ঋজুরেখ দাশগুপ্ত
১৮ই সেপ্টেম্বর, ১৯৬০। রাষ্ট্রসঙ্ঘের জেনারেল অ্যাসেম্বলিতে যোগ দিতে সোভিয়েত বিমান চেপে মার্কিন মুলুকে পা রাখলেন তিনি। সাংবাদিকরা জিজ্ঞেস করল “আর ইউ আ কমিউনিস্ট?”, ডান হাতের তালু উপরে তুলে জবাব দিলেন “দ্য হিস্টোরি উইল টেল ইউ মাই ফ্রেন্ড”। ১১ই অক্টোবর, ১৯৭৯। আবারও নিউইয়র্কে তিনি। এবার সাংবাদিকদের প্রশ্ন- “ডু ইউ ওয়্যার দ্যাট ভেস্ট এভরিটাইম?”/ “হুইচ ওয়ান?”/”দ্য বুলেটপ্রুফ ভেস্ট?”- সঙ্গে সঙ্গে জলপাই রঙের জামার বোতামগুলো খুলে ক্যামেরাকে তাঁর উন্মুক্ত বক্ষ দেখালেন। তারপরেই, সিআইএ যাকে ৬৩৮বার খুন করতে চেয়েও পারেনি, কোটি কোটি ডলার ঢেলেও যার কাছে পর্যদুস্ত হয়েছে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ, সেই অপরাজেয় ইতিহাসের নায়ক ফিদেল কাস্ত্রো জবাব দিলেন- “টেঙ্গো উন চালেকো মোরাল”, অর্থাৎ “আই হ্যাভ আ মোরাল ওয়ান। আ মোরাল ভেস্ট।”
ফিদেলের এই মোরাল ভেস্ট অমর এবং অপরাজেয়। “হয় সমাজতন্ত্র, নয়তো মৃত্যু”- ফিদেলের এই আহ্বানে আলোকিত হয়েছে এই গ্রহের মুক্তিকামী সংগ্রামী মানুষ। ফ্লোরিডা থেকে ৯০ মাইল দূরে মাত্র ১লক্ষ ১০হাজার বর্গকিলোমিটারের ক্যারিবিয়ান দ্বীপরাষ্ট্রে মুক্ত হয়েছে ইতিহাস। মুক্ত হয়েছে স্বৈরাচারের অন্ধ গলির আবর্ত থেকে। আর এই মুক্তির পথে অপরাজিত মাইলফলক হয়ে জেগে আছে ২৬শে জুলাই। জেগে থাকবে, এবং জাগাবে দুনিয়ার খেটে খাওয়া মানুষের এই পচাগলা সমাজটাকে ভেঙে সুন্দর পৃথিবী গড়ার স্বপ্নকে।
১৯৫২ সালে মার্কিন মিলিটারির সহায়তায় কিউবার ক্ষমতা দখল করেন ফুলগেন্সিও বাতিস্তা। কিউবায় জারি হয় একাধারে স্বৈরতন্ত্র ও মার্কিন পদলেহন। বড় বড় আমেরিকান কর্পোরেশনগুলো দখল নেয় কিউবান আঁখের ক্ষেত। আর হাভানা পরিণত হয় মার্কিন সাহেব-মেমদের সৈকত বিনোদন ও ক্যাসিনো শহরে। দেদার লুঠ হতে থাকে কিউবান কৃষক, শ্রমিক ও কৃষ্ণাঙ্গ মানুষের ঘাম। আঁখের মতোই কিউবান জনগণ পিষ্ট হতে থাকে মার্কিন রোলারে।
বাতিস্তার ক্ষমতা দখলের পর থেকেই জনরোষ দানা বাঁধতে থাকে। পাখি শিকারের ব্যবসার অজুহাতে খোদ হাভানার বুকে বন্দুক চালনার ট্রেনিং নিতে থাকেন বিপ্লবীরা। জড়ো হতে থাকেন বাতিস্তাকে হটিয়ে নতুন কিউবা গড়ার লক্ষ্যে। মাত্র ১৩৭জন বিপ্লবী পরিকল্পনা করেন অভ্যুত্থানের। যার মধ্যে নয় জনের বয়স আঠেরোর কম। মাত্র পাঁচ জনের বয়স চল্লিশের বেশি। আপনি ভাবতেই পারেন এ যেন ঠিক চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার দখলের ক্যারিবিয়ান ভার্সান। হাতে রয়েছে মাত্র ৪০টি ১২গেজের শটগান, ৬০টি হ্যান্ডগান আর একটা অর্ধবিকল .৪৫ ক্যালিবারের মেশিনগান। এই রসদে একদল যুবক হেঁটে চলেছেন পিতৃভূমিকে মুক্ত করার স্বপ্ন নিয়ে। ১৯৫৩’র ২৫শে জুলাই রাতে ফিদেল তাঁর কমরেডদের উদ্দেশ্যে বলছেন- “আর কয়েক ঘন্টার মধ্যে তোমরা বিজয়ী বা পরাজিত হবে, কিন্তু জেনে রেখো, এই লড়াই যে কোনো মূল্যে সফল হবেই। (হোসে)মার্তির স্বপ্ন খুব শীঘ্রই বাস্তব হবে কিউবার মাটিতে। হয় স্বাধীনতা, না হয় মৃত্যু।” এই ১৩৭জনই ‘৫৩ সালের ২৬শে জুলাই হানা দেয় সান্তিয়াগো দে কিউবা শহরের মনকাডা অস্ত্রাগার দখলের উদ্দেশ্যে। পরিকল্পনা সফল হয়নি। বাতিস্তার মিলিটারির কাছে প্রাণ হারান ৭০জন বিপ্লবী। গ্রেফতার হন ফিদেল কাস্ত্রো। আপাতদৃষ্টিতে ব্যর্থ হয় বিপ্লব। কিন্তু ইতিহাস আমাদের জন্য রেখে গেছিলো অনেক কাহিনী। ইতিহাস প্রমাণ করেছে মনকাডার গুরুত্ব।
টানা ৭৬দিন একটা ছোট খুপরিতে বন্দী করে রাখা হয় ফিদেল কাস্ত্রোকে৷ হাভানা শহরের বার অ্যাসোসিয়েশনের ডিন সিদ্ধান্ত নেন ফিদেলের হয়ে সওয়াল করার। অনুমতি চেয়েও মাত্র দশ মিনিটের জন্য একজন মিলিটারি গার্ডের উপস্থিতিতে তাঁকে ফিদেলের সঙ্গে দেখা করতে দেওয়া হয়। ফিদেল তাঁকে সওয়াল করতে বারণ করেন এবং জানান তিনি নিজেই নিজের হয়ে সওয়াল করবেন। একটা খাতা-পেনও সরবরাহ করা হয়নি ফিদেলকে। ৭৬দিন পর এজলাসে হাজির করানো হয়। এক টুকরো কাগজ ছাড়াই প্রায় তিনঘন্টা টানা সওয়াল করেন ফিদেল। আজও পৃথিবীর ইতিহাসে এই সওয়াল মাইলস্টোন হয়ে আছে “হিস্টোরি উইল অ্যাবসল্ভ মি” শিরোনামে। এই দীর্ঘ সওয়াল শেষ করতে গিয়ে ফিদেল বলেন- “আমি জানি আমাকে বন্দী করে আমার ওপর কী জঘন্য অত্যাচার করা হবে। তবু, আমি এই জেলখানাকে ভয় করি না, যেমন ভয় করি না এই স্বৈরতন্ত্রকে-যারা আমার ৭০জন কমরেডকে খুন করেছে। আমাকে নিন্দা করুন, তাতে কিছু যায় আসে না। ইতিহাস আমাকে মুক্ত করবেই।”
মনকাডা এই কারণেই আজও প্রাসঙ্গিক। সিআইএ নেতৃত্বাধীন মার্কিন চক্রান্তে কিউবার বিপ্লবী সরকারকে ফেলে দেওয়ার জন্য ১৯৬১’র ১৫ই এপ্রিল ছ’টি বিমান বোমাবর্ষণ করে হাভানায়। মার্কিন চক্রান্ত পরাজিত হলেও সেই বোমায় প্রাণ হারায় ৭জন কিউবান নাগরিক। তাদের মধ্যে ছিলেন ১৬ বছর বয়সী এক কিশোর। যে তার জীবনের অন্তিম মুহুর্তে রক্তস্নাত শরীরের রক্ত দিয়ে দেওয়ালে লিখে দেয় এক উজ্জ্বল নাম! FIDEL! শুধু এই পাঁচটা অক্ষরই ওই কিশোরের শ্রেষ্ঠতম সাহিত্য। মনকাডাই জন্ম দিয়েছে এই কিশোরের। ১৯৫৬’র নভেম্বরে গ্রাণমা ইয়াক্টে চেপে যে ৮২জন মেক্সিকো থেকে ঢুকে পড়েছিলেন সিয়েরা মায়েস্ত্রের জঙ্গলে, তাঁদেরও জন্মদাতা ২৬শে জুলাই। তাঁদেরও জন্মদাতা মনকাডা। পরবর্তী ইতিহাস সবার জানা। ১৯৫৯’র ১লা জানুয়ারি হাভানা মুখরিত হয় বিপ্লবী স্পন্দনে। ইতিহাস মুক্ত করে কিউবা বিপ্লবকে। মনকাডা শিক্ষা দেয় সাময়িক পরাজয়ে হতাশার ‘ভ্যানিটি’ বিপ্লবীদের মানায় না। মনকাডা শিক্ষা দেয় শাসক দেশদ্রোহী বলে প্রচার করলেও মতাদর্শে অটুট থাকাটাই বিপ্লবীদের প্রধানতম কর্তব্য। “মতাদর্শের জন্য লড়াইয়ের চেয়ে আনন্দদায়ক আর কিছুই নেই।” যত সামান্যই হোক রসদ, যত কঠিন হোক পথ- দেশের মাটি অনুধাবন করে বিপ্লবের লক্ষ্যে পথচলা হতে হবে বিরামহীন। আজ আমাদের দেশে অনেকেই বলছেন-বামপন্থীরা অপ্রাসঙ্গিক। আসলে তারা চাইছেন বামপন্থীরা অপ্রাসঙ্গিক হোক। কিন্তু, মনকাডা দিবসের শিক্ষা- “একশো জন মাউন্ট এভারেস্টে চড়তে গিয়ে ব্যর্থ হতে পারে, কিন্তু দিনের শেষে মানব সভ্যতা এ পর্বতমালা জয় করবেই।”
মনকাডা দিবস দীর্ঘজীবী হোক।