সৌভিক ঘোষ
সোভিয়েত বিরোধী রাজনীতি দুভাবে নিজের প্রচার চালায়। প্রথমটি সরাসরি। শীতল যুদ্ধ-টুদ্ধ কোনও কাজের কথা না, আসলে তো যুদ্ধই। মেধা দিয়ে মোকাবিলা করতে গিয়ে ততদিনে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির চাপে ফিনান্স পুঁজির দমবন্ধ হয়ে আসছিল। বাবুর বায়না করা পালায় তাদেরই কাপড় ধরে টানাটানি পড়ছে দেখেই আসরে ভাঁড় নামিয়ে দেওয়া হল। সেই ভাঁড়ের কেতাবি নাম ফ্যাসিবাদ।
পরের কৌশলটি আরও চতুর। কিংবা ইতর। তার নাম ষড়যন্ত্র। নিজেরা যা করে সেটাকেই অন্যের ঘাড়ে চাপিয়ে দোষ দিতে পুঁজিবাদের জুড়ি নেই। আর তাই সম্পত্তি রক্ষায় মানুষের পবিত্র অধিকারের নামে শুরু হল ভিতর থেকে কুরে কুরে খেয়ে ফেলা। সমাজতান্ত্রিক নির্মাণের পথে প্রতিটি ভিন্ন মত, ভিন্ন প্রেক্ষিতকেই রুদ্ধস্বর বলে দাগিয়ে দেওয়ার শুরু তখন থেকেই। এভাবেই প্রচার চলেছে আন্তনিও গ্রামশি নাকি উপযুক্ত মর্যাদা পাননি, ট্রটস্কি’কে নাকি পেশাদার খুনি ভাড়া করে খুন করা হয়েছে। সেই তালিকায় রোজা লুক্সেমবুর্গ সবার উপরে।
সবার উপরে যে তিনি থাকবেন সেই ইঙ্গিত দিয়েছিলেন লেনিন নিজেই। ঈগল আকাশে থাকতে সবার উপর দিয়েই চলে। সেই উচ্চতার পরিমাপ করা এ লেখার প্রসঙ্গ নয়। ঈগল যখন অনেকটাই মাটির কাছাকাছি নেমে আসে, আমাদের আগ্রহ সেই পরিস্থিতিতে নিবিষ্ট।
কারাগার বিপ্লবীদের বিশ্ববিদ্যালয়। আবার সেই কারাগারে বিপ্লবীদের বন্দী করার সঙ্গে সঙ্গেই প্রতিপক্ষে থাকা শাসকও আটকে পড়ে। সেই ফাটক অদৃশ্য, কিন্তু লোহার গরাদের চাইতে বেশি কঠিন। একে ভয় বলে। যদি পালিয়ে যায়, যদি ছাড়া পায় তাহলে কি হবে এই দুশ্চিন্তা শাসককে কিছুতেই ঘুমোতে দেয় না। ফাটকের আরেকদিকে বিপ্লবীরা মাটিতেই ঘুমিয়ে যেতে পারেন, কারণ তাদের মগজকে আটকে রাখতে পারে এমন কারাগার কোথাও নেই।
১৯১৭ সাল নাগাদ লেখা দুটি চিঠি। আরেকটির তারিখ আজও অজানা। তিনটিই লিখেছিলেন রোজা লুক্সেমবুর্গ। প্রতিটি চিঠিই জেলে বসে লেখা হয়েছে। আজও যারা রোজাকে ফ্যান্টাসাইজ করেন, সমাজতান্ত্রিক নির্মাণের মৌলিক ভিত্তিগুলির বিরুদ্ধে তাকে ব্যবহার করেন এমন সবার জন্য এই তিনটি চিঠিই অবশ্যপাঠ্য।
১৯৫০ সালে হামবুর্গ থেকে জার্মান ভাষায় লেখা রোজা লুক্সেমবুর্গের চিঠিপত্রের একটি সংকলন প্রকাশ করেন বেনেডিক্ট কাউটস্কি । ১৯৫৪-এ সেই থেকেই কয়েকটি চিঠির ইংরেজি অনুবাদও বেরোয়। তা থেকেই তিনটি চিঠি আমরা বেছে নিয়েছি।
তিনটি চিঠির সম্পূর্ণ বাংলা অনুবাদ এই লেখায় থাকছে না। সেই সময়ের প্রেক্ষিত এবং চিঠির বয়ান থেকে বিশেষ কয়েকটি অংশই আমরা তুলে ধরব যাতে বোঝা যায় আসলে কেমন ছিলেন লেনিনের সেই ঈগল পাখি?
কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিক (৩য় আন্তর্জাতিক)-র বাসলে কংগ্রেস প্রথম বিশ্বযুদ্ধকে সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ বলে চিহ্নিত করে। এই যুদ্ধের সাথে সর্বহারার কোনও সম্পর্ক নেই- তাই এই যুদ্ধে পিতৃভূমি রক্ষার নামে শ্রমিকরা নিজেদের দেশের শাসক গোষ্ঠীর পক্ষে দাঁড়াবে না। এই যুদ্ধ পরিস্থিতির সুযোগকে কাজ লাগিয়েই দেশে দেশে গৃহযুদ্ধ পরিচালনার মাধ্যমে বিপ্লবী সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতে হবে। পরে রাশিয়া ও জার্মানির পার্টি ছাড়া আর কেউই সেই সিদ্ধান্তের মর্যাদা রাখেন নি। বাকি সকলেই (অন্যান্য দেশের সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টিগুলি) নিজেদের দেশের শাসক গোষ্ঠীর পক্ষ অবলম্বন করেছিল। জার্মানিতে রোজা এবং কার্ল লিবনেখ্ট জার্মান সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টির (এসপিডি) বামপন্থী বিপ্লবী অংশের (স্পার্টাকাস লিগ) নেতৃত্বে ছিলেন, তাঁরা প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির শ্রমিকশ্রেনিকে সমবেত করে ব্যাপক ধর্মঘটের আয়োজন করেন- জার্মানিতে সেই প্রচেষ্টা সফল হয়নি। ১৯১৬ সালের জুন মাসে তাঁরা দুজনেই গ্রেপ্তার হন, আড়াই বছরের জন্য কারাবাসের শাস্তি পেতে হয়। রাশিয়ায় যখন বিপ্লব সংগঠিত হচ্ছে তখনও রোজারা জেলেই ছিলেন, আন্দাজ করা কঠিন নয় সেই সময় ঐ অবস্থার মধ্যে কীভাবে এবং কতটুকু সঠিক খবর তাদের কাছে পৌঁছেছিল। একদিকে ইয়রোপীয় সোশ্যাল ডেমোক্র্যাসির শোভিনিজম সম্পর্কে তাদের অভিজ্ঞতা আরেকদিকে সঠিক তথ্যের অভাব দুয়ে মিলে রোজা’কে নভেম্বর বিপ্লবের ভবিষ্যৎ সাফল্য সম্পর্কে সন্দিহান হতে বাধ্য করেছিল। এমন সন্দেহ স্বাভাবিক, তবে সেকথা উপলব্ধি করতে গেলে বিপ্লবী জীবন সম্পর্কেও অবহিত থাকতে হয়- শুধু বই পড়ে সবটা হয় না।
লেনিনের সাথে রোজার বিতর্ক ছিল। প্রথমেও ছিল, পরেও ছিল। কমিউনিস্ট রাজনীতিতে সফল হতে ধরাবাঁধা হাতে-গরম সূত্র নেই, মার্কস-এঙ্গেলস অমন কিছু লিখে যাননি। তাঁরা দুজনে মিলে এমন এক দর্শনের নির্মাণ করেছেন যার প্রয়োগে বিপ্লবীকে নিজের দেশের বাস্তব পরিস্থিতি বিচার করতে হয়, সেই অনুযায়ী উপযুক্ত সিদ্ধান্তও গ্রহণ করতে হয়। এই প্রসঙ্গেই মনে রাখতে হবে বিপ্লব এমনই ব্যাপার যার সবটা ছাপার অক্ষরে প্রকাশিত পথে চলে না, যেকোনো সময় নতুন পরিস্থিতির বাঁক-মোড় ইত্যাদির বাধা পেরোতে হয়। তাই নির্দিষ্ট পরিস্থিতির সুনির্দিষ্ট বিশ্লেষণ। নিছক সূত্রায়নের তাড়নায় লেনিন একে মার্কসীয় বিশ্ববিক্ষার সারাংশ বলেননি।
সেই প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়কার রাশিয়া, জার্মানি। দুই দেশের সামাজিক, অর্থনৈতিক পরিস্থিতির পার্থক্য অনেক। জার্মানিতে প্রলেতারিয়েত উন্নত গণতান্ত্রিক বোধে সঞ্জাত, রাশিয়া তখনও ইয়োরোপের পিছনের উঠোন, পশ্চাৎপদ চাষাড়ে দেশ। এই দুই দেশে বিপ্লব কীভাবে অভিন্ন লক্ষ্যে বিভিন্ন রূপ নেবে তার রূপরেখা সবটা তৈরি ছিল না। রোজার সাথে লেনিনের বিতর্কের ভিত্তি ছিল এটাই। আজও সবটা আগে থেকে বোঝার উপায় নেই, যেটুকু আছে তা পৃথিবীর বুকে সংগঠিত সফল কিংবা ব্যর্থ বিপ্লবের অভিজ্ঞতা। লেনিন সফল হয়েছিলেন, রোজা পারেননি। আমাদের লেনিনের থেকেও শিখতে হয়, আবার রোজার কথাবার্তাও মনে রাখতে হয়।
জার্মানির সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি দুই না তিন ভাগে বিভক্ত হয়েছিল। এক অংশ যুদ্ধবাজ শাসকের লেজুড়ে পরিণত হল। এরাই দক্ষিণপন্থী সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট। দ্বিতীয় অংশ রোজা ও লিবনেখটের নেতৃত্বে স্পার্টাকাস লিগ, জার্মান সোশ্যাল ডেমোক্র্যাসির বামপন্থী অংশ। তৃতীয় আরেকটি অংশ নিজেদের ‘মেনশ্’ বলে চিহ্নিত করেছিলেন। এরা মধ্যপন্থী। সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী অবস্থান থেকে একশ আশি ডিগ্রি ঘুরে যে দক্ষিণপন্থীরা ‘দেশ যুদ্ধরত, তাই গোলমাল করা চলেনা’ বলে আওয়াজ তুলেছিলেন তাদের মতোই মধ্যপন্থী সুবিধাবাদী ‘মেনশ্’ দের প্রতিও রোজা নিজের ঘৃণা লুকিয়ে রাখেন নি। মতাদর্শের ক্ষেত্রে বিচ্যুতি তার অসহ্য ছিল। রোজা জেলবন্দী ছিলেন। গরাদের বাইরে যেটুকু সময় কাটানোর সুযোগ পেতেন নিজেকে খোলা হাওয়ায় তরতাজা করে নিতেন। ঐ অবস্থাতেই জেলের মাঠে একটি ছোটখাটো বাগানও বানিয়ে ফেলেছিলেন। বিকালে মাঠে ঘুরে বেড়ানোর সময় নিজের হাতে জল দিতেন সেই বাগানের ফুলগাছগুলিতে। রাত নটায় সেলের দরজা বন্ধ হত। স্যাঁতস্যাঁতে অন্ধকারে ডুবে যেতে হত। এমনই অবস্থায় ডিসেম্বর মাসের ২৮ তারিখ বন্ধু ম্যাটিল্ডে উর্ম’কে একটি চিঠি লেখেন তিনি। উর্ম ও তার স্বামী ইমানুয়েল ততদিনে নিজেদের ‘মেনশ্’ বলে জাহির করতে শুরু করেছেন। জার্মান ভাষায় ‘মেনশ্’-র অর্থ হল সৎ। বন্ধুদের এহেন সততাকেই দুরমুশ করে দেন রোজা লুক্সেমবুর্গ।
এক জায়গায় লিখেছেন- ‘তুমি চিঠিতে বলেছ আমি নাকি তোমাদের মধ্যে যথেষ্ট আগুন দেখতে পাই না। তোমরা যে আদৌ এগিয়ে চল না, এগোনোর নামে যা করো তাকে আমি হামাগুড়ি দেওয়াই বুঝি। তোমার মনে হয়েছে আমার এই মতামত বিপ্লবী চেতনা সম্পর্কে ভিন্ন স্তরের প্রশ্নে সন্নিবিষ্ট। না হে! আমি যে তোমাদের বিপ্লবী মনেই করিনা! তোমাদের জাতই আলাদা! তোমাদের মত এত ক্লীব, এত নিস্তেজ, এত ভীতু এবং এত বেশি শিথিলতার দোষে দুষ্টদের আমি আজ যতটা ঘৃণা করি তেমনটা আগে কখনো অনুভব করিনি জানো! আসলে তোমরা সেই মুদির দোকানের মালিকের মতোই! সেই দোকানদারও যথেষ্ট সাহস দেখাতে রাজী, অবশ্য তার বিনিময়ে উপযুক্ত মুনাফা যদি মেলে- তবেই। তোমরা ভুলে গেছ বিকিকিনির হাট সাজিয়ে নায়কের মর্যাদা জোটে না। তোমাদের অবস্থা কেমন জানো? নিজেদের সৎ বলে জাহির করছ তো? সৎ কারা জানো? ‘হিয়ার আই স্ট্যান্ড, আই ক্যাননট ডু আদারওয়াইজ, সো হেল্প মি গড’– এইটে হল সততা। এসবের তিলমাত্রও তোমাদের যোগ্যতায় কুলোবে না ভাই!’
ম্যাটিল্ডা, রোজাকে চিঠি লিখে বড়দিনের শুভেচ্ছা জানিয়েছিলেন। তারই জবাব দিতে বসে রোজা লিখছেন, বা বলা চলে সুবিধাবাদের ব্যবচ্ছেদ করছেন এই বলে- ‘তুমি, তোমার আজকের সঙ্গীসাথীরা সকলেই নাকি মেনশ্। যদি সত্যই মেনশ্ হতে চাও তবে তার অর্থটুকু অন্তত হৃদয়ঙ্গম করতে চেষ্টা করবে এই আশা করি। একসময় তুমি আমি একসাথে নীল আকাশের নিচে হেঁটে বেড়াতাম। দুজনে একসাথে সন্ধ্যার আকাশকে লাল হতে দেখেছি কতদিন। মনে আছে নিশ্চয়ই। সেই লাল আকাশের কথা স্মরণে রেখেই বলছি এই পৃথিবীতে বিপদ অজস্র, তবু আমি চাই যেখানে যত সুবিধাবাদী রয়েছে সকলে ধ্বংস হোক। তারা না থাকলেও এই দুনিয়ার সৌন্দর্য এতটুকু কমবে না। আর মনে রেখো, আজ অথবা কাল মুক্ত আমি হবই। সেইদিন আমার গলার আওয়াজে তোমাদের মত কুয়োর ব্যাঙেরা গোপন আস্তানা ছেড়ে বেরিয়ে আসতে বাধ্য হবে। আমি তোমাদের জন্য ইলিয়াডের পেন্থেসিলিয়াই হতাম, কিন্তু কি আর করি বলো! তোমরা যে অ্যাকিলিস হলে না! যাই হোক, আমাকে বড়দিনের শুভেচ্ছা জানিয়েছিলে। আমিও আজ তোমাকে নিজের অন্তর থেকে নতুন বছরের শুভেচ্ছা জানালাম। তুমি আজ যা হয়েছ- সেই ক্লীবতা, সেই শিথিলতাকেই আমি তোমার পক্ষে সততার সর্বোচ্চ নিদর্শন বলে ধরে নিলাম।’
দ্বিতীয় চিঠিটি হ্যান্স ডিফেনবাখের উদ্দেশ্যে লেখা। ডাক্তার মানুষটি রোজার বিশেষ অন্তরঙ্গ একজন ছিলেন। এই চিঠিটি বিপ্লবী চেতনার এক বিশেষ অভ্যাসের পরিচয় দেয়। আগাগোড়া নিজের ভালোবাসার কথা বলতে চাইছেন, কিন্তু চলে আসছে অন্য কথা। রোজা লুক্সেমবুর্গের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক লেখালেখি পড়লে সাধারণ পাঠক তাকে সহজ মানবিক আবেগ বিবর্জিত এক আগুনখেকো বাগ্মীই ভাববেন। এই কারণেই রোজার ব্যক্তিত্বের সন্ধান পেতে তাঁর লেখা চিঠিপত্রগুলির চর্চা একান্ত জরুরী। সকাল সকাল লিখতে বসে হ্যান্স’কে রোজা তার একাকিত্বের কথা জানাচ্ছেন। সেই অনুভব এই জন্য না যে সন্ধ্যা নামলেই তাকে সেলের চার দেওয়ালে ঢুকে যেতে হয়। বন্দী জীবনের সমস্তটুকু জুড়েই তিনি যাপন করছেন সেই একাকী সত্ত্বা। কেমন সেই যাপন? – ‘আড়াল থেকে যে সমস্ত শব্দ ভেসে আসে, আমাদের উপরে তাদেরই প্রভাব পড়ে বেশি। তুমি নিশ্চয়ই আমার মতোই ভাবো। যখন জ্যুইকো’তে ছিলাম প্রতি রাতে একজোড়া হাঁসের আওয়াজে আমার ঘুম ভাঙত। অদ্ভুত ব্যাপার, সারাটা দিন ওদের এতটুকু সাড়াশব্দ পেতাম না। রাত হলেই সেই একই ব্যাপার। মাঝরাতে কাঁচাঘুম ভেঙ্গে উঠে ধাতস্থ হতে আমার কিছুটা সময় যেত, ধীরে ধীরে মনে পড়ত, আরে আমি তো জেলে রয়েছি- ঐ যে গরাদ আমার সীমানা, সামনের জানলাটা আমার উপরে শীতল বাতাস ছুঁড়ে দেয়। নিস্তব্ধ কারাগারে হাঁসদুটোর ঐ একঘেয়ে আওয়াজই আমাকে বারে বারে মনে করিয়ে দিত, আমি বন্দী।
বার্নিমস্ট্রাস কারাগারে আবার অন্য ব্যাপার! রাত হলেই একটি শিশুর গুমরে ওঠা কান্নার শব্দ ভেসে আসতো, রোজ- প্রায় একই সময়ে। বেশ কিছুক্ষণ সেই কান্নার পরেই শোনা যেত হালকা কিন্তু দ্রুত পায়ের শব্দ। শিশুটিকে প্রথমে শুয়ে পড়তে অনুরোধ করা হবে, তার পরেই দ্বিতিয়জনের গলায় ভর্ৎসনা শোনা যাবে! এখনও ঘুমিয়ে যাওনি কেন? এবার ছোট্ট গালের উপরে সপাটে দুটি চড়ের আওয়াজ- আবার আমার চারপাশটা নিস্তব্ধ হয়ে উঠবে। নটা বাজলেই এই ছিল আমার রোজকার ঘটনা। কেমন একটা অভ্যাস হয়ে গেছিল জানো! আমি যেন গালে চড় মারার আওয়াজের জন্যই অপেক্ষা করতাম। শিশুর মুখটি নিশ্চয়ই মারের চোটে লাল হয়ে উঠত। আমার মনে হত এই যে আঘাতের দ্বারা এক দীর্ঘ সমস্যার সমাধান, এ হল মানবসমাজের একটি প্রাচীনতম রীতি।’
রোজার এমন অনুভূতি আমাদের মনে করতে বাধ্য করে ফ্রেডেরিক এঙ্গেলসের লেখা ইতিহাসে বলপ্রয়োগের ভূমিকা (রোল অফ ফোর্স ইন হিস্ট্রি)-কে। শুধুমাত্র অজ্ঞানতার জন্য কেউ কেউ বিশেষ প্রয়োজন কিংবা জরুরী পদক্ষেপ নিতে দ্বিধায় পড়েন, দোলাচলে আক্রান্ত হন। বিপ্লবী রোজা কি তাদেরই ইঙ্গিত করছেন?
এ চিঠির শেষ অংশটি আমাদের পরিচয় দেয় আপাদমস্তক এক মানুষ রোজা’র। নিজের পছন্দের মানুষের জন্য চিঠি লিখতে বসেছেন, অনেক কথা এমনকি বিখ্যাত কবিতা থেকে নাতিদীর্ঘ কয়েকটি পংক্তি অবধি লিখে ফেলেছেন- অথচ আসল কথাটুকুই বলা বাকি রয়ে গেছে! এমন অবস্থায় হ্যান্স’কে বলছেন- ‘দোহাই তোমার! আমি একটু বেশি কথা বলে ফেলছি, তুমি আবার এমন বকবকের অভ্যাস করে ফেলো না! বিশ্বাস করো, আর কোনোদিন আমায় এমন বিহ্বল অবস্থায় দেখবে না।’
স্বাভাবিক মানুষই এক দীর্ঘ প্রক্রিয়ায় বিপ্লবী হয়ে ওঠেন। আজকের মরচে ধরা লোহার টুকরোই আগামীর ইস্পাতে পরিণত হয়। তবু মানুষ তো! নিছক ইস্পাত হলে অন্য কথা ছিল, মানুষ বলেই তার মনের কোথাও একটু বিহ্বলতা, কিছুটা ভাবপ্রবণতা বোধহয় থেকেই যায়, সেটাই হয়ত স্বাভাবিক। বিপ্লবী মানেই মানবস্বভাব ত্যাগী অন্য গ্রহের জীবের বর্ণনা দেন যারা, তাদের মনে রাখা উচিত বিপ্লব ব্যাপারটা আদ্যন্ত মানবিক। পশু কিংবা যন্ত্রের বিপ্লব করতে লাগে না। হয়ত নানা কথার ফাঁকে এই চিঠিতে তিনি সেদিকেই ইশারা করে গেলেন। লেনিনের যুক্তিকে প্রাধান্য দিয়ে গড়ে ওঠা পার্টি সংগঠন সম্পর্কে ভিন্নমত পোষণ করেছিলেন রোজা- তখনও কি এমনই কিছু বলতে চেয়েছিলেন? এসবের উত্তর খোঁজার কাজ আজও চলছে।
শেষ চিঠিটি লেখা হয়েছিল মার্তা রোজেনবাম’কে। মার্তা ছিলেন রোজার ঘনিষ্ঠ সহযোদ্ধা। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানির বামপন্থী সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটদের মধ্যে তারও গুরুত্বপূর্ণ সক্রিয় ভূমিকা ছিল। ১৯৪০ সালে তাঁর আকস্মিক মৃত্যু হয়। মৃত্যুর সঠিক কারণ এখনও জানা যায় না। মার্তা’কে লেখা চিঠির একটি অংশ বিশেষ উল্লেখযোগ্য-
‘কঠিন সময়েই ইতিহাস আমাদের জন্য শ্রেষ্ঠ পরামর্শদাতা হিসাবে হাজির হয়। জেলে বন্দী অবস্থায় নিজের জন্য বিশেষ কোনও সুবিধা আদায় করে নেওয়ার পক্ষে যুক্তি সাজাতে আমি একথা বলছি না। আমি বলতে চাইছি, কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি দাঁড়িয়েও মানুষের উচিত নিজের ইচ্ছাকেই সর্বোচ্চ স্তরে উদ্দীপিত রাখা। আমাদের সমস্ত শক্তি দিয়েই সচেতন সংগ্রামে যুক্ত থাকাই আমাদের প্রধান কর্তব্য। জনসাধারণের উপরই এমন সচেতন প্রভাবের সাফল্য নির্ভর করে। যখন সবদিকেই ব্যাপক হতাশা বিস্তৃত রয়েছে, ঠিক তখনই ইতিহাসের বসন্তকালকে চিনে নিতে হয়। ইতিহাসের শিক্ষা এই যে কঠিন সময়েই তেমন এক মোড় নিজেকে সামনে এনে হাজির করে। সেই সন্ধিক্ষণ হিংসাত্মক নিশ্চয়ই। ভুলে গেলে চলে না, মানুষের ভবিষ্যৎ বস্তুগত ঐতিহাসিক নিয়মেই নির্ধারিত হয়। কখনও কখনও সেইসব নিয়মাবলী প্রগতির সমস্ত খুঁটিনাটি অনুসরণ করে না ঠিকই। কিন্তু সেইসব খুঁটিনাটি আসলে আমাদেরই সীমাবদ্ধতা- এও তো ঠিক। আমরাই চিহ্নিত করেছি এমনটা হলে অবশ্যই তেমন হবে। কিন্তু জানার ক্ষেত্রে শেষ কথা যে নেই। তাই বলি, কমরেডরা মাথা উঁচু করে সাহস রেখে এগিয়ে চলুন। আপনারা এগোবেন আমি নিশ্চিত, আর তাই আপনাদের সংগ্রামের প্রতি আমি অকুণ্ঠ সমর্থন জানাই।’
আজকের পৃথিবীতে রোজা লুক্সেমবুর্গ প্রতিক্রিয়ার শক্তির না হোক, কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের মধ্যে নির্দিষ্ট কিছু গোষ্ঠীর হাতে উপদলীয় কাজের অজুহাত তো বটেই। তারা এক সহজ কথা ভুলে যান, রোজা বিপ্লবী ছিলেন। সেই বিপ্লবী নিজের লক্ষ্যে অবিচল ছিলেন, শেষ অবধি। মৃত্যুমুখে পতিত হয়েও রোজার লড়াই সর্বহারা বিপ্লবের ইতিহাসে ঈগলের উচ্চতার মর্যাদায় আসীন। কেউ কেউ রোজা’কে মেয়েদের লড়াই প্রসঙ্গে আটকে রেখেই বিবেচনা করতে চান। একটি সহজ ভুল তাদেরও হয়, যে সমাজকাঠামোয় বেশিরভাগ নারীর চেতনা সঠিক অর্থে মুক্ত নয়, সেই একই সমাজে পুরুষ কিছুতেই নিজেকে প্রকৃত অর্থে স্বাধীন করতে পারে না- একথা যেমন ঠিক তেমনই সঠিক রোজা লুক্সেমবুর্গ অন্য কিছুই নন, তিনি আদ্যন্ত মার্কসবাদী। এটুকু ভুললে চলে না।
১৫ই জানুয়ারি, ২০২৩ মার্কসবাদী পথ ওয়েবসাইটে প্রকাশিত প্রবন্ধ (https://marxbadipath.org/article/3-letters-or-rosa/104)