অপূর্ব চ্যাটার্জি
আর কিছুদিনের মধ্যেই অষ্টাদশ লোকসভা গঠনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনী রাজনৈতিক সংগ্রামের মুখোমুখি আমরা। তার আগে দেশবাসী প্রত্যক্ষ করলেন বাবরি মসজিদ ভেঙে নির্মীয়মান- অসমাপ্ত রামমন্দিরে রামলালার প্রতিষ্ঠা ও অন্তর্বতী বাজেট পেশ, সপ্তদশ লোকসভার শেষ অধিবেশনে ও রাজ্য সভায় মোদীর জনসভা মার্কা ভাষণে ঔদ্ধত্য ও একনায়কের হুংকার। এছাড়া ৮ ফেব্রুয়ারি মোদি সরকার একটি ৫৯ পাতার অর্থনীতির ‘শ্বেতপত্র’ প্রকাশ করেছে।
অথচ এই প্রথম বাজেটের আগের দিন আর্থিক সমীক্ষা প্রকাশিত হলো না। সমীক্ষায় সারা বছরে সরকার কি কাজ করেছে, কোন বিষয়গুলি গুরুত্ব পেয়েছে তার একটা বিবরণ থাকে। শ্বেতপত্রের প্রথম ২৪ পাতায় ইউপিএ জমানার বিভিন্ন আর্থিক অভিযোগ নিয়ে চর্চা আছে যা গত ১০ বছরে মোদি সরকার প্রমাণ করতে পারেনি, বাকি ৩৫ পাতায় নির্মম বাস্তবতাকে অস্বীকার করে সাফল্যের অবাস্তব ও মিথ্যার ফানুস সাজিয়ে দাবি করা হয়েছে ইউপিএ জমানার তুলনায় মোদীর জামানায় অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। উদ্ভট ও হাস্যকর যুক্তি।এই সরকার ৩ বছর ধরে জনগণনা স্থগিত রেখেছে, তথ্য দিতেও অনীহা। ভোটের বাজারে মোদি সরকার তথ্যের বিকৃতি- সংখ্যার ছক্কাপাঞ্জা করে যেমন গরিবের সংখ্যা কম দেখিয়ে উল্লসিত তেমনি দেশের ঋণ, অনাদায়ী ঋণ, আর্থিক ঘাটতি, বেকারত্বের হার কমার অসত্য ভাষ্য শ্বেতপত্রে হাজির করে ভোটের প্রচারে মত্ত হবে।
বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। আসলে এই বাজেট বা শ্বেতপত্র বিজেপির নির্বাচনী ইশতেহার -প্রতারণামূলক প্রচারপত্র। অর্থমন্ত্রীর দিবা স্বপ্ন নতুন সরকার গঠনের পর জুলাইয়ে তারা যে বাজেটটি পেশ করবেন তাতেই ২০৪৭ সালের মধ্যে ‘বিকশিত ভারত’ অর্থাৎ উন্নত দেশ হিসেবে ভারতের অর্থব্যবস্থা গড়ে তোলার বিস্তারিত পথ নির্দেশ থাকবে। এমনকি ২০৩০ সালে ৭ লক্ষ কোটি ডলারের ‘তৃতীয় বৃহত্তম’ অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় পৌঁছানোর খোয়াব ফিরি করছেন দেশের মাতব্বরেরা। আসলে ‘মোদি থ্রি পয়েন্ট জিরো’ প্রশ্নে রামলালাকে নিয়ে বিজেপি কনফিডেন্ট নয়। এই ধর্মীয় আবেগ পুলওয়ামা-বালাকোটের মতো উগ্র জাতীয়তাবাদের আবেগের জোয়ারে ভাসানো যাবে কিনা-তা নিয়ে আরএসএস ও বিজেপি সন্দিগ্ধ। তাই রামমন্দিরের ধর্মীয় আবেগ এর সাথে শ্বেতপত্র, ‘অপারেশন লোটাস’ ও মিথ্যা প্রতিশ্রুতির ফুলঝুরির প্যাকেজ ও মার্কেটিং।
ভবিষ্যতের সম্ভাবনাকে বা খোয়াবনামাকে বর্তমানের অন্ধকার ঢাকতে ব্যবহার করার এক কৌশল। কেন শ্বেতপত্রে প্রকৃত ভারতের অর্থনীতির বাস্তব চিত্র তুলে ধরতে অনীহা? কেন ৫ বছর, ২৫ বছরের টার্গেট সামনে রাখা হচ্ছে? আসলে গত দশ বছরে সরকার প্রতিটি ক্ষেত্রেই ব্যর্থ। প্রকৃত অর্থে মোদি জমানায় আমাদের জাতীয় সম্পদ এবং অর্থনীতির ধ্বংস ও লুঠ যেমন কোটি কোটি মানুষের জীবন- জীবিকা নষ্ট করে দেওয়ার ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা নিচ্ছে, তেমনি আমাদের অর্থনীতিকে স্থায়ীভাবে নিম্নগামী ও সংকটাপন্ন করে তুলেছে। ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের চরিত্র পরিবর্তনের ধারাবাহিক প্রয়াস চলছে। সংবিধানের মূল চারটি স্তম্ভ ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্র যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো, সামাজিক ন্যায় এবং আর্থিক সার্বভৌমত্ব আজ আক্রান্ত। জাতি দাঙ্গায় বিধ্বস্ত মনিপুর। হিন্দি বলয়ে বিভিন্ন রাজ্যে সংখ্যালঘুদের উপর পরিকল্পিতভাবে আক্রমণ চালানো হচ্ছে। সংসদের অধিবেশন থেকে ১৪৬ জন সাংসদকে গোটা অধিবেশনের জন্য বহিষ্কার করে বিরোধীদের কণ্ঠস্বর স্তব্ধ করতে মোদি সরকার কুণ্ঠাবোধ করেনি। বিভিন্ন রাজ্যের ৪১১ জন বিধায়ক ভাঙ্গিয়ে নিতেও লজ্জাবোধ করেনি বিজেপি। অথচ উচ্চকিত প্রচারে বলা হচ্ছে,এই সময়ে দেশ উন্নতির শিখরে পৌঁছেছে- এটাই ভারতের অমৃতকাল। সুশাসন বা উন্নয়নের কোন মডেল বা উদাহরণ অথবা এমন কোন প্রকল্প আছে যার কাঁধে ভর করে ২০২৪ সালে ফের ভোট চাইবেন? উত্তর: কিছুই নেই। ঠিক কোন কোন প্রকল্পে এবারও বেশি আস্থা রেখেছেন নরেন্দ্র মোদি? কিছুই না।১০০ দিনের কাজ, আবাস যোজনা, কিষান নিধি,আয়ুষ্মান ভারত এসব প্রকল্পে বরাদ্দ হ্রাস করা হয়েছে।আজকে এখন খেটে খাওয়া গরীব মানুষেরা কিভাবে নিঃশ্বাস নিয়ে বাঁচবেন ?দেশের অর্থনীতি ও উন্নয়ন, শ্রমিক- কৃষক-খেতমজুর সহ আম আদমির জীবন- জীবিকাকে কি অবস্থায় দাঁড় করিয়েছ?
দেশের সার্বিক বেকারত্বের হার ১০% চৌকাঠ অতিক্রম করল কেন?’বিকশিত ভারত’ নির্মাণের স্বপ্নপূরণের অর্থ কোথা থেকে আসবে শ্বেতপত্রে এসবের উত্তর নেই। দেশের আর্থিক বৃদ্ধি ও মোট উৎপাদন বৃদ্ধির প্রশ্নে যেভাবে কথার ফানুস ওড়াচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রীরা তার ছিটেফোঁটাও চোখে দেখা যায় না আমাদের রাজ্য ও দেশে।দেশের অর্থনীতি ক্রমশ গভীরতর সংকটে – ডুবছে ঋণের গর্তে। গত দশ বছরে মোদির জমানায় নোট বাতিল, অপরিকল্পিতভাবে জিএসটি ব্যাবস্থা প্রবর্তন, কোভিডে লকডাউন, অব্যবস্থা সহ বহুবিধ ভুল সিদ্ধান্তের পরিনতিতে অর্থব্যবস্থার যে বিপুল ক্ষতি হয়েছে তার প্রভাব কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়নি। শুধু আর্থিক বৃদ্ধির হারের হৈ চৈ করে দৃষ্টি ঘোরালে হবে না, দেশের ঋণ, রাজস্ব ও আর্থিক ঘাটতি, বেকারি, বৈষম্য, মুদ্রাস্ফীতি ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। সাধারণ মানুষের আয় ও সঞ্চয়ের পরিমাণ হ্রাস পাচ্ছে। মূল্যবৃদ্ধির আগুনে, বেকারত্বের যন্ত্রণায়, বৈষম্যের জ্বালায় আম-আদমির প্রাণ বিপন্ন। কালো ধন ফিরিয়ে আনা,বছরের ২কোটি বেকারের কাজ, ডলারের দাম ৪০ টাকা, পেট্রলের দামও তাই, কৃষকের আয় দ্বিগুণ করা,সবার অ্যকাউন্টে ১৫ লক্ষ টাকা প্রদানের কি হলো? এগুলো শ্বেতপত্রে উল্লেখ নেই।এসবই ইতিমধ্যে ‘জুমলা’ প্রমাণিত হয়েছে।২০১৪তে দেয় প্রতিশ্রুতি ২০২৪-এ পৌঁছে ক’আনা পূরণ হল তার হিসেব যাতে কেউ না চায়-তার জন্য গোলপোস্টটাকে ইচ্ছেমতো সরাও। কখনো বালাকোট, কখনো জম্বু-কাশ্মীরে ৩৭০ ও ৩৫এ ধারা বাতিল, কখনো অসম্পূর্ণ মন্দিরে রামলালার প্রাণপ্রতিষ্ঠা, কাশির জ্ঞানব্যাপী,মথুরা, এক দেশ এক ভোট, সিএএ,ইউসিসি… সাত ট্রিলিয়ন ডলারের সুঠাম অর্থনীতির হাতছানি২০৩০, বিকশিত ভারত ২০৪৭। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন এই বাজেট “কন্টিনিউটির কনফিডেন্স”। আসলে সত্যকে তোয়াক্কা না করা বা মিথ্যা বলার কন্টিনিউটির কনফিডেন্স। যেমন- প্রধানমন্ত্রী এবারের লোকসভায় শেষ ভাষণে বলেন, এনডিএ যদি ৪০০ আসন পায় তাহলে বিজেপি একাই ৩৭০টি আসন পাবে- মিথ্যার কার্পেট বোম্বিং-পোস্ট ট্রুথ। শ্বেতপত্রের শেষ ৩৫ পাতায় সরকারের সাফল্যের অসত্য ভাষ্য নিচের আলোচনায় স্পষ্ট হবে -স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে আর্থিক বৃদ্ধির নিরিখে উজ্জ্বলতম বছরগুলি হল ২০০৪ থেকে২০১১ পুরোটাই ইউপিএ জামানা। ২০০৭-এর বৈশ্বিক মন্দার বছরটি বাদে আর্থিক বৃদ্ধির হার ধারাবাহিকভাবে ৮% বেশি ছিল।
১৯৯১ পরবর্তী পর্যায়ে শ্লথতম বৃদ্ধির দশকটি হল নরেন্দ্র মোদির শাসনকাল। কোভিডের আগেই আর্থিক বৃদ্ধি নিম্নমুখী হয়েছিল-৪৫ বছরে বেকারত্ব সর্বোচ্চ হয়। কোভিড শুরু হওয়ার আগের চারটি আর্থিক বছরের প্রতিটিতে বৃদ্ধির হার তার আগের আর্থিক বছরের তুলনায় কম। আইএমএফ এর তথ্য অনুযায়ী ২০১৯- ২৩ পর্যন্ত ভারতের গড় আর্থিক বৃদ্ধি৩.৫%। প্রচার ও বাস্তবের ফারাকটা স্পষ্ট। তারস্বরে প্রচার হচ্ছে ২০৩০এ ভারতের মোট আভ্যন্তরীণ উৎপাদন পরিমাণ সাত লক্ষ কোটি ডলারে পৌঁছাবে। কিভাবে? এখন ভারতের জিডিপি প্রায় ৩. ৭ লক্ষ কোটি ডলারের।৭লক্ষ কোটি ডলারে পৌঁছাতে হলে বার্ষিক বৃদ্ধির হার ৯.৫ শতাংশের বেশি হতে হবে। কোন ম্যাজিকে হবে? আবার অর্থমন্ত্রী বলেছেন,২০২৩ -২৪ অর্থবর্ষে আর্থিক ঘাটতি জিডিপির ৫.৮% হবে, আগামী বছর ৫.১% ,২০২৫-২৬ এ ৪.৫% হওয়ার সম্ভাবনা। এটা করতে হলেও জিডিপির হার কমপক্ষে আগামী বর্ষে ১০.৫% হতে হবে যা অবাস্তব। অথচ মোদি ক্ষমতায় আসার আগে এই হার ছিল ৪.১%। মোদির জমানায় প্রতি ডলারের বিনিময় মূল্য ৫৯ থেকে ৮৩ টাকা হলো কি করে? ডলারের বিচারে টাকার এই বড় পতন কেন? কিসের ‘বিশ্বগুরু’ যিনি টাকাকে শক্তিশালী করতে পারেননি- দুর্বল করেছেন। বৈদেশিক বাণিজ্যে ঘাটতি রেকর্ড মাত্রা ছুঁয়েছে ২০২৩ সালে অর্থাৎ আমাদের দেশের পণ্য ও পরিষেবার বিদেশে চাহিদা নেই। রপ্তানি নির্ভর আর্থিক উন্নতির গল্প শেষ। বিশ্বগুরুর এ কোন আত্মবিশ্বাস? মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধির হার কমে যাওয়ায়, উৎপাদন ক্ষেত্রে কাঙ্ক্ষিত লাভের সম্ভাবনা না থাকায় নতুন প্রকল্পে বিনিয়োগে পুঁজিপতিদের নিরুৎসাহ- বর্তমান ভারতের কর্মহীনতার সংকটকে গভীরতর করে তুলেছে। ঋণের প্রকৃত চেহারাটা কি? ২০০৪-এ ইউ পিএ ক্ষমতায় আসার আগে সরকারের ঋণ ছিল জিডিপির ৬৭% এবং কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারগুলির সম্মিলিত ঋণের পরিমাণ ছিল জিডিপির ৮৫%। ২০১৪, মোদি ইনিংসের শুরুতে এই ঋণের পরিমাণ ছিল যথাক্রমে ৫৩ % ও ৬৭%। বর্তমানে তা দাঁড়িয়েছে ৫৮% ও ৮২%। আইএমএফ এর দাবি অনুযায়ী ২০২৮ সালে দেশের ঋণ জিডিপির ১০০ শতাংশ ছাড়াতে পারে। ভয়ঙ্কর।
দেশের অর্থনীতিকে যতই রঙিন করে দেখানোর চেষ্টা চলুক না কেন তার কঙ্কালসার চেহারাকে ঢাকা যাচ্ছেনা। জি-২০ সভাপতিত্বকে কেন্দ্র করে যেমন ‘বিশ্বগুরু’ হয়ে ওঠার বয়ান তৈরি করল বিজেপি তাতে এই সত্যটা চাপা পড়ে গেল যে গোষ্ঠীর সভাপতিত্বের দায়িত্বটি ঘুরেফিরে সব দেশই পায়। এর জন্য বিশেষ কৃতিত্বের সুযোগ নেই। সবাই বুক ফুলিয়ে জানান ভারতীয় অর্থনীতি এখন আয়তনের নিরিখে বিশ্বে পঞ্চম স্থানে। কিন্তু এটা প্রধানমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী ও তার গোদি মিডিয়ারা চেপে যান যে গোষ্ঠীভুক্ত ২০টি দেশের মধ্যে সর্বনিম্ন মাথাপিছু আয়(২৬০০ ডলার)ভারতের। আন্তর্জাতিক অর্থভাণ্ডারের হিসাবে মাথাপিছু আয় এর নিরিখে ২০২৩ সালে বিশ্বের ১৯৫ টি দেশের মধ্যে ভারত ১৪৩তম স্থানে। যে দুটি দেশকে টপকে ভারত বিশ্বের ‘তৃতীয় বৃহত্তম’ অর্থব্যবস্থা হবে বলে প্রধানমন্ত্রীরা আত্মগর্বে মত্ত, সেই জার্মানি ও জাপানের মাথাপিছু আয় ভারতের ২০গুন ও ১৪ গুণ। এমনকি আফ্রিকা, ব্রাজিল ও চীনের আয়ও ভারতের চেয়ে যথাক্রমে ৩গুণ,৪গুণ ও ৫গুন বেশি। এ কোন অমৃতকাল?নির্মলা ঘোষণা করেছেন, গত ১০ বছরে দেশের মানুষের গড় প্রকৃত আয় নাকি দেড় গুণ বেড়েছে অথচ বাস্তবতা কি? গত ১০ বছরে এদেশের মানুষের মধ্যে ধর্মীয় মেরুকরণের মত আর্থিক মেরুকরণও বৃদ্ধি পেয়েছে।
গোটা বিশ্বে এই কোভিড পরবর্তী পর্যায়ে আর্থিক পুনরুত্থান ইংরেজি ‘কে’ অক্ষরের আকৃতি ধারণ করেছে অর্থাৎ আয়ের নিরিখে উপরের দিকে থাকা কম সংখ্যক মানুষের আয় বেড়েছে আগের চেয়ে বেশি হারে, নিচের ধাপগুলিতে থাকা বিপুলসংখ্যক মানুষের আয় কমেছে।অক্সফ্যাম একটি রিপোর্ট দেখাচ্ছে- দেশের ধনীতম ১% মানুষ ৪০% সম্পদের মালিক আর আয়ের নিরিখে তলানিতে থাকা দেশের ৫০% মানুষের হাতে এসেছে মোট সম্পদের ৩%। ভারতের এই অসাম্যের প্রবণতা নিয়ে বহু অর্থনীতিবিদ উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। অমর্ত্য সেন তার গবেষণার মাধ্যমে দেখিয়েছিলেন, যে জিডিপির বৃদ্ধি মানুষের কল্যাণকে সুনিশ্চিত করে না। মানুষের জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রের উপর তার সক্ষমতা ভিত্তিক নিয়ন্ত্রণ ও স্বাধীনতাই তার কল্যাণকে সুনিশ্চিত করতে পারে। এজন্য পুষ্টি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কাজ,মত প্রকাশের স্বাধীনতা এইগুলি সুনিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরী। ২০২৩ সালে মানব উন্নয়ন সূচক অনুযায়ী ভারতের স্থান ১৩২ তম (১৯১টি দেশের মধ্যে)। আসলে গত ১০ বছরে মোদির জমানায় মানুষের বেঁচে থাকার এই মৌলিক উপাদান গুলি বিপন্ন। অথচ দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসার পর থেকে মোদির কর্পোরেট সেবা- তোষণ ক্রমবর্ধমান। মোদি জামানায় ১৫.২৩ লক্ষ কোটি ব্যাংক ঋণ মুকুব হয়েছে। কর্পোরেট সেবায় শুধু ঋণ মকুবেই সীমাবদ্ধ নেই-জনগণের গড়ে তোলা সম্পদ-রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা এলআইসি, ব্যাংক -বীমা, রেল, বিদ্যুৎ ক্ষেত্র, বিমানবন্দর, টেলিকম, খনি, স্টেডিয়াম, প্রাকৃতিক গ্যাসের পাইপ লাইন প্রভৃতি জলের দরে শেয়ার বিক্রি বা বেসরকারীকরন-সম্পদ লুটের ব্যবস্থার মাধ্যমে(আদিম পুঁজি সঞ্চয়), কর্পোরেট করের হার অনেকটা কমিয়ে তাদের মুনাফার ভাগ বৃদ্ধির ‘মোদি গ্যারান্টি’র ব্যবস্থা করা হয়েছে। প্রতিদান হিসাবে ইলেক্টোরাল বন্ডে মোদীদের দলীয় তহবিলে কর্পোরেট ঢেলে অর্থ দান করছে। ধান্দার ধনতন্ত্রই হলো জনগণের মূল্যবান সম্পদ মুনাফার স্বার্থে দখলের জন্য রাজনৈতিক নেতা- আমলা ও কর্পোরেটদের মধ্যে অবৈধ সহযোগিতা। দুর্নীতি, দুর্বৃত্তায়ন রাজনীতিকে ও সমাজকে কলুষিত করছে।
জুন, ২০১৪ সালে বিশ্ববাজারে প্রতি ব্যারেল তেলের দাম ছিল ১২৫ ডলার, তারপর ধাপে ধাপে দাম কমে ৭০ ডলারের কাছাকাছি এসে যায়। তেলের দামের বিপুল পতন হলেও তার সুবিধা জনগণের ভাগে আসেনি। পুরোটাই ভোগ করেছে তেল কোম্পানিরা। আজ যখন তেলের দাম কমে ৮০ ডলারের নিচে তখনও বাজারে পেট্রোল-ডিজেলের দাম ১০৬ টাকা ও ৯৪ টাকা। ২০১৪ সালের ৪১৫ টাকার রান্নার গ্যাসের দাম বেড়ে ১২০০ টাকা হয়ে ভোটের আগে ৯২৯ টাকা দাঁড়িয়েছে। ১৪ টাকার কেরোসিন ৯০ টাকা- একে জনগণের সাথে প্রতারণা ছাড়া আর কি বা বলা যায়?
বেকারত্ব ,অসাম্য বৃদ্ধি, মুদ্রাস্ফীতি, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, অনাহারের জন্য আত্মহত্যার প্রবণতা বৃদ্ধি নিয়ে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের কোন হেলদোলও নেই, বাজেটে ও শ্বেতপত্রে কোন শব্দও নেই। ২০১৪ সালে বিশ্ব ক্ষুধা সূচকে ভারতের স্থান ছিল ৫৫ তম ১২০ টি দেশের মধ্যে, ২০২৩ এ ১১১ তম ১২৫ টি দেশের মধ্যে।২০২১ ও ২০২২ সালে ৩.৩৫ লক্ষ মানুষ আত্মহত্যা করেছেন- এর এক-তৃতীয়াংশই দিনমজুর, কৃষক ও খেতমজুর। অনিশ্চিত রোজগারের অসহায়তা তাদের বাধ্য করেছে মৃত্যুকে স্বেচ্ছায় আলিঙ্গন করতে। ২০১৪ থেকে ২০২১ এই পর্বে দৈনিক মজুরদের মধ্যে আত্মহত্যা বৃদ্ধির হার ২০০%। ২০২০ সালে প্রতি লক্ষ জনসংখ্যা পিছু আত্মহত্যা ছিল ১০.২ আর ২০২২ সালে সেটা বেড়ে হয়েছে ১২ জন।গত বছরেএমনকি ১৩ হাজার ছাত্রও আত্মহত্যা করেছে। এ রাজ্যের সাথে সারাদেশেই গত এক দশকে গরিব, খেটে খাওয়া মানুষের জীবনের কোন উন্নতিই হয়নি বরং অবনতি হয়েছে। কাজের সুযোগ বাড়েনি, মজুরিও বাড়েনি।
অথচ প্রত্যেকদিন জীবনযাপনের জন্য যা অতি প্রয়োজনীয় সেই চাল, ডাল, চিনি, তেল ,সবজি, ফল, মাছ, মাংস, ডিম, প্যাকেটজাত ফুড এসবের দাম অস্বাভাবিক বৃদ্ধি হয়েছে। সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। ওষুধ, অপারেশন, চিকিৎসার খরচ জোগাড় খুবই কঠিন হয়ে দাঁড়াচ্ছে। অস্বাভাবিক হারে মূল্যবৃদ্ধির জন্য জীবন যাত্রার মান হ্রাস পেয়েছে। মোদি সরকার যে কৃষি ও কৃষকের উন্নতি চায়না তার প্রমান গত ১০ বছরে কৃষি ক্ষেত্রে সরকারের কার্যকলাপ। গত চার বছরে কৃষিতে বরাদ্দ অর্থ এক লক্ষ কোটি টাকা ফেরত গেছে। এই চার বছরে কৃষিতে মোট বরাদ্দের অংশ হিসাবে ৪.৪% থেকে কমিয়ে ২.৫% করা হয়েছে। ৭৬% কৃষক ধানের ও ৮০% কৃষক গমের সহায়ক মূল্য পান না। সার, বিদ্যুৎ সহ বিভিন্ন উপকরণের মূল্য বৃদ্ধির কারণে চাষের খরচ মারাত্মক বেড়ে গেছে। কৃষক আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ দাবি ছিল-স্বামীনাথন কমিশনের সূত্র মেনে চাষের খরচের দেড়গুণ ফসলের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য নির্ধারণের গ্যারান্টি দিয়ে আইন পাস-সরকার প্রতিশ্রুতি পালন করে নি।
মোদি- মমতার দাবি মত কৃষকের আয় দ্বিগুণ, তিনগুণ হওয়া তো অনেক দূরের কথা কৃষকের আয় ক্রমশ কমে যাচ্ছে,বিপন্নতা বৃদ্ধি পেয়েছে। আমাদের রাজ্যেও অর্থনৈতিক অবস্থা ও জীবন-জীবিকা, বেকারত্ব অত্যন্ত শোচনীয়-বছর শেষে ঋণের বোঝা হবে ৭ লক্ষ কোটি টাকা।সবচেয়ে বড় আয় শুধুমাত্র মদ বিক্রি থেকে ও ধারে। কেন্দ্রের মতনই শুধুই ধাপ্পা, প্রতারণা, লুট, দূর্নীতি, অপশাসন। কোনরকমে বেঁচে থাকতে এ রাজ্য থেকে লক্ষ লক্ষ মানুষ জীবিকার সন্ধানে অন্য রাজ্যে চলে যাচ্ছেন। মানুষের বেঁচে থাকার জন্য কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের আর্থিক নীতি বদলানোর লড়াইকে তীব্র করতে এই নির্বাচন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আর্থিক নীতি বদলানোর সাথে এই গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনী সংগ্রামে আমরা সোচ্চার হতে চাই বিদ্বেষ- ঘৃণার বিভাজনের পরিবেশ এর পরিবর্তে ঐক্য- সম্প্রীতির পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে, প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িকতা,ধর্মের রাজনীতিকরণ বন্ধ করতে।
মোদি ও মমতা সরকারের ব্যর্থতা, বেকারত্ব বৃদ্ধি-কর্মসংস্থান, মূল্যবৃদ্ধি, ক্ষুধা, আত্মহত্যা,চারটি শ্রম কোড বাতিল, গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার, মহিলাদের সমান অধিকার ও সমমর্যাদার দাবিতে ভোটের লড়াই হোক। ভূমি সংস্কার, পরিকাঠামোয় সরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধি, খাদ্য- স্বাস্থ্য- শিক্ষা- কাজের অধিকার নিশ্চিত করতে উচ্চধনীর উপর মাত্র ২% সম্পদ কর সংগ্ৰহ, প্রত্যক্ষ কর বৃদ্ধি, কর্পোরেটদের মকুব ঋণ ফেরত-নির্বাচনী লড়াইয়ে মূল এজেন্ডা হোক। দেশ, সংবিধান বাঁচাতে এবং খেটে খাওয়া শ্রমজীবী মানুষের জীবন রক্ষার লড়াই-ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক মানুষের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই বিজেপি ও তৃণমূলকে পরাস্ত করাই এই নির্বাচনে এ রাজ্যে অন্যতম কর্তব্য।