34 years Of LeftFront 1

Left Front Government WB: The Alternative

অঞ্জন বেরা

বামফ্রন্ট সরকার চৌত্রিশ বছরের (১৯৭৭-২০১১) অভিজ্ঞতা পশ্চিমবঙ্গেই শুধু নয়, বহুদলীয় সংসদীয় ব্যবস্থার সাধারণ ইতিহাসেও অনন্য। জনগণের ভোটে জিতে এরকম উপর্যুপরি বাম-নেতৃত্বাধীন সরকার পরিচালনার নজির অন্য কোথাও তৈরি হয়নি। বামফ্রন্ট সরকার নজিরবিহীন শুধুমাত্র তার মেয়াদের দৈর্ঘ্যের কারণেই নয়। বামফ্রন্ট সরকারের রাজনৈতিক তাৎপর্য বহুমাত্রিক। বামপন্থী সরকারের তাৎপর্যের ভিত্তি তার বিকল্প নীতি। বামফ্রন্ট সরকার পরাজিত হবার পর চোদ্দ বছর পার হয়ে গেলেও জনস্বার্থবাহী বিকল্প নীতির অনুশীলনে সেই সরকারের অভিজ্ঞতাগুলি আজও প্রাসঙ্গিক।

34 years Of LeftFront 3

বামফ্রন্ট সরকারের অভিজ্ঞতা বলতে শুধু  তার সাফল্যের অভিজ্ঞতা নয়, তার সীমাবদ্ধতা এবং দুর্বলতাগুলিও সেই অভিজ্ঞতার অংশ। বুর্জোয়া-জমিদার রাষ্ট্র ব্যবস্থার মৌলিক কাঠামোগত সীমাবদ্ধতার মধ্যেই তাকে কাজ করতে হয়েছে। কার্যকর করতে হয়েছে জনস্বার্থবাহী বিকল্প নীতি। এক্ষেত্রে বামফ্রন্ট সরকারের সাফল্য সমগ্র দেশে আজও বিকল্প নীতি রূপায়ণ-প্রকল্পে গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশিকা। বিশেষত নয়া উদারবাদ পর্বে তার গুরুত্ব সবিশেষ তাৎপর্যময়।

বামফ্রন্ট সরকার কোনও আকস্মিক উন্মোচন নয়। বাম ও গণতান্ত্রিক শক্তির লাগাতার আন্দোলন সংগ্রাম, ১৯৬০ দশকের দ্বিতীয়ার্ধে স্বল্পমেয়াদি দুটি যুক্তফ্রন্ট সরকার,  ১৯৭০-র দশকের প্রথমার্ধে  আধাফ্যাসিস্ত তানাশাহীর বিরুদ্ধে সংগ্রাম, জরুরি অবস্থার মোকাবিলা, অনেক আত্মত্যাগ ১৯৭৭ সালের বামফ্রন্ট সরকার গঠনের প্রেক্ষাপট নির্মাণ করেছিল। রাজ্যস্তরে বাম-নেতৃত্বাধীন সরকার গঠনের সম্ভাবনাগুলি মূর্ত হয় শাসক শ্রেণিগুলির সঙ্কট ও ব্যর্থতার প্রেক্ষাপটে।  ১৯৬৭ সালে প্রথম যুক্তফ্রন্ট সরকারের বিকল্প কর্মসূচি সাধারণ মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। যদিও যুক্তফ্রন্ট সরকার বাম-নেতৃত্বাধীন সরকার ছিল না। জরুরি অবস্থার দিনগুলি শাসক শ্রেণির সঙ্কটকে নগ্নতর করে দেয়। নতুন অভিজ্ঞতার প্রেক্ষাপটে শাণিত জনমানস জন্ম দেয় ১৯৭৭ সালের বামফ্রন্ট সরকারের। বামফ্রন্ট সরকার ছিল পথিকৃৎ, বহু ক্ষেত্রেই। যে পথে আগে কেউ হাঁটেনি সেপথে চলতে হয়েছে বামফ্রন্ট সরকারকে। প্রতিকূলতা ছিল পাহাড়প্রমাণ। ষড়যন্ত্র, অপপ্রচার, হিংস্র আক্রমণ কখনও থামেনি।

সমস্ত রাজনৈতিক বন্দির মুক্তি, গণতান্ত্রিক অধিকার, নাগরিক অধিকার, ট্রেড ইউনিয়ন অধিকারের সুরক্ষা দেওয়া, রাজ্য সরকারি কর্মচারীদের এমনকি পুলিশ কর্মীদের সংগঠনের স্বীকৃতি, গণতান্ত্রিক আন্দোলন বা ধর্মঘট ভাঙতে পুলিশি নির্যাতন রদ, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা এবং  সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে পুলিশি বা প্রশাসনিক হস্তক্ষেপ রদ করা— বামফ্রন্ট সরকারের অসামান্য কীর্তি। সমস্ত রাজনৈতিক বন্দির মুক্তির অর্থ সবাই, কংগ্রেস, নকশালপন্থী সহ। এটা আজকের পশ্চিমবঙ্গ সরকার বা কেন্দ্রের সরকারের কাছে কেউ প্রত্যাশাও করতে পারেন না।

আজকের চরম প্রতিহিংসা পরায়ণ তৃণমূল সরকার ও মোদী সরকারের আমলে এটা ভাবাও দুষ্কর যে জাতীয় সড়ক অবরোধ করে দিনের পর দিন তাণ্ডব  চালানো সত্ত্বেও পুলিশ কেস দেয়নি। বিরোধী রাজনৈতিক পরিসরকে অনুগত প্রশাসনিক পান্ডা ও দলীয় মাস্তানদের দিয়ে পিষে মেরে ফেলার রাষ্ট্রীয় প্রকল্প আজকের শাসকদের মৌলিক বৈশিষ্ট্য। রাস্তায় মিছিল বা সভা করতে বিরোধীদের সামনে আদালতই ভরসা— এই অবস্থা ২০১১ পরবর্তী সময়ের সৃষ্টি। বিরোধীদের নামে হাজার হাজার মিথ্যা মামলা গত চোদ্দ বছরের অবদান। ঠিক যেমন, ২০১৪-পরবর্তী ভারতের প্রতীকে পরিণত হয়েছে ভীমা-কোরেগাঁও মামলা। আইন শাসনের প্রচলিত ধারণাটিই বিপর্যস্ত শাসকের হাতে।

যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর গণতান্ত্রিক পুনর্বিন্যাসের দাবি তুলে প্রশাসনিক ও আর্থিক ক্ষেত্রে রাজ্য সরকারগুলির অধিকারের প্রশ্নে বামফ্রন্ট সরকারের উদ্যোগ গণতন্ত্রের সংগ্রামে উল্লেখযোগ্য। কেন্দ্রীয় সরকার বাধ্য হয় কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্ক পুনর্বিন্যাসের জন্য সারকারিয়া কমিশন গঠন করতে মূলত জ্যোতি বসুর নেতৃত্বাধীন সরকারের অবিস্মরণীয় ভূমিকার জন্যই। বামফ্রন্ট সরকারের পরাজয়ের পর থেকে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর গণতান্ত্রিক পুনর্বিন্যাসের প্রশ্নে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ভূমিকার অবসান ঘটেছে। যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর গণতান্ত্রিক পুনর্বিন্যাসের দাবি মানে, রাজ্য ও কেন্দ্রের প্রশাসনিক প্রধানদের পারস্পরিক আস্ফালন নয়। কুকথার স্রোত নয়। সঙ্ঘ পরিবারের আবার যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাতেই ঘোর আপত্তি। তথাকথিত ’ইন্টিগ্রাল হিউম্যানিজম’ মতে, যুক্তরাষ্ট্রীয় ধারণাই নাকি ‘হাস্যকর’। যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার বদলে দেশের নাকি দরকার এককেন্দ্রিক ব্যবস্থা।

বামফ্রন্ট সরকারের অনবদ্য কীর্তি ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের ধারণা। মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু শপথ নেওয়ার দিনই স্পষ্ট করে দেন, বামফ্রন্ট সরকার শুধুমাত্র মহাকরণে বসে কাজ করবে না। ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের লক্ষ্যে গড়ে তোলা হবে গ্রামের সরকার।

বামফ্রন্ট সরকার ক্ষমতায় বসার পরের বছরই, ১৯৭৮ সালে পঞ্চায়েত নির্বাচনের মাধ্যমে গ্রামে গ্রামে বাস্তুঘুঘুর বাসা ভেঙে গ্রামোন্নয়নের ভার তুলে দেয় হয় গ্রামের সাধারণ মানুষের হাতে। বামফ্রন্ট সরকার নিয়মিত পঞ্চায়েত নির্বাচন করেছে। পঞ্চায়েত ব্যবস্থার নেতৃত্বে উঠে আসে দুর্বলতর অংশের জনপ্রতিনিধিরা। বামফ্রন্ট সরকারই পঞ্চায়েতে মহিলাদের জন্য সংরক্ষণের ব্যবস্থা করে— প্রথমে ৩৩ শতাংশ, তারপর ৫০ শতাংশ। তফসিলি জাতি, উপজাতি এবং ওবিসি সম্প্রদায়ের জন্য জনসংখ্যার অনুপাতে পঞ্চায়েতে আসন ও পদ সংরক্ষণ করা হয়। একই ব্যবস্থা নেওয়া হয় পৌরসভাতেও। বামফ্রন্ট সরকারই দেশের মধ্যে প্রথম পশ্চিমবঙ্গে পৌর নির্বাচনে ১৮ বছর বয়স্কদের ভোটাধিকার প্রদান করে।

তৎকালীন বিরোধীরা চৌত্রিশ বছর যাবৎ বামফ্রন্ট-বিরোধীদের মিলিত ভোট সব সময়ই প্রায় ৫০ শতাংশ থেকেছে। বহু পঞ্চায়েত ও পৌরসভায় চৌত্রিশ বছরে কখনই বামফ্রন্ট জেতেনি। রাজ্যের বেশ কয়েকটি বিধানসভা বা লোকসভা কেন্দ্রেও তাই। কিন্তু তার জন্য বিরোধী নেতা কর্মীদের সাজানো মামলায় লটকে দেওয়া হয়নি। শাসক দলের নেতারা আজকের মতো তখন প্রতিপক্ষদের ‘গাঁজা কেস’-এ লটকে দেবার নির্দেশ দেয়নি। 

তৃণমূল শাসন প্রকৃত অর্থেই পশ্চিমবঙ্গ গণতন্ত্রের জীবন্ত অন্তর্ঘাত। স্বায়ত্বশাসিত সংস্থাগুলির গণতান্ত্রিক কাঠামোটিকে তৃণমূল জমানা কল্পনাতীত ‘দক্ষতা’য় মাটিতে মিশিয়ে দিয়েছে। পঞ্চায়েত চালায় অনির্বাচিত ‘মেন্টর’। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা, এমনকি শাসক তৃণমূলের জনপ্রতিনিধিরাও কোণঠাসা, ক্ষমতাহীন। পঞ্চায়েত ও পৌরসভা নির্বাচন কাঠামোগতভাবে প্রহসনে পরিণত হওয়ায় ক্ষমতার  বিকেন্দ্রীকরণের ধারণা এখন কার্যত অপ্রাসঙ্গিক। গণতন্ত্রীকরণ ও ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ প্রকল্পের অবিচ্ছেদ অঙ্গ হিসাবেই বাম আমলের ভূমিসংস্কার কর্মসূচি বিচার্য।  ভূমি সংস্কারের ফলেই রাজ্যে ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকেরা ৮৪ শতাংশ কৃষি জমির মালিকে পরিণত হয়। পাট্টা পেয়ে জমির মালিক হয়েছেন কৃষক পরিবারের মহিলারাও। পশ্চিমবঙ্গে প্রায় ১৫ লক্ষ ১৩ হাজার নথিভুক্ত বর্গাদারের আইনি অধিকার সুরক্ষিত করা হয়।

ভূমি সংস্কারের উপর ভিত্তি করেই কৃষিতে সাফল্য এসেছিল। বামফ্রন্ট সরকারের আমলে খাদ্যশস্য উৎপাদনে উদ্বৃত্ত রাজ্যে পরিণত হয় পশ্চিমবঙ্গ। দারিদ্রসীমার নিচে থাকা মানুষের সংখ্যা বামফ্রন্ট সরকারের আমলে ধারাবাহিকভাবে কমেছে। গ্রামাঞ্চলে শিল্পপণ্যের বাজার প্রসারিত হয়েছে বিস্ময়কর দ্রুততায়। এখন তো কি রাজ্য কি কেন্দ্রীয় সরকারের স্বচ্ছ অর্থনৈতিক সমীক্ষা রিপোর্ট প্রকাশেও বেজায় আপত্তি।

শুধুমাত্র ১০০ দিনের কাজের প্রকল্প নিয়ে তৃণমূল সরকার ও মোদী সরকার গত কয়েক বছর ধরে কী করে চলেছে তা সবাই দেখছে। মোদী সরকার এবং বিজেপি মুখে যতই নাটক করুক, দুর্নীতিরোধে সুনির্দিষ্ট প্রশাসনিক পদক্ষেপ কী নিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার? ত্রিপুরার মতো বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলির সাম্প্রতিক অবস্থা কী? কেন্দ্রে বিজেপি মানে রাজ্যে তৃণমূল কংগ্রেস কাঠামোগতভাবে সুরক্ষিত!

শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে চরম নৈরাজ্য আজ গোটা দেশে রাজ্যের ভাবমূর্তি টেনে নামিয়েছে। প্রাথমিকস্তর থেকে উচ্চশিক্ষায় সুস্থ স্বাভাবিক অন্তর্ভুক্তিমূলক গণতান্ত্রিক পরিবেশ তৃণমূল এবং বিজেপি ধ্বংস করে চলেছে কার্যত প্রায় অভিন্ন কর্মপরিকল্পনায়। উচ্চশিক্ষায় সংখ্যালঘুদের আরও বেশি উৎসাহিত করতে বামফ্রন্ট সরকারের আমলে আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। কিন্তু গত চোদ্দ বছরে কী হয়েছে? তথাকথিত জাতীয় শিক্ষানীতি রূপায়ণ করছে দু’পক্ষই। শিক্ষার বেসরকারিকরণ ও বাণিজ্যিকীকরণ  চলছে আগ্রাসীভাবে।

চাকরিহারা শিক্ষকদের খোদ কলকাতায় প্রকাশ্যে জনপদে দাঁড়িয়ে লাথি মারার ঘটনারও এখন সরকারি কর্তারা নিন্দা করেন না। শিক্ষকদের লাথি মারার জন্য কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে? কেউ জানেন? বামফ্রন্ট সরকার যদি শিক্ষকদের জন্য সরকারি তহবিল থেকে বেতন, পেনশন ও পারিবারিক পেনশনের ব্যবস্থা না করে যেত তাহলে কী হতো এই লাথির জমানায়! সামান্য ডিএ-র জন্য রাজ্য সরকার কী করছে সবাই দেখছেন। আদালতের নির্দেশের পরও মাথা খুঁড়তে হচ্ছে। অথচ এই তৃণমূলই বামফ্রন্টের আমলে সরকারি কর্মচারীদের উসকানি দিত নানা অজুহাত খাড়া করে।

বামফ্রন্ট সরকার পঞ্চায়েত ও পৌরসভাগুলির মাধ্যমে সাধারণ মানুষকে যুক্ত করে জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করেছিল। রাজ্যে ৭৩% মানুষ সরকারি হাসপাতালে আসতেন। তখন গোটা দেশে এই হার ছিল ৪০ শতাংশের মতো। গড় আয়ু, জন্মহার, মৃত্যুহার, প্রসূতি মৃত্যুর হার এবং শিশু মৃত্যুর হারে পশ্চিমবঙ্গ জাতীয় হারের চেয়ে অনেক এগিয়ে যায় বামফ্রন্ট সরকারের সময়ে।  এখনকার ক্ষমতাসীন সরকার চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে শায়েস্তা-অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে। আরজি কর কাণ্ড দিয়ে সাধারণ মানুষ আজ রাজ্যের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে চিনছে দেশে বিদেশে।

সর্বগ্রাসী নৈরাজ্যের প্রেক্ষাপটেই আজ কর্মসংস্থানমুখী উন্নয়ন পরিকল্পনার মৌলিক ধারণাটিকে তৃণমূল সরকার ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে। অথচ কৃষির সাফল্যের ভিতের উপর দাঁড়িয়েই রাজ্যের অর্থনীতি ও কর্মসংস্থানের সুযোগ প্রসারিত করতে শিল্পায়নের উপর নজর দেয় বামফ্রন্ট সরকার। বেসরকারি পুঁজির সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে গড়ে তোলা হলদিয়া পেট্রোকেমিক্যালসে ন’শোর বেশি অনুসারী শিল্পে দু’লক্ষাধিক মানুষের কর্মসংস্থান হয়।  সল্টলেকে তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পেও কাজের সুযোগ বেড়েছিল। ১৯৯১ থেকে ২০০৮-এর মধ্যবর্তী সময়ে শিল্প বিনিয়োগের পরিমাণের মানদণ্ডে আমাদের রাজ্য উঠে আসে দেশের মধ্যে তিন নম্বর স্থানে। এগুলির সাম্প্রতিক বেহাল দশা সবাই দেখছেন। সিঙ্গুরে কারখানা ধ্বংসকারীরা যে শিল্পে বিনিয়োগের জন্য সাক্ষাৎ বিপদ তা সবাই বোঝে। কী অবস্থা এখন স্বনির্ভর গোষ্ঠীগুলির! এখন শিক্ষিত বেকারদের চপ ভাজার পরামর্শ দিচ্ছেন মন্ত্রীরা।

শিল্পায়ন ও পরিকাঠামো উন্নয়ন বিপর্যস্ত হওয়ায় রাজ্যে  ২০১১ সালের পর একটিও নতুন বিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরি হয়নি। ১৯৭৭ সালে এরাজ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদন হতো মাত্র ১৬১৫ মেগাওয়াট। ২০১১ সালের গোড়ায় তা দাঁড়ায়, ১১,৩০০ মেগাওয়াটে। কত গুণ বৃদ্ধি? আর কেন  গত প্রায় দেড় দশকে রাজ্যের নতুন বিদ্যুৎ কেন্দ্র লাগে না?

বামফ্রন্ট সরকার সমাজের দুর্বলতর অংশের স্বার্থরক্ষায় সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্প গ্রহণ করে অনেক আগে থেকে। ভূমিহীন কৃষক, রাজ্যের বন্ধ কলকারখানা ও বন্ধ চা বাগানের শ্রমিক, অন্যান্য অসংগঠিত ক্ষেত্রের  শ্রমিকদের জন্য নানা ধরনের সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্পের পথিকৃৎ বামফ্রন্ট সরকারই। বামফ্রন্ট সরকার আড়াই কোটিরও বেশি গরিব মানুষকে ২টাকা কেজি দরে চাল দিত। বামফ্রন্ট সরকারই ‘ল্যাম্পস’-র কর্মচারীদের রাজ্য বেতন কমিশনের আওতায় এনেছিল। মহিলা সমৃদ্ধি যোজনা এবং আদিবাসী মহিলা স্বশক্তিকরণ যোজনা প্রকল্প রূপায়ণে পশ্চিমবঙ্গের স্থান ছিল দেশের মধ্যে প্রথম।

পশ্চিমবঙ্গে সংখ্যালঘু বিষয়ক দপ্তর প্রথম চালু হয় বামফ্রন্ট আমলে। মাদ্রাসা শিক্ষার আধুনিকীকরণ, মাদ্রাসা শিক্ষাকে মাধ্যমিক শিক্ষার সমতুল্য করার কৃতিত্ব বামফ্রন্ট সরকারের। বামফ্রন্ট সরকারই মাদ্রাসা সার্ভিস কমিশন গঠন করে। মাদ্রাসাগুলিকে সংখ্যালঘু প্রতিষ্ঠান হিসাবে ঘোষণা করে। পশ্চিমবঙ্গ সংখ্যালঘু উন্নয়ন ও বিত্ত নিগমের প্রতিষ্ঠাও বামফ্রন্ট সরকারের আমলে। কর্মসূচি রূপায়ণে নিগম একদশকের উপর ধারাবাহিকভাবে দেশের মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করে। ২০১১ সালের পর অবস্থা বেহাল।

বামফ্রন্ট সরকারই দেশে প্রথম রঙ্গনাথ মিশ্র কমিশনের সুপারিশ মেনে ‘অন্যান্য অনগ্রসর সম্প্রদায়’(ওবিসি)-র তালিকায় বিভিন্ন মুসলিম সম্প্রদায়কে অন্তর্ভুক্ত করে। মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষও এর ফলে উপকৃত হয়। সরকারি চাকরিতে সংরক্ষণের সুবিধা সম্প্রসারণে তা ছিল এক ঐতিহাসিক এবং নজিরবিহীন পদক্ষেপ। অথচ তৎকালীন বিরোধী তৃণমূল এই সব পদক্ষেপের জন্য বামফ্রন্ট সরকারের মুন্ডুপাত করে।

বামফ্রন্ট সরকারের সময়ে সরকারি দপ্তরগুলিতে এবং স্কুল কলেজ গ্রন্থাগার প্রভৃতি ক্ষেত্রে নিয়ম মেনে শূন্যপদ পূরণে দৃষ্টান্তমূলক পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। স্কুল সার্ভিস কমিশন, কলেজ সার্ভিস কমিশন, মাদ্রাসা সার্ভিস কমিশন, মিউনিসিপ্যাল সার্ভিস কমিশন বামফ্রন্ট সরকারের সময়েই তৈরি। লক্ষ্য ছিল স্বচ্ছতাকে আইনগত রূপ দেওয়া। আজ গণতান্ত্রিক কাঠামোর বিলুপ্তিই দুর্নীতিকে লাগামহীন করেছে। দায়বোধহীন সরকার দুর্নীতিকে অপরাধ মনে করছে না।

বাম-নেতৃত্বাধীন সরকারের কর্মকাণ্ডই জনস্বার্থবাহী বিকল্প নীতির সুস্থায়ী উন্নয়নের অন্যতম প্রধান শর্ত ধর্মনিরপেক্ষতা, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও জাতিগত ঐক্য। ১৯৮৪-র শিখবিরোধী দাঙ্গা এবং ১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা দমনে বামফ্রন্ট সরকারের ভূমিকা গোটা দেশে প্রভাব ফেলে।

বাম-নেতৃত্বাধীন রাজ্য সরকারকে যে কোনও মূল্যে ঠেকানো এবং সংসদে বামপন্থীদের সামর্থ্য নিয়ন্ত্রণের  ষড়যন্ত্রে শাসক শ্রেণি তাই এতো মরিয়া? নয়া উদারবাদী জমানায় নয়া ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রীয় প্রকল্প নিষ্কণ্টক রাখতে হবে, যে কোনও মূল্যে। আজ কেরালাতেও তাই এলডিএফ সরকারকে সর্বাত্মক বিরোধিতার মুখোমুখি হতে হচ্ছে।

কারণ বামফ্রন্ট সরকারের কর্মকাণ্ড  আগামী দিনের বিকল্প নীতি ও কর্মসূচি নির্মাণের লড়াইয়েরও অবিচ্ছেদ্য অংশ।

বামফ্রন্ট সরকারের অভিজ্ঞতা বলতে শুধু  তার সাফল্যের অভিজ্ঞতা নয়, তার সীমাবদ্ধতা এবং দুর্বলতাগুলিও সেই অভিজ্ঞতার অংশ। বুর্জোয়া-জমিদার রাষ্ট্র ব্যবস্থার মৌলিক কাঠামোগত সীমাবদ্ধতার মধ্যেই তাকে কাজ করতে হয়েছে। কার্যকর করতে হয়েছে জনস্বার্থবাহী বিকল্প নীতি। এক্ষেত্রে বামফ্রন্ট সরকারের সাফল্য সমগ্র দেশে আজও বিকল্প নীতি রূপায়ণ-প্রকল্পে গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশিকা।

Spread the word

Leave a Reply