার্কিন রাষ্ট্রপতি ট্রাম্প হুঁশিয়ারি শুনিয়েছেন, ‘কিউবার জনগণ চায় এমন এক সরকার, যারা শান্তিপূর্ণভাবে রক্ষা করবে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, অর্থনৈতিক স্বাধীনতা, ধর্মীয় স্বাধীনতা এবং মানবাধিকার। এবং আমার প্রশাসন এই লক্ষ্য অর্জনে থাকবে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’
পালটা কিউবা জানিয়ে দিয়েছে, ‘বিপ্লবকে দুর্বল করা অথবা কিউবার জনগণকে আত্মসমর্পণ করাতে ওরা কিছুতেই পারবে না— যে কোনও কেন্দ্র থেকে, যে কোনও ধরনের আগ্রাসানের বিরুদ্ধে আমাদের প্রতিরোধের প্রাচীর গত ছয় দশক ধরে অটুট, অক্ষত। কিউবার রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক ব্যবস্থা পরিবর্তনে যে কোনও স্ট্র্যাটেজি, তা সে চাপ সৃষ্টি কিংবা কঠোর বিধি আরোপ, অথবা আরও কোনও তীক্ষ্ণ কায়দায় নেওয়া হোক না কেন, তার বিপর্যয় অনিবার্য।’
শুধু ট্রাম্প নন। ২০১৪’তে, কিউবা সম্পর্কে ‘নীতি পরিবর্তনের’ কথা ঘোষণার সময় ওবামা পর্যন্ত বলেছিলেন, ‘আমরা বিশ্বাস করি, কিউবার শ্রমিকরা এখন স্বাধীনভাবে ইউনিয়ন তৈরি করতে পারবেন।’
এর মানে কী? কিউবায় শ্রমিকদের মতপ্রকাশ, ইউনিয়ন গঠনের কোনও স্বাধীনতা নেই?
কিউবার শ্রমিকদের ৯০ শতাংশের বেশি ইউনিয়নের সদস্য। অন্যদিকে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এই হার মাত্র ১১.৩ শতাংশ। ১৯৫৯, কিউবায় বিপ্লব। তার ২০-বছর আগে ১৯৩৯ সালে সমস্ত ইউনিয়নকে নিয়ে তৈরি হয় ফেডারেশন অব কিউবান ওয়ার্কার্স (সিটিসি)। ইউনিয়নগুলি পুরোপুরি স্বাধীন, স্বনির্ভর। সদস্যপদের চাঁদা মজুরির ১ শতাংশ সরাসরি সংগ্রহ করা হয় কর্মস্থল থেকে, মজুরি থেকে কেটে নেওয়া হয় না।
কিউবার মানবাধিকার নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অভিযোগের জবাবে ২০১৬’র এপ্রিলে কিউবার কমিউনিস্ট পার্টির সপ্তম কংগ্রেসে রাউল কাস্ত্রো বলেন, ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বরাবর দাবি করে কিউবায় না কি মানবাধিকার নেই, আর সেটাই অর্থনৈতিক অবরোধ তোলার ক্ষেত্রে তাদের প্রধান প্রতিবন্ধকতা। আমাদের কাছে, মানবাধিকারের অর্থ: সমকাজে সমমজুরি, তা সে পুরুষ হোন, আর মহিলা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-সহ অন্যান্য দেশে এটা নেই। মহিলারা পান কম মজুরি। অথচ, এনিয়ে কয়েকডজন মানবাধিকারের উল্লেখ করা যেতে পারে। বিনমূল্যে স্বাস্থ্য পরিষেবা— কিউবায় অন্যতম একটি মানবাধিকার। এরকম মানবাধিকার এই বিশ্বে আর ক’টি দেশে আছে? বহু দেশে এটা কোনও মানবাধিকারই নয়। বরং, ব্যবসা। আমাদের দেশে শিক্ষা মেলে বিনামূল্যে। বিশ্বে আর ক’টি দেশ আছে, যেখানে ফ্রি-তে শিক্ষা মেলে? এটাও সব দেশে ব্যবসা। সেকারণেই এনিয়ে আমরা যে কারোর সঙ্গে যে কোনও জায়গায়, যে কোনও সময় আলোচনা করতে প্রস্তুত।’
কিউবায় প্রতি ১৭০ জন পিছু একজন ডাক্তার। আমেরিকায় দ্বিগুণেরও বেশি, ৩৯০ জন পিছু একজন ডাক্তার। আর ভারতে, সাড়ে আটগুনেরও বেশি, ১৪৫৭ জন পিছু একজন ডাক্তার।
পাঁচদশকের অবরোধের মুখেও কিউবা মানব উন্নয়নে গোটা বিশ্বের কাছে এক অনন্য নজির। বর্ণবিদ্বেষের অবসান। মহিলাদের সমানাধিকার, মহিলাদের উত্থান। নিরক্ষরতার হার, শিশুমৃত্যু তলানিতে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, চিকিৎসা সংক্রান্ত গবেষণা, ক্রীড়ায় সমানে পাল্লা দিয়ে চলেছে দুনিয়ার সবচেয়ে উন্নত দেশগুলির সঙ্গে।
মানব উন্নয়ন সূচকে সবচেয়ে উন্নত দেশগুলির তালিকায় কিউবা। ১৮৯টি দেশের মধ্যে স্থান ৭২, যেখানে ভারত ১২৯। গড় আয়ু ৭৯.৫, যেখানে আমেরিকায় ৭৮.৯৩, আর ভারতে প্রায় ৭০। পাঁচ বছরের কম বয়েসী শিশুর মৃত্যু হার প্রতি এক হাজারে মাত্র ৫, যেখানে আমেরিকায় ৬.৫, আর ভারতে ৩৬.৬।
পঞ্চাশ বছরের বেশি সময় ধরে মার্কিন অবরোধের মুখে কিউবা। ১৯৬২, যে বছর বব ডিলানের প্রথম অ্যালবাম প্রকাশ, ওভারডোজে মারলিন মনরোর মৃত্যু, নেলসন ম্যান্ডেলার জেল, সে বছরই কিউবার উপর পুরোপুরি অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা। অবরোধের কারণে অর্ধ শতকে কিউবায় লোকসানের পরিমাণ ৭৫,৩৬৮ কোটি ডলার। যার প্রভাব পড়েছে স্বাস্থ, শিক্ষা, ক্রীডা, সংস্কৃতি-সহ দেশের অন্যান্য স্ট্র্যাটেজিক ক্ষেত্রের উন্নয়নে।
কে বলেছে কিউবা একা? কিউবাকে কোণঠাসা করতে গিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রই আজ একঘরে। ১৯৯২ থেকে রাষ্ট্রসঙ্ঘের সাধারণ পরিষদ ভোট দিয়ে আসছে কিউবায় অবরোধের অবসান চেয়ে। শেষ গত বছরের ভোটে কিউবার পক্ষে ছিল ১৮৭টি ভোট। বিরুদ্ধে মাত্র তিনটি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, তার বিশ্বস্ত শরিক ইজরায়েল এবং এই মুহূর্তে ট্রাম্পের ক্লোন বোলসোনারোর ব্রাজিল। ভোটদানে বিরত থাকে দু’টি দেশ। কলম্বিয়া আর ইউক্রেন।
এই গ্রহের এক ক্ষুদ্র দ্বীপরাষ্ট্রের লড়াই এই দুনিয়ার সবচেয়ে শক্তিশালী দেশের সঙ্গে। মাত্র নব্বই মাইল দূরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাকের ডগায় কিউবা। এমন এক দ্বীপ, যা তার শত্রুর চেয়ে ৮৪ গুণ ছোট।
একরত্তি দেশ। আয়তন মেরেকেটে ১ লক্ষ বর্গ কিলোমিটার। জম্মু কাশ্মীরের চেয়ে বড়, তেলেঙ্গানার চেয়ে ছোট। জনসংখ্যা সাকুল্যে এক কোটি দশ লক্ষ। উত্তর চব্বিশ পরগণা, দক্ষিণ দিনাজপুর মিলিয়ে এর চেয়ে বেশি মানুষ থাকেন। আমেরিকার জনসংখ্যা এর ৩৩ গুণ। তেত্রিশ কোটি।
এই কিউবা কখনও আটকে থাকেনি কিউবাতে। এই কিউবা কখনও বন্দি থাকেনি ছোট্ট দ্বীপরাষ্ট্রের ভূগোলের মধ্যে। এই কিউবা কখনও বসে থাকেনি সুখি আটপ্রৌঢ়ে গৃহকোণের আড়ালে। বৈষয়িক সাহায্য থেকে মুক্তি আন্দোলন— গুয়েতামালা থেকে ভিয়েতনাম, সিরিয়া থেকে কঙ্গো— কিউবা পাঠিয়েছে ডাক্তার, শিক্ষক থেকে মুক্তিযোদ্ধা।
সর্বহারার আন্তর্জাতিকতাবাদের এক অনন্য অনুশীলন। এই করোনার সময় মোকাবিলায় ৩০টির বেশি দেশে পাঠিয়েছে ডাক্তার, স্বাস্থ্যকর্মী। ইতালির দিকে যখন গোটা ইউরোপ মুখে ফিরিয়ে নিয়েছে, তখন সেখানে কিউবার চিকিৎসকরা। শুধু করোনা নয়, গত ৫৬ বছর ধরে প্রাকৃতিক বিপর্যয় মোকাবিলায় দেশে-দেশে পাঠিয়েছে ৪,০০,০০০ স্বাস্থ্যকর্মী। ১৬৪টি দেশে স্বাস্থ্য পরিষেবা নির্মাণে সহায়তা করেছে।
ওয়াশিংটন এই গ্রহে রপ্তানি করে চলেছে সমরাস্ত্র। বিপরীতে, হাভানা রপ্তানি করে চলেছে জীবনদায়ী স্বাস্থ্য পরিষেবা। ওয়াশিংটন পাঠায় জলপাই পোশাকের ইয়াঙ্কি সেনা। হাভানা পাঠায় সাদা পোশাকের ডাক্তার। লাতিন আমেরিকার জটিল পরিস্থিতিতে ফিদেলের কিউবাই নেতৃত্ব দিয়েছে জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনে।
গোটা বিশ্বকে দেখিয়ে চলেছে তাক লাগিয়ে দেওয়া বৈপরীত্য: সমাজতান্ত্রিক কিউবা বনাম সাম্রাজ্যবাদী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
কিউবার বিপ্লব মানে বিপ্লবী সৃজনশীলতা, স্বাধীনতার স্বপ্নপূরণ, শ্রমিক ও মহিলাদের উত্থান, সাম্রাজ্যবাদের ধারাবাহিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতি চব্বিশ ঘণ্টার লড়াই, দেশপ্রেম, আন্তর্জাতিক সংহতি, সমাজতন্ত্রকে রক্ষা এবং নতুন সমাজতান্ত্রিক সমাজ নির্মাণে প্রত্যয়ী মনোভাবের উদাহরণ।
কিউবা মানে শপথ। হয় সমাজতন্ত্র, না হয় মৃত্যু।
কিউবা মানে প্রত্যয়। প্রিয় স্বদেশ, অথবা মৃত্যু।
কিউবা মানে সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী আন্দোলনের ধ্রুবতারা।
কিউবাবাসীর বোধে উপলব্ধিতে স্বাধীনতা, সমাজতন্ত্র আজ একাকার। সমার্থক। যার অর্থ জীবন। স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকা।