আমরা কমবেশি প্রায় সবাই স্বামী বিবেকানন্দের রাজনৈতিক মানসিকতা নিয়ে বেশি কৌতুহলী।
এই প্রশ্ন মাথায় ঘুরপাক খায়। তিনি কি হিন্দুত্ববাদী ছিলেন?
সম্প্রতি কিছু ঘটনা নজরে এসেছে হিন্দুত্ববাদীরা নরেন বা বিলেকে সম্পূর্ণ ভুল ভাবে তুলে ধরে তাদের দখলে নিয়েছে।
প্রশ্ন হল বিবেকানন্দের মতো একজন সাম্যবাদী, সমাজতান্ত্রিক ভাবনার মানুষ “গরিব তথা দরিদ্র মানুষের সেবাকার্মকে ঈশ্বরের সেবা বলেছিলেন “তাকে কি করে আমরা হিন্দু মৌলবাদীর হাতে ছেড়ে দেব? নাকি আমরা নতুন করে বিবেকানন্দ পড়তে শুরু করব।
১২ জানুয়ারি স্বামী বিবেকানন্দের জন্মদিন।
১৮৬৩ সালে এই দিনে তিনি জন্মেছিলেন। ১৬১ বছর পার হয়ে গিয়েছে। বিবেকানন্দ কে নিয়ে আলোচনা ফুরোয়নি রবীন্দ্রনাথ, গান্ধীর পরেই তিনি বোধায় ভারতের সবথেকে বেশি আলোচিত ব্যক্তি।
ভারতবাসীকে উদ্দীপিত করার উদ্দেশ্যে স্বামী বিবেকানন্দ বলতেন ” ওঠো! জাগো! “চিত্ত আলোড়নকারী ভাষণ ও পত্রাবলীর মাধ্যমে স্বামীজি উনবিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগে ভারতকে জাগ্রত কোনে করেছিলেন নিঃসন্দেহে।এই জাগরনের ফলস্বরূপ ভারতের রাজনৈতিক পুনরুত্থান হয়েছিল।স্বামী বিবেকানন্দের শিকাগো ভাষণ ভারতের সাংস্কৃতিক ইতিহাসের এক উল্লেখযোগ্য সন্ধিক্ষণ। এই ঘটনার পর থেকেই ভারতীয় সমাজ সংস্কৃতি ও ভারতবাসী আগের মতো থাকেনি। অতীতের ছায়ার আবরণ ছড়িয়ে নতুন ভারতবর্ষ রূপ নেয়।
ভারতবর্ষের অভ্যন্তরে যে সাম্যবাদী সমাজ বা সাংস্কৃতিক ব্যাবস্থার কথা স্বামীজি বস্তুগত স্তরে কল্পনা করেছেন তা অনেকাংশে ভুলিয়ে দেবার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। সমাজতান্ত্রিক ভাবধারার আধুনিক উওরন ইউরোপে কিন্তু উনিশ শতকে স্বামীজির ভাবনা ভারতীয় মডেলের এক সমাজের কথা প্রকাশ করে। আমরা জানি কাল মার্ক্স ও বিবেকানন্দ এই দশকের দুজন শ্রেষ্ঠ চিন্তাবিদ যারা মানবসভ্যতার সর্বস্তরের ভাবধারাকে প্রভাবিত করেছে। বিবেকানন্দের চিন্তা ছিল মূলত বেদান্তের উপর নির্ভরশীল একজন বেদান্তের শিক্ষক হিসেবে তিনি universal religion কথা ঘোষণা করেন। যা ছিল মানবজাতির ঐক ও কল্যাণের ধারক ও বাহক। তাঁর ধারণা অনুযায়ী ঈশ্বর সকলের জন্য সমান এবং সকল সৃষ্টি ঈশ্বরের তৈরি। তাই ঈশ্বর সৃষ্ট মানুষ কে তিনি ভালোবাসার কথা বলেন। তিনি কখনো ধর্মান্তকরনের পক্ষে ছিলেন না, যেমনটা বর্তমানে RSS ঘর বাপাসির কথা বলে। কারন ইতিপূর্বে স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী শুদ্ধি আন্দোলনের মাধ্যমে মুসলমান ও খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের মানুষকে হিন্দু ধর্মে ফিরিয়ে আনার কথা বলেছিলেন। প্রকৃতপক্ষে, RSS সেই দয়ানন্দ সরস্বতীর আদর্শ কে অনুসরণ করে চলছেন,তারা বিবেকানন্দের বাণী গ্রহণ করে না বরং তার বিপরীত ধর্মী কাজ করে। স্বামী বিবেকানন্দের মতে “যদি তুমি খ্রিস্টান হয়ে জন্ম নাও, তবে তুমি ভালো খ্রিস্টান হও। যদি তুমি হিন্দু হিসেবে জন্ম নাও, তবে ভালো হিন্দু হও।যদি তুমি মুসলমান হিসেবে জন্ম নাও, ভালো মুসলমান হও”(অনুবাদ ইংরেজি থেকে)। অর্থাৎ, RSS বিবেকানন্দের এই শব্দ গুলো অস্বীকার করে তাকে অপমান করছে প্রতিনিয়ত এবং তারা ধর্মান্তরিত করার যে আধুনিক তালেবানি পদ্ধতি অনুসরণ করছে তাতে তারা মুসলিম মৌলবাদের মতো নিজেদের কোন অংশে পার্থক্য করে নি।
বিবেকানন্দের শ্রেনীর ধারণা অনেকটা চমকপ্রদ, যদিও মার্ক্সের শ্রেণী চেতনা আর তাঁর শ্রেণী চেতনার ধারনার মধ্যে কিছু মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। কারন ভারতবর্ষের সমাজ ইউরোপীয় সমাজের মতো অর্থনৈতিক ভাবে বিভক্ত নয়, বরং এই সমাজ জাতি, ধর্ম, সম্প্রদায় ও বর্ন দ্বারা বিভক্ত। স্বামী বিবেকানন্দের আজীবন লড়াই ছিল এই অভিশপ্ত ভারতীয় সমাজের প্রতিস্ঠিত যে জাতিবাদ তার বিরুদ্ধে শ্রেনীর লড়াই,যা তাকে আরও স্বতন্ত্র করে তুলেছে। তিনি এই বৈষম্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন, কারন সমাজের মানুষ যদি শ্রমের সঠিক মূল্য না পায় যদি সমান কাজ সমান চিন্তার সুজোগ না পায় তবে তা দুর্বল সমাজে রূপান্তরিত হয় এটা তিনি উপলব্ধি করতেন। তিনি বহিরাগত ইসলাম বা খ্রিস্টান ধর্মের ভারতবর্ষে প্রভাব বিস্তার কে এই বৈষম্যের ফলাফল হিসেবে মনে করতেন।
আসলে তিনি এক মানবতাবাদী বস্তুবাদী সমাজের কথা কল্পনা করেছেন। ধর্মকে সন্মান জানিয়ে তিনিই সদর্পে ঘোষণা করেছেন “গীতা পাঠ অপেক্ষা ফুটবল খেলা ভালো”। তিনি সর্বপ্রকার কারীগরি শিক্ষা ও বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষনের কথা বলেন,যা স্বদেশী যুগে সামাজিক আন্দোলনের এক অস্ত্র হিসেবে পরিনত হয়েছে।ধর্মকে তিনি মানুষের বাস্তবিক জীবনে কার্যকারী করার মাধ্যম হিসেবে দেখেছেন, ধর্মকে কখনো অলিক বস্তু হিসেবে তিনি দেখেন নি। এহেন মানব মুক্তির অগ্রদূতকে যদি RSS নিজেদের আর্দশ বলে দাবি করে তবে তাকে কলঙ্কিত করা হয়। বিবেকানন্দের বাণী আসলে সামাজিক বিপ্লবের বানী।