Lenin, Imperialism and the Question – Nilotpal Basu

৭ নভেম্বর ২০২৩(মঙ্গলবার)

আবার নভেম্বর। সোয়াশো বছর পেরিয়ে এবছর ১২৬। নভেম্বর মাস বিপ্লবের মাস। আর প্রকৃতপক্ষে লেনিন মাস। যতবার আমরা ফিরে তাকাই উপলব্ধি আরও গভীর হয়। তত্ত্ব আর প্রয়োগের অপূর্ব সমন্বয়ে বৈপ্লবিক সৃজন যতবার বিশ্লেষণ করা যায় ততই স্পষ্ট হয় কেন লেনিনবাদ মার্কসবাদের স্বাধীন কিন্তু ধারাবাহিকতায় সম্প্রসারণ লগ্নিপুঁজি। এবং সাম্রাজ্যবাদ মার্কসের পুঁজি সংক্রান্ত, এবং উল্লেখযোগ্যভাবেই পুঁজি এবং শ্রমের দ্বন্দ্বে যুক্তিসঙ্গত পরিণতি।

লগ্নিপুঁজি এবং সাম্রাজ্যবাদ সংক্রান্ত তাত্ত্বিক উদ্ভাবন কিন্তু বস্তুগত, সমাজ এবং ইতিহাসের বিশ্লেষণের গর্ভজাত। মার্কস আগেই আবিষ্কার করেছিলেন পুঁজিবাদের অনিবার্য পরিণতি একচেটিয়া বিকাশে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ইউরোপের বিভিন্ন দেশের জাতীয় পুঁজির মধ্যে অনিবার্য সংঘাত প্রভাব ইউরোপীয় শ্রমিক আন্দোলনেও সংঘাত তৈরি করছিল। স্ব-স্ব দেশের পুঁজিবাদের স্বার্থের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হয়ে পড়ছিল সেই সব দেশের শ্রমিক আন্দোলন। শ্রমিক আন্দোলনের এবং শ্রমিকশ্রেণির যে বৈশিষ্ট্য তার অনিবার্য চাহিদা শ্রমিকশ্রেণির আন্তর্জাতিক চরিত্র এবং আন্তর্জাতিকতাকে রক্ষা করতে হলে যে কোনও মূল্যেই এই বিভাজন এবং সংঘাতকে অতিক্রম করে শ্রমিকশ্রেণির ঐক্য প্রতিষ্ঠার চ্যালেঞ্জটিকে গ্রহণ করতেই হতো। লেনিনও তাই করলেন। শ্রমিকশ্রেণিকে ঐক্যবদ্ধ করবার বাস্তব চাহিদাই সাম্রাজ্যবাদের ধারণাটির জন্ম দিল। কোনও কল্পনাবিলাসী তত্ত্ব নয়, বরং বস্তু পরিস্থিতি এবং পরিবর্তনের প্রয়োজনকে আত্মস্থ করা।

বিভিন্ন ইউরোপীয় দেশের জাতীয় পুঁজির সীমার মধ্যে পুঁজিবাদী দেশগুলির সংঘাতকে ব্যাখ্যা করা সম্ভব হচ্ছিল না। সুতরাং, সাম্রাজ্যবাদের তত্ত্ব। সাম্রাজ্য দখলের বাজার, শ্রম আর প্রাকৃতিক সম্পদের নিয়ন্ত্রণ— বা আরও নির্দিষ্টভাবে আধিপত্য বিস্তারের রাজনৈতিক অভিব্যক্তি। কিন্তু এর অর্থনৈতিক অনুষঙ্গ তো উপেক্ষিত হতে পারে না। সুতরাং, পুঁজির দ্রুত এবং অতিকায় বৃদ্ধির জন্য পুঁজির নতুন বৈশিষ্ট্যও বিশ্লেষণ করাও জরুরি ছিল। লেনিন দেখালেন দেশের অভ্যন্তরে দেশীয় একচেটিয়া পুঁজি দেশের বাজারকে ব্যবহার করে যে মুনাফা অর্জন করে তা সীমান্ত পেরিয়ে দেশান্তরে পুঁজি বিনিয়োগের যে নতুন চাহিদা সাম্রাজ্যবাদ দাবি করে তার জন্য লগ্নিপুঁজির গুরুত্বপূর্ণ ও অপরিসীম ভূমিকা। ব্যাঙ্ক পুঁজি এবং শিল্প পুঁজির সংমিশ্রণে— লগ্নিপুঁজি।

(২)

তখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলির মধ্যে দেশ দখলের প্রতিযোগিতা। যুদ্ধ‍‌ শেষে পৃথিবী উথাল-পাথাল। লাল-নীল পেন্সিল হাতে নিয়ে সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলো মানচিত্রকে কাটাছেঁড়া করা। কিন্তু সবকিছুকে ছাপিয়ে গেল সাম্রাজ্যবাদীদের বুকে কাঁপন ধরানোর নতুন চ্যালেঞ্জের অভ্যুদয় নভেম্বর বিপ্লব। সোভিয়েত ইউনিয়ন।

লেনিন সাম্রাজ্যবাদের তত্ত্বের ব্যাখ্যা সামনে এনেছিলেন দেশে দেশে শ্রমিকশ্রেণির মধ্যেকার বিরোধকে অতিক্রম করতে। তার বাস্তবসম্মত অভিব্যক্তি ঘটলো নতুন স্লোগান সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে শ্রমিকশ্রেণির ঐক্যের অনিবার্য প্রয়োজনে। শান্তি চাই। সাম্রাজ্যবাদের অনিবার্য বৈশিষ্ট্য দেশ দখলের আধিপত্যের যুদ্ধ। শ্রমিকশ্রেণির প্রতিনিধি শ্রমিকশ্রেণির নেতৃত্ব মৌলিকভাবে এর বিরোধী। আর শ্রমিকশ্রেণির রাষ্ট্র সোভিয়েত ইউনিয়ন হয়ে উঠলো এই রণধ্বনির মূর্ত প্রতীক। একটুকরো রুটি, একখণ্ড জমি আর যুদ্ধ নয়, শান্তি।

British troops go over the top of the trenches during the Battle of the Somme, 1916. (Photo by Paul Popper/Popperfoto/Getty Images)

(৩)

কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে সমাজতন্ত্র এবং সাম্রাজ্যবাদের মধ্যে দ্বন্দ্বে ভারসাম্য তো সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতিষ্ঠায় গুণগতভাবে বদলালো না। আর পৃথিবীর মানচিত্রকে কাটাছেঁড়া করার যে চিরাচরিত প্রবণতা তারও পরিবর্তন ঘটলো না।

কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অবসানে অটোমান সাম্রাজ্যের পতন ঘটলো। ব্রিটিশ এবং ফরাসি সাম্রাজ্যবাদ ভাগ-বাটোয়ারায় লিপ্ত হয়ে পড়লো তাদের স্ব-স্ব প্রভাবের এলাকা নির্দিষ্ট করে নেওয়ার জন্য।

সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রভাবে প্রথম বিশ্বযুদ্ধত্তোর সময়েই উন্মেষ ঘটলো সাম্রাজ্যবাদী প্রভাবমুক্ত নতুন জাতীয়তাবাদের। অটোমান সাম্রাজ্যের প‍‌তনের পর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়েই ব্রিটিশ ও ফরাসি সাম্রাজ্যবাদীরা নিয়ন্ত্রণের বাটোয়ারা করতে গিয়ে নিজেদের মধ্যে উপনীত হলো কুখ্যাত সাইকস-পাইকট চুক্তিতে। এই গোপন চুক্তি আরব ব-দ্বীপের বাইরের আরব প্রদেশগুলিকে ভবিষ্যতে নিয়ন্ত্রণ ও প্রভাবের এলাকাগুলিকে ভাগ করে নিল। রাশিয়ার জার সরকারও চুক্তির অংশীদার ছিল। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠার পর নতুন সরকার লেনিনের নেতৃত্বে এই চুক্তির কদর্য সাম্রাজ্যবাদী পরিকল্পনাকে সামনে নিয়ে এসেছিল।

এই সময়েই ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীর ব্যালসফ ঘোষণায় বলা হলো ব্রিটেনের মহামহিমের সরকার প্যালেস্তাইনে ইহুদিদের একটি জাতীয় বাসভূমি প্রতিষ্ঠার সপক্ষে এবং ব্রিটিশ সরকার তাদের সমস্ত প্রয়াস জারি রাখবে ইহুদি বাসভূমির এই লক্ষ্যকে সফলভাবে রূপায়িত করতে। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী লয়েড জর্জ নির্দিষ্টভাবেই ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের লক্ষ্য নির্ধারণ করে দিলেন। তাঁর স্পষ্ট বক্তব্য ‘‘এই সঙ্কটপূর্ণ পরিস্থিতিতে ইহুদিদের সহমর্মিতা বা তার বিপরীত বিকল্প মিত্রপক্ষের প্রয়োজনের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য গড়ে দেবে। বিশেষত এই সহমর্মিতা মার্কিনী ইহুদিদের সমর্থন আদায় করে নেবে। এই সমর্থনের ভারসাম্য জার্মান সামরিক চাহিদা‍‌গুলিকে পূরণ করতে এবং পূর্ব সীমান্তে তাদের অর্থনৈতিক অবস্থাকে অটুট রাখবার লক্ষ্যকে পূরণ করবে।

লেনিনের সাম্রাজ্যবাদ সম্পর্কে তাত্ত্বিক বিশ্লেষণরে এত নিখুঁত প্রতিফলন সমসায়িক ঘটনাবলীতে হয়তো আর দেখতে পাওয়া যাবে না। সাম্রাজ্যবাদের যে চিরাচরিত বৈশিষ্ট্য সাম্রাজ্যবাদের নিয়ন্ত্রণে থাকা ভূখণ্ডের জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতি বিন্দুমাত্র বিবেচনাকে অস্বীকার করা তাও এই ইহুদি জনগণের বাসভূমি এবং রাষ্ট্র পত্তনের মধ্যেই স্পষ্ট হলো। বিংশ শতাব্দীর শুরুতে প্যালেস্তাইনের এই আরব ভূখণ্ডে জনসংখ্যার ৯৭ শতাংশই ছিলেন আরব-প্যালেস্তিনীয়।

এই ভূখণ্ডেই জেরুজালমে। খ্রিস্টান, ইসলাম এবং ইহুদি ধর্মাবলম্বীদের কাছে পবিত্র। ইতিহাসের ঘটনাবলীর বিশ্লেষণের থেকে এটাও পরিষ্কার যে এই ভূখণ্ডে আরব প্যালেস্তিনীয় অধিবাসীদের বহিষ্কার করার দাবি সমস্ত ইহুদী ধর্মাবলম্বী অনুগামীদের দাবি ছিল না। এই দাবি ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষদিকে ইউরোপে বসবাসকারী ধনী ইহুদিদের। তারই রাষ্ট্রিক অভিব্যক্তি জায়নবাদ।

বিংশ শতাব্দীর তিরিশের দশকে ফ্যাসিবাদের উত্থানের পটভূমিতে ইহুদি পলায়ন ত্বরান্বিত হলো প্যালেস্তাইনের দিকে। ইহুদি ধর্মাবলম্বীদের জনসংখ্যা কিছুটা বাড়লেও এই ভূখণ্ডে ছিল আরব প্যালেস্তিনীয়দের নিরঙ্কুশ এবং চূড়ান্ত সংখ্যাগরিষ্ঠতা। কিন্তু তাসত্ত্বেও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে নতুন রাষ্ট্রসঙ্ঘ প্রতিষ্ঠার পর ১৮১ (২) প্রস্তাবিত ও গৃহীত হলো সাধারণ পরিষদে। এই প্রস্তাবের নির্যাস ছিল এই ভূখণ্ডের বিভাজন একটি আরব রাষ্ট্র, একটি ইহুদি রাষ্ট্র এবং জেরুজালেম সহ। যার নিয়ন্ত্রণ নিরঙ্কুশভাবে প্যালেস্তিনীয় বা ইহুদী কারোর হাতেই থাকবে না।

কিন্তু জায়নবাদের আক্রমণাত্মক মতাদর্শের মূল নির্যাস কখনোই আরব এবং ইহুদিদের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের পক্ষে ছিল না। রাষ্ট্রসঙ্ঘে বিভাজনের যে পরিকল্পনা গৃহীত হলো স্বভাবতই দু’হাত তুলে তাকে সমর্থন জানিয়েছিল জায়নবাদীরা, ইজরায়েলীরা। কারণ জনসংখ্যার তুলনামূলক ভারসাম্যকে চূড়ান্তভাবেই উপেক্ষা করে ইজরায়েলীদের দেওয়া হয়েছিল ভূখণ্ডের শতকরা ৫৮ শতাংশের নিয়ন্ত্রণ।

আধুনিক রানৈতিক জায়নবাদের নেতারা প্রথম থেকেই একটি ইহুদি সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্র গড়ে তুলতে চেয়েছে পৃথিবীর এমন একটি ভূখণ্ডে যেখানে প্যালেস্তিনীয় আরবরা ছিল শুধু নিরঙ্কুশ নয়, ভয়ঙ্করভাবেই সংখ্যাগরিষ্ঠ। সুতরাং জায়নবাদীদের রণধ্বনির শুরুর থেকেই জনসংখ্যার স্থানান্তর— আজকের রাজনৈতিক ভাষ্যে ‘এথনিক ক্লিনসিং’। তাদের কুখ্যাত তাত্ত্বিক-আধুনিক জায়নবাদের জনক থিওডর হাজিল লিখেছিল ১৮৯৫ সালে ‘‘আমরা কপর্দক শূন্য আরও জনসংখ্যাকে স্থানান্তরিত করবো আশপাশের বিভিন্ন দেশে। রোজগার দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে। কিন্তু তাদের কোনোভাবেই আমাদের দেশে রোজগারের কোনও সম্ভাবনাই বর্জন করবো। দরিদ্র প্যালেস্তিনীয়দের স্থানান্তর এবং তাদের জমি কেড়ে নেওয়ার প্রক্রিয়াটি হবে নীরবে।’’ নৃশংস এই জায়নবাদ ১৯৩৭ সালের আগস্টে জায়নবাদী সংগঠনগুলির সম্মেলনে ডেভিড মেনগুরিয়ান ১৯৪৮ সালে ইজরায়েলের প্রথম প্রধানমন্ত্রী স্পষ্টভাবে ঘোষণা করে দিয়েছিল যে আরব প্যালেস্তিনীয়দের স্থানান্তর না করে নতুন জমি দখলে আনা সম্ভব হবে না। ১৯৩৮ সালের জুন মাসে মেনগু‍‌রিয়ান দ্বিধাহীনভাবে বলেছিল ‘‘আমি বাধ্যতামূলকভাবে স্থানান্তরকে সমর্থন করি। আমি এর মধ্যে অনৈতিক কিছুই দেখি না।’’ এবং ‘উপসংহারে মেনগুরিয়ানের বক্তব্য ‘‘প্যালেস্তাইনে ইহুদি ক্ষমতার ক্রমবর্ধমান অগ্রগতি বড় আকারে স্থানান্তরের সম্ভাবনাও আমাদের জন্য বাড়িয়ে দেবে।’’ ১৯৪৮ সালে তৈরি হলো জায়নবাদীদের প্ল্যান ডালেট। তেল আভিভে যে সামরিক নির্দেশ কার্যকর করার পরিকল্পনা হলো সেখানে নির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত হলো প্যালেস্তিনীয় জনসংখ্যার সেই কেন্দ্রগুলিকে যেখানে তাদের নিশানা বানানো হবে— এমন একটা নীল নকশা যেগুলির লক্ষ্য হবে প্যালেস্তিনীয় মুক্ত ভূখণ্ড এবং তাদের ধ্বংস করা।

আসলে ইজরায়েলের জায়নবাদী এই আগ্রাসন সম্ভবই হতো না সাম্রাজ্যবাদের পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া। প্রথমে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ এবং পরে ’৬০-র দশক থেকে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের সক্রিয় মদত। ১৯৪৮ সালে রাষ্ট্রসঙ্ঘে যে প্রস্তাব ভাগ করার জন্য গৃহীত হয়েছিল তা কার্যকরী হতে পারেনি মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী এবং তাদের পশ্চিমী সহযোগীদের জন্য। একটি হিসাব বলছে ১৯৭১ সাল থেকে আজ পর্যন্ত রাষ্ট্রসঙ্ঘের সাধারণ পরিষদ এবং নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাবগুলিকে নির্বিষ করে দেওয়ার জন্য মার্কিনীরা ৩৫ বার ভেটো প্রয়োগ করেছে। একদিকে ইজরায়েলের একতরফা আইন লঙ্ঘন আর অন্যদিকে সাম্রাজ্যবাদের আর্থিক এবং অস্ত্রশস্ত্রের মদত। এটাই প্যালেস্তিনীয়দের বিরুদ্ধে একটি বৈষম্যবাদী দখলদারি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে সাহায্য করেছে। এককথায় বলতে গেলে ইজরায়েলের কার্যকলাপ সাম্রাজ্যবাদী-জায়নবাদী জোটের পরিণতি।

A Palestinian man sits with members of his family outside a building destroyed in an Israeli air strike in Rafah in the southern Gaza Strip on October 12, 2023. Thousands of people, both Israeli and Palestinians have died since October 7, 2023, after Palestinian Hamas militants entered Israel in a surprise attack leading Israel to declare war on Hamas in the Gaza Strip enclave on October 8. (Photo by SAID KHATIB / AFP) (Photo by SAID KHATIB/AFP via Getty Images)

(৪)

ইজরায়েল অভ্যন্তরীণ উপনিবেশবাদের প্রবক্তা। তাই ’৪৮ সালে বিপর্যয় যেখানে প্রায় ৮ লক্ষ প্যালেস্তিনীয়কে স্থানান্তরিত হতে বাধ্য করেছিল এবং ১৯৬৭ সালের যুদ্ধের পরে আরও বিস্তীর্ণ এলাকা ইজরায়েল তার নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসে। তারপরেও ক্রমাগত ওয়েস্ট ব্যাঙ্কে নতুন নতুন ইজরায়েলী উপনিবেশ তৈরি হচ্ছে। আর অন্যদিকে গাজায় তৈরি হয়েছে পৃথিবীর সর্ব বৃহৎ খোলা আকাশের নিচে জেলখানা। দানবীয় তথাকথিত নিরাপত্তা প্রাচীর এবং প্রায় ১৮০টি নিরাপত্তা চেকপোস্ট প্যালেস্তিনীয়দের অবাধ যাতায়াতকে নিষিদ্ধ করে দিয়েছে ইজরায়েলী রাষ্ট্র। অভ্যন্তরীণ উপনিবেশে সব অর্থেই প্যালেস্তিনীয়রা নিজভূমে পরবাসী। ১৯৪৮ সাল থেকে আজ অব্দি কয়েক দশক ধরে অকথ্য অত্যাচার ও নিপীড়নের শিকার তারা। তথাকথিত আত্মরক্ষার অধিকারের নামে জায়নবাদী ইজরায়েল প্যালেস্তিনীয়দের মানবিক অধিকার ও স্বাধীনতাকে ধূলিসাৎ করে দিয়েছে।

রাজনৈতিকভাবেও প্যালেস্তিনীয়দের মুক্তিসংগ্রামকে অস্তিত্বহীন করার জন্য ’৮০-র দশকে প্রতিষ্ঠিত হামাসকেও প্রাথমিকভাবে পৃষ্ঠপোষকতা করেছে ইজরায়েল। কিন্তু নিরবচ্ছিন্ন অত্যাচার আজও প্যালেস্তাইনের বধ্যভূমিতে প্রতিরোধের যে আবহ তৈরি হয়েছে তাকে অস্বীকার করে ইজরায়েল এবং তার মার্কিনী পৃষ্ঠপোষকরা এবং তাদের পশ্চিমী সহযোগীরা যতই সার্টিফিকেট দেওয়ার চেষ্টা করুক না কেন স্পষ্ট যে ইজরায়েল একটি নৃশংস সন্ত্রাসবাদী রাষ্ট্র যারা প্যালেস্তিনীয়দের মানবাধিকারকে স্বীকার করে না।

কিন্তু এতসব করেও শেষরক্ষা হয়নি। ইজরায়েলের অভ্যন্তরে এবং গোটা পৃথিবীতেও আন্তর্জাতিক কর্পোরেট মিডিয়া যে ধারণা তৈরি করেছিল যে ইজরায়েল দুর্ভেদ্য এবং কোনোভাবেই প্যালেস্তিনীয় প্রতিরোধ তাদের ন্যায় সঙ্গত উচ্চারণগুলিকে ধ্বনিত হতে দেবে না তাও চুরমার হয়ে গেছে।

আসলে উপনিবেশের মানুষের স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা যখন সশস্ত্র বিরোধিতায় রূপান্তর ঘ‍‌টে তখনই স্বাধীনতাকামীদের সন্ত্রাসবাদী হিসাবে চিহ্নিত করার ষড়যন্ত্র চলে। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীরা এদেশে ভগৎ সিংদের, সিপাহী বিদ্রোহের কুশীলবদের, চট্টগ্রামের বিপ্লবীদের এভাবেই দেখেছে। কিন্তু ইতিহাস সাক্ষী স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষাকে অত্যাচারের তীব্রতায় কখনোই স্তব্ধ করে দেওয়া যায় না।

(৫)

আসলে ইজরায়েলী জায়ণবাদীদের এই নরমেধ যজ্ঞ এবং গণহত্যার যা এখনো নিরবচ্ছিন্ন বোমাবর্ষণের মধ্য দিয়ে অব্যাহত রয়েছে গাজা ভূখণ্ডে তা কি এই সত্যকে ইজরায়েলের অভ্যন্তরীণ উপনিবেশবাদী কার্যকলাপের বাস্তবতাকে লুকিয়ে রাখতে পারে! তিনশো ছাপ্পান্ন বর্গ কিলোমিটারের ভূখণ্ডে ২২ লক্ষ প্যালেস্তিনীয় পৃথিবীর মধ্যে সর্বোচ্চ জনসংখ্যার ঘনত্ব বিশিষ্ট এলাকা। যার সমস্ত সীমানা আটকে তাণ্ডব চালানো হচ্ছে সন্ত্রাসবাদের অজুহাতে বিশ্বজনমতের সামনে এর গ্রহণযোগ্যতাকে বৈধতা দিয়ে পারে!

(৬)

পশ্চিম এশিয়ার রাজনৈতিক জমিতে ইজরায়েলের গণহত্যার ভারসাম্যের কিছুটা হলেও পরিবর্তন ঘটিয়েছে। দু’বার নিরাপত্তা পরিষদে ইজরায়েলের গণহত্যার বিরুদ্ধে যুদ্ধ বিরতি ঘোষণা করার প্রস্তাব আটকে দিয়েছে মার্কিনী ভেটো। তারপরে সাধারণ পরিষদে ঐতিহাসিক ভোট। ১২০টি দেশ একঘরে করেছে ইজরায়েল এবং তার মার্কিনী সহযোগীদের। মার্কিন বিদেশ সচিব অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন ও মার্কিন রাষ্ট্রপতি জো বা‍ইডেন আরও  দেশগুলির মধ্যে ইজরায়েলের ভূমিকার বৈধতা দেওয়ার জন্য সমস্ত রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক প্রচেষ্টা বানিয়েছেন। কিন্তু তাই অক্টোবরের ঘটনার পরবর্তীতে ইজরায়েল ও সৌদি আরবের মধ্যে সম্পর্ককে স্বাভাবিক করার যে প্রচেষ্টা তাকে বিশবাঁও জলে ফেলে দিয়েছে।

আসলে দুনিয়াব্যাপী যে একমেরু পৃথিবী মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ গড়তে চেয়েছিল চীনের শক্তিশালী অর্থনৈতিক উপস্থিতি ন্যাটোর সঙ্গে ইউক্রেন নিয়ে সাম্রাজ্যবাদীদের সঙ্গে রাশিয়ার সংঘাত আরব দেশগুলিতেও একটি স্বাধীন অবস্থান নেওয়ার পরিস্থিতি তৈরি করেছে। মানবতার স্বার্থে যুদ্ধবিরতির যে প্রস্তাব রাষ্ট্রসঙ্ঘের সাধারণ পরিষদে গৃহীত হলো তা উত্থাপন করেছিল আরব লীগের সমস্ত সদস্যরা যৌথভাবেই।

আর প্যালেস্তাইনকে ঘিরে প্রচণ্ড শক্তিশালী সংহতি আন্দোলন সৃষ্টি হয়েছে। লক্ষ লক্ষ মানুষ ইউরোপের রাজধানীগুলিতে, আরব দুনিয়ায় সাম্রাজ্যবাদী মার্কিনী কার্যকলাপকে জনগণের ধিক্কারের মুখোমুখি করে দিয়েছে। আরব দেশগুলির সরকারগুলিও জনগণের এই সংহতি প্রতিরোধকে উপেক্ষা করতে পারছে না।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি ব্যাপক এলাকাজুড়ে ইহুদি ধর্মালম্বী মানুষের নেতানিয়াহুর জায়নবাদী অমানুষিক ভূমিকার বিরুদ্ধেও সোচ্চার। নিউইয়র্কের সেন্ট্রাল মেট্রো স্টেশনের যে দৃশ্য আমরা দেখেছি তা এককথায় অভূতপূর্ব। যুদ্ধের বিরুদ্ধে ইহুদিরা এই স্লোগা‍‌নে লক্ষ লক্ষ ইহুদি মানুষ সমবেত হচ্ছে না। আর ইজরায়েলের অভ্যন্তরেও নেতানিয়াহুর সরকারকে এই মরিয়া গণহত্যায় প্ররোচিত করছে তার বিরুদ্ধে ৭ অক্টোবর যে জনমত ছিল তাকে পুরোপুরি স্তব্ধ করতে পারেনি।

(৭)

আসল এই সংহার কোনও ধর্মযুদ্ধ নয়। জায়নবাদ একটি রাজনৈতিক প্রকল্প। রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের জন্য এবং মূল অধিবাদীদের স্বাধীনতা কেড়ে নিয়ে জনসংখ্যা বিতাড়নকে ভিত্তি করে এই প্রচেষ্টা আজকে পরিষ্কার। সারা পৃথিবী জুড়েই উগ্র দক্ষিণ পন্থার যে উত্থান তারই প্রতিফলন সমকালীন পশ্চিম এশিয়ায়।

ইজরায়েলকে তার রণনীতিগত ঘাঁ‍‌টি হিসাবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর আরব জাতীয়তাবাদী তরঙ্গের বিরুদ্ধে প্রতিস্থাপিত করতে চেয়েছিল সাম্রাজ্যবাদ। মধ্যপ্রাচ্যে যে সাম্রাজ্যবাদী আধিপত্য তারই মূল বর্শাফলক হিসাবে সাম্রাজ্যবাদ ইজরায়েলকে দেখেছে। তাই ইজরায়েলের শর্ত মানবতা বিরোধী অপরাধকে ও তারা কখনোই বিরোধিতা করেনি। এই গণ ধ্বংসযজ্ঞের পটভূমিতেও তাদের রক্তাক্ত হাতকে মোছবার কোনও প্রচেষ্টাও চোখে পড়ছে না।

তাই অনিবার্যভাবেই লেনিন এসে পড়েন। এটাই সাম্রাজ্যবাদ, সাম্রাজ্যবাদের রণনীতি জায়নবাদ সৃষ্টি করেছে। উগ্র দক্ষিণপন্থী অভিযানের বর্শফলক সাম্রাজ্যবাদী জায়নবাদীদের জোট। লেনিনের উত্তরসূরি ফিদেল কাস্ত্রো যেমন বলেছিলেন পৃথিবীর সামনে বিকল্প সমাজতন্ত্র কিংবা বর্বরতা। আজ আবার এটাই প্রমাণিত।

আক্ষেপের বিষয় যে ভারতের জাতীয়তা আন্দোলন স্বাধীনতার আগের থেকেই প্যালেস্তিনীয় মুক্তিসংগ্রামের সবচেয়ে দৃঢ় সমর্থক ছিল মার্কিন সাম্রাজ্যবাদে অধীনস্ত মিত্র হিসাবে মোদী সরকার সেই উত্তরাধিকারের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। এটা কোনও কাকতালীয় ঘটনা নয়। আরএসএস প্রকাশ্যেই ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের বিরুদ্ধে স্পষ্ট অবস্থান নিয়েছিল। সুতরাং প্যালেস্তাইনের জনগণের মুক্তির ন্যায়সঙ্গত বৈধতা নিয়ে নরেন্দ্র মোদীর কোনও মাথাব্যথা নেই। ৭ অক্টোবরের পরেই মোদী তাই ট্যুইন করে নেতানিয়াহুকে সমর্থন জানিয়েছিল। আরএসএস একধাপ এগিয়ে তাদের স্বয়ংসেবকদের রণাঙ্গনে পাঠাবার কথাও বলেছিল। কিন্তু পরিস্থিতি তো বদলাচ্ছে। তাই ভারতীয় বিদেশমন্ত্রককেও অন্তত আনুষ্ঠানিকভাবে হলেও ভারতীয় বিদেশনীতির সাবেক অবস্থানকে উচ্চারণ করতে হয়েছে।

কিন্তু আমরা জানি লড়া‍‌ইয়ের পথ দীর্ঘ। প্যালেস্তাইনের মানুষেরও, আমাদেরও। গাজার গণহত্যার মধ্যে দাঁড়িয়েও তারা টিকে থাকবার জন্য, প্রতিরোধ করবার জন্য, নিজেদের বাসভূমিতে ফিরে আসার জন্য স্লোগান তুলেছেন। আর অন্যদিকে আমাদের সামাজিক মিডিয়ায় বিজেপি’র আইটি সেলের যোদ্ধারা মিথ্যা খবর প্রচার করেছেন। প্যালেস্তাইনের স্বাধীনতা সংহতিতে দাঁড়ালো ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ শক্তির বিরুদ্ধে, ইজরায়েলের অভিযান নিয়ে সারা পৃথিবীতে যত মিথ্যা খবর প্রচার হয়েছে তার অর্ধেকের বেশি তৈরি হয়েছে ভারতেই। লক্ষ্য একটাই ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ বিরোধীদের সন্ত্রাসবাদের সমর্থক হিসাবে প্রতিপন্ন করা।

লেনিন শিখিয়েছিলেন সমকালীন পৃথিবীতে সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতা না করে কোনও প্রগতিশীল বিপ্লবী আন্দোলনের অগ্রগতি ঘটতে পারে না। আমাদের লড়াই তাই শুধু বিধ্বস্ত প্যালেস্তিনীয়দের প্রতি সংহতি জ্ঞাপন নয়। আমাদের দেশেও যে উগ্রহিন্দুত্বের ছত্রছায়ায় ফ্যাসিবাদী অভিযান তার বিরুদ্ধেও ভারতীয় জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করতে। আজকের সময়ের ডাক এটা প্রমাণ করায় ভারতীয় জনগণ প্যালেস্তিনীয়দের ন্যায়সঙ্গত সংগ্রাম সম্পর্কে ভারতের সরকারের অবস্থানকে পরাস্ত করবে।

Spread the word

Leave a Reply