ভূমিকা
আজ ভারতীয় গণনাট্য সংঘের প্রতিষ্ঠা দিবস। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আবহে ফ্যাসিবাদ বিরোধী সংগ্রামের ঢেউ এসে আমাদের দেশেও ধাক্কা দেয়। সেই আন্তর্জাতিক আন্দোলনের প্রত্যক্ষ অংশীদার হিসাবেই ভারতে প্রগতি লেখক সংঘ ও গণনাট্য সংঘের ন্যায় সংগঠন গড়ে ওঠে।
ঐ ইতিহাস আজকের প্রজন্মের জন্য নিজেদের উত্তরাধিকার চিনে নেওয়ার দলীল।
১৯৩৫ সালের ২১জুন আন্তর্জাতিক প্রগতি লেখক সংঘের প্রথম অধিবেশনে ফরাসী সাহিত্যিক আঁদ্রে জিদ্’র বক্তৃতা ইউরোপের বিভিন্ন দেশে আলোড়ন তুলে দেয়। ঐ অধিবেশনের মূল উদ্যোক্তা ছিলেন ম্যাক্সিম গোর্কি, রম্যা রঁলা ও অঁরি বারবুস। শিল্প সাহিত্যে ব্যক্তি ও সমষ্টির ভূমিকা ও চিরায়ত মানবিক দায়বদ্ধতার প্রসঙ্গে জিদ্’র সেই বক্তৃতাই রাজ্য ওয়েবসাইটে আজকের প্রতিবেদন।
মূল বক্তৃতার বাংলা ভাষান্তর করেছিলেন অরুণকুমার মিত্র। সামান্য কিছু বানানের পরিবর্তন ব্যতীত আমরা সে বয়ানই ব্যবহার করছি। প্রতিবেদনের ইংরেজি শিরোনাম রাজ্য ওয়েবডেস্কের নিজস্ব।

আঁদ্রে জিদ্
কতকগুলো প্রচলিত ভুল ধারণা দূর করে দেওয়াই আমার এই বক্তব্যের উদ্দেশ্য।
এই সব ভুল ধারণার প্রথমটি হচ্ছে এই যে, জাতীয়তাবাদীরা প্রায়ই আন্তর্জাতিকতাকে ভুল বোঝে, তারা আন্তর্জাতিকতাকে নিজের দেশের প্রতি বিদ্বেষ, স্বদেশকে অস্বীকার ও অবহেলা করার সঙ্গে গুলিয়ে ফেলে। তারা ‘দেশপ্রেমিক’ কথাটাকে এত সঙ্কীর্ণ, এত অভিসন্ধিমূলক ও এত বিদ্বিষ্টভাবে ব্যবহার করে যে, তাতে কথাটার কদর্থই হয়। নিজের দেশকে ভালোবাসার প্রথম উপাদানই হচ্ছে অন্য দেশের প্রতি ঘৃণা-এ কথা মেনে নেওয়া আমরা কয়েকজন অসম্ভব মনে করি। আমার কথা বলতে পারি, আমি প্রখরভাবে ফরাসী থেকেও দৃঢ় আন্তর্জাতিকতাবাদী। ঠিক ঐ ভাবে, আমি একান্ত ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী হয়েও কমিউনিষ্ট দৃষ্টিভঙ্গীর সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত; প্রকৃতপক্ষে কমিউনিজম আমার ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের সহায়ক। আমি সব সময়েই বলেছি যে, প্রত্যেক ব্যক্তি তার স্বকীয় বৈশিষ্ট্য বজায় রাখলেই সমষ্টিকে প্রকৃষ্টভাবে সেবা করতে পারে। এরই সঙ্গে আজ ‘করোলারী’ হিসাবে জুড়ে দেওয়া যায় যে, এক কমিউনিষ্ট সমাজেই ব্যক্তি ও তার বৈশিষ্ট্যের সব চেয়ে বেশী বিকাশ হতে পারে, অথবা মাল্লার ভাষায় ‘কমিউনিজম ব্যক্তিকে বিকশিত করে’।
ব্যক্তির সম্বন্ধে যা সত্য, জাতি সম্বন্ধেও তাই। সোভিয়েট রুশিয়ার যে সব গুণের আমি প্রশংসা করি তাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ হচ্ছে-বিরাট যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে প্রত্যেক জাতি, প্রত্যেক ছোট রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্যের প্রতি শ্রদ্ধা-প্রত্যেক জাতি ও রাষ্ট্রের ভাষা, আচারব্যবহার, সংস্কৃতি ও নিজস্ব বৈশিষ্ট্যের প্রতি শ্রদ্ধা। সোভিয়েট যুক্তরাষ্ট্রকে প্রায়ই এই বলে ভর্ৎসনা করা হয় যে, সে তার বিশাল রাজ্যের সমস্ত অধিবাসীকে সমান করে ফেলতে চায়, একই স্তরভুক্ত করতে চায়; এবং পরে সমগ্র পৃথিবীকে নিয়ে তার এই খেলা খেলবার মতলব আছে। কিন্তু সোভিয়েট যুক্তরাষ্ট্রে বিভিন্ন জাতি ও রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্যের প্রতি যে শ্রদ্ধা দেখান হয় তাতে এ অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণিত হয়।
আমি সাহিত্যিক হিসেবে কথা বলছি এবং আমার মনোযোগ নিবদ্ধ রাখছি সংস্কৃতি ও সাহিত্যের প্রতি। কিন্তু অন্য সব ক্ষেত্র থেকে সাহিত্যের ক্ষেত্রেই ব্যষ্টির উপর সমষ্টির, ব্যক্তির মধ্যে সার্বভৌম মানবতার এই জয় ঠিকমত উপলব্ধি করা যায়। ত্রিশ বৎসরেরও বেশী আগে আমি বলেছিলাম, ‘সেরভান্তেস-এর চেয়ে কে বেশী স্পেনীয়, শেক্সপীয়রের চেয়ে কে বেশী বৃটিশ, গোগোলের চেয়ে কে বেশী রুশীয়, আর রাবুলে বা ভয়েরের চেয়ে কে বেশী ফরাসী-অথচ এঁদের চেয়ে একই বা বেশী সর্ব্বজনীন ও সার্ব্বভৌম?’ এই সব লেখকের প্রত্যেকেই নিজের বৈশিষ্ট্যের উপর দাঁড়িয়েছিলেন বলেই আমাদের সার্ব্বজনীন মানবতার রাজ্যে উত্তীর্ণ হতে পেরেছিলেন। সুতরাং আপনাদের আমি একজন ফরাসী হিসেবেই সম্বোধন করছি; এবং আমরা সকলে যে গুরুতর সমস্যার সম্মুখীন হয়েছি তাকে ফরাসী দৃষ্টিভঙ্গী দিয়েই বিচার করছি, যা করা আমার উচিত।
প্রথমে আমি আমাদের সাহিত্যকে সাধারণ দিক দিয়ে বিচার করব।
একটু আগে রাব্লের উল্লেখ করেছি। ফরাসী সুকুমার সাহিত্যে তিনি একটা দুর্দান্ত ভাবের প্রবর্তন করেছিলেন। আমি উপরে বলেছি যে, তিনি বিশেষভাবে ফরাসী ছিলেন, কিন্তু তিনি আরও বিশেষভাবে ছিলেন তাঁর যুগের লোক। প্রায় এই যুগের অব্যবহিত পরেই আমাদের সাহিত্য শান্ত, সংযত ও বিজ্ঞ হয়ে ওঠে। আমার কাছে সমগ্রভাবে ফরাসী সাহিত্যের বৈশিষ্ট্য এই মনে হয় যে, সে বস্তুনিরপেক্ষ রাজ্যে নিজেকে সর্বাঙ্গসুন্দর করতে চায়; সঙ্কট, দুর্ব্বিপাক ও জীবনের বাস্তব বিঘ্ন থেকে সে সরে থাকে।
বলা বাহুল্য, আমি উল্লেখ করছি সেই সাহিত্যের যাকে বলা হয় ‘ক্লাসিকাল’ সাহিত্য। এ সাহিত্যে গ্রন্থকার, দর্শক বা পাঠক এবং অভিনেতৃবর্গ (উপন্যাস বা নাটকের চরিত্র) সকলেই অভাব থেকে দূরে থাকেন। সাহিত্যিকের কাজ এখানে অর্থবানদের জন্যে অর্থবানদের কাহিনী রচনা করা; আর লেখক যদি হ’ন অভাবগ্রস্ত তবে তাঁকে সে কথা চেপে রাখতে হবে। আর যে দুর্গতি ভাগ্যবানদের সমৃদ্ধির ভিত্তি সে সম্বন্ধে মাথা ঘামানও আমাদের কাজ নয়। এই সব বিরক্তিকর সমস্যার সঙ্গে সাহিত্য ও উচ্চ চিন্তার কোন সংস্রব নেই। দৃষ্টান্ত স্বরূপ-রাসিনের চমৎকার নাটকগুলি শুধু কাঁচের ঘরে শোভা পাওয়ার মতন ফুল। যে সব মানুষের কথা ঐ নাটকগুলির বিষয়বস্তু তারা সকলে বিশ্রাম-ভোগী, বোদলেয়রের রচনায় তাদের আছে প্রচুর ‘সুরভিত অবসর’ (embalmed leisure); তাদের হাতে যথেষ্ট সময় এবং সে সময় তাদের প্রয়োজন হয় ইন্দ্রিয়, মন ও আত্মার বিকাশের জন্য।
এ সাহিত্য সম্বন্ধে রায় দেওয়া আমার উদ্দেশ্য নয়, কারণ এ সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ রচনাগুলির আমার চেয়ে বড় ভক্ত কেউ নেই। প্রাচীন গ্রীসের পর সাহিত্যকলার এমন উৎকর্ষ আর হয়নি। সম্প্রতি আমরা এমন কথা শুনেছি যে, সপ্তদশ শতাব্দীর এই সব রাজারাণীর সম্বন্ধে আমাদের আধুনিকদের কোন আগ্রহ থাকতে পারে না। যাঁরা একদিকে ঐ সব চরিত্রের কথা ও কাজের মাধুর্য্য হৃদয়ঙ্গম করতে পারেন না এবং অন্যদিকে যে আবেগ ঐ সব অভিজাত-চরিত্রের আভরণ সেই আবেগের অকৃত্রিমতাকে বুঝতে পারেন না, তাঁদের জন্যে আমি দুঃখিত। তথাপি, নাটকের সব লোকই সুবিধাভোগী। এই ধরণের লোক নিয়েই এই সাহিত্যের কারবার এবং শুধু এদের মস্তিষ্ক ও হৃদয়ের প্রতি তার দৃষ্টি নিবৃদ্ধ থাকায় এ সাহিত্য হয় বস্তুনিরপেক্ষ। আর্ট যখন জীবনের বাস্তবতা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে তখন তা হয়ে ওঠে কৃত্রিম। একমাত্র ল্যাটিন সাহিত্য এ বিষয়ে ক্লাসিকাল যুগের ফরাসী সাহিত্যকে হার মানায়। এ ছাড়া আমি এমন কোন ইউরোপীয় সাহিত্য জানি না যা ফরাসী সাহিত্যের চেয়ে বেশী প্রাণহীন, বাস্তব জগতের সঙ্গে যার সংযোগ এত কম। ফরাসী সাহিত্য অবিরতই স্বপ্নরাজ্যে নিজেকে হারিয়ে ফেলে। শক্ত জমির উপরের ভিত্তি থেকে, জনসাধারণের জীবন থেকে সাহিত্য শক্তি ও নব যৌবনাবেগ আহরণ করে। এ সম্বন্ধে গ্রীক কাহিনীর গভীর তাৎপর্য্যটি আমাদের মনে আসে- দৈত্য আন্টিযুসের চরণ যতবার ধরণীমাতার স্পর্শ পে’ত ততবার তার শরীরে শক্তির নববিকাশ হত; কিন্তু হারকিউলিস যখন তাকে শূন্যে তুলে ফেললেন তখন সে বিড়ালছানার মত দুর্বল হয়ে গেল। অষ্টাদশ শতাব্দীতে আমাদের সাহিত্য যখন একান্তভাবে চাইছিল জীবনের নব প্রবাহ, তখন সে প্রবাহ এসেছিল মঁত্রেস্কিয়্যের কাছ থেকে নয়, এমন কি ভলতেয়রের কাছ থেকেও নয়; এসেছিল সমাজের সাধারণশ্রেণীর লোক জ্যাঁ জাক্ রুসো এবং দিদেরোর কাছ থেকে।
ছাঁচ এবং সম্ভবত রূপের প্রতি অত্যধিক প্রীতির জন্যে ফরাসী সাহিত্য অনবরত কৃত্রিমতার রাজ্যে আকৃষ্ট হয়েছে। ক্লাসিক যুগের সাহিত্যের কৃত্রিমতা নষ্ট করবার জন্যে রোমান্টিসিষ্ট আন্দোলন যে চেষ্টা করেছিল তাতে আরও বেশী কৃত্রিম সাহিত্যেরই সৃষ্টি হয়েছিল। তা ছাড়া নতুন লেখকগোষ্ঠীর প্রধান প্রতিনিধিরা কেউই-লামার্তিন, ভিক্রি, এমনকি ভিক্তর য়্যুগো পর্যন্ত- এঁরা কেউই জনসাধারণের মধ্য থেকে উদ্ভূত হননি, কিংবা জনগণের তাজা রক্তের স্পন্দন জাগাতে পারেননি সাহিত্যে। অবশ্য য়্যুগো বেশ ভালই জানে, মুক্তি আস্বে কোন দিক থেকে। ম্যুগো যে জনসাধারণের সঙ্গে ভ্রাতৃত্ব স্থাপনের, জনসাধারণের নামে কথা বলার, তাদের প্রতিনিধিত্ব করার প্রবল, চেষ্টা করেছিলেন, তার কারণই এই। য়্যুগোর এই চেষ্টাই এখনকার দক্ষিণপন্থীদের কাছে অত্যন্ত বিসদৃশ এবং য্যুগোর নির্ব্বন্ধিতার প্রমাণস্বরূপ। আমিও অবশ্য মনে করি যে স্থাগোর সুবিধাবাদ এর একটা কারণ; কিন্তু সে সুবিধাবাদ গভীর সহজাত অনুভূতির ফল।
কৃত্রিমতার দিকে, ভণ্ডামির দিকে আমাদের সাহিত্যের এই গতির উপর আমি যে খুব জোর দিচ্ছি, এতে কি অতিরঞ্জন হচ্ছে? আমি মনে করি না। জোলার স্বভাববাদের (naturalism) পরেই যে প্রতীকপন্থী (symbolist) প্রতিক্রিয়া আরম্ভ হয়, তাতেও এই গতি লক্ষ্য করি। এমন কি জোলার মধ্যেও (যাঁর গুণ ও প্রাধান্যকে বহু সমালোচক অন্যায় ভাবে উপেক্ষা করেছেন) আমি দেখি বিষয়কে সংশ্লেষণ করবার, বস্তুনিরপেক্ষ করবার একটা ঝোঁক; এর ফলে তাঁর সমস্ত ‘বাস্তববাদ’ সত্ত্বেও তাঁর রচনা প্রেরণায় না হোক, ছাঁচে হয়েছে রোমান্টিসিষ্টদের অনুরূপ।
না, অতিরঞ্জন আমি একটুও করছি না; দক্ষিণপন্থীদের মধ্য থেকে একজন যে আমাদের সংস্কৃতির কৃত্রিমতা স্বীকার করেছেন এ জন্যে আমি আনন্দিত; তবে তিনি স্বীকার করেও সেই কৃত্রিমতাকেই সমর্থন করেছেন। মঃ তিয়েরি মলনিয়ের ‘আঁকসিয় ফ্রাঁসেজ’ পত্রিকায় লিখছেন, সভ্যতা হচ্ছে মিথ্যাচার। এ হচ্ছে স্বাভাবিক মানুষের স্থানে কৃত্রিম মানুষকে, নগ্নতার স্থানে পরিচ্ছদ, অলঙ্কার ও মুখোসকে চালাবার চেষ্টা। কিন্তু সভ্যতার এই স্বভাববিরোধী গতি, সভ্যতার এই অপূর্ব্ব মিথ্যাচারই সভ্যতার আসল উদ্দেশ্য, তার এবং আমাদের মহত্ব-এ কথা যে অস্বীকার করে সে সভ্যতার বিরোধী।’
আমি বলি, ‘না’। আমি বিশ্বাস করতে পারি না যে, সভ্যতাকে মিথ্যার উপর প্রতিষ্ঠিত থাকৃতে হবে। এই রকম সভ্যতা- যা নিজে চায় ভুয়া হতে এবং নিজেকে ঘোষণাও করে তাই বলে, যা মিথ্যাময় সামাজিক অবস্থার প্রতিচ্ছবি এবং ফল-এইরকম সভ্যতার মৃত্যুর বীজ নিজের মধ্যেই রয়েছে। যে সব রচনা সে এখনও সৃষ্টি করছে তা মৃতপ্রায়, যে সমাজ তাকে সমর্থন করছে তারই মতন মৃতপ্রায়। আমরা যদি এই কৃত্রিমতাকে নষ্ট না করতে পারি তবে আমরা মরব। কৃত্রিম আবেষ্টনীতে লালিত সংস্কৃতির দিন চলে গিয়েছে; যদি জাতীয়তাবাদীরা তাকে সমর্থন করেন তবে ভালই। তাতে আমরা পরিষ্কার ভাবে দেখতে পাই এবং বুঝতে পারি যে, সংস্কৃতির প্রকৃত রক্ষকেরা আজ তাঁদের দিকে নেই, তারা বিপরীত তীরে, বিপক্ষ শিবিরে রয়েছে। অবশ্য আমি বলতে চাই যে, এই সংস্কৃতিকে আক্রমণ করতে আমি আদৌ ইচ্ছুক নই, তার দানের আমি প্রশংসা করি। অতীতকে অস্বীকার করা বিফল ও হাস্যকর। এমন কি, এ কথাও আমি স্বীকার করব যে, যে সংস্কৃতির স্বপ্ন আমরা দেখছি তাকে অবিলম্বে উপযুক্তভাবে প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব নয় এবং এ সংস্কৃতির উপক্রমণিকারূপে একটা মিথ্যাচারী সংস্কৃতি প্রথমে নিশ্চয়ই আস্ব। তা ছাড়া, ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থা য়তই ঘৃণ্য মনে হোক, আমাদের ঈপ্সিত কমিউনিজমে পৌঁছবার পথে ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থা একটা আবশ্যকীয় পৰ্য্যায়।’
কিন্তু আমি জোর গলায় বলি যে সাহিত্য, সংস্কৃতি, সভ্যতা এই অতীত সংস্কৃতির বিরোধিতা করেই শুধু বিকশিত ও সমৃদ্ধ হ’তে পারে, এই সংস্কৃতির জের টেনে আর সে বাড়তে পারে না। উপরোদ্ধৃত প্রবন্ধ-রচয়িতা আমাকে তিরস্কার করে বলেছেন, আমি সংস্কৃতির শত্রু, কারণ আমি আন্তরিকতার দাবী নিয়ে যুঝি। আমার বৈরিতা আমাদের বর্তমান সংস্কৃতির বিরুদ্ধে নয়; সেই সংস্কৃতির ঝুটা রীতিনীতির বিরুদ্ধে। আমি দৃঢ়স্বরে বলি, তারাই হচ্ছে সংস্কৃতির শত্রু যারা মিথ্যাকে সমর্থন করে এবং সেই সঙ্গে আমাদের বর্তমান মিথ্যাচারী সমাজ-ব্যবস্থাকে সমর্থন করে, আমি দৃঢ়স্বরে বলি, সংস্কৃতির শত্রু আজ ফ্যাসিস্তরা, নাৎসীরা, এবং আমাদের স্বদেশের জাতীয়তাবাদীরা।
মঃ তিয়েরি মলনিয়ের উপসংহারে বলেছেন, ‘দুটোর মধ্যে একটাকে আমাদের বেছে নিতে হবে-হয় সভ্যতা, নয় আন্তরিকতা।’ আমি আবার বলি: আমি একথা মানি না যে, সভ্যতাকে কপট হতেই হবে (এই অভিমতের গূঢ় অর্থ স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে); অর্থাৎ অন্য কথায়, আমি মানি না যে মানুষ মিথ্যাবাদী হলেই শুধু সভ্য হতে পারে, নচেৎ নয়। আমি আন্তরিকতা সম্বন্ধে এই ধারণাটিকে খুব গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করি; কারণ ব্যক্তির মধ্যে তাকে আমি সীমাবদ্ধ রাখতে রাজী নই। আমার মত এই যে, সমগ্র সমাজটাই কপট, সে গণসাধারণের কণ্ঠরোধের চেষ্টা করে, গণসাধারণকে কথা বলার সমস্ত সুযোগ থেকে বঞ্চিত করতে চায়, সে গণসাধারণকে এমনভাবে দাসত্ব-শৃঙ্খলিত, এমন পশুবৎ ও এমন অজ্ঞ করে রেখেছে যে, জনগণ নিজেরাই জানে না, তারা আমাদের কাছে কি বর্তে চায়, যদিও জনসাধারণের ইচ্ছার সঙ্গে পরিচয় হ’লে যে কোন উৎকৃষ্ট সংস্কৃতিই লাভবান হ’তে পারে। আমার জীবনের প্রারম্ভ থেকেই আমি তৎকালীন জাতীয়তাবাদীদের মতের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছি; তারা বলল ‘মানুষের যা বলার আছে মানুষ তা সবই বলেছে। সুতরাং এখন থেকে সে নিজের কথার পুনরাবৃত্তি করতে পারে মাত্র।’ দুই শতাব্দী আগে ব্রুইয়ের এই সিদ্ধান্তে এসেছিলেন যে, ‘আমাদের আসতে বড়ই দেরী হয়ে গেছে। তার দুই’শ বছর পরে আজ আমরা আশা ও আকাঙ্খা পূর্ণ এক অজ্ঞাতের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে অনুভব করছি এক সমগ্র জগৎকে, যে জগতের মানুষ বীর্য্যবান, যৌবনোচ্ছল এবং নব নব সৃজন-প্রতিভায় মণ্ডিত। ব্রুইয়েরের দুইশ’ বছর পরে আজ এইভাবে অনুভব করা নিশ্চয়ই খুব অভিনব।
এখন একটু পেছিয়ে গিয়ে আবার সুরু করা যাক। সাহিত্য বলেই বোঝা যায় সংযোগ-স্থাপন। আমাদের জানতে হবে শুধু এই যে, সাহিত্য কার সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করছে। কোন কোন সাহিত্যে, বিশেষ করে ফরাসী সাহিত্যে আমরা একটা অদ্ভুত ব্যাপার দেখি। প্রতিভাশালী সাহিত্যিক অনেক সময় নিজের জীবিতকালে বেশী পাঠক পান না। তাহলে কি আমরা বলব যে, তিনি শুধু নিজের জন্যেই লিখছেন? না; স্থানের হিসেবে যে সংযোগ তিনি স্থাপন করতে পারলেন না, কালের হিসেবে তা স্থাপন করবার আশা তিনি করতে পারেন; তাঁর পাঠক-সম্প্রদায় ভবিষ্যতের মধ্যে বিস্তৃত। প্রথমে তাঁকে মনে হয় অদ্ভুত ও অতি অল্প লোকের বোধগম্য; তাঁর মূল্য বোঝা যায় না, তাঁর গুণ স্বীকৃত হয় না। আমি বোয়ের, র্যাঁবো, এমন কি স্তাদালএর মত লেখকদের কথা বলছি; স্তাঁদাল তো নিজেই বলেছিলেন যে, তিনি মুষ্টিমেয় পাঠকের জন্মে লেখেন এবং তাঁর প্রকৃত পাঠকরা এখনও জন্মায় নি। নিট্শে, উইলিয়াম ব্লেক, হারমান মেলভিল- এঁদের ভাগ্যও এই রকম হয়েছিল। মৃত্যুর পূর্ব্বে যে সকল লেখক উপযুক্ত সম্মান পাননি, তাঁদের শ্রেষ্ঠদের মধ্যে মাত্র কয়েকজনের নাম আমি উল্লেখ করলাম।
এঁদের প্রত্যেকের রচনাতেই যোগাযোগ স্থাপনের একটা সত্যিকার অন্তর্নিহিত শক্তি আছে, কিন্তু সে যোগাযোগ আশু নয়, কালের ব্যবধান পার হয়ে। এ থেকে আমি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হচ্ছি যে, কোন গ্রন্থকার প্রথমে বেশী পাঠক না পেলে তাঁকে আমরা অবজ্ঞা করতে পারি না।
আমি স্বীকার করছি যে, মস্কোতে লেখক সম্মেলনে বিভিন্ন ধরণের বহু শ্রমিক গ্রন্থকারদের সম্বোধন করে’ যে কথা বলেন আমি তাতে একটু পীড়া বোধ করেছিলাম; শ্রমিকরা গ্রন্থকারদের কাছে আবেদন জানিয়ে বলেছিলেন, ‘আমাদের কথা লিখুন, আমাদের চিত্র আঁকুন।’ দর্পণ হওয়া সাহিত্যের উদ্দেশ্য নয়, অন্তত সমগ্র উদ্দেশ্য নয়। এতদিন সোভিয়েট যুক্তরাষ্ট্র এই ভূমিকা নিয়েই সন্তুষ্ট ছিল এবং এই ভূমিকায় সে কতকগুলি উৎকৃষ্ট জিনিষও সৃষ্টি করেছে।
কিন্তু সাহিত্যের ঐখানে চুপ করে থাকলেই চলে না। এই নতুন মানুষ, যাকে আমরা ভালবাসি, যাকে আমরা কামনা করি, সে যাতে বাধানিষেধ, নিরর্থক সংগ্রাম ও কপটতা থেকে মুক্তি পায় সে জন্মে তাকে সাহায্য করার প্রশ্নই সাহিত্যের প্রধান কথা। নতুন মানুষের গঠন ও বৃদ্ধিতে সাহায্য করা প্রয়োজন। ঐ মস্কো কংগ্রেসে বুখারিন, গোর্কি নিজে এবং অন্য অনেকে চমৎকারভাবে এই কথাই ব্যক্ত করেন। সাহিত্য শুধু অনুকরণে তুষ্ট নয়, সে তথ্য দেবে, প্রস্তাব আনবে, সৃষ্টি করবে। অতীতের যে সকল শ্রেষ্ঠ লেখক তাঁদের জীবিতকালে সমাদর পাননি, কিন্তু আজ যাঁদের পাঠক-সংখ্যা বিপুল, তাঁরা মানুষের আত্মজ্ঞানকে বিশেষভাবে সমৃদ্ধ করেছেন নিজেরা অভূতপূর্ব্ব আত্মজ্ঞান উপলব্ধি করে- মানুষ তখন যেমন ছিল বা যেমন নিজেকে মনে করত সেই ভাবে তাঁকে আঁকলে তাঁরা কখনই এমন আন্তরিকতা অর্জন করতে পারতেন না তাঁদের এই আন্তরিকতাই মানুষের আত্মজ্ঞানের ভাণ্ডার সমৃদ্ধ করেছে। সংযোগ স্থাপনই অবশ্য লেখকের লক্ষ্য হবে, কিন্তু সব সময়ে প্রথম চেষ্টাতেই তিনি এতে সফল হবেন না। আমার নিজের কথা ধরুন (আমার নিজের সম্বন্ধে উল্লেখ করার জন্যে ক্ষমা করবেন): আমি জন্মে ও শিক্ষায় বুর্জোয়া হলেও আমার সাহিত্য-জীবনের প্রারম্ভ থেকেই অনুভব করতাম যে, আমার মধ্যে যা কিছু খাঁটি, যা কিছু মূল্যবান, যা কিছু সাহসিক, তার সঙ্গে প্রচলিত রীতিনীতি, অভ্যাস ও আমার পারিপার্শ্বিক মিথ্যাচারের ঠোকাঠুকি লাগছে। আমার মতে ‘আধুনিক ধনতান্ত্রিক সমাজে প্রকৃত সাহিত্যকে বিরোধিতার সাহিত্য হতে হবে, না হয়ে উপায় নেই।
সুতরাং বুর্জোয়া লেখকের পক্ষে তাঁর নিজের শ্রেণীর কাছে কথা বলা অসম্ভব। আর জনগণের কাছে কথা বলা আমি বলি সে-ও অসম্ভব। যতদিন জনগণ আজকের মৃত অবস্থায় থাকে, তারা যা হ’তে পারে, তাদের যা হওয়া উচিত এবং আমরা সাহায্য’ করলে তারা যা হবে তা যতদিন তারা না-হয়, ততদিন তাদের কাছে কথা বলা অসম্ভব। এ ক্ষেত্রে একমাত্র উপায় হচ্ছে ভবিষ্যতের অজ্ঞাত পাঠকের জন্যে লেখা, এই দৃঢ়বিশ্বাস নিয়ে লেখা যে আমাদের নিজেদের মধ্যে একবার যদি আমরা মানবসত্ত্বাকে গভীরভাবে উপলব্ধি করতে পারি তবে আমাদের কথা তার কাছে পৌঁছুবেই। সোভিয়েট্ যুক্তরাষ্ট্র আমাদের সামনে আজ অভূতপূর্ব্ব দৃশ্য ধরেছে, এর গুরুত্ব বিরাট, আশাতীত ও আদর্শস্থানীয়। এই সেই দেশ যেখানে লেখক সোজাসুজি তাঁর পাঠকদের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করতে পারেন। আমাদের যেমন স্রোতের প্রতিকূলে সাঁতার কাটুতে হয়, এখানে তার বদলে লেখককে শুধু স্রোতের মুখে গা ভাসিয়ে দিতে হয়। তাঁর চারিদিকের বাস্তবে তিনি একই সঙ্গে পান প্রেরণা, পদ্ধতি ও তাঁর রচনার প্রতিধ্বনি। এর বিপদও আছে নিঃসন্দেহ; কারণ আর্ট সৃষ্টির তাৎপৰ্য্যই হচ্ছে কোন বাধাকে জয় করা। কিন্তু এই নতুন ধরণের বিঘ্ন সম্বন্ধে পরে কথা বলার সময় পাওয়া যাবে। আমি নতুন সোভিয়েট্ সাহিত্যে প্রশংসনীয় সৃষ্টি দেখেছি; কিন্তু এখনও এমন রচনা দেখিনি যাতে নতুন মানুষ-যাকে এই সাহিত্য গড়ছে এবং আমরা যার প্রতীক্ষা করছি, সে মানুষ রক্তমাংসে পূর্ণাবয়ব হয়ে উঠেছে। এখনও আমাদের সানে রয়েছে সংগ্রাম, এখনও রয়েছে গর্ভধারণকাল ও প্রসব-বেদনা। আমি বিরাট পটভূমিকায় আঁকা নবকালের বার্তাবাহী রচনার জন্যে প্রতীক্ষা করছি, যে রচনার মধ্য দিয়ে লেখক বাস্তবকে অতিক্রম করে তার অগ্রদূত হবেন, বাস্তবকে পথ দেখিয়ে যাবেন আগে আগে।
আমরা আজও নতুন মানুষের আগমন প্রতীক্ষা করছি। আমাদের ক্লিষ্ট ও পীড়িত পাশ্চাত্যে হয় তো এখনও দীর্ঘকাল আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। তার প্রসবের বেদনা এখনও শেষ হয় নি। সংগ্রাম, যন্ত্রণা, প্রসব-বেদনা- এসব এমনি কিছু ভালো নয়, কিন্তু এদের মধ্যে দিয়ে যে জন্মের সূচনা হয় তারই জন্যে এরা ভাল।
প্রত্যেক স্থায়ী আর্ট-সৃষ্টিতে- নিত্য নব কামনা তৃপ্তি করতে পারে যে সব সৃষ্টি তাদের প্রত্যেকটিতে এমন কতকগুলো গুণ আছে যা কোন একটা শ্রেণীর বা একটা যুগের মানুষের প্রয়োজন মেটানর চেয়ে বড় ও শ্রেষ্ঠতর। যাঁরা এ বিষয়ে উৎকর্ষ দেখিয়েছেন তাঁদের রচনা পাঠে উৎসাহ দেওয়া নিশ্চয়ই ভাল। পুশকিনের লেখার পুনর্মুদ্রণ করে এবং শেক্সপীয়ারের নাটক অভিনয় করে’ সোভিয়েট রুশিয়া সংস্কৃতির প্রতি তার আন্তরিক অনুরাগের পরিচয় দিয়েছে। নিজের সাফল্যের মহিমা কীর্ত্তন করে ছাপা-খানা থেকে গাদা গাদা বই (যার অধিকাংশের হয় তো সাময়িক মূল্যের বেশী কিছু আর নেই; অবশ্য অনেক উৎকৃষ্ট রচনাও আছে), বার করার চেয়ে সংস্কৃতির প্রতি অনুরক্তির এ বড় প্রমাণ। তবে আমার মতে এতে একটা ভুল করা হচ্ছে, সে হচ্ছে ঐ সব শ্রেষ্ঠ রচয়িতাদের রচনায় কি কি জিনিষের প্রতি মনোযোগ দেওয়া উচিত তার উপর বেশী জোর দেওয়া, কি কি শিক্ষা তাঁদের রচনা থেকে আমরা নেব তা অযথা নিদ্দিষ্ট করে দেওয়া।
কারণ, যে কোন রচনা শিক্ষা দেয় সম্পূর্ণ তার সৌন্দর্য্যের দ্বারা; কোন একটা শিক্ষা নিতেই হবে বলে তন্ন তন্ন করে খোঁজার মধ্যে, রচনার প্রসাদগুণকে (quiétif) বাদ দিয়ে তার অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্যকে একমনে যাচাই করার মধ্যে আমি সৌন্দর্য্য সম্বন্ধে একটা অবজ্ঞা ও অজ্ঞতা দেখতে পাই। তা ছাড়া আমি মনে করি প্রত্যেককে তার নিজের রুচি, জ্ঞান ও বুদ্ধি অনুসারে শ্রেষ্ঠ রচনার ব্যাখ্যা করতে দেওয়া উচিত। ‘সরকারী’ শিক্ষা থেকে ভিন্ন রকম যদি কেউ নিয়মমাফিক বা কোন শিক্ষা পায় তা হলেও সে-ই হয়তো আসলে ঠিক হতে পারে; আর সে যদি ভুলও করে তবু তার ভুল গৃহীত মতের প্রতি অন্ধ আত্মসমর্পণের চেয়ে তার পক্ষে বেশী মঙ্গলকর। সংস্কৃতির লক্ষ্য মনকে মুক্ত করা, শৃঙ্খলিত করা নয়।
শুধু কমিউনিজমের শত্রুরাই কমিউনিজমের মধ্যে সকলকে এক ছাঁচে ঢালবার অভিপ্রায় দেখতে পায়। সোভিয়েট যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে আমরা যা প্রত্যাশা করি এবং যা কঠিন সংগ্রামকালে ও সাময়িক বিধি-নিষেধের (অবশ্য এর উদ্দেশ্য ছিল ব্যাপকতর মুক্তির ব্যবস্থা করা) পর আজ দেখতে পাচ্ছি তা হচ্ছে- এক সামাজিক রাষ্ট্র যেখানে প্রত্যেক মানুষ তার পূর্ণ বিকাশের সুযোগ পায়। আমাদের হতভাগ্য পাশ্চাত্যে আমরা অনেক পিছনে পড়ে আছি। তবে বর্তমান মুহূর্তে অন্তত সামাজিক প্রশ্ন সমস্ত বিষয়কে ছাঁড়িয়ে গেছে, কিন্তু এর কারণ এ নয় যে সামাজিক প্রশ্ন নিজগুণে আমাদের কাছে বেশী আগ্রহের বস্তু হয়ে উঠেছে, এর কারণ হচ্ছে এই যে সমাজের অবস্থার উপরেই সংস্কৃতির অবস্থা সম্পূর্ণরূপে নির্ভর করে। সংস্কৃতির প্রতি অনুরাগ আছে বলেই আমরা চলতে বাধ্য হচ্ছি: যতদিন সমাজ এখন যেমন আছে তেমন থাকবে ততদিন তার পরিবর্তনসাধনই হবে আমাদের প্রধান চিন্তা।
আজ আমাদের সমস্ত সহানুভূতি, যোগাযোগ স্থাপনের সমস্ত কামনা নির্যাতিত, প্রবঞ্চিত ও পীড়িত মানুষের দিকে ছুটেছে। কিন্তু মানুষের ক্ষুধা, যন্ত্রণা ও পীড়ন যখন থাকবে না তখন মানুষ আর আগ্রহ জাগাবে না, এ মত আমি মেনে নিতে পারি না।
আমি মেনে নিতে পারি না যে, মানুষ যতক্ষণ দুর্গত থাকে ততক্ষণই শুধু আমাদের সহানুভূতি পেতে পারে। এ কথা সত্যি যে, দুঃখ অনেক সময় আমাদের আত্মাকে মহত্তর করে। দুঃখ আমাদের ধ্বংস না করতে পারলে আমাদের দৃঢ়তর ও শ্রেষ্ঠতর করে। তবুও আমি ধ্যান করি, একান্তভাবে কামনা করি সেই সামাজিক অবস্থাকে যেখানে আনন্দ থেকে কেউ বঞ্চিত থাকে না। যে মানুষকে দুঃখের বদলে আনন্দই মহৎ করবে সেই মানুষের আগমন আমি প্রতীক্ষা করছি।