৮ জুলাই ২০২১, বৃহস্পতি বার,
জ্যোতি বসু প্রায়শই বলতেন, ‘আই অ্যাম নট এ প্র্যাগম্যাটিস্ট, আই অ্যাম এ মার্ক্সিস্ট।’’
একজন প্রাজ্ঞ নেতা এবং দক্ষ প্রশাসক হিসেবে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গির স্বচ্ছতার জন্য, জাতীয় ইস্যুগুলি সম্পর্কে তাঁর তাৎক্ষণিক তীক্ষ্ণ মতামত এবং বাস্তববাদী মনোভাবের জন্য বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে তাঁকে অনেক সময়ই ‘প্র্যাগম্যাটিস্ট চিফ মিনিস্টার’ বিশেষণে ভূষিত করা হতো। অনেক সময়ই প্রশংসাসূচকভাবেই হয়তো তা দেওয়া হতো। কিন্তু জ্যোতি বসুর নিজের এই বিশেষণে আপত্তি ছিল। বিশিষ্ট সাংবাদিক-সম্পাদক এন রাম জ্যোতি বসু সম্পর্কে তাঁর স্মৃতিচারণায় এই প্রসঙ্গের উল্লেখ করে বলেছেন, ‘‘১৯৯৫ সালের গোড়ার দিকে ‘ফ্রন্টলাইন’-এর জন্য একটি সাক্ষাৎকারে আমার কাছে উনি মন্তব্য করেছিলেন, ‘‘ওঁরা আমাকে এভাবেই বলেন, কিন্তু আমি ‘বাস্তববাদী’ নই, আমি একজন মার্কসবাদী।
এন রামের কথায়, ‘‘জ্যোতি বসু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই, বিশেষকরে সাক্ষাৎকার দেওয়ার সময় খুবই খোলামেলা কথা বলতেন। অনেক সময় দেখা গেছে, তাঁকে এজন্য ভুলভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে, অথবা অতি-বামপন্থী, গোঁড়া এবং কমিউনিস্ট-বিরোধী সাংবাদিকরা তাঁদের রাজনৈতিক এবং মতাদর্শগত দৈন্যতার জন্য উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে তাঁর বক্তব্যকে বিকৃত করেছেন। একজন প্রতিভাবান ব্যক্তির ক্ষেত্রে জরুরী বিষয় হলো সবসময় বিভ্রান্তি, অবজ্ঞা, কূটতর্ক এবং অর্থহীন বাক্যকে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে যাওয়া। জ্যোতি বসুর ঝরঝরে, সুশৃঙ্খল এবং তীক্ষ্ণ মনন, এবং অর্ধশতাব্দীর বেশি সময়কাল ধরে বিপ্লবী কাজের ধারার (যেখানে জনতার সঙ্গে সরাসরি সংযোগ অনেক মূল্যবান বিবেচিত হয়) মাধ্যমে অর্জিত অভ্যাস এবং ভঙ্গিমা তাঁকে এইসব আবিলতা কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করেছে।’’
সাধারণভাবে জ্যোতিবাবুর বক্তৃতায় খুব একটা চাকচিক্য বা ভাষার কারুকার্য থাকতো না। সহজ-সরল, অতি সাধারণ মানুষের বোধগম্য ভাষায় তিনি বক্তব্য রাখতেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও সাংবাদিকদের কাছে জ্যোতি বসুর প্রোগ্রাম সবসময় একটা প্রাইম অ্যাসাইনমেন্ট পাওয়া হিসেবে বিবেচিত হতো। সিনিয়র সাংবাদিকরা বলতেন, জ্যোতিবাবু ঠিক একটা নতুন লাইন দিয়ে দেবেন। তোমাকে মনোযোগ দিয়ে শুনতে হবে, লাইনটা খুঁজে বের করতে হবে। অনেক সময় দেখা গেছে সাংবাদিক যে প্রশ্ন করেছেন, জ্যোতিবাবু ঠিক তার উত্তর না দিয়ে অন্য একটা উত্তর দিয়েছেন। কিন্তু যেটা বলেছেন, সেটা এমন একটা খবর যা সংবাদ হিসেবে পরদিনের ফ্রন্টপেজ হেডলাইন হয়ে যেতে পারে। তবে কি জ্যোতিবাবু প্রশ্নটা ঠিক শুনতে পাননি, এই আলোচনা তখন অবান্তর হয়ে যেত। তবে অভিজ্ঞ সাংবাদিকরা বলতেন, আসলে জ্যোতিবাবু আজ ওটাই বলবেন ঠিক করেছিলেন। তুমি যে প্রশ্নই করতে না কেন, উত্তর এটাই আসতো। তাঁদের মতে, জ্যোতিবাবুর মত যুগন্ধর ব্যক্তিরা কখনও আলটপকা মন্তব্য করেন না। উনি যা বলেন, ভেবেচিন্তেই বলেন। তোমাকে সঠিক প্রশ্নটা করতে হবে।
২০০৪ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর। তখন কেন্দ্রে বামপন্থীদের সমর্থনে ইউপিএ সরকার সদ্য কাজ শুরু করেছে। তার আগের দিন যোজনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান মন্টেক সিং আলুওয়ালিয়া একঝাঁক বিদেশী অর্থনৈতিক সংস্থার ব্যাক্তিকে পরামর্শদাতা হিসেবে নিয়োগ করেছেন, যা নিয়ে আলোড়ন পড়ে গেছে। সেদিন ছিল পার্টির রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর বৈঠক। আলিমুদ্দিনে ঢোকার সময় এই প্রশ্ন করতেই জ্যোতি বসু বললেন, “হি ইজ ডুয়িং অল রং, হি বিলঙস্ টু ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্ক। হি ইজ এ ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্ক ম্যান।” ব্যস, সারাদেশে তোলপাড় শুরু হয়ে গেল। বিকালে যোজনা কমিশনে মন্টেক সিং-এর তৈরি প্যানেল বাতিল হয়ে গেল। শুক্রবার সকালে তাই আলিমুদ্দিনে সাংবাদিকদের আনাগোনা লেগেই থাকতো।
‘ঐতিহাসিক ভুল’ ইন্টারভিউ নেওয়ার জন্য বিখ্যাত সাংবাদিক-সম্পাদক এমজে আকবর বলেছেন, ‘‘আমাকে অনেকেই জিজ্ঞাসা করেন, আপনি কি এটা জিজ্ঞাসা করেছিলেন, না উনি নিজে থেকেই এই মন্তব্য করেছেন? একটা সাক্ষাৎকারে এই রসায়ন বিশ্লেষণ করা খুবই কঠিন। আমি শুধু এটাই তখন মনে করেছিলাম যে আমি একটা স্বপ্নের স্কুপ পেয়ে গেছি। তবে এটা বলার সময় তাঁর মধ্যে কোনো রাগ বা অনুশোচনা ছিল না। কেবল একজন বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাসবিদের মতই ঘটনার বিশ্লেষণ করছিলেন।’’
১৯৯৭ সালের ২জানুয়ারি এমজে আকবরের নেওয়া সাক্ষাৎকারটি তাঁর সম্পাদিত ‘দি এশিয়ান এজ’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। তার ঠিক পরদিনই জ্যোতিবাবু বিশাখাপত্তনমে যান। সেখানে সিআইটিইউ জেনারেল কাউন্সিল মিটিংয়ের প্রকাশ্য সমাবেশের প্রধান বক্তা ছিলেন তিনি। সমাবেশের পর তিনি যে হোটেলে ছিলেন, সেখানে সাংবাদিকদের যেতে বলেন তাঁর আপ্ত সহায়ক জয়কৃষ্ণ ঘোষ। ঘটনাচক্রে আমার সেখানে থাকার সুযোগ হয়েছিল গণশক্তির পক্ষ থেকে কভার করার জন্য। সিপিআই(এম)-র কেন্দ্রীয় কমিটি কি সরকারে যোগদানের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করবে? সেখানে এই প্রশ্ন অবশ্যম্ভাবীভাবে উঠে এলে জ্যোতিবাবু সরাসরি তা খারিজ করে বলেন, ‘‘এই সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার কোন প্রশ্নই ওঠে না। আপনারা বাবর, আকবরের কথা যেমন ইতিহাসে পড়েছেন, সেরকম এটাও এখন ইতিহাস হয়ে গেছে।’’
বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মূহুর্তে, বিশেষ করে সঙ্কটের সময়ে জ্যোতিবাবুর ভূমিকা সম্পর্কে অনেক কথাই লিপিবদ্ধ রয়েছে। সঠিক সময়ে সঠিক ও সময়োপযোগী কথা বলতে পারার বিশেষ দক্ষতা অনেকটা সহজাত প্রতিভার মত জ্যোতিবাবুর ছিল বলে অনেকে মনে করেন। ১৯৬৮সালে নকশালপন্থী আন্দোলন তুঙ্গে থাকার সময় জ্যোতিবাবুর একটি সাক্ষাৎকার অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস নিয়েছিল, যেটি এখন ওয়েবে সার্চ করলে পাওয়া যায়। সেখানে প্রশ্নের উত্তরে নকশালপন্থীদের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে তিনি জোরালো ভাষায় বলেছিলেন, ‘‘ভারতের রাজনীতিতে এদের কোনও ভবিষ্যৎ আছে বলে আমি অন্তত মনে করি না।’’ পরে ডঃ বিপ্লব দাশগুপ্তের লেখা ‘জ্যোতিবাবুর সঙ্গে’ নামে দুই খন্ডে প্রকাশিত স্মৃতিচারণায় সেই সময় জ্যোতি বসু, প্রমোদ দাশগুপ্ত সহ সিপিআই(এম)-র শীর্ষ নেতৃবৃন্দের জেলে থাকার সময় একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। সেখানে চারু মজুমদার একদিন আলাপচারিতায় প্রস্তাব দেন, ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী)-কে এখনই চীনের কমিউনিস্ট পার্টির শাখা এবং চীনের চেয়ারম্যানকে আমাদের চেয়ারম্যান হিসেবে ঘোষণা করা উচিত। জ্যোতি বসু সেই মূহুর্তে চারু মজুমদারকে বলেন, ‘‘এই ধরণের প্রস্তাব দেওয়ার পর থেকে আপনার সঙ্গে আর কোনও রাজনৈতিক আলোচনা করাই উচিত না। যেহেতু আমরা এখন জেলের মধ্যে রয়েছি, তাই আমরা এখন থেকে আপনার সঙ্গে কেবল সিনেমা, খেলাধুলা, আবহাওয়া ইত্যাদি বিষয় নিয়েই আলোচনা করবো।’’
২০০১সালের ২৪ফেব্রুয়ারি ছিল বিধানসভায় জ্যোতিবাবুর শেষ দিন। সেদিনই ছিল দ্বাদশ পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার শেষদিন। অধ্যক্ষকে ধন্যবাদসূচক প্রস্তাবের ওপর আলোচনা চলছিল। জ্যোতিবাবুও আর এই বিধানসভায় আসছেন না, এটা যেহেতু তখন সর্বজনবিদিত তাই অধ্যক্ষকে ধন্যবাদ জানানো নামমাত্র হয়ে প্রত্যেক সদস্যের বক্তব্য ছিল জ্যোতিবাবুর ভূয়সী প্রশংসায় ভরা। বিরোধী দলের সমস্ত সদস্যই সেদিন জ্যোতিবাবুর অকুন্ঠ প্রশংসা করে বক্তব্য রেখেছিলেন। কিন্তু জ্যোতিবাবু বক্তব্য রাখতে উঠেই বললেন, ‘‘শুনেছি পন্ডিত মানুষেরা বলে থাকেন, ‘প্রশংসা বিষবৎ, নিন্দা অমৃতসমান’।’’ এরপর যথারীতি স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে সেই সময় বিরোধী বিধায়কদের তুলোধোনা করে বক্তব্য রাখলেন। যেহেতু তারপরেই নির্বাচনী ময়দানে নামার কথা, তাই জ্যোতিবাবুর কাছে এসব বিষয় অপাংক্তেয় ছিল।
২০০৬ সালে বিধনাসভা নির্বাচনের প্রাকমূহুর্তে সিপিআই(এম)-র রাজ্য সম্পাদক অনিল বিশ্বাসের আকস্মিক মৃত্যুতে সারা বাংলার পার্টিকর্মী, সমর্থকরা যখন শোকবিহ্বল হয়ে পড়েছিলেন, সেই সময়েও জ্যোতিবাবু শোককে শপথে পরিণত করার আহ্বান জানিয়েছিলেন। ভিড়ে ঠাসা স্মরণসভায় প্রায় সব নেতাই যখন শোকে, আবেগে বক্তব্য অসমাপ্ত রেখেছিলেন, তখন শেষ বক্তা জ্যোতি বসু বলে, ‘‘কমরেড অনিল বলেছিল, ৫০শতাংশের বেশি মানুষের সমর্থন আমাদের পেতে হবে। অনিলের সেই আহ্বানকে মনে রেখে আরও বেশি মানুষের সমর্থন নিয়ে, আরও বেশি আসনে জয়ী হয়ে শোককে শপথে পরিণত করুন। সেটাই কমরেড অনিল বিশ্বাসের প্রতি আমাদের প্রকৃত শ্রদ্ধাজ্ঞাপন হবে।’’
বাংলার মানুষ সেদিন জ্যোতিবাবুর কথা রেখেছিলেন।