Lenin : The Constants of Revolutionary Proggress in Human Liberation – Sitaram Yechury



মাত্র ৫৪ বছরের সংক্ষিপ্ত জীবনকাল ছিল ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিনের। তার মধ্যেই তিনি বিশ্বব্যাপী প্রলেতারীয় বিপ্লবকে এগিয়ে নিয়ে যেতে স্থায়ী ছাপ রেখে গেছেন। এর জন্য তিনি মার্কসবাদের বিজ্ঞানসম্মত সৃজনশীল বিকাশের মর্মবস্তু কেবল আত্মস্থ করেননি, এটিকে তিনি তাঁর নিজের সময়কালে রুশ বিপ্লবের বিজয়ের উপযোগী করে তুলেছিলেন। যার ফলে বিশ্বের প্রথম সমাজতান্ত্রিক দেশ — সোভিয়েত ইউনিয়ন গড়ে তোলাতেও তিনি সফল হয়েছিলেন। বিবিধ বিচ্যুতির মোকাবিলা করে বিপ্লবী আন্দোলনকে বিপথগামিতা থেকে রক্ষা করেছিলেন এবং মার্কসবাদকে তিনি সমৃদ্ধ করেছিলেন। মার্কসবাদী তাত্ত্বিক হিসাবে তাঁর রণনীতি ও রণকৌশল ছিল অতুলনীয়। বিপ্লবী আন্দোলনের বিভিন্ন বাঁক ও মোড়ের মুখে সঠিক ও যথাযথ কৌশল গ্রহণেও তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত। বিশ্বব্যাপী প্রতিটি দেশে বিপ্লবী আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে যে অবদান তিনি রেখে গিয়েছিলেন, তার মূল্যায়ন, নিরন্তর অধ্যয়ন ও অনুশীলনের দাবি রাখে।

মার্কসবাদী মর্মবস্তুর আত্তীকরণ

‘দার্শনিকরা বিশ্বকে নানাভাবে ব্যাখ্যা করেছেন; কিন্তু, কথাটা হলো একে পরিবর্তন করতে হবে’—মার্কসের এই বিখ্যাত উক্তির বাস্তবতা উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন বলেই মহান অক্টোবর সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব বা রুশ বিপ্লবের বিজয় অর্জন করতে পেরেছিলেন লেনিন।
মার্কসবাদের বিজ্ঞানসম্মত প্রক্রিয়া, তার সৃজনশীল সম্ভাবনা ও তার বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গিকে পুরোপুরি আত্মস্থ করায় পরিবর্তনশীল বিশ্বে নেতৃত্ব দিতেও তিনি সফল হয়েছিলেন। লেনিনের ‘রাষ্ট্র ও বিপ্লব’, ‘সোশাল ডেমোক্র্যাসির দুই কৌশল’, ‘কী করিতে হইবে’ অথবা ‘সাম্রাজ্যবাদ, পুঁজিবাদের সর্বোচ্চ পর্যায়’ এইসব রচনাগুলি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে আজকের পরিস্থিতিতে মানবমুক্তির লড়াইকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হলে তাঁর এইসব কাজগুলির মর্মবস্তু প্রত্যেক বিপ্লবীকে উপলব্ধি করতে হবে।
কিন্তু একই সঙ্গে সমান গুরুত্বপূর্ণ হিসাবে বিবেচনা করতে হবে যে রুশ বিপ্লব তথা বিশ্বের সর্বহারা মানুষের আন্দোলনের বাঁক ও মোড়ের মুখে দাঁড়িয়ে কেনই বা লেনিনকে এত তাত্ত্বিক লেখালেখি করতে হয়েছিল। মার্কসবাদ সম্পর্কে লেনিনের দুটো সূত্রায়নকে একত্রিত করলে এইসব সৃজনশীল বৈজ্ঞানিক তত্ত্বগুলো যে আন্তর্জাতিক, সেটাও স্পষ্ট হয়ে যায়। প্রথমত, লেনিন ‘জনগণের বন্ধুরা কারা…’ প্রবন্ধে বলেছিলেন – শত সহস্র শ্রমজীবী মানুষ মার্কসবাদের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিল এই কারণেই যে, মার্কসবাদ হচ্ছে সেই দর্শন যেখানে একই সঙ্গে বৈপ্লবিক ও চূড়ান্তরূপে বিজ্ঞানভিত্তিক। এটি যদিও কখনোই আপনা থেকে একত্রিত হয়ে থাকেনি। মার্কসবাদের প্রতিষ্ঠাতারাই প্রথমে তাঁদের নিজেদের জীবনে এই দুটি দিককে আগে প্রয়োগ করে দেখেছেন। পরে দর্শনগতভাবে ‘মার্কসবাদ’ তাদের অবিচ্ছিন্ন ও অন্তর্নিহিত এই অভিব্যক্তি দুটিকে যুক্ত করে নিয়েছে। দ্বিতীয়ত, লেনিন দেখিয়েছেন যে সুনির্দিষ্ট অবস্থার সুনির্দিষ্ট বিশ্লেষণই হলো ‘মার্কসবাদের সবচেয়ে প্রয়োজনীয় উপাদান, তার জীবন্ত সার।’
মার্কসবাদের অভ্যন্তরে অবস্থিত বৈপ্লবিক এবং চূড়ান্ত বিজ্ঞানসম্মত উভয় দিকের সমন্বয়ের মাধ্যমেই মানব মুক্তির বৈপ্লবিক লক্ষ্য বাস্তবায়িত হতে পারে। এর যে কোনও একটি দিককে বাড়িয়ে বা কমিয়ে দেখা বিপ্লবী আন্দোলনকে বিচ্যুতির দিকে নিয়ে যাবে। আবার বিপ্লবী সম্ভাবনাকে উপেক্ষা করে শুধুমাত্র পরিস্থিতির বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণে মনোনিবেশ করলে তা যেমন সংস্কারবাদের দিকে ধাবিত হবে তেমনি পরিস্থিতির বিজ্ঞানসম্মত মূল্যায়নকে উপেক্ষা করে শুধুমাত্র বিপ্লবী স্লোগানের উপর নির্ভর করলে তা বামপন্থী হঠকারীতার পথে ঠেলে দেয়। এই সব বিচ্যুতি থেকে মুক্ত থাকতে উভয় বৈশিষ্ট্যের যথাযথ সমন্বয় অত্যন্ত জরুরি।
সুনির্দিষ্ট অবস্থার সুনির্দিষ্ট বিশ্লেষণের জন্য সুনির্দিষ্ট অবস্থার বস্তুগত মূল্যায়নেরও প্রয়োজন থাকে, যার ভিত্তিতে সঠিক বিপ্লবী বিশ্লেষণ সম্ভব। বিষয়ীগত বিবেচনার উপর ভিত্তি করে সুনির্দিষ্ট অবস্থার একটি ভুল অনুমান বিপ্লবী আন্দোলনকে ত্রুটিপূর্ণ এবং ভ্রান্ত রাজনৈতিক বিশ্লেষণের দিকে নিয়ে যেতে পারে। সুতরাং, বিপ্লবী আন্দোলনকে সুনির্দিষ্ট পথে এগোতে হলে সুনির্দিষ্ট অবস্থার বস্তুনিষ্ঠ মূল্যায়ন এবং সেখান থেকে মার্কসবাদের উপরোক্ত দুটি বৈশিষ্ট্যের সমন্বয় সাধন একান্তই জরুরি। আবার সেই অনুমান যদি নির্ভুলও হয় এবং বিপ্লবী আন্দোলনের রাজনৈতিক-কৌশলগত লাইনের ক্রমবিবর্তন ও বিশ্লেষণ যদি সঠিকও হয়, তাহলেও তার প্রায়োগিক সাফল্য পার্টি সংগঠনের শক্তির উপরেই নির্ভরশীল। এক্ষেত্রে লেনিনকে অনুসরণ করেই স্তালিন বলেছিলেন – রাজনৈতিক লাইন একশ ভাগ সঠিক হলেও, পার্টি সংগঠন ছাড়া জনগণের মধ্যে তার প্রভাব নিতান্তই সামান্য। অর্থাৎ একটি সক্ষম ও শক্তিশালী পার্টি সংগঠনই বিপ্লবী আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যেতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এটিকেই লেনিন ‘বিষয়ীগত দিক’ হিসাবে অভিহিত করেছেন।
লেনিন কিন্তু এই সমস্ত দিকের সংস্কারবাদী এবং বামপন্থী হঠকারিতার মতো (শিশুসুলভ বিশৃঙ্খলা) দুই বিচ্যুতির বিরুদ্ধের লড়াইয়ে ছিলেন নিরলস। একইসঙ্গে বিপ্লবী অগ্রগতির সন্ধিক্ষণে উঠে আসা প্রতিটি বিচ্যুতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের সঙ্গে সঙ্গে শ্রমিক শ্রেণির আন্দোলন এগিয়ে নেওয়ার সঠিক পথ চিহ্নিত করে কিছু স্মরণীয় রচনাও তিনি লিখে গিয়েছিলেন। ঐ সময়ে তাঁকে শ্রমিক শ্রেণির প্রতিষ্ঠিত একাধিক নেতার বিরুদ্ধে অবিচ্ছিন্ন আদর্শগত লড়াই চালাতে হয়েছিল, যাতে বিপ্লবী আন্দোলন সুনির্দিষ্ট গতিপথ ধরে শেষ পর্যন্ত বিজয়ের দিকে এগিয়ে যেতে পারে।

যুগোপযোগী মার্কসবাদ: রুশ বিপ্লব সম্পর্কে উপলব্ধি


মার্কসবাদকে উপলব্ধি করে লেনিন অবশেষে এই বোঝাপড়ায় এসে পৌঁছেছিলেন যে, রুশ বিপ্লব সহ কোনও বিপ্লবই বিশ্বের গতিপ্রকৃতি ও দ্বন্দ্বের যথাযথ বিশ্লেষণের সাথে সাথে দেশীয় পরিস্থিতি এবং দ্বন্দ্বের বিশ্লেষণ ছাড়া সফল হতে পারে না। আন্তর্জাতিক স্তরে পুঁজিবাদের বিকাশের পথ অনুসরণ করে লেনিন মার্কসের পুঁজির পর্যবেক্ষণ ও প্রবণতার দিক উল্লেখ করে বলেছিলেন, পুঁজিবাদ বিকশিত হওয়ার সাথে সাথে পুঁজির কেন্দ্রিভবন ও সঞ্চয়নের প্রবণতা একটা নতুন স্তরে পৌঁছে একটা গুণগত পরিবর্তন ঘটানোর দিকে এগোচ্ছে। মার্কস তাঁর নিজের সময়ের শেষদিকে পুঁজির একচেটিয়া প্রবণতার কথা উল্লেখ করেছিলেন, যা পরবর্তীকালে মার্কসের মৃত্যুর পর প্রকাশিত ‘ক্যাপিটাল’গ্রন্থের তৃতীয় খণ্ডে অন্তর্ভুক্ত করে গিয়েছিলেন এঙ্গেলস। লেনিন দেখালেন যে, বিংশ শতকের শুরুতে, বিকশিত একচেটিয়া পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় পুঁজির শাসন সাম্রাজ্যবাদের পর্যায়ে এসে সামগ্রিক দাসত্বের স্তরে আমাদের ঠেলে দিয়েছিল। যে স্তরকে তিনি সাম্রাজ্যবাদের সর্বোচ্চ পর্যায় হিসাবে অভিহিত করেছিলেন। এর ফলে সাম্রাজ্যবাদের অভ্যন্তরে যে দ্বন্দ্বগুলি তৈরি ও প্রকট হয়েছিল তার মূল্যায়ন ও বিশ্লেষণ করে তিনি এই সিদ্ধান্তে এসে উপনীত হয়েছিলেন যে বর্তমান স্তরের সাম্রাজ্যবাদ সমগ্র বিশ্বকে শৃঙ্খলিত করে ফেলেছে ঠিকই, তবে সাম্রাজ্যবাদের অন্তর্দ্বন্দ্বকে কাজে লাগিয়ে তার দুর্বলতম যোগসূত্রটিকে ছিন্ন করা সম্ভব — যা মানব সভ্যতার ইতিহাসে সর্বপ্রথম রুশ দেশে সম্ভব হয়েছিল। সুনির্দিষ্ট অবস্থার সুনির্দিষ্ট বিশ্লেষণের ভিত্তিতে রুশ দেশের জনতার উদ্দেশে শেষে তিনি শান্তি, রুটি ও জমির দাবিকে সামনে রেখে জনতার আন্দোলনকে অগ্রসর করে নিয়ে যেতে আন্তঃসাম্রাজ্যবাদী দ্বন্দ্বকে (প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে) তিনি গৃহযুদ্ধে পরিণত করার ডাক দিয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত রুশ বিপ্লবী আন্দোলনকে ১৯১৭ সালের অক্টোবরে এসে চূড়ান্ত বিজয়ের দিকে নিয়ে যেতে পেরেছিলেন।
সাম্রাজ্যবাদ সম্পর্কে লেনিনবাদী বোঝাপড়া, তার বিশ্লেষণ এবং আন্তসাম্রাজ্যবাদী দ্বন্দ্বের বৃদ্ধি আবারও প্রমাণ করেছিল – দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে এই দ্বন্দ্বগুলি নতুনভাবে বিকশিত হয়েছিল জার্মনির নেতৃত্বে। অবশেষে আন্তঃসাম্রাজ্যবাদী দ্বন্দ্বকে সফল ভাবে ব্যবহারের ফলে ফ্যাসিবাদের পরাজয় ঘটে, পূর্ব ইউরোপে মুক্তির বাতাস বয়ে যায় এবং সেই সূত্রে আন্তর্জাতিক পারস্পরিক সম্পর্কের গুণগত পরিবর্তনের ফলে কল্যাণকামী পুঁজিবাদের আগমন নিশ্চিত করে এবং শেষপর্যন্ত যা সমাজতন্ত্রের পক্ষেই তার অবস্থানের পরিবর্তন ঘটায়।
কৌশলগত ভাবে শ্রমিক-কৃষক সহ শোষিত শ্রেণির সকল অংশকে সংগঠিত করার মধ্য দিয়ে শ্রমিক শ্রেণির পার্টি গঠন করে সুনির্দিষ্ট অবস্থার সুনির্দিষ্ট বিশ্লেষণের মাধ্যমে মানবমুক্তির ইতিহাসের ধারাকে রূপ দিতে, বিপ্লবী আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যেতে, উপযুক্ত রণকৌশল গ্রহণের শিক্ষা আমাদের গ্রহণ করতে হবে। লেনিনবাদকে সজ্ঞায়িত করে স্তালিন বলেছিলেন লেনিনবাদই হলো ‘সাম্রাজ্যবাদী যুগের মার্কসবাদ’।

বিশ্বব্যাপী সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী সংগ্রাম


লেনিন ছিলেন বিশ্ব প্রলেতারীয় বিপ্লবের নেতা । তিনি উপলব্ধি করেছিলেন যে রুশ দেশে সমাজতন্ত্রের বিজয় এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের গঠন বিশ্বব্যাপী সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী বৈপ্লবিক সংগ্রামকে অগ্রসর করে নিয়ে যেতে প্রেরণা জোগাবে। কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালও এই বোঝাপড়ার ভিত্তিতে, বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশে কমিউনিস্ট পার্টি গঠনে সহায়তা করেছিল এবং বিশ্বের সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সংগ্রামের সঙ্গে দেশীয় জনগণের অভ্যন্তরীণ সংগ্রামের সংযুক্তি সাধনেও সহায়তা করেছিল, যেটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা । ‘ন্যাশনাল অ্যান্ড কলোনিয়াল কোয়েশ্চন’ শীর্ষক থিসিসে তিনি সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী সংগ্রামের সঙ্গে ঔপনিবেশিক দেশগুলির জাতীয় মুক্তি সংগ্রামকে একসূত্রে গেঁথে দেওয়ার কথা বলে গিয়েছিলেন।
পৃথিবীব্যাপী জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম এবং ঔপনিবেশিকবাদ বিরোধী সংগ্রামের উপরে এই থিসিস গভীর প্রভাব ফেলেছিল। সারা বিশ্বে তার এমনই প্রভাব ছিল যে এটি বিপ্লবী আন্দোলনের অগ্রগতির ইতিহাসেও পরিবর্তন ঘটিয়ে দিয়েছিল যা তাৎপর্যপূর্ণভাবে প্রভাবিত করেছিল ফ্রান্সে থাকাকালীন হো-চি-মিন’কে।
হো’র কথায়, ‘সেই সময়, অক্টোবর বিপ্লবের প্রতি আমার সহজাত সমর্থন ছিল, এখনও এর সমস্ত ঐতিহাসিক গুরুত্ব আমি উপলব্ধি করে উঠতে পারিনি। লেনিনকে ভালবাসতাম, প্রশংসাও করতাম তাঁর, কারণ এটা বুঝেছিলাম তিনি কেবলমাত্র একজন মহান দেশপ্রেমিকই ছিলেন না, নিজের দেশের মানুষকেও মুক্ত করেছিলেন। তখনও পর্যন্ত আমি তাঁর কোনও বই পড়িনি। পরে একজন কমরেড আমাকে ‘এল’হিউম্যানাইট’ থেকে প্রকাশিত লেনিনের লেখা ‘জাতীয় ও ঔপনিবেশিক প্রশ্নে থিসিস’বইটি পড়তে দিলেন। এই থিসিসের মধ্যে এমন কিছু রাজনৈতিক শব্দ ছিল যা আমার পক্ষে বোঝা খুবই কঠিন ছিল। আমি সেই সময় এটি বোঝার জন্য বারংবার তা পাঠ করতে থাকি এবং অবশেষে এর মূল অংশটা আমি ধরতেও পারি। কি আবেগ, কি উদ্দীপনা, কি স্পষ্ট-দৃষ্টি এবং আত্মবিশ্বাস সেই সময় আমার মধ্যে সঞ্চারিত হয়ে গেল, যে আনন্দে আমার চোখে জল এসে গিয়েছিল। তখন ঘরে আমি একা। কিন্তু একা বসে থাকলেও মনে হচ্ছিল এক বিশাল জনসমুদ্রের সামনে আমি যেন দাঁড়িয়ে আছি। আমি উচ্চস্বরে বলে চলেছিলাম ‘আমার প্রিয় শহীদ দেশপ্রেমিক জনগণ! এটাই তো আমাদের প্রয়োজন ছিল, কারণ এটাই আমাদের মুক্তির পথ!’ (‘The Path which Led Me to Leninism’ 1960, Selected Works of Ho Chi Minh, Vol IV )
লেনিন প্রাচ্যের মেহনতি মানুষের শিক্ষার জন্য একটি বিশ্ববিদ্যালয়ও প্রতিষ্ঠা করে গিয়েছিলেন। দেশ বিদেশের নানা প্রান্ত থেকে কমরেডরা এখানে এসে মার্কসবাদের তত্ত্বগত ও প্রয়োগিক দিকের শিক্ষা নিয়ে নিজেদের ইস্পাতদৃঢ় করে গড়ে তুলেছিলেন এবং দেশে ফিরে গিয়ে তাঁরা নিজেদের দেশের বিপ্লবী আন্দোলনকে শক্তিশালী করে সুনির্দিষ্ট পথে চলার জন্য কাজ করেছিলেন। এইভাবে শ্রমিক শ্রেণির আন্দোলনের আন্তর্জাতিক সংহতিকে শক্তিশালী করতে, অর্থাৎ ‘বিশ্বের শ্রমজীবী মানুষ এক হও, শৃঙ্খল ছাড়া তোমাদের হারাবার কিছু নেই’— এই কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিক মতবাদকে সুদৃঢ় করতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন লেনিন।

বিষয়ীগত ভাবধারা


পুঁজিবাদ কখনই আপনা-আপনি ভেঙে পড়ে না। তাকে উৎখাত করতে হয়। জনপ্রিয় সংগ্রাম ও শ্রেণি সংগ্রামের তীব্রতা বৃদ্ধির মাধ্যমে পুঁজির শাসনের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক সংগ্রামের জন্য প্রস্তুতি শুরু করতে হয় শ্রমিক শ্রণির নেতৃত্বেই। এই বস্তুগত ক্ষমতা ও শক্তি হলো একটি বিষয়ীগত ধারণা, যাকে বিকশিত করা অপরিহার্য এবং আবশ্যিক। বস্তুগত উপাদান, সঙ্কটের সুনির্দিষ্ট অবস্থা ইত্যাদি যতই উপযোগী হোক না কেন, বৈপ্লবিক অগ্রগতির জন্য অপরিহার্য ও আবশ্যিক শর্ত হিসাবে এই বিষয়ীগত ভাবধারাকে শক্তিশালী না করে পুঁজির শাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রামকে বিপ্লবী কার্যক্রমে রূপান্তরিত করা যায় না।
শ্রেণি আন্দোলনকে তীব্র করতে এবং বাস্তব অবস্থার মোকাবিলা করতে শ্রমিক শ্রেণির পক্ষ থেকে বিভিন্ন অন্তর্বর্তী স্লোগান, ব্যবস্থা এবং কৌশল এমনভাবে উপস্থিত করা দরকার, যাতে শ্রমজীবী মানুষের আন্দোলনের তীব্রতা বৃদ্ধি করে বাস্তব অবস্থার মোকাবিলা করে নিজ নিজ দেশে বিপ্লবী রূপান্তরের প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে।

বিপ্লবী কৌশল


আন্দোলনের এই প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নিতে কিভাবে উপযুক্ত কৌশল গ্রহণ করা যাবে, লেনিনের কাছ থেকে আমরা সেই নির্দেশও পেয়ে থাকি। লেনিনের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে প্রয়াত এম, বাসবপুন্নাইয়া, ‘পিপলস ডেমোক্রেসি’ পত্রিকায় একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন যার শিরোনাম ছিল ‘মাস্টার ট্যাকটিশিয়ান অব দ্য ওয়ার্কিং ক্লাস ইন ইটস স্ট্রাগল ফর পলিটিক্যাল পাওয়ার অ্যান্ড ইটস কনসোলিডেশন’। এই প্রবন্ধে বলা হয়েছে, লেনিন কীভাবে রুশ বিপ্লবের বিজয়ের লক্ষ্যে পরিচালিত ঘটনার প্রতিটি মোড়ে সঠিক কৌশল নির্ধারণ করেছিলেন, অবশ্য তাঁর কৌশলগত প্রতিভার এই দিকটায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে, অনেকেই মনোযোগ দেন না। বিশ্বব্যবস্থার বর্তমান পর্যায়ে সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে বিশ্ব বিপ্লবী আন্দোলনকে এগিয়ে নিতেও সঠিক কৌশল অবলম্বনের নির্দেশনা আমরা তাঁর কাছেই পাই।
স্তালিন তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘লেনিনবাদের ভিত্তি’র মধ্যে লেনিনের কৌশলগত নীতির যে সংক্ষিপ্তসার রচনা করে দিয়ে গেছেন তার মূল কথা হলো (১) জাতীয় বিশেষত্ব এবং বৈশিষ্ট্যগুলির উপর ভিত্তি করা, (২) সর্বহারা শ্রেণির জন্য মিত্র অর্জনের ক্ষুদ্রতম সম্ভাবনাগুলিকে ব্যবহার করা, এমনকি যদি তারা অস্থায়ী, অস্থির, দোদুল্যমান বা অবিশ্বস্ত হয়, এবং (৩) জনগণের বাস্তব রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা হিসাবে কেবল প্রচার এবং আন্দোলন রাজনৈতিক শিক্ষার জন্য যে যথেষ্ট নয়। এই কথা সত্য হলেও বিপ্লবী সংগ্রামের অগ্রগতির ক্ষেত্রে তা কাজে লাগাতে হবে।

আজকের দিনে আমাদের কাজ


বর্তমান ভারতীয় পরিস্থিতিতে, লেনিনবাদী পথেই আমাদের অগ্রসর হতে হবে। এর জন্য আশু কর্তব্য হলো বিজেপি-কে বিচ্ছিন্ন ও পরাস্ত করা। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাকে ব্যবহার করে ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক সাধারণতন্ত্রকে আরএসএস’র ভাবনায় পরিচালিত করতে, ভারতীয় সংবিধানকে ধ্বংস করার জন্য একটি তীব্র অসহিষ্ণু, ফ্যাসিবাদী ‘হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্র’ প্রতিষ্ঠা করতে, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাকে তারা ব্যবহার করতে চাইছে। এদের বিছিন্ন করাই আমাদের মূল কাজ। এক্ষেত্রে লেনিনবাদী নীতির উপর ভিত্তি করে উপযুক্ত কৌশল অবলম্বন করাই আজকের দিনের কাজ।
লেনিন দীর্ঘজীবী হোন!

Spread the word

Leave a Reply