সীতারাম ইয়েচুরি
মহাত্মা গান্ধীর জন্মবার্ষিকীতে তাঁর হত্যাকারীরা আরো একবার বিরোধী বিতর্কের ঝড় তুলেছে। বামপন্থীদের বিরুদ্ধে মিথ্যা গুজব আর কটুক্তিতে পরিপূর্ণ একটি বই প্রকাশ করে, আরএএসের প্রধান গোয়েবেলসীয় প্রচারনীতিকেই নিখুঁতভাবে অনুসরণ করছেন যে যত বড় মিথ্যা এত বেশিবার বলো যাতে তা সত্যি বলে মনে হয়।
প্রধানমন্ত্রীর ধামা ধরে মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রী দেখা গেল সর্বোচ্চ আদালতের এনসিআরটির পাঠ্যসূচি সংক্রান্ত রায়ের সম্পূর্ণ অপব্যাখ্যা করলেন এবং তার মধ্যে দিয়ে অধুনা কুখ্যাত – ভারতীয় শিক্ষাব্যবস্থার সাম্প্রদায়িকীকরণের তিনি সমর্থন খুঁজছেন। পুনরাবৃত্তি হলেও একথা বলা দরকার যে সর্বোচ্চ আদালত এই কথা বলেছেন যে শিক্ষা সংক্রান্ত কেন্দ্রীয় মন্ত্রণাদাতা সংস্থা, সিএবিই, যেহেতু কোনো সংবিধান অনুমোদিত সংস্থা নয় (যার সাথে আলোচনা করা হয়নি), তাই সেকারণে পাঠ্যসূচি প্রণয়ন নীতিবিরুদ্ধ নয়, কিন্তু একই সাথে সর্বোচ্চ আদালত এও সতর্কবার্তা দিয়েছেন যে ধর্মীয় শিক্ষা প্রদান বিকৃতিপূ্র্ণ হওয়া উচিত নয়।
এক্ষেত্রে যে নির্লজ্জতা ঘটনাক্রমে প্রদর্শিত হয়েছে, তা অনেকটাই সেই বিকৃত শিক্ষাপদ্ধতির ফলাফল। আরএসএস প্রধান এতটাই অধঃপতিত হয়েছেন যে তিনি, একাই বামপন্থীদের টিকটিকির ল্যাজের সাথে তুলনা করেছেন। একথা মনে করিয়ে দেওয়া দরকার যে কিছু টিকটিকি প্রজাতিভুক্ত প্রাণীর হুলটাও ল্যাজেই থাকে। তাই, সাবধানে থাকবেন।
মানবসম্পদ মন্ত্রীও অভব্যভাবে বামপন্থীদের বৌদ্ধিক সন্ত্রাসবাদী বলে চিহ্নিত করেছেন। এমনকি তিনি পশ্চিমবঙ্গের জনগণকে ইতরভাবে অপমান করছেন কারণ তাঁরা সিকি শতাব্দী ধরে বামপন্থীদের নির্বাচিত করে আসছেন।
আরো যে সমস্ত কুৎসিত অভিযোগ বামপন্থীদের বিরুদ্ধে দেগে দেওয়া হয়েছে তা বমি উদ্রেক করে, কিন্তু তবুও তাদের মধ্যে অন্তত দু’টোর উত্তর দিতে হবে। প্রথমটি, ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে বামপন্থীদের ভূমিকা। দ্বিতীয়টা, উপমহাদেশের দেশভাগে বামপন্থীদের ভূমিকা।
স্বাধীনতা আন্দোলনে বামপন্থীদের ভূমিকা ইতোমধ্যেই তথ্যপ্রমাণ সহ সমৃদ্ধ এবং নথীবদ্ধ হয়েছে, বিশেষ করে উল্লেখের প্রয়োজন নয়। এটুকুই বললে যথেষ্ট হবে যে যখন ভারত ছাড়ো আন্দোলনের পঞ্চাশ বছর পালিত হচ্ছে তখন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি, ডাঃ শঙ্কর দয়াল শর্মা সংসদের মধ্যরাতের অধিবেশনে বলেছিলেন: ‘কানপুর, জামশেদপুর আর আহমেদাবাদের কারখানাগুলোতে ধর্মঘটের পর সেক্রেটারি অফ স্টেটকে দিল্লি থেকে লন্ডনে পাঠানো পাঁচই সেপ্টেম্বর, ১৯৪২ সালের একটি চিঠিতে, ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি সম্পর্কে জানানো হয় যে: ‘অনেক আগে থেকেই যেমনটা মনে হচ্ছিল করা গিয়েছিল, এখন এদের অনেক সদস্যের আচরণেই স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে, ব্রিটিশ বিরোধী বিপ্লবী সশস্ত্র সন্ত্রাসবাদীদের দ্বারাই দলটা তৈরি’।
অপরদিকে, ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে আরএসএসের ভূমিকা সকলের জানা গোপন কথা, যাকে বলে ওপন্ সিক্রেট। বোম্বের হোম ডিপার্টমেন্ট ১৯৪২ সালের ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সময়ে খেয়াল করেছিল যে সংঘ অত্যন্ত সন্তর্পণে আইন বাঁচিয়ে চলছে এবং অগাস্ট ১৯৪২ সালে যেখানে গণ্ডগোল ছড়িয়ে পড়ে সেখান থেকে নিজেদের বিযুক্ত রেখেছে।এমনকি নানাজি দেশমুখ, এই আন্দোলনের নেতা, এই প্রশ্ন তোলেন যে কেন আরএসএস সংগঠন হিসেবে স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগদান করেনি? গোড়া থেকে তারা রাজঅধিগ্রহে থাকা প্রদেশগুলোর সাথে বোঝাপড়া চালিয়ে যাচ্ছেন, যাঁরা নিজেরাও স্বাধীনতা আন্দোলনের অংশ হননি। তাঁদের মধ্যে একজন হলেন কাশ্মীরের রাজা হরি সিং , যিনি ভারতে যোগদানের বিষয়ে উদাসীন ছিলেন।
তাই, সকলেই দেখতে পারেন যে কারা স্বাধীনতা আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, আর কারা ব্রিটিশদের পদলেহন করেছে। ভারতীয় উপমহাদেশের বিভাজন বিষয়ে কমিউনিস্ট পার্টি একথাই বরাবর বলে এসেছে যে সাম্প্রদায়িক দেশবিভাজন একটি ভয়ঙ্করভাবে ক্ষতিকর ঘটনা। আজো এর ফলাফল বুঝতে পারা যাচ্ছে। দেশভাগ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী নীতির ফলশ্রুতি, যার মাধ্যমে ক্ষমতা ভারতীয় শাসকশ্রেণীর হাতে অর্পণ করা হয়েছিল।
কারা ব্রিটিশদের এই ঘটনা ঘটাতে সাহায্য করেছিল? যিনি প্রথম দ্বিজাতিতত্ত্বের ধারণা দিয়েছিলেন, তিনি আর কেউ নন, গৈরিক বাহিনীর স্বাভাবিক নায়ক, বা ‘বীর’ সাভারকার। জিন্না ও মুসলিম লীগের তিন বছর আগে হিন্দু মহাসভার সভাপতির ভাষণে তিনি বলেছিলেন আমরা হিন্দুরা নিজেরাই একটি জাতি… আমরা জাতি হিসেবে নিজেদের আলাদা করেছি’। পরে তিনি পুনরাবৃত্তি করে বলেন, ‘আমার মিঃ জিন্নার দ্বিজাতিতত্ত্বের সঙ্গে কোনো বিরোধ নেই। আমরা হিন্দুরা একটি জাতি এবং এটা ঐতিহাসিক সত্য যে হিন্দুরা এবং মুসলিমরা দুটি জাতি’।
ইন্ডিয়ান আ্যানুয়াল রেজিস্টার, ১৯৪৩, খণ্ড ২
যাঁরা দীর্ঘস্থায়ীভাবে ভারতীয় জনগণের স্বার্থের পরিপন্থী ছিলেন, তাঁরা এখন অহঙ্কারী ভঙ্গিতে যাঁরা দেশপ্রেম ও অগণিত আত্মস্বার্থ বিসর্জন দেওয়ার জন্য বিখ্যাত, যাঁরা বামপন্থী আন্দোলনের আলো জ্বেলে ছিলেন, তাঁদের নিয়ে কথা বলার চেষ্টা করছেন। তাই, এভাবেই সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিবাদী প্রচারসর্বস্বতা, যেমন দেখা যাচ্ছে, মিথ্যা ও বিকৃতির উপর ভর করে ভারতের সমৃদ্ধ ইতিহাসকে পরিবর্তিত করার চেষ্টার কসুর করে না। এর প্রয়োজন পড়ে, ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক চিত্রটা দ্রুত অসহিষ্ণু ফ্যাসিবাদী প্রবণতাসম্পন্ন হিন্দু রাষ্ট্রে বদলে দেওয়ার ক্ষতিকর প্রকল্পের অগ্রগতির স্বার্থে। কিন্তু তা হতে দেওয়া চলবে না।
২০০২ সালের ৬ই ডিসেম্বর তারিখে
পিপলস্ ডেমোক্রেসি পত্রিকায় প্রকাশিত সম্পাদকীয়, ২০০২ সাল
ভাষান্তরঃ নবারুণ চক্রবর্তী