গিরিরাজ ছিল খারকিভে, ফোনে কথা বলতেই বলতেই বিকট আওয়াজ, বম্বিং হচ্ছে ওদের এপার্টমেন্ট এর পাশেই। আমি ওকে বললাম জলদি চলে এসো আমাদের এখানে উজহোর্ডে। সবাই তখন দিশেহারা, যেভাবে হোক দেশে ফিরতে হবে। টানা বলে থেমেছেন চেতনা।
হরিয়ানার পানিপথের মেয়ে চেতনা, ইউক্রেনের পশ্চিম প্রান্তে উজহোর্ড শহরের উজহোর্ড ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ষষ্ঠ বর্ষের মেডিক্যাল ছাত্রী। ফাইনাল পরীক্ষার ঠিক তিন মাস আগেই যুদ্ধ, ফিরে আসতে হয়েছে ফের পানিপথে।
‘হাঙ্গেরি সীমান্ত ঘেঁষা ইউক্রেনের পশ্চিম প্রান্তে উজহোর্ড হওয়ায় আমাদের খানিক শান্তি ছিল বম্বিং হয়তো এখানে হবে না, যেমন হচ্ছে খারকিভ, ক্রিয়েভ, ডনবাস বা ওডেসায়। ২৪ ফেব্রুয়ারি তখন আমি হস্টেলে হঠাৎ শুনি রাশিয়া বম্বিং শুরু করেছে, কদিন আগে থেকেই ছিল টানটান উত্তেজনা’, বলেছেন চেতনা।
সেদিন থেকেই কলেজ বন্ধ, হস্টেলে বন্দী চেতনা।রোজ তাদের শেখানো হচ্ছে ওয়ার ড্রিল, বম্বিং শুরু হলে কিভাবে নিরাপদ থাকা যায়। যুদ্ধ শুরু হতেই জিনিস পত্রের দাম আগুন, কয়েকদিনের খাবার মজুত করে হস্টেলে থাকা।
ইন্ডিয়ান এম্ব্যাসির একের পর এক অ্যাডভায়সারি জারি হচ্ছে আর টোল ফ্রি নম্বরে ফোন করলে বেজে যাচ্ছে, কিভাবে চেতনা আর তার বন্ধুরা ফিরবে দেশে!
শুধু উজহোর্ড এ আটশো ভারতীয় পড়ুয়া, আরো কয়েক হাজার কিয়েভ থেকে খারকিভে। ‘ আমরা নিজেরাই উদ্যোগ নি, রাতারাতি বানানো হতে থাকে অসংখ্য হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ, বিশেষত যেখানে বোম পড়ছে, মিসাইল হানা হচ্ছে সেখানকার বন্ধুদেরকে যেমন ভাবেই নিয়ে আসতে হবে পশ্চিম প্রান্তে, আই হ্যাভ সিন দ্য বেস্ট এন্ড ওয়র্স্ট অফ হিউম্যানিটি”, বলেছেন চেতনা।
এম্ব্যাসির সঙ্গে প্রতিদিন চলছে যোগাযোগ আর রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছে নয়া নাজি গ্রুপের সদস্যরা।
– আপনাদের সঙ্গে রুশ ছাত্র ছাত্রী ছিল না?
– না না, থাকলেই ওদের মেরে ফেলত, এমনকি রুশ ভাষা একটাও অজান্তে বলে ফেললেও বিপদ। ইউক্রেনের পশ্চিম প্রান্তে এতটাই রুশ বিরোধী সেন্টিমেন্ট, ভাবা যায় না।
– তাহলে আমেরিকান ন্যাশনাল বা ন্যাটো দেশভুক্ত কোন নাগরিক তাঁদের জন্য তো লাল কার্পেট পাতা থাকবে!
– ভুল, ইউক্রেনিয়ানদের বদ্ধমূল ধারণা তাদের দেশকে ধবংস করছে আমেরিকা আর ন্যাটো, ওদের খুব আশা ছিল আমেরিকা আর ন্যাটো বোধহয় বাঁচাতে আসবে। যতটা রাগ পুতিনের বিরুদ্ধে ততটাই রাগ বাইডেনের বিরুদ্ধে।
খারকিভ আর কিয়েভ থেকে একের পর বন্ধুরা ভিড় জমাতে শুরু করেছে উজহোর্ড এর হোস্টেলে, যুদ্ধকে সামনে থেকে দেখা ভারতীয় পড়ুয়াদের জড়িয়ে ধরছেন চেতনারা, যেভাবেই হোক হাঙ্গেরি বর্ডার ক্রস করে পৌঁছতে হবে বুদাপেস্ট। এভাকুয়েসান ফ্লাইট ধরতে হবে দ্রুত।
১ মার্চ গাড়ি ভাড়া করে উজহোর্ড থেকে হাঙ্গেরির জোহানি বর্ডার ক্রস করে বুদাপেস্ট পৌঁছনোর কথা চেতনাদের। জোহানি বর্ডারে ১০ ঘণ্টা বসে থাকতে হয় গাড়িতেই, ভিসা যতক্ষণ না ইস্যু হয়।
‘তখনও পর্যন্ত আমরা ইন্ডিয়ান এম্বাসির কাউকে দেখিনি, আমাদের সবটাই সাহায্য করেছে আমাদের ইউনিভার্সিটির টিচার আর হাঙ্গেরি প্রশাসন’। জানিয়েছেন চেতনা।
বুদাপেস্ট পৌঁছেও মন ভালো নেই চেতনার, হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে ভেসে আসছে কিয়েভ আর খারকিভে আটকে থাকা ভারতীয় পড়ুয়াদের মেট্রো সুড়ঙ্গের আটকে থাকার ছবি।
‘২ তারিখ সকালে আমরা ইন্ডিগোর ফ্লাইটে উঠি, উঠে দেখি তখন প্রথম ইন্ডিয়ান এম্বাসিরর অফিসিয়ালদের। যাদের টোল ফ্রি নম্বর বেজে গেছে, তারাই তখন বলছে এই যে তোমরা ইভাকুয়েশন ফ্লাইট পেয়েছ, সব মোদীজির জন্য! স্লোগান দাও মোদীজি জিন্দাবাদ!
দাঁতে দাঁতে চেপে ছিলেন চেতনা, মোদীজির জয়ধ্বনি করেননি। ‘কেন করব? ওঁর কি ভূমিকা? আমি আমার মত স্লোগান দিয়েছি, ডাউন ডাউন ইম্পরিয়ালিজম, ডাউন ডাউন ন্যাটো..’
আমেরিকা আর ন্যাটো যদি ইউক্রেনকে গিলে খেতে না চাইতো, আমেরিকা যদি দিনের পর দিন আজভ রেজিমেন্টকে অস্ত্র না যোগাত, ইভানুকোভিচকে সরিয়ে রেজিম চেঞ্জ না করত, রাশিয়া ইউক্রেন উত্তেজনা বাড়ত না, এই যুদ্ধ এড়ানো যেত, দেরিতে হলেও বুঝছেন এখন ইউক্রেনিয়ানরা। আগ্রাসী রাশিয়ার বিরুদ্ধে যেমন ঘৃণা ততটাই ঘৃণা উগড়ে দিচ্ছেন তাঁরা ন্যাটো আর আমেরিকার বিরুদ্ধেও। জানিয়েছেন চেতনা।
চেতনার বাবা সুনীল দত্ত সিপিআই (এম) এর পানিপথ জেলা সম্পাদক, সিআইটিইউ’ র রাজ্য নেতা। মেয়েকে নিয়ে চিন্তায় ছিলেন কমরেড সুনীল আর তাঁদের পরিবার, পানিপথে কাজে গিয়ে শুনি কমরেড সুনীলের মেয়ে বাড়ি ফিরেছেন, ওঁর সঙ্গেই তাই যাওয়া চেতনাদের বাড়িতে, খাটিয়াতে বসে বসে অজস্র অভিজ্ঞতা শুনিয়েছেন চেতনা, ভাবিজি অবিরাম যোগান দিয়ে গেছেন লাড্ডু আর চায়ের।
‘যুদ্ধে সব থেকে ক্ষতি হয় গরিব মানুষের, হাহাকার লেগে গেছে উজহোর্ড এ, যুদ্ধ ফিরলেই আবার ফিরে যাবো, ফাইনাল পরীক্ষা দেব, আর আমি ঠিক করে নিয়েছি ডাক্তার হয়ে যেখানে যুদ্ধ হবে সেখানে ছুটে যাবো বোমায় ঝলসে যাওয়া মানুষদের বাঁচাতে, খুব দরকার খুব দরকার, যুদ্ধের সময়ে আহত মানুষের পাশে থাকা, বাঁচিয়ে তোলা। দেখবো কে জেতে মিসাইল না জীবনদায়ী ওষুধ!’
যুদ্ধ থামলে আবার ইউক্রেন ফিরবেন চেতনা। আবার ফিরবেন উজহোর্ড। বরফ মোড়া উজহোর্ড এর রাস্তায় গিটার গান আড্ডা, চেতনার বন্ধুরা সবাই মিলে গাইবেন লেননের গান, ওয়ার ইজ ওভার…!
অর্ক রাজপন্ডিত