প্রসূন ভট্টাচার্য
অধ্যাপক অমর্ত্য সেনের ‘হোম ইন দ্য ওয়ার্ল্ড: এ মেমোয়ার’ নামের যে বইটি এবার মুজফ্ফর আহমদ স্মৃতি পুরস্কার পেয়েছে তাতে ১৯৪৩ সালের বাংলার মন্বন্তর ও সংবাদমাধ্যম সম্পর্কে একটি শিক্ষনীয় গল্প বলেছেন তিনি। অন্য অনেকের মতোই নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ দৃঢ়ভাবে মনে করেন, বাংলার সেই দুর্ভিক্ষ ছিল ব্রিটিশ সরকারের তৈরি করা একটি ঘটনা। যুদ্ধে জাপান পূর্ব ভারতে ঢুকে পড়বে এই আশঙ্কায় এই অঞ্চলে খাদ্যের কৃত্রিম অভাব সৃষ্টি করা হয়েছিল সরকারী নীতিতে। ফলে লক্ষ লক্ষ মানুষ না খেতে পেয়ে প্রাণ হারিয়েছিলেন। কিন্তু যুদ্ধ চলছে বলে কথা, তাই ব্রিটিশ সরকারের ফতোয়ায় কোনো ইংরাজি সংবাদপত্র দুর্ভিক্ষের ভয়াবহতার কথা লিখছিল না। ঐ সময়ে মানুষের দুর্দশার সংবাদ লেখা মানে রাজদ্রোহীতা। ১৯৪২ সাল থেকেই সঙ্কটের শুরু, কিন্তু ১৯৪৩ সালে এসে কলকাতার রাস্তায় না খেতে পাওয়া মানুষের মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখে আর স্থির থাকতে পারেননি তৎকালীন দ্য স্টেটসম্যান পত্রিকার সম্পাদক ইয়ান স্টিফেন। তিনি নিজে ইংরেজ, কিন্তু শেষপর্যন্ত স্টেটসম্যানে চার্চিল সরকারের খাদ্যনীতিকে দায়ী করে দুর্ভিক্ষের কথা ছেপে দিলেন। এর ফলাফল কী হয়েছিল? দেরীতে হলেও ব্রিটিশ পার্লামেন্টে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয় এবং চার্চিল সরকার বাধ্য হয়ে ব্রিটিশ ভারতে খাদ্যনীতিতে কিছু পরিবর্তন আনতে বাধ্য হয়, কিছুটা হলেও সমস্যার সুরাহা হয়।
ঔপনিবেশিক ভারত তারপরে স্বাধীন হয়েছে, স্বাধীন ভারতের সংবিধানের ১৯(১) ধারায় বাক স্বাধীনতা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে, গণতন্ত্রকে মান্যতা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সংবাদমাধ্যমকে যদি সমালোচনামূলক দৃষ্টিতে স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশ করতে না দেওয়া হয় তাহলে মানুষের দুর্দশার কথা পাবলিক ডিসকোর্সে উঠে আসবে কী করে? পাবলিক পলিসি নির্ধারণে সরকারের জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতা পালন নিশ্চিত হবে কী করে? মিডিয়া যদি কেবল সরকারের প্রচারযন্ত্রে পরিণত হয়ে যায় তাহলে ত্রুটি চিহ্নিত করবে কে? বিরোধিতার জনমত তৈরি হবে কী করে? হ্যাঁ, মিডিয়া ছাড়াও স্বাধীন চিন্তা ও ভিন্ন মত প্রকাশের জন্য সমাজে নানা সংগঠন ও ব্যক্তি রয়েছেন, কিন্তু মিডিয়া ছাড়া তাঁদের বক্তব্যই বা প্রচারিত হবে কী করে!
দেশ স্বাধীন হওয়ার কয়েক বছরের মধ্যেই প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু এই জন্যই প্রথম প্রেস কমিশন গঠন করেছিলেন। প্রেসের স্বাধীনতা বজায় রেখে কীভাবে তাদের সদ্য স্বাধীন দেশের সমাজগঠনে শামিল করা যায় তার জন্যই সুপারিশ করতে বলা হয়েছিল সেই প্রেস কমিশনকে। সুপারিশে প্রেস কমিশনও কোথাও প্রেসকে সরকারী হাতে নিয়ন্ত্রণের কথা বলেনি, বরং সত্যিকারের স্বাধীন সাংবাদিকতা নিশ্চিত করতে ব্যবসায়িক মালিকগোষ্ঠীর হাত থেকেও প্রেসকে মুক্ত রাখার সুপারিশ করেছিল।
আজকে স্বাধীনতার ৭৫ বছরে দাঁড়িয়ে আমরা দেখতে পাচ্ছি, বিশ্ব ক্ষুধা সূচকে ভারত ১১৬টি দেশের মধ্যে ১০১তম স্থানে নেমে এসেছে। কমপক্ষে ৭১ শতাংশ ভারতবাসীর নাগালের বাইরে চলে গিয়েছে পুষ্টিকর খাবার। মন্দা আর মহামারীর ধাক্কায় বেকারী চরমে। আয় নিম্নগামী, জিনিসপত্রের দাম উর্ধগামী। এই দুর্দশার চিত্র সংবাদমাধ্যমে কোথায়? যদি মিডিয়া এই দুর্দশার বিবরণ, এর পিছনে সরকারের দায়িত্ব, এবং উত্তরণের উপায় সম্পর্কে কোনো দিশা না দেখাতে পারে তাহলে স্বাধীন দেশের স্বাধীন সংবাদমাধ্যমের গর্ব করে লাভ কি?
লাভ নেই। কারণ ভারতে এখন প্রেস স্বাধীনতাও তলানিতে। আন্তর্জাতিক সংস্থা ‘রিপোর্টারস উইদআউট বর্ডার’ এর সাম্প্রতিক সমীক্ষা রিপোর্টে বলা হয়েছে যে বিশ্বের ১৮০টি দেশের মধ্যে গণমাধ্যমের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে ভারত ১৫০তম স্থানে রয়েছে। ক্ষুধাসূচক আর প্রেসের স্বাধীনতা সূচকের এমন হাত ধরাধরি করে তলানিতে নামার পিছনে সংযোগগুলো বুঝতে কোনো অসুবিধা আছে? সেই ১৯৪৩ সালের কাহিনীর মতোই শোনাচ্ছে নাকি? তফাৎ কেবল এই যে এখন স্টেটসম্যানের সেই সম্পাদক ইয়ান স্টিফেনদের দেখা পাওয়া মুশকিল। মুশকিল তো হবেই, বর্তমান ভারতের সাহসী সাংবাদিকদের হয় জেলে পোরা হচ্ছে, নয়তো খুন হতে হচ্ছে। ইয়ান স্টিফেন সেই তুলনায় ভাগ্যবান, তিনি ইংল্যান্ডে ফিরে গিয়ে দিব্যি সম্মানের সঙ্গে শিক্ষামূলক কাজ করতে পেরেছিলেন।
আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে সংবাদপত্রগুলির সংগ্রামের গৌরবজনক কাহিনী রয়েছে। হিন্দু প্যাট্রিয়টের সম্পাদক হরিশ মুখার্জির ভবানীপুরের বাড়িতে এসে নীলচাষীরা নীলকর সাহেবদের অত্যাচারের কথা বলতেন। পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ নিয়ে হরিশ মুখার্জি তা ছাপতেন আর ব্রিটিশ সরকারকে জেরবার করতেন। দেশীয় ভাষার সংবাদপত্রগুলিকে নিয়ন্ত্রণের জন্য ব্রিটিশ সরকার কঠোর আইন চালু করলে অমৃতবাজার পত্রিকা রাতারাতি একদিনে বাংলা থেকে ইংরাজি পত্রিকায় পরিণত হয়েছিল, কিন্তু ব্রিটিশ বিরোধিতা বন্ধ করেনি। তিলক, গান্ধী, নেহরু সবাই সংবাদপত্রকে জাতি গঠনে ও জাতীয়তাবাদী আন্দোলন গঠনে ব্যবহার করেছেন। আর মুজফ্ফর আহ্মদের প্রচেষ্টার কথা তো আমরা সবাই জানি।
সেই দেশ স্বাধীনতা লাভের ৭৫ বছর উদযাপন করছে, স্বাধীন সাংবাদিকতাকে প্রায় কবরে পাঠিয়ে দিয়ে। জরুরী অবস্থার সময়েও ইন্দিরা গান্ধী প্রেসের স্বাধীনতাকে কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু পারেননি। জরুরী অবস্থার অবসানের সঙ্গে সঙ্গে স্বাধীন সাংবাদিকতা নিজেকে পুণঃস্থাপিত করেছে। এত সংগ্রামের ঐতিহ্য নিয়েও ভারতে সাংবাদিকতা এখন মুমুর্ষু। বিষয়টা শুধু সংবাদমাধ্যমের সঙ্কট নয়, গণতন্ত্রের সঙ্কট। স্বৈরতান্ত্রিকরা যা দেখাতে চান, যা বলতে চান কেবল সেটাই দেখান, সেটাই বলেন এবং হাততালি পেতে ভালোবাসেন। অন্যরা যা শুনতে চান, জানতে চান তার জবাব দেওয়া স্বৈরশাসকদের অভ্যাসের মধ্যে পড়ে না। হিটলারের শ্রোতাদের জন্য নির্দেশই ছিলো, ‘সি হিম, হিয়ার হিম, চিয়ার হিম’। আমাদের দেশের এবং রাজ্যের শাসকও এই ব্যবস্থাই কায়েম করেছেন।
তাঁরা দুরকমভাবে মিডিয়াগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করছেন। বাইরে থেকে নিয়ন্ত্রণ এবং ভিতর থেকে নিয়ন্ত্রণ। সরকারী প্রশাসন, পুলিশ, মামলা ইত্যাদি হাতিয়ারের মাধ্যমে মিডিয়ার কন্ঠস্বর নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে বাইরে থেকে নিয়ন্ত্রণ। এতে খানিক কোলাহল হয়, প্রতিবাদ হয়, সমাজে সমালোচনা হয়, সরকারের স্বৈরতান্ত্রিক রূপটা প্রকাশিত হয়ে যায়। কিন্তু দ্বিতীয় পদ্ধতিটা আরও মারাত্মক। এখানে মিডিয়ার মালিক নিজেই ব্যবসায়িক মুনাফা ও অন্যান্য অর্থনৈতিক কারণে সরকারের পক্ষাবলম্বী। আম্বানিদের রমরমা এখন মিডিয়া মালিকানাতেও। জি’র মালিক শাসকদলের ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী। প্রায় সব বড় মিডিয়ার মালিকই শাসকদের পক্ষে, ভারতের পটভূমিতেও এটা সত্যি, পশ্চিমবঙ্গের পটভূমিতেও তাই। এদের জন্য বাইরে থেকে শাসকের নিয়ন্ত্রণের দরকার কী? মিডিয়ার সাংবাদিকরা তো চাকরি করছেন, মালিকের নির্দেশমতো তাঁরা সংবাদ লিখছেন, দেখাচ্ছেন। এখানে শাসকের জয়গান ছাড়া আর কিছু প্রত্যাশা করা যায় নাকি!
অথচ সাংবাদিকতার শিক্ষার্থীদের শেখানো হয়, ‘জার্নালিজম ইজ পাবলিশিং সামথিং সামওয়ান ওয়ান্টস টু হাইড, এভিরিথিং এলস ইজ স্টেনোগ্রাফি’। সাংবাদিকতা হলো সেই সত্যকে প্রকাশ করা যা কোনো ক্ষমতাবান মানুষ লুকোনোর চেষ্টা করছে। বাকি সব কিছু নিছকই প্রচার। এখানেই সাংবাদিকতায় পেশাদারী দক্ষতা ও সাহসের প্রয়োজন। সাংবাদিকদের দেশপ্রেমের পরিচয় এখানেই। শাসকের প্রতি নয়, দেশবাসীর প্রতিই তার দায়বদ্ধতা। ব্যবসায়িক কাঠামোয় রমরমিয়ে চলা মিডিয়ায় সেই সাংবাদিকতার ঠাঁই কোথায়!