Site icon CPI(M)

Indian Freedom Struggle and RSS – A Retrospective ( Part – 23)

ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস (পর্ব – ২৩)

ধারাবাহিক রচনায়ঃ গৌতম রায়

ভারতবর্ষের কৃষি অর্থনীতির সঙ্গে সমকালীন যান্ত্রিক প্রেক্ষিতে র সংযোগ প্রসঙ্গে গরুর একটি বিশেষ রকম সামাজিক মূল্য তৈরি হয়েছিল ।সেই সামাজিক মূল্যের নিরিখে গরুকে কেন্দ্র করে অর্থনৈতিক তাগিদ থেকেই যে শ্রদ্ধা, ভালোবাসা, সহমর্মিতার একটা দৃষ্টিভঙ্গির প্রাচীন ভারতীয় সমাজ ব্যবস্থায় ধীরে ধীরে কায়েম হয়েছিল, তার সঙ্গে ধর্মীয় ধ্যান-ধারণা যুক্ত হয়ে ,যে  ধরনের প্রেক্ষিত রচিত  হয়েছে ,সেটা আমাদের অজানা নয় ।
               

ঔপনিবেশিক যুগে সাম্প্রদায়িক সীমানা নির্ধারণের ক্ষেত্র হিসেবে এই গোরুকে  ব্যবহার একটা চরম পর্যায়ে পৌঁছে ছিল। বিশেষ করে হিন্দু সংস্কারবাদী আন্দোলন ,ব্রাহ্মণ্যবাদী চিন্তা-চেতনার বিকাশ, আর্য সমাজ, প্রার্থনা সমাজ ইত্যাদি সংগঠনগুলির কার্যকলাপের ভেতর দিয়ে সাম্প্রদায়িক, আঞ্চলিক, ভাষা ভিত্তিক নানা ধরনের কার্যক্রমকে অতিক্রম করে ,অর্থনীতির একটা মূল উপাদান, বিশেষ করে কৃষি অর্থনীতির একটা মূল উপাদান ,হিসেবে গরুর যে গ্রহণযোগ্যতা ,সেটাকে একটা প্রতীকে পরিণত করা হয়েছিল ।
                       

প্রাচীন ভারত থেকে আধুনিক ভারতের ধারাবাহিকতার ভেতর দিয়ে ভারতীয় সমাজ ব্যবস্থায় এই বিষয়টিকে ঘিরে ১৮৭১  সালে শিখ সম্প্রদায়ের মানুষের ভিতরে যে সংস্কারবাদী আন্দোলন তৈরি হয় কুকা  সম্প্রদায়ের নেতৃত্বে ,সেখানে এই গোরুর  বিষয়টিকে প্রথম একটি সামাজিক প্রেক্ষিতে র ভেতর দিয়ে রাজনৈতিক প্রেক্ষিত হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়।
              

মজার কথা হলো, রাজনৈতিক হিন্দুরা গরুকে মুসলমান সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে, সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী চিন্তা চেতনা প্রসার ও প্রয়োগের ক্ষেত্রে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে, আধুনিক ভারতবর্ষে সেই গোরুকে ঘিরে  সাম্প্রদায়িক চিন্তা-চেতনার প্রচলনে একটা বড়ো ভূমিকা পালন করে।  ঔপনিবেশিক ভারতে, উনিশ শতকের শেষদিকে করেছিল এই যে প্রবণতা শিখ সম্প্রদায়ভুক্ত ,সংস্কারবাদী কুকা সম্প্রদায়ের মানুষজন প্রথম জোরদার ভাবে শুরু করে। কুকা সম্প্রদায়ের  ভেতর থেকে কিন্তু প্রথম গো সুরক্ষার বিষয়টি উঠে এসেছিল ।
                 

তাঁরা চেয়েছিল ; এই গুলো কে কেন্দ্র করে সাধারণ মানুষের ভেতরে যে  অর্থনৈতিক একটা টানাপোড়েন আছে, সেটিকে ব্যবহার করে ,এক ধরনের সামাজিক আবেগ তৈরি করতে, যা তাঁদের সংস্কারবাদী আন্দোলনকে প্রভাবিত করতে পারে।শিখদের কুকা  সম্প্রদায়ের লোকেরা গোহত্যার নাম করে, মুসলমানদের উপর সেই সময় নানা ধরনের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের সঙ্গে নিজেদের সম্পৃক্ত করে ।বস্তুত ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ,তাদের শাসন যন্ত্রটিকে আরো শক্তিশালী করার লক্ষ্যে ভারতীয় সমাজ ব্যবস্থার ভেতরে ,বহুত্ববাদী ধারার বিভাজনের লক্ষ্যে, কুকা সম্প্রদায়ের ভেতর থেকে উঠে আসা গোরক্ষা কে কেন্দ্র করে ,মুসলমান বিদ্বেষের বিষয়টিকে বাইরে থেকে যথেষ্ট উৎসাহ দিতে শুরু করে।
                

কুকা সম্প্রদায় গোরক্ষার নাম করে মুসলমানদের উপর উনিশ শতকের শেষ দিকে যে ধরনের দমন-পীড়ন চালায়, সেই দমন-পীড়ন কে প্রশাসনিকভাবে একটা প্রচ্ছন্ন মদত দিয়ে ,মুসলমান সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে ভারতীয় জনমানুষকে উস্কে দেওয়ার ক্ষেত্রে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কুকা সম্প্রদায়ের ভেতর থেকে তৈরি হওয়া এই গোরক্ষার দৃষ্টিভঙ্গি ক্রমশ মুসলমান সম্প্রদায়ের দিকে ধাবিত হতে শুরু করে। এই বিষয় টি উনিশ শতকের নয় শতকের সাতের দশক থেকে অবিভক্ত পাঞ্জাব,  উত্তর-পশ্চিম প্রদেশ,  অযোধ্যা এবং রহিলখান্ড ছড়িয়ে পড়তে থাকে। বিষয়টি এমন ভাবে  একটা সাম্প্রদায়িক বাতাবরণ তৈরি করে,তাতে দেখা যায়, আগে যে সাম্প্রদায়িক বাতাবরণ তৈরি হত সীমান্ত রক্ষার প্রশ্নে ,এলাকা রক্ষার প্রশ্নে, পেশীশক্তির প্রদর্শনের স্বার্থে, সার্বিক চরিত্রটা তার থেকে বদলে যেতে থাকল।
              

গোরক্ষার সেইসব  বিষয়গুলিকে  কেন্দ্র করে এক ধরনের বীভৎস সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের লক্ষ্যে সবকিছু  পরিচালিত হতে শুরু করে ।কুকা সম্প্রদায়ের ভেতর থেকে গোরক্ষা কে কেন্দ্র করে সাম্প্রদায়িক চিন্তা-চেতনা প্রসূত দৃষ্টিভঙ্গির আন্দোলন বিকাশ লাভ করে ,সেই আন্দোলনকে কার্যত নিজেদের আন্দোলনে পরিণত করে আর্য সমাজ। কুকা  সম্প্রদায়ের আন্দোলনটিকে কার্যত হাইজ্যাক করে এই আন্দোলনকে গোটা ভারতবর্ষে ছড়িয়ে দিয়ে, তাদের তথাকথিত শুদ্ধি আন্দোলনের ভেতর দিয়ে, মুসলমান -খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে ,বিদ্বেষ- বিভাজনের রাজনীতিকে একটা বল্গাহীন জায়গায় পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রে  উৎসাহী হয়ে পড়ে ।
              

এই উদ্দেশ্যে আর্য সমাজের পক্ষ থেকে উত্তর উত্তর-পশ্চিম এবং পূর্ব ভারতের বিভিন্ন প্রান্তের নানা ধরনের গোরক্ষিণী সভা প্রতিষ্ঠিত হয় ।এইসব গোরক্ষিনীর সভা গুলি সম্পর্কে বিবেকানন্দের কি অভিযোগ ছিল, তা আমাদের কারো অজানা নয় ।গোরক্ষিণী  সভার নেতারা বিবেকানন্দের কাছে সমর্থন চাইতে এলে ,বিবেকানন্দ তাঁদের কাছে অত্যন্ত স্পষ্ট ভাষায় ,ভাতের দাবিকে সামনে তুলে আনার বিষয়টির অবতারণা করেছিলেন ।বলাবাহুল্য বিবেকানন্দের এই যুক্তিসঙ্গত ন্যায্য দাবির প্রতি সহমর্মিতা জ্ঞাপন করা সাম্প্রদায়িক গোরক্ষিণী সভার লোকজনের পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব হয়নি। বিবেকানন্দ একদিকে ভারতআত্মার সন্ধানে তখন গোটা ভারতবর্ষের জুড়ে তাঁর নিঃসঙ্গ একা পথিকের যাত্রা করছেন। অপরপক্ষে আর্য সমাজের প্রত্যক্ষ মদতে ,প্রার্থনা সমাজের প্রত্যক্ষ মদতে, রাজনৈতিক হিন্দু সাম্প্রদায়িকতাকে উস্কে দেওয়ার লক্ষ্যে গোরক্ষীবাহিনীর উদ্যোগে ,দেশের বিভিন্ন প্রান্তে গোরক্ষার নাম করে ,সভা-সমিতির ভেতর দিয়ে ,একটা সামাজিক আন্দোলনকে নেতিবাচকভাবে তুলে ধরে, সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের পথ কে পরিষ্কার করে দেওয়া হচ্ছে ।
                

এই তথাকথিত সামাজিক আন্দোলন কিন্তু হিন্দু প্রধান এলাকাগুলোতে বেশি শক্তিশালী ভাবে ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হলো। যেমন; বিহার, বারাণসী বিভাগ ,পূর্ব এলাহাবাদ, অযোধ্যা এই পরিকল্পনাটি প্রথম পর্যায়ে খুবই বিস্তার লাভ করে । পরবর্তীকালে বাংলা ,বোম্বাই প্রেসিডেন্সি, মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সি, এমনকি সিন্ধু প্রদেশ, রাজপুতানা এবং সেন্ট্রাল প্রেসিডেন্সিতে গোরক্ষিণী বাহিনীর কার্যকলাপ এবং তাকে ঘিরে নানা ধরনের সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী আস্ফালন তীব্র হয়ে ওঠে।এই কার্যকলাপগুলির মূল লক্ষ্য ছিল; মুসলমান সম্প্রদায়ের প্রতি আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠা। সেগুলি ধীরে ধীরে ভারতবর্ষে সমাজ জীবনের বুকে একটা কালান্তক ক্ষতের সৃষ্টি করে ।আর এভাবেই ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শক্তিকে ,তাদের সাম্প্রদায়িক বিভাজনের ভেতর দিয়ে, ভাজক রেখাটি কে  তীব্র করে ,শাসনের নামে শোষণৃর পথ কে পরিষ্কার করে দেয়।
                    

মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষের কাছে সেই সময় কালে গরুর ব্যবহার ,বিশেষ করে বকর ঈদ  ইত্যাদির ক্ষেত্রে গরুর ব্যবহারের প্রাধান্যের একটা অন্যতম কারণ ছিল কিন্তু, তৎকালীন অর্থনৈতিক রীতিনীতি অনুযায়ী, বাজারের চাহিদা অনুযায়ী, ভেড়া -ছাগলের দামের থেকে গরুর দাম  কম থাকার বিষয়টি। গরু যেভাবে তৎকালীন কৃষি অর্থনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে পড়েছিল,  গরুর উৎপাদনের প্রশ্নে মানুষের উৎসাহ যত বেশি ছিল ,ভেড়া বা ছাগল  উৎপাদনের ক্ষেত্রে কিন্তু মানুষের উৎসাহ ততখানি ছিল না ।ফলে, বাজারে গরুর দাম কিন্তু ভেড়া, ছাগলের দামের  থেকে অনেক কম ছিল।
                

তাই মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষ ,তাঁদের ধর্মীয় রীতিনীতি বা খাদ্যাভ্যাসের কারণে ,তাঁদের ভেতর কেউ কেউ গরুর প্রতি যে ঝুঁকেছিলেন –এটি ছিল তার পেছনে একমাত্র অর্থনৈতিক কারণ ।অপরপক্ষে রাজনৈতিক হিন্দু সাম্প্রদায়িকতার বিকাশ কে কেন্দ্র করে, গরুকে যেভাবে রাজনৈতিক হিন্দুদের প্রতীকে পরিণত করার একটা তীব্র মানসিকতা তৈরি হলো ,সেই মানসিকতাকে মোকাবিলা করার উদ্দেশ্যে, মুসলমানদের ভেতরেও গরুকে ঘিরে একটা মুক্তির প্রতীকের চিন্তা ও কিন্তু বিকাশ লাভ করল।
               

হিন্দু সম্প্রদায় যখন গোরক্ষিণী সভা নাম করে সমাজের প্রায় প্রতিটি স্তরে সভা-সমিতির   ভেতর দিয়ে মুসলমান সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ -বিভাজনের মানসিকতা ছড়াতে শুরু করে ,তার পাল্টা হিসেবে মুসলমান সম্প্রদায় ও কিন্তু প্রান্তিক স্তরে, একেবারে সমাজের শেকড়ের কাছে ফিরে গিয়ে ,এই গোরুকে  কেন্দ্র করেই এক ধরনের আত্মশক্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে  এগিয়ে আত্মপ্রতিষ্ঠা লাভের চেষ্টা করে ।একটা বড় অংশের রাজনৈতিক হিন্দুদের গরু কে ঘিরে কর্মকান্ড,  অপরপক্ষে সেই হুমকির মোকাবিলা তে একটা বড় অংশের মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষের পাল্টা হুমকি –এর ফলে উনিশ শতকের শেষ দিকে, বিশেষ করে নয়ের দশকের প্রথম ভাগে, প্ররোচনা, পাল্টা  প্ররোচনা– একটা তীব্র আকার ধারণ করে ।
                       

১৮৯৩  সালের জুন মাসে আজামগড় জেলার মৌ অঞ্চলে গরুকে কেন্দ্র করে ভয়াবহ দাঙ্গা বাঁধে ।সেখানে গোহত্যার উপর জারি হয়েছিল আইনি নিষেধাজ্ঞা। আর সেই নিষেধাজ্ঞার ব্যাখ্যা কে কেন্দ্র করে শুরু হয় পরস্পরের প্রতি বিদ্বেষ। শুরু হয় হিংসার সাম্রাজ্য বিস্তার। গোটা এলাকায় তড়িৎগতিতে দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে ।বিহারে এবং উত্তর-পশ্চিম প্রদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ১৮৯৩  সালের প্রথম ছয় মাসে একটি দৃষ্টি দাঙ্গার ঘটনা সংঘটিত হয়েছিল।
             

বলা বাহুল্য, এই দাঙ্গা গুলি কিন্তু মূলত সংগঠিত করেছিলেন সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থার সঙ্গে জমি কেন্দ্রিক বিধিব্যবস্থা সঙ্গে সংযুক্ত জমিদারেরা এবং তাদের বশংবদ ধর্মপ্রচারকরা। রাজনৈতিক হিন্দুদের পক্ষ থেকে এই কাজে রাজনৈতিক আবেগ ,ধর্মীয় আবেগ ব্যবহার করে, কৃষকদেরকে সামনে ফেলে দেওয়া হয়েছিল । তবে সামাজিক পীড়ন সেই সময়কার দাঙ্গার যে একটি অন্যতম প্রধান কারণ ছিল, এ কথা বলবার কোনো অপেক্ষা রাখে না।
            

এইঘটনাক্রমের   পিছনে বাজার জনিত নানা ধরনের সম্পর্কের বিষয় গুলি কিন্তু অত্যন্ত প্রবল ছিল। বাজার জনিত সম্পর্কের কারণে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, সংঘর্ষ ,হিংসা ,সামাজিক বিভাজন, রাজনৈতিক চিন্তা চেতনার ক্ষেত্রে একটা বিভাজনের রূপরেখা তৈরি করা– এই সবের মধ্যে দিয়ে রাজনৈতিক হিন্দুদের  সঙ্ঘবদ্ধ হওয়ার যে প্রয়াস ,যেটিকে আমরা  প্রবল হতে দেখি, ১৯২৫  সালে আরএসএস প্রতিষ্ঠার ভেতর দিয়ে বা তারও আগে আমরা দেখেছি ১৯১৯  সালে হিন্দু মহাসভা প্রতিষ্ঠার ভেতর দিয়ে।
               

এই গুলিকে একটা সুচারু বিন্যাসের মধ্যে দিয়ে নিয়ে আনার ক্ষেত্রে বাজার কেন্দ্রিক এই প্রেক্ষিত গুলি  বিশেষ রকম ভাবে ব্যবহৃত  হয়িছিল ।এই সময়কালে গরু কে কেন্দ্র করে সুদূর বোম্বাইতে পর্যন্ত দাঙ্গা সংঘটিত হয়। অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে শ্রমিকদের কে ও সেই দাঙ্গার মধ্যে সংযুক্ত করে দেয়া হয়। ব্রিটিশেরা অত্যন্ত ঠাণ্ডা মাথায়, রাজনৈতিক হিন্দুদের মদদ দিতে গিয়ে, শ্রমিকদের কে ও ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার স্বার্থে ব্যবহার করে এবং তাদের কেউ সম্পৃক্ত করে দেয় দাঙ্গার সঙ্গে।
                         

গোটা ভারতে যখন ক্রমে  শ্রমিক সমাজের ভেতর তখন  যে দাবি-দাওয়া গুলি ,মালিকের অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে মুখর হয়ে ওঠার যে দৃষ্টিভঙ্গির বিকাশ লাভ করেছিল,যার ঢেউ ক্রমে বোম্বাইতে এসে লাগছিল, সেগুলো যাতে বিভ্রান্ত হয়, বিপথে চালিত হয় ,সেটাই ছিল শ্রমিককে এই দাঙ্গার  সঙ্গে সংযুক্ত করে দেওয়ার জন্য ব্রিটিশের  কৌশল।
            

এই কৌশলে ব্রিটিশ রাজনৈতিক হিন্দুদের খুব বিশেষ ভাবে ব্যবহার করে। তবে ব্রিটিশ কিন্তু খুব নিশ্চিত ছিল না, শ্রমিকশ্রেণির বোম্বাইতে অবস্থান ঘিরে। কারণ, তাদের ভেতর এই ধারণাও ছিলো যে ,শ্রমিকেরা খুব বেশি ভাবে এইসব দাঙ্গার সঙ্গে জড়িয়ে পড়ার ভেতর দিয়ে শ্রমিকদের ভেতর একটি ব্রিটিশবিরোধী মানসিকতা ধীরে ধীরে বিকাশলাভ ঘটলেও ঘটতে পারে ।তাই তারা শ্রমিকদের ব্যাপারে বেশ খানিকটা দ্বিধা-সংকোচের ভেতরে  কৌশল নির্ধারণের ক্ষেত্রে কাটায় নি, সে কথা বলা যায় না ।
                     

হিন্দুদের ভেতর হিন্দু ধর্ম রক্ষার প্রশ্নে গো-হত্যা একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এই দৃষ্টিভঙ্গি জাগিয়ে দিয়ে ,রাজনৈতিক হিন্দুরা সাম্প্রদায়িকতার পালে হাওয়া জুগিয়ে, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিভাজনের নীতি কে, বিভাজনের মধ্য দিয়ে দেশকে শাসনের নামে শোষণ কার্যক্রমকে এগিয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে সব রকম ভাবে কাজ করেছে।
              

মধ্যকালীন ভারত এবং তার পরে ঔপনিবেশিক যুগের সূচনা পর্বে, সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের ক্ষেত্রে যে আঞ্চলিক বিভিন্ন বিষয়াবলী ,জমি-জিরেতের  সমস্যা, এলাকা দখলের লড়াই– ইত্যাদি প্রেক্ষিত  কার্যকরী ছিল, সেই গোটা পর্যায়ক্রমে কিন্তু আর্য সমাজ, প্রার্থনা সমাজ ,হিন্দু পুনরুত্থান বাদী আন্দোলনের ব্যক্তিবর্গ, তাদের আন্দোলন , সম্প্রদায়ের সংস্কারবাদী আন্দোলন, সর্বোপরি গোরক্ষিণী  সভা গুলির কর্মকান্ডের ভেতর দিয়ে দাঙ্গার প্রেক্ষিত ,তাকে একটা ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ,বিভাজনের পথে পরিচালিত করতে শুরু করে।
             

এই লক্ষ্যের ভেতর দিয়ে হিন্দু মুসলমানের বিরোধ,বি সংবাদ ,যেগুলি নানা ধরনের আঞ্চলিক প্রশ্নের  উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠছিল ,যে গুলির মধ্যে জাতিগত ,ধর্মগত সম্প্রদায়গত বিদ্বেষের থেকেও  বেশি কার্যকরী ছিল; নানা ধরনের ব্যক্তিস্বার্থের টানাপোড়েনের পর্যায়, এবং সেই পর্যায়ে গুলিকে কেন্দ্রবিন্দুতে উপস্থাপিত করেছিল জমি। সেই প্রেক্ষিত  কে কার্যত একদম বদলে দেয় উনিশ শতকের শেষভাগে  শিখ সম্প্রদায়ের ভেতর কুকা সম্প্রদায়ের ভেতর যে গোরক্ষা কে কেন্দ্র করে আন্দোলন ,এবং গোরক্ষিণী সভার আন্দোলন ।
            

এসবের ভেতর দিয়ে এভাবে সাম্প্রদায়িকতার ভাবনাকে একটা অন্য খাতে বইয়ে দিয়ে ,সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের পরিমণ্ডলকে একটা চিরস্থায়ী ক্ষতে রূপান্তরিত করবার চেষ্টা করা হয়। মধ্যকালীন ভারত থেকে শুরু করে, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের এদেশে ক্ষমতা দখল করার প্রথম পর্যায় পর্যন্ত যে সমস্ত সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ গুলি ঘটেছিল, তার মূল কেন্দ্রবিন্দুতে ,’জমি ‘ থাকার জন্য, তার মূল কেন্দ্রবিন্দুতে সামন্ততন্ত্রের একটা স্বার্থ জড়িত থাকার কারণে ,সেইসব সংঘর্ষ গুলি কিন্তু খুব একটা দীর্ঘস্থায়ী হতো না। কিন্তু উনিশ শতকের শেষভাগে গরু কে কেন্দ্র করে যে ধরনের সামাজিক মেরুকরণের  তৈরি হলো ,তার ফলে ;যে সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের বাতাবরণ তৈরি হলো ,সেগুলো কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকল, এবং সমাজের বুকে একটা চিরস্থায়ী ক্ষতের পরিবেশ তৈরি করে দিতে পারলো।
                 

যে ক্ষত এর উপর দাঁড়িয়ে পরবর্তীকালে রাজনৈতিক হিন্দুরা, তাদের রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের লক্ষ্যে ,বিভিন্ন কার্যাবলী গুলি কে প্রসারিত করতে পেরেছিল। হিন্দু মহাসভা তারপরে আরএসএস প্রতিষ্ঠাকে কেন্দ্র করে যে প্রেক্ষিত রচিত হয়েছিল ,সেই প্রেক্ষিতে র ভিত্তিভূমি তৈরীর ক্ষেত্রে  বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয় গরু কে কেন্দ্র করে যে উত্তেজনা, তাকে।
              

উনিশ শতকের শেষ দিকে, বিশেষ করে ১৮৯৩  সালের পরে , ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী নানা ধরনের আন্দোলনের প্রেক্ষিতে, গোটা সামাজিক প্রেক্ষাপট অন্য ধারায় প্রবাহিত হতে শুরু করে। ফলে গোরক্ষা ঘিরে কর্মকান্ড সাময়িকভাবে স্থগিত হলেও তার প্রভাব কিন্তু ভারতবর্ষের আর্থ-সামাজিক- সাংস্কৃতিক ,এমনকি ধর্মীয় জীবনে অত্যন্ত নেতিবাচকভাবে থেকে যায় ।
                      

উনিশ শতকের  শেষ দিকে গোরক্ষা আন্দোলন অনেকটা গুরুত্ব হারিয়েছিল জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের তীব্রতার জন্য ।কিন্তু গুরুত্ব হারালেও  গোরক্ষা কে ঘিরে সাম্প্রদায়িক বাতাবরণ, বিভাজনের বাতাবরণ, হিন্দু-মুসলমানের ভেতর বৈরিতা তৈরীর প্রচেষ্টা, সেই পরিবেশ-পরিস্থিতি, কিন্তু একেবারে হারিয়ে গেল ,অপসৃত হলো ,এমনটা মনে করার কোনো কারণ নেই ।দেশের বিভিন্ন জায়গায় বিক্ষিপ্ত ভাবে গোরক্ষা কে ঘিরে নানা ধরনের আন্দোলন কিন্তু তারপরেও সংঘটিত হয়েছে এবং সেই আন্দোলন গুলিকে ব্যবহার করে, রাজনৈতিক হিন্দুরা তাদের প্রেক্ষাপট টি কে  বিস্তৃত করার কাজ অনেক জোরদারভাবে করে গেছে।
              

ব্রিটিশের  কাছ থেকে শাসনতন্ত্র তৈরীর জন্য জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের ভেতর যে ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি ধীরে ধীরে প্রসার লাভ করেছিল ,ব্রিটিশের  অর্থনৈতিক শোষণ সম্পর্কে ,জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম যুগের নরমপন্থী নেতারা যে ধরনের পর্যায়ক্রম তৈরি করছিলেন, এবং তার বিপরীতে চরমপন্থী ভাবধারার বিকাশের যে চেষ্টা হচ্ছিল –এই সমস্ত কিছুই হয়তো গরু কে কেন্দ্র করে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের প্রচেষ্টাকে সাময়িকভাবে থামিয়ে দিয়েছিল ।কিন্তু একেবারে বন্ধ করে দিয়েছিল– , পরিস্থিতি একদম বদলে গিয়েছিল– এমনটা মনে করার কোনো কারণ নেই।
               

ভারতের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের ভেতর ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের পক্ষে-বিপক্ষে নানা ধরনের সামাজিক প্রতিষ্ঠান তৈরি হওয়ার বিষয়টি কিন্তু উনিশ শতকের শেষদিকে গরু কে কেন্দ্র করে যে ধরনের সাম্প্রদায়িক বিভাজনের রাজনীতির বিকাশ লাভ করতে শুরু করেছিল ,তার প্রেক্ষিতে কে দুর্বল করে দেওয়ার ক্ষেত্রে একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে ।হিন্দু – মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের মানুষদের ভেতরে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের স্বরূপ উপলব্ধি কে ঘিরে যে ধরনের বাতাবরণ তৈরি হচ্ছিল, তাতে সাম্প্রদায়িক শক্তি প্রকাশ্যে তাদের কার্যকলাপের  ক্ষেত্রে বেশ কিছুটা সংযত আচার-আচরণ দেখাতে বাধ্য হলেও, তাদের গোপন কর্মসূচি কিন্তু বেশ জোরদার ভাবেই চলছিল ।
               

আর সেই গোপন কর্মসূচীর ফলশ্রুতি কিন্তু হিন্দু মহাসভা বা আরএসএসের প্রতিষ্ঠা এবং তাদের বিভিন্ন ধরনের সাম্প্রদায়িক কার্যকলাপ। অনেকেই মনে করেন;  ভারতবর্ষের সামাজিক প্রেক্ষিতে পরিপূর্ণ সাম্প্রদায়িক বিভাজনের ক্ষেত্রে গরু খুব একটা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে নি। সাম্প্রদায়িক সংগঠনগুলি তৈরি হয়েছিল সমাজের উচ্চবর্ণের ,উচ্চবিত্তের, সামন্ততান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির ,জমিদার তন্ত্রের ভেতরে থাকা মানুষজনদের স্বার্থের দিকে তাকিয়ে ।
                

এই স্বার্থরক্ষাকারী মানুষজনের কিন্তু যে কোনো অবস্থাতেই যে কোনো রকম প্রতীককেই  ধর্মীয় প্রতীকে রূপান্তরিত করে ,ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহারের  ভেতর দিয়ে, সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের রাস্তার দিকে হেঁটে,  খুব পরিষ্কার করে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির ব্যাপারে একদম সিদ্ধহস্ত ছিল,তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
           

এভাবে তারা একদিকে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি ঘটাচ্ছিল ।নিজেদের রাজনৈতিক অভিপ্সা সিদ্ধ  করবার পথে ধীরে ধীরে পা বাড়াচ্ছিল ।অপরপক্ষে ব্রিটিশ যাতে হিন্দু মুসলমানকে আড়াআড়ি ভাগ করে, তাদের শাসনের নামে শোষণ যন্ত্রটিকে ,আরো শক্তিশালী করতে পারে ,আরও হিংস্র করতে পারে, আরও তীব্র করতে পারে ,সেই ব্যাপারে ব্রিটিশ কে সাহায্য করতে একেবারে আত্মনিবেদনের ভঙ্গিতে, নিজেদেরকে উপস্থাপিত করছিল 
           

যে সমস্ত গোরক্ষিণী সভা  তৈরি হয়েছিল ,তার প্রায় প্রত্যেকটি নেতৃত্বের বা আড়াল থেকে নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষেত্রে জমিদারদের একটা বিশেষ রকম উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল। এই সংগঠনগুলির  সামাজিক প্রতিপত্তি প্রতিষ্ঠার পেছনে কি ধরনের সামন্ততান্ত্রিক স্বার্থের বিষয়টি ফলপ্রসূ ছিল, তা খুব সহজেই বুঝতে পারা যায় ।
              

গরু কে কেন্দ্র করে যে সাম্প্রদায়িক বাতাবরণ তৈরি, তার পেছনে যে অভিজাত সম্প্রদায় ,সামন্ততান্ত্রিক সম্প্রদায়ের নগ্ন শ্রেণীস্বার্থ সবথেকে বেশি কার্যকরী ছিল ,তা  বলার অপেক্ষা রাখে না ।সেই স্বার্থকে ব্যবহার করে ,স্বার্থ সুরক্ষিত রাখার তাগিদ থেকে কিন্তু সাম্প্রদায়িক চিন্তা-চেতনার বিকাশে ক্ষেত্র টি অনেক বেশি বিস্তৃত হয়েছে এবং রাজনৈতিক হিন্দু সম্প্রদায় তাদের জন্ম লগ্ন থেকেই অত্যন্ত সচেতনভাবে জমিদার, জোতদার শ্রেণীর স্বার্থ সামন্ততান্ত্রিক প্রভুদের স্বার্থ সংরক্ষণের ব্যাপারে সব রকম ভাবে যত্নবান থেকেছে।

ধারাবাহিক লেখাগুলি পড়তে ক্লিক করুনঃ www.cpimwb.org.in

ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (পর্ব – ২২)

ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (পর্ব – ২১)

ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (পর্ব – ২০)

ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (পর্ব – ১৯)

ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (পর্ব – ১৮)

ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (পর্ব – ১৭)

ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (পর্ব – ১৬)

ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (পর্ব – ১৫)

ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (পর্ব – ১৪)

ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (পর্ব – ১৩)

ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (পর্ব – ১২)

ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (পর্ব – ১১)

ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (পর্ব – ১০)

ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (পর্ব- ৯)

ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (অষ্টম পর্ব)

ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (সপ্তম পর্ব)

ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (ষষ্ঠ পর্ব)

ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (পঞ্চম পর্ব)

ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (চতুর্থ পর্ব)

ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (তৃতীয় পর্ব)

ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (দ্বিতীয় পর্ব)

ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (প্রথম পর্ব)

Spread the word