অতিমারি মোকাবিলায় জো বাইডেনের ঘোষিত ত্রান তহবিল – একটি পর্যালোচনা
প্রভাত পট্টনায়েক
ইংরেজিতে লেখা মূল প্রবন্ধটি পিপলস ডেমোক্র্যাসি পত্রিকায় ৩১শে জানুয়ারি, ২০২১ সংখ্যায় প্রকাশিত, সেই লেখারই সম্পূর্ণ বাংলা অনুবাদ রাজ্য পার্টির ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হল।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নব নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি জো বাইডেন রাষ্ট্রপতি ভবনে স্থিত হবার আগেই দেশের জনগনের উদ্দেশ্যে অতিমারি মোকাবিলায় ১.৯ ট্রিলিয়ন ডলার ত্রান তহবিলের ঘোষণা করলেন যার মধ্যে প্রায় ১ ট্রিলিয়ন ডলার সরাসরি জনগণের হাতে তুলে দেওয়া হবে। ২০২০ সালের হিসাব অনুযায়ী আমেরিকায় জিডিপি’র পরিমান ২০.৮ ট্রিলিয়ন ডলার। বাইডেনের ঘোষিত তহবিল আমেরিকার জিডিপি’র প্রায় ১০ শতাংশের সমান। এই প্রসঙ্গে মনে রাখতে হবে অতিমারির আক্রমন চলাকালীন পূর্বতন রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্পের ঘোষিত ত্রান তহবিলকে চালু রেখেই বাইডেন এই নতুন তহবিল গড়েছেন। নতুন ঘোষণার ফলে স্পষ্ট হয়ে যায় অতিমারি মোকাবিলায় আমেরিকার সরকার দেশের জনগণের উদ্দেশ্যে সরাসরি সহায়তা প্রকল্পের পরিসর এবং কলেবর দুইই আরও বেশী সময়ের জন্য কার্যকরী রাখতে চাইছে। করোনা সংক্রমনের ধাক্কায় আমেরিকার অর্থনীতি প্রবল ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিল, এখন অবস্থা কিছুটা শুধরেছে – গত বছরের এপ্রিল মাসে বেকারির সূচক ছিল ১৫ শতাংশে, ডিসেম্বর মাস নাগাদ সেই সূচক কমে এসে ৬.৭ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। বেকারি সুচকের কমে যাওয়ার যুক্তি দেখিয়ে রাষ্ট্রপতি বাইডেনের ঘোষিত ত্রান তহবিলের সমালোচনা করেছে আমেরিকার রক্ষনশীল রাজনৈতিক পক্ষ, তাদের বক্তব্য এখনকার পরিস্থিতিতে এমন তহবিল আর প্রয়োজনীয় নয়।
রাষ্ট্রপতি বাইডেন ত্রান তহবিলকে কোভিড-১৯ মোকাবিলা প্রসঙ্গে ঘোষণা করলেও এই তহবিলের কার্যকারিতা তার চাইতেও অনেক সুদূরপ্রসারী। অতিমারির সময়ে জনস্বার্থে সরকারী ব্যায়বরাদ্দের মূল্যমান বাড়ানোর পরিসর ব্যাতিরেকেও এই তহবিলের বিচার করতে হবে। গত মাসে আমেরিকান কংগ্রেসের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এই তহবিলে করদাতাদের উদ্দেশ্যে পূর্বতন করছাড়ের পরিমান (এক হাজার চারশো ডলার) আরও ছয়শো ডলার বাড়িয়ে দিয়ে দুহাজার ডলার করা হয়েছে। গত বছরের সেপ্টেম্বর মাস অবধি আমেরিকার বেকার ভাতা ছিল প্রতি সপ্তাহে তিনশো ডলার, তাকে বাড়িয়ে করা হয়েছে সপ্তাহে চারশো ডলার, এই সুবিধা পাবেন আমেরিকার আঠারো মিলিয়ন বেকার মানুষ। একইসাথে ন্যুনতম মজুরি বেড়ে হয়েছে প্রতি ঘণ্টায় পনেরো ডলার। সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার ক্ষেত্রে জানুয়ারি মাস অবধি স্থগিতাদেশ ছিল, সেই সময়সীমা বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে এই বছরের সেপ্টেম্বর মাসের শেষ অবধি। এর সাথেই তহবিলে বহুবিধ ধারায় যেমন জনগণের জন্য প্রতিষেধকের বন্দোবস্ত, শিক্ষাক্ষেত্র এবং ছোট ব্যাবসায় সহায়তা প্রদান ইত্যাদি অনেক প্রকল্পে বরাদ্দের ঘোষণা রয়েছে।
সরকারী ব্যায়বরাদ্দ বাড়িয়ে এতো বড় আকারের ত্রান তহবিল ঘোষনার থেকেও যা বেশী গুরুত্বপূর্ণ তা হল এই বরাদ্দের অর্থসংস্থানে বাইডেনের নীতি। বাইডেন আমজনতার উপরে করের বোঝা চাপিয়ে অর্থসংস্থানের রাস্তায় হাঁটেন নি, তিনি ধনীদের বাড়তি কর দেওয়ার আইন করেছেন। তার নীতিতে সাধারণ আয়করের পরিমান বাড়ানো ছাড়াও আয়করের সর্বোচ্চ সীমা বাড়িয়ে ৪০ শতাংশ করা হয়েছে, এরইসাথে যাবতীয় লাভজনক পূঁজিকে করের আওতায় নিয়ে আসা হয়েছে। বাইডেনের নীতি স্পষ্ট, ধনীদের কর বাড়িয়ে দিয়ে বর্ধিত আদায়কে শ্রমজীবী মানুষের স্বার্থে সরাসরি ব্যায় করা – বামেরা প্রথম থেকেই সংকট মোকাবিলায় এই দাবী জানিয়ে এসেছে। এই নীতির সমালোচনা প্রসঙ্গে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকেরা বাইডেনের বামপন্থার প্রতি ঝুঁকে যাওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছেন। যদিও প্রথম থেকেই বাইডেন নির্বাচনী প্রচারে এমন নীতি প্রণয়নের দাবী জানিয়ে এসেছেন, সেই সময় আমেরিকার প্রথম সারির খবরের কাগজ এবং পত্রিকাগুলিতে সেইসব বিস্তারিত আকারে প্রকাশও হয়। প্রচারের সময় তিনি যেসব দাবী এবং অঙ্গীকার জনগণের সম্মুখে রেখেছিলেন এখন বাইডেন সেগুলিকেই কার্যকরী করছেন, অন্যদের মতো ভোটে জেতার পরে নিজের বলা কথা ভুলে যান নি।
ডেমোক্র্যাট দলের আরেক রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী বার্ণি সন্ডার্স (যাকে বাইডেন রাষ্ট্রপতি পদের জন্য মনোনয়নের লড়াইতে পরাজিত করেন) – এর মতো জো বাইডেন আদৌ বামপন্থী নন, তিনি নিজে সেরকম দাবিও কখনো করেন নি। বারাক ওবামার সাথে উপরাষ্ট্রপতি থাকাকালীন তার রাজনৈতিক অবস্থান ওবামার মতোই ছিল, এবং বামপন্থার তুলনায় সেই অবস্থান বহুদুরের। তবে তার বর্তমান অবস্থানকে কীভাবে ব্যাখ্যা করা যায়? একে কোনভাবেই সুবিধাবাদী বলা যায় না, কেননা তাহলে মধ্যপন্থীদের মতো তিনি ভোটে জেতার পরে নিজের দাবীসমূহ থেকে সরে আসেন নি।
আসলে বাইডেনের অবস্থান পুঁজিবাদের সংকটকালে আমেরিকায় উদ্ভূত পরিস্থিতির প্রতিফলন। এই সময় সংকটকে অবহেলা করলে কিংবা নাকচ করলে সেটাই হতো ধ্বংসাত্মক পদক্ষেপ। গতবারের নির্বাচনে প্রচারের সময় হিলারি ক্লিন্টন অর্থনৈতিক সংকটকে অবহেলা করেছিলেন তারই ফলে ডোনাল্ড ট্রাম্প জয়ী হন। অনেকে ভাবেন আমেরিকায় হঠাৎ করেই চরম দক্ষিনপন্থার উদ্ভব হয়েছে, তা নয়, পুঁজিবাদের সংকটকালে জনজীবনে যে দুর্দশা নেমে আসে তার প্রতি আমেরিকান লিবারাল বুর্জোয়াশ্রেণী অবহেলা দেখিয়েছিল, জনমানসে ক্ষোভের সুযোগকে কাজে লাগিয়েছিল রক্ষনশীল গোষ্ঠী। বাইডেন সেই একই ভুল দ্বিতীয়বার করেন নি। অর্থনীতির এই গভীর সংকট করোনা অতিমারির অনেক আগেই জনজীবনকে বিপর্যস্ত করে দিয়েছিল, সঠিকভাবেই বাইডেন সেই সংকটের প্রতি মনোযোগ দিয়েছেন।
এই সংকট মোচনে কার্যকরী পদক্ষেপ না নিয়ে কর্পোরেট জগতকে তোষণ করতে পুঁজিবাদের “পাশবিক প্রবৃত্তি”-র নামজপ করে চললে যে আদপেই কোন সুরাহা হবে না জনগণ সেই কথা উপলব্ধি করেছেন। আর্থিক সংকটের সূত্রপাত হয় বাজারে চাহিদার ঘাটতির কারনে। সেই সমস্যার সমাধানে একমাত্র পথ হল পণ্যের চাহিদা বৃদ্ধি করতে শ্রমজীবী মানুষের হাতে নগদ অর্থের যোগান দেওয়া। প্রথম থেকেই বামেরা সম্পদ পুনর্বন্টনের দাবী করে এসেছে। বাইডেন সেই কাজই করেছেন। ব্যক্তিগত রাজনৈতিক অবস্থান যাই হোক না কেন, জনগণের সমস্যা সমাধানে তার বাধ্যবাধকতাই এমন পদক্ষেপের প্রধান কারন।
আমেরিকার কর্পোরেটরা বাইডেনের এই পদক্ষেপে খুশি নয়। আগামীদিনে বিনিয়োগের চেহারাই তাদের সেই অসন্তোষকে প্রকাশ করবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পৃথিবীতে সবচেয়ে বড় পুঁজিবাদী দেশ, এখনও অবধি বিশ্ববাজারে আমেরিকার মুদ্রা সোনার সমতুল্য বলে ধরা হয়। এই বাড়তি সুবিধাই আমেরিকাকে অন্যান্য পুঁজিবাদী দেশের থেকে অনেকটা এগিয়ে রেখেছে। বাইডেনের বর্তমান নীতি যদি আরও কিছু সময় চলে তবে আমেরিকার পুঁজিবাদী দেশ হিসাবে এখনকার শক্তিশালী অবস্থান বেশিদিন টিকবে না। কিছুদিনের মধ্যেই পরিস্থিতি এমন জায়গায় পৌঁছাবে যখন বাইডেনকে দুটি রাস্তার একটি বেছে নিতে হবে। হয় পরিস্থিতির দাবী মেনে বাইডেনকে আরও বেশী বামদিকে সরে আসতে হবে, নয়ত পূঁজির বা আরও নির্দিষ্ট করে বললে আন্তর্জাতিক ফিন্যান্স পূঁজির আদেশের সামনে আত্মসমর্পণ করতে হবে।
একই প্রেক্ষিতে ভারতে মোদী সরকার জনগণের সমস্যা সমাধানে চরম নির্বোধের ন্যায় নীতি প্রণয়ন করেছে। সংকট সমাধানে বিত্তবানেদের থেকে বাড়তি কর আদায় করার মতো নীতি অনুসরণ করতেও মোদী সরকার নারাজ। করোনা সংক্রমনের মতো অভূতপূর্ব পরিস্থিতি চলাকালীন মেহনতি মানুষের সহায়তায় স্বাভাবিকভাবেই বিভিন্ন প্রকল্প নেওয়াই যেত – আন্তর্জাতিক পূঁজির বিরুদ্ধাচারন না করেই। মোদী সরকারের অকর্মণ্যতা এতটাই যে সেই কাজটুকুও তারা এড়িয়ে গেছে। এখনও এই সরকার জনগণের দুর্দশার বিনিময়ে কর্পোরেট – পুঁজিপতিদের স্বার্থরক্ষা করতেই ব্যাস্ত। দেশের অর্থনৈতিক সংকট কাটাতে এদের প্রতিটি পদক্ষেপই জনগণের জন্য ক্ষতিকর প্রতিপন্ন হয়েছে। দিল্লী সীমান্তে ভয়াবহ শীত সহ্য করে কৃষকদের আন্দোলনই এর সবচেয়ে বড় প্রমাণ।
মোদী সরকার করোনা মোকাবিলায় মাত্র চারঘন্টার নোটিশে সার্বিক লকডাউন ঘোষণা করেই ক্ষান্ত হয় নি, এমনকি ট্রাম্পও নিজের দেশে লকডাউন চলাকালীন সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা স্থগিত রেখেছিলেন – ভারতে লক্ষ লক্ষ শ্রমিকদের এক কলমের খোঁচায় ভিটেমাটি ছাড়া হয়ে কয়েকশো মাইল পথ পায়ে হেঁটে নিজেদের গ্রামে ফিরতে হয়। ট্রাম্প দেশের জনগণের জন্য প্রয়োজনের তুলনায় কম হলেও রাজকোষ থেকে কিছু বরাদ্দ ঘোষণা করেছিলেন, আমাদের দেশে শ্রমজীবী মানুষের জন্য সেসব কিছুই করা হলনা। অন্তত কিছু মাসের জন্য হলেও প্রতিটি পরিবারের হাতে মাসে সাত হাজার টাকার দাবী জানানো হয়েছিল সমাজের সব অংশ থেকে – কার্যত সেইসব দাবীর সামনে সরকার কালা সেজে থেকেছে।
শেষ অবধি সরকারের তরফে ত্রান তহবিলের নামে দুটি ঘোষণা হল ঠিকই, কিন্তু দেখা গেল সেইসবই কার্যত অতিমারি হবার অনেক আগেই কেন্দ্রীয় বাজেটে বরাদ্দ করা আর্থিক প্রস্তাবনা ছাড়া কিছুই নয়। করোনা মোকাবিলা করতে সরকারী ত্রান তহবিলে ২০ লক্ষ কোটি টাকার আওয়াজ শোনা গেলেও কার্যত সেই প্রকল্পে রাজকোষ থেকে খরচ হল মাত্র ১.৯ লক্ষ কোটি (মতান্তরে ১.৬৫ লক্ষ কোটি) যা ভারতের মোট জিডিপি’র এক শতাংশও নয়।
পরে বোঝা গেল সরকার নিজের ঘোষিত অর্থটুকুও খরচ করে নি। ২০১৯ সালের এপ্রিল থেকে নভেম্বর মাস অবধি সরকারের খরচের সাথে তুলনা করলে দেখা যাবে ২০২০ সালে ঐ একই পর্বে সরকারের খরচ বেড়েছে মাত্র ৪.৭ শতাংশ। এই এক বছরে মুদ্রাস্ফীতির হার ছয় শতাংশ ছিল, অর্থাৎ করোনা মহামারির সবচেয়ে কঠিন সময়েও কেন্দ্রীয় সরকারের ব্যায় বরাদ্দ আদৌ বাড়েনি, বরং কমেছে।
সংকটের সময় কেন্দ্রীয় সরকার নির্লজ্জের ন্যায় শুধু যে নিজের ব্যায়বরাদ্দ কমিয়েছে তাই নয়, জিএসটি বাবদ ক্ষতিপূরণের যে অর্থ রাজ্য সরকারগুলির ন্যায্য পাওনা ছিল তাকেও বকেয়া রেখে দিয়েছে। অত্যন্ত লজ্জার হলেও এটাই সত্য যে আজ সারা পৃথিবীতে ভারতের অবস্থান সেইসব দেশের সাথে যারা মহামারী চলাকালীন জনকল্যানে নিজেদের ব্যায়বরাদ্দ কমিয়ে দিয়েছে। কেবলমাত্র একটি প্রেক্ষিত বিচার করলেই নরেন্দ্র মোদীর তুলনায় জো বাইডেনের অবস্থানগত ফারাক স্পষ্ট হয়ে যায়।
ওয়েবডেস্কের পক্ষে অনুবাদঃ সৌভিক ঘোষ