১৯৪৮ সাল। ৩০শে জানুয়ারী। সদ্য ৬ মাসের স্বাধীনতা। শীতের সন্ধ্যা নামছে দিল্লিতে। সূর্য ডুবলেও গোধূলির শেষ আলোয় আকাশ লাল। পাখির কলকাকলী আর প্রাক সন্ধ্যার বিষন্নতা – দুই এর মাঝে দ্রুত নেমে আসছে শীতের অন্ধকার। হটাৎ ৩টে গুলির শব্দে চমকে উঠলো দিল্লির বিড়লা হাউস। রক্তাক্ত গান্ধীজি লুটিয়ে পড়লেন।
বোঝা গেল সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাস্নাত দেশ ধর্মের নামে ভাগাভাগি হলেও, স্বাধীন বিভক্ত দেশেও ঘৃণার আগুন জ্বালাবার শক্তি রয়ে গেছে।
” সাম্প্রদায়িকতার বিদ্বেষপরায়ণ শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণায় আমরা দায়বদ্ধ ; আমাদের মধ্যে তিক্ততার বীজ বপন করেছে জঘন্য যে শক্তি, তার প্রতি ঘৃণায় আমরা দায়বদ্ধ; সাধারণ মানুষকে নিষ্পেষণের চেষ্টা করছে যারা তাদের বিরুদ্ধে সরকারের ভেতর কিংবা বাইরে মানুষের পবিত্র ক্রোধ জাগিয়ে তুলতে আমরা দায়বদ্ধ। তাদের বিরুদ্ধে আমরা যুদ্ধ ঘোষণা করবো। সত্যিকারের মুক্ত এবং গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠায় আমরা সকলেই সামনের দিকে এগিয়ে যাব।”
১৯৪৮ সালের ৩০ শে জানুয়ারী মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীকে হত্যা করেছিল নাথুরাম গডসে, আজকের বিজেপি আর.এস.এস-এর পূর্বসূরী। ১০ই ফেব্রুয়ারি গান্ধীজী’র শোক প্রস্তাবের উপর তৎকালীন বিধানসভার আলোচনায় অংশ নিয়ে জ্যোতি বসু সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করার আহ্বান জানিয়েছিলেন। সেটা নিছক ঘোষণাই ছিল না। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত দেশের মানুষের ঐক্য অটুট রাখার জন্য আপোষহীন লড়াই করেছিলেন তিনি। বুঝেছিলেন কোনও অবস্থাতেই মানুষের ঐক্য ভাঙার শক্তির সাথে আপোষ করা যায়না।
এর ৫০ বছর পরে, ১৯৯৮ সালের ১৩ই নভেম্বর। জওহরলাল নেহেরু স্মারক বক্তৃতা।
“বিগত অর্ধ শতাব্দী জুড়ে ভারতবর্ষ নানাভাবে বিপর্যস্ত ও বিধ্বস্ত হয়েছে, তবু এর মধ্যেই সে তার একান্ত নিজস্বতায় একটি বহুজাতিক,বহু ভাষাভাষী, বহু ধর্মীয় ও বহু সংস্কৃতিসম্পন্ন সমাজের বৈচিত্র্যকে রক্ষা করে চলেছে। এই ঐতিহ্যের ওপর সাম্প্রতিকতম আক্রমণটি এসেছে হিন্দু সমাজের একীকরণের উদ্ভট মতাদর্শগত ধারণাকে প্রচারের অপপ্রয়াসের মধ্যে। সংঘ পরিবারের এই জাতীয় ভাবনা থেকে উদ্ভুত হিন্দু রাষ্ট্রের ধারণা আমাদের সমাজের গণতান্ত্রিক কাঠামোকেই ধ্বংস করতে চাইছে। এই বিষয়ে আমাদের অত্যন্ত সজাগ থাকতেই হবে।”
আপোষহীন সজাগ দৃষ্টি ৮৬ বছর বয়সেও।
১৯৪০ থেকে ২০১০। সুদীর্ঘ ৭০ বছরের প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক জীবন। পরাধীন ভারত, অখণ্ড দেশ, দাঙ্গা, দেশভাগ, স্বাধীনতা, লক্ষ কোটি উদ্বাস্তু মানুষের স্রোত থেকে একবিংশ শতাব্দীর ভারত – এই বিশাল রাজনৈতিক জীবন আমাদের দেশে আর কারুর আছে কি না, আমার জানা নেই। এই ৭০ বছর ধরেই আপোষহীন যুদ্ধ চালিয়েছেন মানুষের ঐক্য ভাঙার চক্রান্তের বিরুদ্ধে। বিরামহীন লড়াই করছেন মানুষের ঐক্যের জন্য। ভোট-ক্ষমতা কোনো কিছুর জন্যই এই প্রশ্নে কখনোই আপোষ করেন নি। যা আমাদের দেশের রাজনীতিতে বিরল।
জেল, আত্মগোপন, মুখ্যমন্ত্রী, জাতীয় নেতা, প্রধানমন্ত্রীত্বের প্রস্তাব – ৭০ বছরের জীবনটাই ওঠানামা, উত্থান -পতনের অভিজ্ঞতায় ঠাঁসা। এই বিশাল অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ জ্যোতি বসু বুঝেছিলেন মানুষের ঐক্য রক্ষা করতে না পারলে দেশ উন্নয়নের রাস্তায় হাঁটতে পারে না। শ্রমিক- কৃষকসহ মেহনতী মানুষের লড়াই দুর্বল হয়ে যায়। তাই এই প্রশ্নে আজীবন তিনি নির্দ্ধিধায় চাঁচাছোলা ভাষায় আক্রমণ করতেন বিভেদমূলক শক্তিকে।
তাঁকে একবার বাজপেয়ী জিজ্ঞাসা করেছিলেন – আপনি আমার দল বিজেপিকে অসভ্য বর্বর বলেন কেন? উত্তরে জ্যোতি বসু তাঁকে বলেছিলেন – যারা একটা মসজিদকে ভেঙে ফেলে দাঙ্গা বাঁধায়, তাদের কি বলবো? আপনি তো সাহিত্য চর্চা করেন, ভাষাজ্ঞান অনেক, আপনিই বলুন এছাড়া আর কি ভালো ভাষা এদের জন্য ব্যবহার করা যায়!
(২)
১৯৪৬ এর ২৯শে জুলাই। হরতাল-চাকা বন্ধ্। স্তব্ধ কলকাতা। নেতাজী সুভাষ বসু প্রতিষ্ঠিত আই.এন.এ বন্দীদের মুক্তির দাবীতে এবং নৌসেনাদের বিদ্রোহের প্রতি সহমর্মিতা জানিয়ে হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে ধর্মঘটে সামিল হয়েছিল সেদিন সব মানুষ। কলকাতা শহর দেখেছিল জাতি -ধর্ম-ভাষা নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধ মানুষের লড়াই; দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের বীর সেনানীদের মুক্তির দাবীতে।
কিন্তু বাংলার মানুষের গড়ে ওঠা ঐক্য তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়েছিল দাঙ্গায় রক্তস্নাত হয়ে এর মাত্র ১৮ দিনের মধ্যেই। সুরাবর্দির সরকার তখন। তবে ব্রিটিশরাজ চলছে। আলাদা পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠনের জন্য ‘প্রত্যক্ষ সংঘর্ষ দিবস’ পালনের ডাক দিয়েছিল অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগ। দাঙ্গায় রক্তস্নাত হ’ল বাংলা। সুরাবর্দি সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব আনল কংগ্রেস দল।
১৯৪৬ সালের ১৯শে সেপ্টেম্বর এই প্রস্তাবের উপর বিধানসভায় বক্তৃতা দিয়েছিলেন জ্যোতি বসু। মাত্র ৩৪ বছর বয়সে সেদিন যে প্রস্তাব তিনি দিয়েছিলেন বিধানসভায়, তা মেনে নিলে হয়ত বাংলাভাগ এড়ানো যেত।
একদিকে সুরাবর্দি সরকারকে তুলোধোনা করেছিলেন দাঙ্গাকে প্রশ্রয় দেওয়ার জন্য, অপরদিকে ব্রিটিশ শাসকদের প্রকৃত চেহারা উন্মোচিত করেছিলেন।
” সবশেষে স্বাধীনতাও নয়, এমনকি গণতান্ত্রিক অধিকার বা স্বায়ত্তশাসনের অধিকার দেওয়ার পরিবর্তে তারা (ব্রিটিশ) আমাদের দেশবাসীর এক সম্প্রদায়ের সাথে অন্য সম্প্রদায়ের বিরোধকে পরিকল্পিত ভাবে জিইয়ে রাখল এবং মানুষের মনকে বিষিয়ে তুলল। এসবের চূড়ান্ত পরিণতি হল কলকাতার মারাত্মক দাঙ্গা।”
তিনি অভিযোগ আনলেন –
“আমাদের এমন দুর্দশা করতে পারতো না (ব্রিটিশরা), যদি লীগ এবং কংগ্রেস সেই অশুভ চক্রান্তের শিকারে পরিণত বা হতো।”
ব্রিটিশ শাসকদের চক্রান্ত উন্মোচিত করে বলেছিলেন; “অতীতে যখনই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়েছে তখনই আমরা, সঠিকভাবেই সাম্রাজ্যবাদকেই (ব্রিটিশ) তার প্রধান উস্কানিদাতা হিসাবে ভৎর্সনা করেছি এবং আমরা দেখেছি সাম্রাজ্যবাদীদের হাতে দেশবাসী কিরকম অসহায় দুর্বল দাবার বোড়েতে পরিণত হয়। এবারের দাঙ্গা সম্পর্কে আলাদা কিছু ভাবনার কারণ নেই। সমস্ত দেশপ্রেমিক শক্তির সাথে আমিও অভিযুক্ত করছি এই দাঙ্গার প্রধান অপরাধীদের। এরাই ’হোয়াইট হল’ অথবা দিল্লি অথবা কলকাতার ’গভর্ণর হাউসে’ আত্মতৃপ্তি নিয়ে বসে আছেন এবং সুতোর টানে আমাদের প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলগুলিকে তাদের পাতা ফাঁদে পা ফেলতে বাধ্য করেছে।”
সেদিন তিনি প্রস্তাব দিয়েছিলেন – “একমাত্র দেশপ্রেমের উদ্দীপনা থেকে রাজনৈতিক দলগুলি একযোগে কোয়ালিশন সরকার গঠন করে বাংলাকে বাঁচাতে পারে। আমি উল্লেখ করেছি ইউরোপীয়দের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে এই সরকারের কর্মসূচী হবে – প্রগতিশীল আইন, বাঁচার মতো মজুরি, ইউনিয়নের সুরক্ষা, জমিদারি প্রথার উচ্ছেদ, পাটের ন্যায্য নূনতম মুল্য, সকলের জন্য পর্যাপ্ত খাদ্য ও বস্ত্র, সম্পূর্ণ নাগরিক অধিকার এবং অবশিষ্ট রাজনৈতিক নেতাদের মুক্তিদান।”
সেই সময়ে বাংলা এবং দেশকে ঐক্যবদ্ধ রাখার জন্য কংগ্রেস-লীগ যৌথ মন্ত্রীসভা গঠন করাই ছিল একমাত্র বিকল্প। সেই প্রস্তাব উত্থাপন করে শুধু বিধানসভায় বক্তৃতাই করেন নি জ্যোতি বসু। তার আগে ১৩ই সেপ্টেম্বর তৎকালীন ৩জন কমিউনিস্ট বিধায়ক জ্যোতি বসু, রূপনারায়ন রায় এবং রতন লাল ব্রাহ্মণ এক বিবৃতি প্রকাশ করে বলেছিলেন – “এই পরিস্থিতিতে বাঁচবার একমাত্র উপায় সর্বদলীয় মন্ত্রীসভা গঠন করা। একে অপরকে দোষারোপ করে তা সম্ভব নয়। বরং আলোচনার মাধ্যমে একটি অভিন্ন কর্মসূচীতে উপনীত হওয়ার জন্য অভিন্ন সিদ্ধান্তে পৌঁছানো দরকার, যা বাংলাকে বাঁচাবে।…. আমরা কমিউনিস্টরা কখনোই ভাইকে ভাইয়ের বিরুদ্ধে লড়তে সাহায্য করিনা। বরং অভিন্ন শত্রুর বিরুদ্ধে তাদের একত্রিত করার যথাসাধ্য চেষ্টা করি।… যে কোনো রকম গঠনমূলক কাজে, এবং সাম্রাজ্যবাদী আমলাতন্ত্রের বিরুদ্ধে যে কোনো ধরনের সংগ্রামে, জমিদারদের বিরুদ্ধে, কায়েমী স্বার্থান্বেষী এবং মুনাফাকারীদের বিরুদ্ধে এবং যে কোন প্রকারের বাংলা ভাগের বিরুদ্ধে সংগ্রামে বিধানসভার ভেতরে এবং বাইরে পূর্ণ সমর্থনের আশ্বাস দিচ্ছে কমিউনিস্ট পার্টি।”
কিন্তু এই প্রস্তাবে সেদিন কংগ্রেস বা লীগের নেতৃত্বের কেউ সায় দেয় নি। অবশ্য কংগ্রেস নেতা ডঃ কুমুদ শঙ্কর রায় চেষ্টা করেছিলেন এবং সেই জন্য কিছু উদ্যোগও নিয়েছিলেন। কিন্তু মুসলিম লীগ এবং কংগ্রেস নেতৃত্ব পৃথক বাংলার রাস্তাতেই হেঁটেছিল। আর লীগের প্রত্যক্ষ সংঘর্ষ দিবস পালন যেমন দেশভাগের অন্যতম প্রধান কারণ, তেমনই জঘন্য ভূমিকা ছিল হিন্দু মহাসভার।
১৯৪৬ সালের শেষের দিকে শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ও অন্যান্য কয়েকজনের নেতৃত্বে তৈরী হয় Bengal Partition League, পরবর্তীতে যা Bengal Provincial Conference নামে পরিচিত হয়। ঐ বছর ফেব্রুয়ারী মাসে হিন্দু মহাসভার বাংলা শাখা হিন্দুদের জন্য আলাদা বাংলা রাজ্য গঠনের জন্য একটি কমিটি তৈরী করে এবং ২৯শে মার্চ এর বার্ষিক সাধারণ সভায় হিন্দুদের জন্য আলাদা রাজ্যের দাবীতে প্রস্তাব পাশ করে। এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে শ্যামাপ্রসাদের নেতৃত্বে হুগলি জেলার তারকেশ্বরে বাঙালী হিন্দু সম্মেলন সংগঠিত হয়। এখান থেকেই শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় প্রস্তাব দেন ‘বাংলা ভাগই সমস্যা সমাধানের একমাত্র রাস্তা।’ এই সম্মেলন থেকে তাঁকেই দায়িত্ব দেওয়া হয় – বাঙালি হিন্দুদের জন্য পৃথক রাজ্যের দাবীতে একটি কাউন্সিল গঠন এবং গণপরিষদের কাছে বাংলা ভাগের সীমানা নির্ধারণের আবেদন করার জন্য।
১৯৪৬ সাল। স্বাধীনতার প্রাক মুহূর্ত। জ্যোতি বসুর নেতৃত্বে বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি যখন লড়ছিল ঐক্যবদ্ধ বাংলার জন্য, তখন শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে হিন্দু মহাসভা লড়েছিল বাংলা ভাগ করার জন্য।
এই ইতিহাসটাই পাল্টে দিতে চাইছে আজ সংঘ পরিবারের আই.টি সেল। ইতিহাস বিকৃত করা দক্ষিণপন্থীদের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট।
(৩)
১৯৪৬ এর অভিজ্ঞতা থেকেই জ্যোতি বসু বুঝেছিলেন – সরকার না চাইলে দাঙ্গা হয়না। তাই ১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদ ধ্বংস করার পর দেশ জুড়ে দাঙ্গার আগুন ছড়িয়ে পড়লেও, বাংলায় সেই আগুন জ্বলতে দেয়নি তাঁর সরকার।
১৯৪৬ সালের সেই ঐতিহাসিক বক্তৃতায় তিনি বলেছিলেন – ” মিঃ সুরাবর্দি এবং তাঁর মন্ত্রীরা বলার চেষ্টা করেছেন যে, তাঁদের দায়িত্ব কেবল আদেশ করা, আর তা পালন করার করা পুলিশ কমিশনারের কাজ। কিন্তু মিঃ সুরাবর্দি জানেন, তাঁর গাড়ির উইন্ডস্ক্রীন দিয়ে স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করেছেন যে ১৬ই আগষ্ট দুপুরবেলা জনসমাগম কেমন করে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেল। তারই অধিনস্থ পুলিশ কমিশনার দায়িত্ব পালন করছে কিনা, তা দেখা মিঃ সুরাবর্দির দায়িত্ব। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী (তখন প্রদেশ প্রধানকে বলা হত) আন্তরিকতা ও দৃঢ়তার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করছেন তার কোনও লক্ষ্মণ নেই। তিনি কি দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ পুলিশ কমিশনার বা অন্যান্য ডেপুটি কমিশনারদের সাময়িকভাবে বরখাস্ত করার কথা ভাবছেন? তাঁর সেই সাহস নেই কারণ তিনি নিজের ব্যর্থতা তদোপরি সরকারের শোচনীয় ব্যর্থতার কথা জানেন। ”
চোখের সামনে দেখেছিলেন একটা সরকার দাঙ্গার সময়ে কোনো পক্ষ নিলে বা হাত গুটিয়ে বসে থাকলে দাঙ্গা থামানো যায় না। তাই সরকার চালাতে গিয়ে সদা সতর্ক
থেকেছেন এই প্রশ্নে। শুধু পুলিশ-আমলা-প্রশাসনের উপর ভরসা করে সরকার চালান নি তিনি এই কারনেই। বারে বারে বলতেন – আমাদের সরকার রাইটার্স বিল্ডিং থেকে চলে না। ৫৫ হাজার জনপ্রতিনিধি চালায় আমাদের সরকার।
আপনার রাজ্যে দাঙ্গা কেন হয়না? সাংবাদিকদের এই প্রশ্নের উত্তরে সেইজন্যই অনায়াসে বলতে পারতেন – আমার সরকার দাঙ্গা চায় না, তাই দাঙ্গা হয়না। সরকার না চাইলে দাঙ্গা কখনোই হয় না।
১৯৪৬ এর দাঙ্গা থেকে জীবনের শেষ দিন – দীর্ঘ ৭০বছর ধরে দেশের মানুষের ঐক্য অখণ্ডতা যখনই আক্রান্ত হয়েছে, তখনই রুখে দাঁড়িয়েছেন জ্যোতি বসু।
(৪)
“… ধর্ম ও রাজনীতিকে কখনও মেশাবেন না। এটা মেশালে সর্বনাশ হয়ে যাবে। আমাদের যে সংবিধান আছে তা হ’ল ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্র। তার জন্য আমরা গর্বিত। এটাই হওয়া উচিত। আমাদের পাশে অনেক প্রতিবেশী রাষ্ট্র আছে এখানটা সেরকম নয়। সেখানে কোনো একটা ধর্ম আছে, সেটা কোনো একটা ধর্মের রাষ্ট্র। এটা আমরা চাইনা।….. নানা সংস্থা আছে যারা ধর্ম এবং রাজনীতিকে মিলিয়েছে এবং বিশেষ করে রাম জন্মভূমি এবং বাবরি মসজিদ নিয়ে। আমি অনেক খোলা মিটিং-এ বলেছি যে ধর্মের বিরুদ্ধে কেউ হতে পারে না, এটা সংরক্ষিত আছে, এই অধিকার সংবিধানে আছে যে, যে যার ধর্ম পালন করবেন। কিন্তু এটা মেশালে সর্বনাশ হয়ে যাবে।”
১৯৯০ সালের ২৪ শে জানুয়ারী বিধানসভায় আরও বলেছিলেন জ্যোতি বসু-
” রাম জন্মভূমিতে একটা মন্দির হতে পারে, রাম জন্মভূমিতে অনেক রামের মন্দির আছে, আরও একটা মন্দির হলে ক্ষতি কি আছে! আরও একটা মসজিদ হলে ক্ষতি কি আছে! আরও একটা মন্দির বা মসজিদ হলে কেউ কিছু বলতো না। কিন্তু একটা মসজিদ ধ্বংস করে আরও একটা রাম মন্দির করা, এটা এখন কি করে হয়!”
” পূর্ণ ক্ষমতা দেওয়া হয়েছিল আপনাকে। আপনার উচিত ছিল নজিরবিহীন এই ক্ষমতা দেশের স্বার্থে ব্যবহার করা। কিন্তু আপনারা চুপচাপ বসে রইলেন। এমনকি বিজেপি-ভি.এইচ.পি-র আক্রমণাত্মক কর্মসূচির নিন্দা পর্যন্ত করলেন না। এর কোনো ক্ষমা নেই।” নরসীমা রাওকে মুখের উপর এই কথা বলেছিলেন জ্যোতি বসু। পরে বারবার বলেছেন – নরসীমা রাও-র সেই ঔদাসীন্য ও নিষ্ক্রিয়তা আমাকে এখনো বিস্মিত করে।
বর্তমানে আমাদের মূখ্যমন্ত্রী সেদিন ছিলেন রাও মন্ত্রীসভার অন্যতম সদস্যা। একটি বাক্যও খরচ করেন নি তাঁর মন্ত্রীসভার মসজিদ ধ্বংস নিয়ে নিষ্ক্রিয়তা প্রসঙ্গে। এরা ক্ষমতা-মন্ত্রী-অর্থ এইসবের জন্য রাজনীতি করেন। আর জ্যোতি বসু করতেন মানুষের জন্য, দেশের জন্য। তাই এই অপরাধের সুদুরপ্রসারি প্রভাবের কথা ভেবেই বাবরি মসজিদ ভেঙে দাঙ্গা করার কারিগরদের অসভ্য বর্বর বলতে দ্বিধা করতেন না। আর নরসীমা রাওকে বলতেন; আপনি এটা হতে দিলেন – এর কোনো ক্ষমা নেই। এই বুকের পাটা আজ দেশের কোনো বিরোধী মুখ্যমন্ত্রীর নেই – তাই আপনার অভাবটা খুবই প্রকট আজ।
২০১৯ সালের ৯ই নভেম্বর সুপ্রিম কোর্ট রায় দিল মসজিদ ভাঙা অন্যায় হয়েছে, কিন্তু ওখানে রাম মন্দির হবে।
রায়ের ফলও হাতেনাতে মিললো। এই বিচিত্র বিতর্কিত রায়দানের মাত্র ৪মাসের মধ্যেই বিজেপির মনোনীত রাজ্যসভার সদস্যপদ পুরষ্কার পেলেন তৎকালীন প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈ। ঐ ৫ বেঞ্চের আর এক বিচারপতি মনোনীত হলেন প্রধান বিচারপতি মাত্র ৯ দিনের মাথায়। এখন তিনি তিনি হার্লে ডেভিডসনের ৫০ লাখি বাইকে চড়ে ছবি তোলেন। অভিযোগ ঐ বাইকের মালিক নাকি নাগপুরের কোনো বিজেপি নেতার ছেলে। দেশের কোনো মুখ্যমন্ত্রীর প্রতিবাদ করার মুরোদ নেই!
বিচার ব্যবস্থা-সংসদীয় ব্যবস্থা- প্রশাসন-সংবাদ মাধ্যম সবই এখন দক্ষিণপন্থী সাম্প্রদায়িক শক্তি নিজেদের নিয়ন্ত্রণে আনার মরীয়া চেষ্টা চালাচ্ছে। এনেও ফেলেছে অনেকটাই।
এমন সময়ে ঋজু মেরুদণ্ডের ছোটখাটো এই মানুষটিকে বড় প্রয়োজন ছিল দেশের। ধর্মনিরপেক্ষ সব দলগুলিকে এক ছাতার তলায় এনে এই ফ্যাসিবাদী শক্তির বিরুদ্ধে লড়াইটা এগিয়ে নিয়ে যেতে পারতেন তিনিই।
(৫)
বিধানসভার ঐ বক্তৃতায় একই সাথে দুই মৌলবাদের বিপদ সম্পর্কেই তিনি সাবধান করেছিলেন।
”এই যে মৌলবাদ মাথাচাড়া দিচ্ছে, এর বিপদ হিন্দুদের মধ্যে যেমন আছে তেমনই মুসলমানদের মধ্যেও আছে। সবাই মিলে এই মৌলবাদের বিরোধিতা করতে হবে। বিরোধী পক্ষে যারা আছেন তাঁদের এবং আমাদের একসাথে বিরোধিতা করতে হবে। এছাড়া আমাদের পথ নেই। এটা না করলে আমরা ভারতবর্ষকে বাঁচাবো কি করে? কাজেই সকলে মিলে এই কাজটা করতে হবে। বিপদটা এখন বাড়ছে।”
আজ বাংলার মুখ্যমন্ত্রী এই কথা বলার সাহস রাখেন? কখনো হিজাব কখনো নামাবলী চড়িয়ে দুই মৌলবাদকে তুষ্ট করে ভোটে জিততে ব্যস্ত আজকের বাংলার মুখ্যমন্ত্রী।
১৯৪৬-২০০১। দীর্ঘ ৫৫ বছর লাগাতার বিধানসভার সদস্য ছিলেন (‘৭২র রিগিং নির্বাচন বাদে)। কোনওদিন মাথায় ফেজটুপি বা গায়ে নামাবলী চড়াতে হয়নি ভোটে জেতার জন্য। অথচ তাঁর মুখ্যমন্ত্রীত্বের সময়ে বাংলায় মন্দির-মসজিদ-গীর্জা-গুরুদ্বার ছিল দেশের মধ্যে সবচেয়ে সুরক্ষিত, একইসাথে যুক্তিবাদও।
জ্যোতি বসু আজ ১০৬। আপনি আজ সশরীরে নেই। কিন্তু আপনার ঋজু শক্ত মেরুদণ্ডটাই আজও গণতন্ত্র, অধিকার এর লড়াইয়ে মূল অনুপ্রেরণা; বিভেদকামীদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের শক্তি।