২০২৪-২৫ অর্থবর্ষের জন্য কেন্দ্রীয় অন্তর্বর্তীকালীন বাজেট পেশ হয়েছে আজ। সেই প্রসঙ্গে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি মার্কসবাদী-র পলিট ব্যুরো’র বিবৃতি নিচে দেওয়া হল –
দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী বিরাট বিরাট দাবী করে আসছিলেন। আজ ২০২৪-২৫ অর্থবর্ষের জন্য কেন্দ্রীয় অন্তর্বর্তীকালীন বাজেট পেশ হয়েছে। এই বাজেটে ভারতে শ্রমজীবী জনসাধারণ যেরকম ভয়ানক অবস্থার মধ্যে রয়েছেন তা স্পষ্ট হয়ে গেছে। একইসাথে স্পষ্ট হয়েছে উন্নয়ন প্রসঙ্গে মোদী সরকারের ভাবনাটি আসলে কেমন। গরীবকে ক্রমাগত নিংড়ে নিয়ে ধনীদের আরও সম্পদ লুটতে দেওয়ার ফিকিরই হল এই সরকারের নীতি। এতে বড়লোক আরও বড়লোক হবে, গরীব মানুষ ক্রমশ তলিয়ে যাবেন। আজকের বাজেট ঘোষণা যদিও অন্তর্বর্তীকালীন, আগামী লোকসভা নির্বাচনের পরে নির্বাচিত নতুন সরকারই ২০২৪-২৫ অর্থবর্ষের প্রকৃত বাজেট ঘোষণা করবে।
২০২৩-২৪ অর্থবর্ষের বাজেটে আজকের বাজেট প্রসঙ্গে আগের বছরের তুলনায় ১৩.৩ শতাংশ হারে রাজস্ব আদায় বৃদ্ধির কথা বলা হয়েছিল। আজকের ঘোষণায় দেখা যাচ্ছে তার চাইতে বেশিই আদায় হয়েছে। তা সত্ত্বেও এবারের কেন্দ্রীয় ব্যয়বরাদ্দে আগেরবারের বাজেট ঘোষণায় যতটা করা হবে বলা হয়েছিল তার থেকে কম রাখা হল। অজুহাত রাজকোষীয় ঘাটতি কমানো। কেন্দ্রীয় ব্যয়বরাদ্দে বৃদ্ধি ঘটেছে জিডিপি বৃদ্ধির চাইতেও কম হারে (ধরা হয়েছিল প্রায় ৮.৯ শতাংশ হারে জিডিপি বৃদ্ধি পাবে) মাত্র ৭ শতাংশ। জনস্বার্থে কেন্দ্রীয় ব্যয়বরাদ্দ কমলেও সরকারের নিজের খরচের বেলায় বরাদ্দ বেড়েছে। তাহলে বর্ধিত আদায় আসলে গেল কোথায়? আসলে জনকল্যান প্রকল্পসমূহ এবং পরিকাঠামো খাতে বরাদ্দ দুইই কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। ভবিষ্যতে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং বুনিয়াদি আর্থিক প্রগতির পথে এমন সিদ্ধান্তের কুপ্রভাব দেখা দেবে।
কৃষি ও সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রসমূহ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, জনকল্যানমূলক প্রকল্প এমনকি প্রধানমন্ত্রী কৃষি সিঁচাই যোজনা থেকে শুরু করে তফশিলি জাতি, উপজাতি ও পিছিয়ে থাকা অন্যান্য অংশের উন্নয়নের জন্য যে আমব্রেলা প্রকল্পের খাতেও পূর্ববর্তী বাজেট ঘোষণার চাইতে বরাদ্দের পরিমাণ কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনা, পিএম গ্রাম সড়ক যোজনা এবং পিএম পোষণ ইত্যাদি প্রকল্পেও আগের বাজেটের তুলনায় বরাদ্দ কমেছে। এইসব প্রকল্পে ২০২২-২৩ অর্থবর্ষে যে পরিমাণ ব্যয় হয়েছিল তার চাইতেও এবারের বরাদ্দ কম। মহিলা ও শিশুদের জন্য নির্দিস্ট প্রকল্পগুলির ক্ষেত্রে নির্ধারিত (এস্টিমেটেড) এবং প্রকৃত (রিয়াল) দুধরনের মাপকাঠিতেই এবারের বাজেটে বরাদ্দের পরিমাণ কমানো হয়েছে। ২০২২-২৩’র তুলনায় ২০২৩-২৪ অর্থবর্ষের বাজেটে কৃষিকাজে প্রয়োজনীয় সার, খাদ্যসামগ্রী, এমএনরেগা ও শহরাঞ্চলে রোজগার প্রকল্প সবকিছুতেই ভর্তুকির পরিমানে ছাঁটাই বেড়েছিল। ঐ পর্বে খাদ্যসামগ্রীতে ভর্তুকি ছাঁটাই হয় ৬০৪৭০ কোটি, সারে ছাঁটাই ৬২৪৪৫ কোটি টাকার। পূর্ববর্তী অর্থবর্ষের তুলনায় এমএনরেগা প্রকল্পে ছাঁটাই হয় ৪৮০৬ কোটি। গ্রামোন্নয়ন খাতে ব্যয়বরাদ্দ এবং রাজ্যগুলির হাতে প্রাপ্য বকেয়া ফেরত দেওয়ার বিষয়টি কার্যত আটকে রাখা হয়েছিল, যেটুকু দেওয়া হয় তাও প্রকৃত (রিয়াল) অর্থে কার্যত ছাঁটাই। জিএসটি’র কারণে ক্ষতিপূরণ বাবদ রাজ্যগুলির প্রাপ্য হিসাবে ঋণের যে পরিমাণ দেওয়ার অঙ্গিকার করা হয়েছিল তার তুলনায় অনেকটাই কম বরাদ্দ হয়।
কেন্দ্রীয় ব্যয়বরাদ্দে ছাঁটাইয়ের চাপ এবং রাজস্ব আদায়ে যে আপেক্ষিক ‘উন্নতি’ দেখা যাচ্ছে তা কার্যত অত্যন্ত দুর্বল। অর্থনৈতিক পরিস্থিতির যে জায়গায় রয়েছে তাতে এমন বৃদ্ধিতে খুব একটা ভরসা করা চলে না। ২০২৩-২৪’র অর্থবর্ষে ৭.৩ শতাংশের যে বৃদ্ধি নিয়ে ঢাকঢোল পেটানো হচ্ছে সেসব আসলে বিশুদ্ধ কল্পকাহিনী। এমন অযৌক্তিক ভিত্তির উপর ভিত্তি করেই মুদ্রাস্ফীতির হার ২০২৩-২৪’এ মাত্র ১.৬ শতাংশে নেমে এসেছে। কনজিউমার প্রাইস ইনডেক্সের (সিপিআই) উপর ভিত্তি করে মূল্যস্ফীতির হারের সাথে এমন ধারনাটি কার্যত একেবারেই উল্টো। মুদ্রাস্ফীতির হার আসলে প্রায় ৬ শতাংশ এবং খাদ্যসামগ্রীতে তা প্রায় ১০ শতাংশ। মূল্যবৃদ্ধি রোধ করার জন্য রিজার্ভ ব্যংক অফ ইন্ডিয়া ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে রেপোরেটকে ৬.৫ শতাংশ আটকে রেখেছে। এটাই ভারতে মুদ্রাস্ফীতির আসল গল্প।
এমন খারাপ পরিস্থিতিতেও যেটুকু যা আয় (সরকারের) হয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার তার বেশিরভাগটাই ধনী ও বড় বড় ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর সুবিধায় উৎসর্গ করার মতলব করেছে। রাজস্ব এবং কর্পোরেট থেকে কর বাবদ আদায় এই সবে কোভিড-পূর্ব অবস্থায় ফিরতে শুরু করেছে। করের হার বৃদ্ধি পেয়েছে বলে এমন কিছু ঘটেনি বরং জাতীয় আয়ের মোট পরিমানে ধনীদের আনুপাতিক দখল বেড়েছে বলেই এমন পরিস্থিতি দেখা যাচ্ছে। অর্থশাস্ত্রের ভাষায় একে ‘কে’ (K) আকারের বৃদ্ধি বলে চিহ্নিত করা হয়। এমন বৃদ্ধির পরিস্থিতিতে গরীব মানুষকে বাড়টি কাজের বোঝা সহ্য করেও কম মজুরি পাওয়া মেনে নিতে বাধ্য করা হয়। এটি এক অন্তর্বর্তীকালীন বাজেট। আজকের ঘোষণায় যা রয়েছে তা কার্যত মোদীর প্রচারযন্ত্রের বিরাট মুখ থেকে নির্গত ফাঁপা আওয়াজ বৈ আর কিছুই নয়। ঐ আওয়াজ ঘোষণা করে শ্রমজীবী, দুঃস্থ-গরীব জনতাও নাকি উন্নয়নের কর্মযজ্ঞে অংশীদার। আমাদের দেশের প্রকৃত অবস্থাটি আসলে কেমন? দেশের জনসাধারণের এক বিরাট অংশকে পিষে-নিংড়ে নিয়ে গুটিকয়ের জন্য সুখবিলাসের বন্দোবস্ত, আরও আরও মুনাফা লুটের ব্যবস্থা।