অনিরুদ্ধ চক্রবর্তী
গত শতাব্দীর ৯০ এর দশকে কোন একটা বছর হবে। পশ্চিমবঙ্গের একটি বহুল প্রচারিত বাংলা সাহিত্য পত্রিকা জ্যোতি বসুর উপর বিশেষ সংখ্যা প্রকাশের ঘোষণা করেছিল। বিজ্ঞাপনে সে খবর দেখে হকারকে আগে থেকে বলে রেখেছিলাম। কিন্তু পত্রিকাটি যখন হাতে পেলাম তখন প্রচ্ছাদের দিকে তাকিয়ে একরকম যেন আঁতকে উঠলাম। প্রচ্ছাদের তেল রঙে আঁকা জ্যোতি বসুর মুখাবয়ব, এঁকেছেন বিখ্যাত চিত্রশিল্পী বিকাশ ভট্টাচার্য।
কিন্তু এ কোন জ্যোতি বসু? ওর গোটা মুখ জুড়ে লাল পোড়া মাটির আভা। মোটেই ভালো লাগেনি দেখে। জ্যোতি বসুকে চেনা যাচ্ছে ঠিকই কিন্তু রংয়ের ব্যবহার দেখে রীতিমতো বিরক্ত হয়েছিলাম।
ভেবে পেলাম না বিকাশ ভট্টাচার্যের মত অত বড় মাপের শিল্পী কেন এরকম আঁকলেন? এখানেও পত্রিকাটি নিয়ে যখন আমি আমার এক অগ্রযোগে দেখালাম তিনি কিন্তু প্রচ্ছাদের দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইলেন। তারপর বললেন, বাঃ! এই না হলে বড় শিল্পী!
আমি অবাক হয়ে বললাম সে কি!
এই প্রচ্ছদ আপনার ভালো লেগেছে?
তিনি বললেন, প্রথম দর্শন এই হয়তো ভালো লাগে না। কিন্তু একটু তলিয়ে ভাবতে হবে ছবিটির দিকে তাকিয়ে।
তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন কেন মুখের রং পোড়া মাটির মতো করেছেন বলো তো?
আমি কোন উত্তর খোঁজার আগেই তিনি বললেন আসলে বিকাশ ভট্টাচার্য বলতে চেয়েছেন জ্যোতি বসু একজন সত্যিকারের পোড় খাওয়া নেতা। প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে করতে তার শরীরের উপর দিয়ে যে ঝড় ঝাপটা গিয়েছে, মুখের উপর পোড়া মাটির রং সেইদিকেই ইঙ্গিত করছে।
বাস্তবিকই তাই। বিচিত্র ঘটনা বহুল দীর্ঘ জীবনে জ্যোতি বসু ছিলেন বহু অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ পোড়খাওয়া জননেতা।
মানুষ বয়স হলে অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ হয়। জীবনের অনেক ওঠা পড়া তাকে সমৃদ্ধ করে। কিন্তু জ্যোতি বসু তার রাজনৈতিক জীবনে যে পাথেয় সঞ্চয় করেছিলেন তার গভীরতা ও ব্যাক্তি পরিমাপ করা সত্যিই কঠিন।
যে কোন ঘটনায় পরিপ্রেক্ষিত দ্রুত ধরতে পারার আশ্চর্য ক্ষমতা ছিল তার। একটি শব্দ, একটি বাক্য সমাজের বিভিন্ন অংশে কি প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে এ বিষয়ে সর্বদা সজাগ ছিলেন তিনি। তার মন্তব্য রাজনীতির দিক নির্দেশ করত, রাজনীতির মোড় ঘোরাত, মুখস্ত ভাষণ আওড়ে দেওয়া তার ধাতে ছিল না। এই ক্ষমতা একদিনে তৈরি হয় না।
আমরা যারা সাংবাদিকতা সূত্রে তার জীবন সায়াহ্নের শেষ দুটি দশক দেখেছি, তাদের সকলের অভিজ্ঞতা একথাই বলে, জ্যোতি বসু কখনো বেফাঁস আলগা মন্তব্য করেননি। না বিধানসভার ভিতরে, না মাঠে ময়দানে। কখনো এমন হয়নি যে তিনি একটা কথা বলেছেন, পরে সেকথা প্রত্যাহার করেছেন। অথবা কখনো তাঁর কোন মন্তব্য বিধানসভার কার্যবিবরণী থেকে বাদ দিতে হয়নি, কখনো না। অথচ যা বলার সবই বলেছেন। ঝাঁঝালো আক্রমণে বিদ্ধ করেছেন।
এখানে তার ঘটনা বহুল দীর্ঘ জীবন নিয়ে আলোচনা করছি না। করা সম্ভবও নয়। কিন্তু পাঠক বর্গের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই এই দেশে জ্যোতি বসুর রাজনৈতিক জীবনের একদম গোড়ার দিনগুলির দিকে। সেই সব ঝোড়ো দিনগুলিতে বিলেত ফেরত ব্যারিস্টার যুবক জ্যোতি বসু কমিউনিস্ট পার্টির সর্বক্ষণের কর্মী হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লেন।
১৯৪৩ সালের মন্বন্তরে প্রাণের কাজে অংশ নিচ্ছেন, দুনিয়া জোড়া ফ্যাসিবাদী উত্থানের বিরুদ্ধে জনমতকে সজাগ করতে প্রচার সংগঠিত করছেন। সেই সময় শ্রমিক শ্রেণীর ধর্মঘট, ডাক তার কর্মীদের লাগাতার ধর্মঘট। নৌ বিদ্রোহ, ভিয়েতনাম মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে কলকাতার সমাবেশে পুলিশের গুলিচালনা এর সবই ঘটে চলেছে।
পার্টি জ্যোতি বসুকে রেল কর্মীদের সংগঠিত করার কাজে দায়িত্ব দিচ্ছে। তিনি নিজেই লিখছেন ” তখন যুদ্ধ। ট্রেনে আসা-যাওয়া খুব কঠিন। একটা ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে যাতায়াত করতাম কোনক্রমে। তবে পরিশ্রম বা কষ্ট কোনটাই বোধ করতাম না। “
যতদূর মনে পড়ে, জ্যোতি বসু, পৃষ্ঠা ২১
জ্যোতি বসু তার রাজনৈতিক জীবনের একদম শুরু থেকেই সরব ছিলেন গণতন্ত্র, নাগরিক অধিকারের প্রশ্নে। বিশেষ করে বিনা বিচারে আটক করার বিরুদ্ধে তিনি বিধানসভার ভিতরে ও বাইরে সর্বদা প্রতিবাদ জানিয়ে এসেছেন। ১৯৪৬ সালের ২৪ শে জুলাই বিধানসভা বন্দিমুক্তির দাবিতে জ্যোতি বসুকে সরব হতে দেখেছিল। সদ্য এমএলএ হওয়া তরুণ জ্যোতি বসু সেদিন বাংলার প্রধানমন্ত্রী হাসান সুরাবর্দিকে বলতে পেরেছিলেন, আমি নিশ্চয়ই স্পিকারের রুলিং মেনে চলবো, আপনার রুলিং নয়।
দেশ স্বাধীন হওয়ার অব্যবহিত পরেও কালা কানুনের বিরোধিতায় সদা সক্রিয় থেকেছেন। যা সত্য বলেছেন তার পক্ষে দাঁড়িয়েছেন, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে তার বুক কাঁপেনি। সোজা কথা বলিষ্ঠতার সঙ্গে উপস্থিত করেছেন। ফলে রাজনীতির বৃত্তে সকলের মনে নিজের জন্য সম্ভ্রমের জায়গা তৈরি করে নিতে পেরেছিলেন। এই পর্বেই তিনি তিন দফায় জেলে আটক হয়েছেন। এই সময় জ্যোতি বসু তেভাগা আন্দোলনের তথ্য সংগ্রহ করতে ময়মনসিংহ যাচ্ছেন। ১৯৪৬ সালে দাঙ্গার প্রতিবাদে অন্য কমিউনিস্ট নেতা কর্মীদের নিয়ে একসাথে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন।
নিজের রাজনৈতিক জীবনের সূচনা পর্বেই তিনি সাম্প্রদায়িকতার ভয়ানক রূপ দেখেছিলেন। জ্যোতি বসু ও তার প্রজন্মের কমিউনিস্ট নেতাদের একটা বড় অবদান হলো যুক্তবঙ্গের শেষ অধ্যায় ও দেশভাগের পর দীর্ঘ সময় জুড়ে হিন্দু মুসলমান হানাহানির বিরুদ্ধে ধারাবাহিক লড়াই চালিয়ে যাওয়া। সেই লড়াইয়ের মধ্যে দিয়েই তারা সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে ভোঁতা করে দিয়েছিলেন।
দাঙ্গার সময় কলকাতা কি ভয়ানক চেহারা নিয়েছিল সে বর্ণনা জ্যোতি বসুর নিজের লেখাতেই আছে। কি হিন্দু কি মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে হিংসার উন্মত্ততা প্রত্যক্ষ করেছিলেন। আবার তিনিই লিখছেন ” কিন্তু সেই সঙ্গে আর একটা দিকের কথা ভুললে চলবে না। হিন্দু অধ্যুষিত অনেক এলাকায় এমন সব ব্যক্তি ছিলেন, যারা এই উন্মত্ততার মধ্যেও নিজেদের জীবন বিপন্ন করে মুসলমানদের আশ্রয় দিয়েছেন। আবার অনেক মুসলমান অধ্যুষিত এলাকায় এমন সব ব্যক্তি ছিলেন যারা অনুরূপভাবেই বহু হিন্দু পরিবারকে রক্ষা করেছেন, আশ্রয় দিয়েছেন এবং এলাকা থেকে নিরাপদে বেরিয়ে যেতে সাহায্য করেছেন। “
যতদূর মনে পড়ে, জ্যোতি বসু, পৃষ্ঠা ৪১
উপরের এই মন্তব্যটি থেকে জ্যোতি বসুকে চেনা যায়।
সাম্প্রদায়িক হানাহানির মধ্যেও যে উভয় সম্প্রদায়ের বেশ কিছু মানুষের মধ্যে শুভবুদ্ধি ছিল, এটা তিনি শুধু দেখেননি, আমাদের মনে করিয়েও দিয়েছেন। অর্থাৎ সমাজে কিছু মানুষের যে শুভ বোধ আছে, বিবেক আছে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার সাহস আছে, এই ভরসা জ্যোতি বসুর বরাবর ছিল। মানুষের বিচার বুদ্ধির উপর ভরসাকে সম্বল করেই সত্যের মুখোমুখি হয়েছিলেন তিনি। ফলে তীব্র প্রতিকূলতার মধ্যেই জ্যোতি বসুর সেরাটা বেরিয়ে এসেছিল, যা মানুষের নজর এড়ায়নি।