অরিন্দম মুখোপাধ্যায়
কাজী নজরুল ইসলামকে অনেকে আখ্যায়িত করেছেন ‘যুগের কবি’ বলে। কাকে যুগের কবি বলা যায়? যিনি যুগের দাবি বা প্রয়োজন পূরণ করেন, তিনিই যুগের কবি। তবে নজরুল যুগের দাবি পূরণ করার সঙ্গে চিরকালের শাশ্বত বাণীও রেখে গেছেন তাঁর সৃজন কর্মে। তাই তিনি কালোত্তীর্ণ। সাম্রাজ্যবাদ ও উপনিবেশবাদের বিরূদ্ধে বিদ্রোহের আগুন ছড়িয়ে ধূমকেতুর মতো সাহিত্যাকাশে তাঁর আবির্ভাব। ‘অত্যাচারীর খড়্গকৃপাণ’ স্তব্ধ না হওয়া পর্যন্ত শান্ত না হবার দৃঢ় প্রত্যয় ছিল তাঁর ঘোষণায়। একইসঙ্গে তিনি উপলব্ধি করেছিলেন সাম্রাজ্যবাদী শাসকদের দেশ থেকে বিতাড়নের জন্য প্রয়োজনীয় জনজাগরণের পথে প্রধান অন্তরায় সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদ। দেশ স্বাধীন হবার এত বছর পরেও সেই বিপদ আরও বিপুল আকারে বর্তমান সময়ে বিরাজমান। যা স্বাধীন দেশের অর্জনগুলিকেই আজ চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে। তার সঙ্গে যে নতুন উপাদান যোগ হয়েছে, তা হল সন্ত্রাসবাদ। এই প্রেক্ষিতেই নজরুলের অসাম্প্রদায়িক চেতনা হতে পারে আমাদের সংগ্রামের দিকনির্দেশিকা।

নজরুলের শিক্ষাজীবন শুরু হয়েছিল মাদ্রাসায়। জীবনের তাগিদে মুয়াজ্জিনের কাজও করেছেন। সেই তিনিই তাঁর কবিতায় বলতে পেরেছেন-
‘মিথ্যা শুনিনি ভাই,
এই হৃদয়ের চেয়ে বড়ো কোনও মন্দির-কাবা নাই।’
এটা সম্ভব হয়েছে কবির প্রথম জীবনে লেটো দলে যোগদানের সূত্রে রামায়ণ, মহাভারত, লোককথা, পুরাণ কাহিনি ইত্যাদির সঙ্গে পরিচয় সাধনের মধ্য দিয়ে। এছাড়া কবির প্রথম যৌবনে বিশ্ব রাজনীতির যে মৌলিক পরিবর্তন ঘটেছিল রুশদেশে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সফল হবার মধ্য দিয়ে, দেশে কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠায় ও গান্ধীজীর নেতৃত্বে স্বাধীনতা আন্দোলনে নতুন গতি সঞ্চারের ঘটনায় কবির চেতনার নব উন্মেষ ঘটে। কবি তাঁর যৌবনকালে বারবার প্রত্যক্ষ করেছেন সাম্প্রদায়িক বিভেদের কলুষিত রূপ। দেখেছেন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। যা কবিমনে গভীর রেখাপাত করেছিল। তাই ‘প্রলয়শিখা’ কাব্যে তিনি লিখেছিলেন:
‘ভাঙি মন্দির, ভাঙি মসজিদ
ভাঙিয়া গির্জা গাহি সংগীত,
এক মানবের একই রক্ত মেশা
কে শুনিবে আর ভজনালয়ের হ্রেষা।’
নজরুল জীবনভর ধর্মীয় মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে গেছেন। তিনি তাঁর বিভিন্ন কবিতা, গান, গল্পে লিখে গেছেন, যে শক্তি ধর্মের নামে মানুষে মানুষে বিভেদ সৃষ্টি করে বা পরস্পরের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়, তা ধর্ম নয় অধর্ম। সেই অপশক্তির বিরুদ্ধেই ছিল তাঁর সংগ্রাম। তিনি মনে করতেন অসাম্প্রদায়িকতার অর্থ ধর্মহীনতা নয়। নজরুল ধর্মবিরোধী ছিলেন না। তাঁর মত ছিল নিজ ধর্মমতের পাশাপাশি অন্য সব সম্প্রদায়ের ধর্মমতকে শ্রদ্ধা করা। তিনি তাই বারবার মানবধর্মের কথাই বলেছেন। এক্ষেত্রে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে তাঁর মতের মিল ছিল একশ শতাংশ। তাই নজরুল লিখেছিলেন:
‘মানুষেরে ঘৃণা করি
ও’ কারা কোরান, বেদ, বাইবেল চুম্বিছে মরি মরি।
ও’ মুখ হইতে কেতাব গ্রন্থ নাও জোর করে
কেড়ে
যাহারা আনিল গ্রন্থ-কিতাব সেই মানুষেরে মেরে।
পূজিছে গ্রন্থ ভণ্ডের দল! মূর্খরা সব শোনো,
মানুষ এনেছে গ্রন্থ; গ্রন্থ আনেনি মানুষ কোনো।’
ইসলাম ধর্ম ও হিন্দুধর্ম এই দুই ধর্ম সম্পর্কে নজরুল নিবিড়ভাবে জানতেন। তাই তিনি যেমন গজল আর ইসলামি গান রচনা করতে পারতেন, আবার একইসঙ্গে শ্যামাসংগীত, ভজন আর কীর্তন অঙ্গের গানও রচনা করেছেন অনেক। যৌবনকালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় নজরুলের ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে যোগদানের সূত্রে করাচীতে বসবাস এবং সেই সূত্রে রুশ বিপ্লবের কথা ও পশ্চিম এশিয়ার ঘটনাবলীর কথা জানতে পারা তাঁর জীবনে বড়ো প্রভাব ফেলে। আবার যুদ্ধ শেষে করাচী থেকে ফেরার পরে কলকাতায় কমিউনিস্ট নেতা মুজফ্ফর আহমেদ ও দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের সাহচর্য তাঁকে মানবধর্মের এক নতুন পথের সন্ধান দেয়। তাই তিনি পেরেছিলেন এহেন সাহসী উচ্চারণ করতে:
‘তব মসজিদ মন্দিরে কভু নাই মানুষের দাবী।
মোল্লা পুরুত লাগায়েছে তার সকল দুয়ারে চাবি!
কোথা চেঙ্গিস, গজনী মামুদ, কোথায় কালাপাহাড়?
ভেঙে ফেল ঐ ভজনালয়ের যত তালা দেওয়া দ্বার!
খোদার ঘরে কে কপাট লাগায়, কে দেয় সেখানে তালা?
সব দ্বার এর খোলা রবে, চালা হাতুড়ি-শাবল চালা!
হায়রে ভজনালয়,
তোমার মিনারে চড়িয়া ভণ্ড গাহে স্বার্থের জয়।’
১৯২২ সালে প্রকাশিত নজরুলের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘অগ্নিবীণা’য় সংকলিত হয়েছিল ‘মোহরম’, ‘কোরবানী’, ‘খেয়াপাড়ের তরণী’, ‘শাত-ইল-আরব’-এর মতো ইসলামি অনুষঙ্গের কবিতার পাশাপাশি হিন্দু দেবীকে নিয়ে রচিত ‘রক্তাম্বর ধারিণী মা’, ‘আগমনী’র মতো কবিতা। এছাড়াও এই কাব্যগ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল ‘প্রলয়োল্লাস’ ও ‘বিদ্রোহী’র মতো অসাধারণ কবিতা। ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় হিন্দু,মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ধর্ম ও পুরাণের নানা অনুষঙ্গ অসাধারণ মুন্সিয়ানার সঙ্গে ব্যবহার করা হয়েছে। এই নিদর্শনগুলি নজরুলের অসাম্প্রদায়িক মানবিক চেতনার উজ্জ্বল নিদর্শন।
হিন্দু-মুসলমান ধর্ম সম্প্রদায়ের বিরোধের প্রেক্ষিতে তিনি ‘হিন্দু-মুসলমান’ প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘অবতার,পয়গম্বর কেউ বলেনি আমি হিন্দুর জন্য এসেছি, আমি মুসলমানের জন্য এসেছি, আমি খ্রিস্টানের জন্য এসেছি। তারা বলেছেন আমরা মানুষের জন্য এসেছি, আলোর মতন সকলের জন্য।’
কাজী নজরুল ইসলাম কেবলমাত্র কবি,গীতিকার, সুরকার বা সাহিত্যিক ছিলেন না। সমসাময়িক রাজনীতি ও পরাধীন দেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম তাঁর সাহিত্যকর্মের প্রধান অনুষঙ্গ ছিল। তাই তিনি ধর্মভিত্তিক রাজনীতির ঘোর বিরোধী ছিলেন। এই প্রসঙ্গেই উল্লেখ্য যে, কাজী নজরুল ইসলাম বরাবর মুসলিম লীগ নেতা মুহম্মদ আলি জিন্নাহ-র দ্বিজাতিতত্ত্ব ও পাকিস্তান প্রস্তাবের বিরোধী ছিলেন। ‘নবযুগ’, ‘ধূমকেতু’, ‘লাঙল’, ‘গণবাণী’ প্রভৃতি পত্রিকায় তাঁর স্বাক্ষরিত একাধিক সম্পাদকীয় ও নিবন্ধে তিনি কঠোর ভাষায় দ্বিজাতিতত্ত্ব ও পাকিস্তান পরিকল্পনার বিরোধিতা করেছিলেন।
কলকাতায় ব্রিটিশ শাসকদের মদতপুষ্ট ১৯২৬ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা নজরুলকে ভীষণভাবে বিচলিত করে। সেই সময়ে ‘কান্ডারী হুঁশিয়ার’ কবিতায় তিনি লেখেন :
‘অসহায় জাতি মরিছে ডুবিয়া, জানে না সন্তরণ
কান্ডারী! আজ দেখিব তোমার মাতৃমুক্তিপণ
‘হিন্দু না ওরা মুসলিম’ ওই জিজ্ঞাসে কোনজন?
কান্ডারী! বলো ডুবিছে মানুষ সন্তান মোর মা’র।’
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য কৃষ্ণনগরে জাতীয় কংগ্রেসের প্রাদেশিক সম্মেলনে গানটি প্রথম গাওয়া হয়।
ধর্মান্ধতা ও সাম্প্রদায়িকতা কীভাবে মানুষের শুভবোধ, নৈতিকতা ও মানবিকতা ধ্বংস করে হিংসায় উন্মত্ত পশুতে পরিণত করে ‘মন্দির মসজিদ’ প্রবন্ধে নজরুল ব্যাখ্যা করেছেন। আজও আমাদের দেশে সেই হিংসোন্মত্ত ‘পশুর দল’ স্বরূপ সাম্প্রদায়িক শক্তি দ্বিগুণ সক্রিয়। রবীন্দ্র-নজরুল আয়ুধে সজ্জিত হয়েই সেই পশুশক্তির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।
ধর্মের নামে যারা খুনোখুনি করে, নজরুল তাদের ‘ধর্ম-মাতাল’ বলে অভিহিত করেছেন। তাঁর মতে ‘ইহারা ধর্ম- মাতাল। ইহারা সত্যের আলো পান করে নাই, শাস্ত্রের এলকোহল পান করিয়াছে। মদ্যপ মাতালদের যেমন হিতাহিত জ্ঞান থাকে না, তেমনই ধর্ম-মাতালদেরও স্বাভাবিক বোধবুদ্ধি থাকে না। তারা মানুষরূপী হিংস্র জানোয়ারে পরিণত হয়।’
বিভেদ-বিদ্বেষের বিপরীতে হিন্দু-মুসলমানকে এক সূত্রে গাঁথার অভিপ্রায়ে তিনি গানে গানে ছড়িয়ে দেন অসাধারণ মিলন ও সম্প্রীতির বাণী :
‘মোরা এক বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু মোসলমান
মুসলিম তার নয়নমণি হিন্দু তাহার প্রাণ।’
গোদি মিডিয়ার সঞ্চালক ‘কীসের কুসুম’ বলে যতই চেঁচান, এই বাণী চিরকালীন শাশ্বত বাণী রূপে মানুষের মনে রয়ে যাবে।
নজরুলের কাছে একাধারে কাম্য ছিল শোষণমুক্ত ও বিভেদমুক্ত সমাজ। জাতপাত ও শ্রেণিবৈষম্য এই দুইয়ের বিরুদ্ধেই তিনি ছিলেন সোচ্চার। তাঁর ‘জাতের বজ্জাতি’ কবিতাটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল:
‘জাতের নামে বজ্জাতি সব জাত-জালিয়াৎ খেলছে জুয়া
ছুঁলেই তোর জাত যাবে? জাত ছেলের হাতের নয়তো মোয়া।’
কবিতাটির মধ্যভাগে লিখেছিলেন:
‘সকল জাতই সৃষ্টি যে তাঁর, এ বিশ্বমায়ের বিশ্বঘর,
মায়ের ছেলে সবাই সমান, তাঁর কাছে নাই আত্মপর।’
নজরুল কেবলমাত্র কবিতা বা সাহিত্যেই অসাম্প্রদায়িক মনোভাব প্রদর্শন করেননি। ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবনেও তা বাস্তবায়নের চরম নমুনা রেখেছেন। তিনি ব্রাহ্মকন্যা আশালতা সেনগুপ্ত ওরফে প্রমীলা দেবীকে বিয়ে করার সময় তাঁকে ধর্মান্তরিত করেন নি। তাঁর চার সন্তানের নামকরণ করেন হিন্দু-মুসলিম ঐতিহ্যের সম্মিলনে—কৃষ্ণ মহম্মদ, অরিন্দম খালেদ, কাজী সব্যসাচী ইসলাম ও কাজী অনিরুদ্ধ ইসলাম। অসাম্প্রদায়িকতার নিদর্শন এর চেয়ে বেশি আর কী হতে পারে? তাঁর রচিত গজল ও ইসলামি সংগীত আর শ্যামাসংগীত সমানভাবে জনপ্রিয়।
একটি অভিভাষণে নজরুল বলেছেন, ‘কেউ বলেন, আমার বাণী যবন, কেউ বলেন, কাফের। আমি বলি ও দুটোর কিছুই নয়। আমি মাত্র হিন্দু মুসলমানকে এক জায়গায় ধরে এনে হ্যান্ডশেক করাবার চেষ্টা করেছি, গালাগালিকে গলাগলিতে পরিণত করার চেষ্টা করেছি।’ এই সরল ও সরাসরি স্বীকারোক্তির পর নজরুলের সম্প্রীতিচেতনা আলাদা করে অন্বেষণের প্রয়োজন পড়ে না।
তিনি মনে করতেন, হিন্দু ও মুসলিম যদি পরস্পরকে ঈর্ষা ও ঘৃণা করতে থাকে, তাহলে ভারতের স্বাধীনতা লাভ অসম্ভব। ইংরেজরা তাদের শিক্ষার চাকচিক্যে ভারতীয় হিন্দু ও মুসলিমের নিজস্ব প্রাচীন ঐতিহ্য থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছে। তিনি এ প্রসঙ্গে ভারতীয় হিন্দু ও মুসলিমদের সজাগ করেছেন এক অভিভাষণে : ‘ভারত যে আজ পরাধীন এবং আজও যে স্বাধীনতার পথে তার যাত্রা শুরু হয় নি—শুধু আয়োজনেরই ঘটা হচ্ছে এবং ঘটা ভাঙছেও—তার একমাত্র কারণ আমাদের হিন্দু-মুসলমানের পরস্পরের প্রতি হিংসা ও অশ্রদ্ধা। আমরা মুসলমানরা আমাদেরই প্রতিবেশী হিন্দুর উন্নতি দেখে হিংসা করি, আর হিন্দুরা আমাদের অবনত দেখে আমাদের অশ্রদ্ধা করে।’ আসলে তিনি কর্মের মিলন সাগরে সব ধর্মের মানুষকে মেলাতে চেয়েছিলেন।
মানুষকে ও মানবধর্মকে সবচাইতে বড়ো করে দেখেছেন কবি নজরুল ইসলাম। আজীবন তিনি যে চিন্তাকে লালন করেছেন সেটি হল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী দ্রোহ। সেই দ্রোহই হয়ে উঠেছিল তাঁর কবিতার ভাষা। তিনি স্বপ্ন দেখতেন রুশ বিপ্লব স্পন্দিত এক সমাজবিপ্লবের, এক সাম্যবাদী সমাজের। যেখানে শোষণ-বৈষম্যহীন এক অসাম্প্রদায়িক ব্যবস্থা বিরাজমান। সেই সাম্যের সমাজ গঠনের স্বপ্নে বিভোর কবি তাই লিখেছেন,
‘গাহি সাম্যের গান
যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা-ব্যবধান
যেখানে মিশেছে হিন্দু-বৌদ্ধ-মুসলিম-ক্রীশ্চান।’