সুমিত গঙ্গোপাধ্যায়
১৮৭১ সাল। প্যারি কমিউনের ঐতিহাসিক লড়াই শেষ হয়েছে তিন মাসও কাটেনি। সেই সময় ১৫ই আগস্ট প্রথম আন্তর্জাতিকের সাধারণ সভার মিটিং বসেছে। সেই সভায় সভাপতি সহ ২০ জন সদস্য ও ১১ জন ‘অতিথি'(visitor)- এর উপস্থিতিতে একটি চিঠি পাঠ করা হয়েছিল। সভায় অন্যান্যদের সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন কার্ল মার্কস ও ফ্রেডরিক এঙ্গেলস।
চিঠিটি গিয়েছিল কলকাতা থেকে। মার্কস এবং এঙ্গেলসের উপস্থিতিতে চিঠিটি পাঠ করা হয়।
সোভিয়েত ইউনিয়নের মস্কোয় অবস্থিত মার্কসিস্ট-লেনিনিস্ট ইনস্টিটিউট থেকে সংকলিত ও প্রগতি প্রকাশনী, মস্কো থেকে প্রকাশিত ‘ডকুমেন্টস অফ দ্য ফার্স্ট ইন্টারন্যাশনাল’ এর ২৫৮ পৃষ্ঠায় লেখা আছে
‘……..পূর্ববর্তী সভার কার্যবিবরণী পড়া এবং নিশ্চিত হওয়ার পর সেক্রেটারি ঘোষণা করেন যে লিসেস্টারশায়ারের লিভারপুল এবং লাবার্গে শাখা গঠন করা হয়েছে। তিনি ভারতে একটি বিভাগ চালু করার অনুমতি চেয়ে কলকাতা থেকে লেখা একটি চিঠিও পড়েন। সেক্রেটারিকে একটি শাখা প্রতিষ্ঠার বিষয়ে লিখতে এবং পরামর্শ দেওয়ার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল, তবে তিনি লেখককে যেন অবহিত করেন যে এটিকে অবশ্যই স্বাবলম্বী (self-supporting) হতে হবে। তিনি অ্যাসোসিয়েশনে স্থানীয় মানুষদের সদস্য করার প্রয়োজনীয়তার প্রতিও আহ্বান জানান।’
পরবর্তীকালে চিন্মোহন সেহানবিশ একটি সম্ভাব্য তালিকা তৈরি করেছিলেন, যে এই চিঠিটি কে পাঠিয়ে থাকতে পারেন। তিনি তালিকায় বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের নাম প্রথমেই উল্লেখ করেন সম্ভবতঃ বঙ্কিমের সাম্য ও বিড়াল প্রবন্ধের জন্য। এর মধ্যে সাম্য প্রবন্ধে সুবিস্তারে সাম্য সংক্রান্ত ধারণা, বুদ্ধ থেকে যীশু হয়ে রুশো, প্রুধো, মিল, ওয়েন, ফুরিয়র, কমিউনিজম, সাঁ সিমোঁর মতবাদ, ফরাসি বিপ্লব, সম্পত্তি সম্পর্ক, তার ব্যবহার, ভারতের কৃষকের অবস্থা, স্ত্রীদের অবস্থা, সবকিছু নিয়ে আলোচনা করেন।
এছাড়া জেমস লং যেহেতু ১৮৬১ সালে নীল দর্পণ অনুবাদের দায়ে জেল খাটতে হয়েছিল, তাই তাঁকেও সম্ভাব্য লেখক হিসাবে ধরেছেন।
এবাদেও প্যারি কমিউনের সমর্থক ও কৃষ্ণনগর কলেজের অধ্যক্ষ Lobbe যিনি পজিটিভিস্ট ছিলেন তাঁকেও তালিকায় রাখেন চিন্মোহণ সেহানবীশ।
এবার কেশব চন্দ্র সেন সম্পর্কে ১৮৭১ সালের আগস্ট মাসে অমৃতবাজার পত্রিকা একটি প্রতিবেদনে জানায় যে কলকাতার কিছু বিশিষ্ট নাগরিক একটি পিপলস অ্যাসোসিয়েশন তৈরি করার পরিকল্পনা করেছেন। পরের বছর ১৮৭২ সালে অমৃতবাজার পুনরায় জানায় যে ১৮৭০ সালে কেশব যখন বিলেত যান, তখন সেখানকার কিছু চিন্তাবিদ তাঁকে কলকাতায় একটি পিপলস অ্যাসোসিয়েশন তৈরি করার পরামর্শ দেন ফলে তাঁকেও তালিকা থেকে বাদ দিতে পারেননি।
একই রকমভাবে শিবনাথ শাস্ত্রী এবং শশিপদ ব্যানার্জি মিলে যেহেতু ১৮৭৪ সালে শ্রমজীবী সমিতি তৈরি করেন, এবং দেশের প্রথম শ্রমিক পত্রিকা প্রকাশ করেন ১৮৭৪ সালের মে মাসে, তাঁদের ও বাদ দেননি।
কিন্তু আসলে চিঠিটি কে লেখেন?
বলা খুব মুশকিল। চিঠিটির বয়ান সম্পর্কে ‘ডকুমেন্টস অফ দ্য ফার্স্ট ইন্টারন্যাশনাল’ এর ৫৩০ পৃষ্ঠায় ২৭৬ নম্বর টিকায় লেখা আছে…..’দ্য ইস্টার্ন পোস্ট নং ১৫১, আগস্ট ১৯, ১৮৭১-এ প্রকাশিত এই কাউন্সিল সভার সংবাদপত্রের প্রতিবেদনে কলকাতা থেকে প্রাপ্ত একটি চিঠির অংশ উদ্ধৃত করা হয়েছে যেখানে বলা হয়েছে: ‘জনগণের মধ্যে ব্যাপক অসন্তোষ রয়েছে এবং (তাঁরা) ব্রিটিশ সরকার সম্পূর্ণরূপে অপছন্দ করে। করের পরিমাণ অত্যাধিক এবং একটি ব্যয়বহুল সরকারী ব্যবস্থা বজায় রাখার জন্য রাজস্ব গলধঃকৃত হয়। অন্যান্য জায়গার মতো শাসক শ্রেণীর অতিরিক্ত উগ্রতা শ্রমিকদের শোচনীয় অবস্থার সঙ্গে বেদনাদায়কভাবে বিপরীতে অবস্থান করে, (সেই শ্রমিক) যাদের শ্রম সম্পদ সৃষ্টি করে। ইন্টারন্যাশনালের নীতি জনগণের বড় অংশকে তার সংগঠনের মধ্যে আনবে যদি একটি শাখা চালু করা হয়।’
এটা সত্যি যে সোমপ্রকাশ পত্রিকার কোনও কোনোও সম্পাদকীয়তে এই বক্তব্য গুলো উঠে এসেছে, কেউ কেউ মনে করেন যে বকলমে এই বক্তব্য গুলো ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের লেখা, সম্ভবত চিঠিটিও। একথা মনে করবার একটি অন্যতম কারণ হলো, পরবর্তী কালে ১৮৮৬ ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের দ্বিতীয় বার্ষিক অধিবেশন বসে কলকাতায়, যেখানে বিদ্যাসাগর কে সভাপতি হতে অনুরোধ করা হয়, কিন্তু তিনি প্রত্যাখ্যান করেন। তাঁর বদলে দাদাভাই নওরোজী সভাপতি হন।
যদিও অধ্যাপক কুণাল চট্টোপাধ্যায় মনে করেন ওই চিঠি কোনও ভারতীয় লেখেননি। কারণ, মিনিটস এ পরিষ্কার লেখা আছে ‘He was also to urge the necessity of enrolling natives in the Association’ অর্থাৎ ‘তিনি অ্যাসোসিয়েশনে স্থানীয় মানুষদের সদস্য করার প্রয়োজনীয়তার প্রতিও আহ্বান জানান’। ফলে অধ্যাপক চট্টোপাধ্যায় মনে করেন কোনও অভারতীয় ব্যক্তি না লিখলে আন্তর্জাতিক ‘native’ দের অন্তর্ভুক্ত করার ‘প্রয়োজনীয়তার’ কথা লিখতো না।
ঠিক কে লিখেছিল বলা মুশকিল। কিন্তু এই বাংলার কথা, শ্রমজীবী, গ্রামীণ সমাজের কথা বারংবার উঠে এসেছে প্রথম আন্তর্জাতিক ও মার্কসের কথায়।
সামনেই ১৭ই অক্টোবর। এই বাংলার দুই বিপ্লবী যাঁরা সমাজতন্ত্রের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে কমিউনিস্ট পার্টি গঠন করার কাজে নিয়োজত হন ও তাঁদের তৈরী দল শ্রমজীবীদের আন্তর্জাতিক ঐক্যের প্রতীক তৃতীয় আন্তর্জাতিকের অনুমোদন পায় সেই মানবেন্দ্র নাথ রায় (নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য) ও অবনী মুখার্জী ছিলেন ১৯২০ সালের ১৭ই অক্টোবর প্রতিষ্ঠিত সিপিআই-এর দুইজন নেতৃস্থানীয়।
সেকথা মনে রেখেই আগামী প্রজন্মের কাছে তুলে ধরা হলো পার্টি গঠনের অর্ধ শতক আগের পার্টি গঠনের আকাঙ্খার ইতিহাস। আগামী দিনে নিশ্চয়ই সেই অজ্ঞাত পরিচয় লেখককে চিহ্নিত করা যাবে।