Sudipta Basu
দৃশ্য এক) মাথার ওপর আগুন সূর্য। হাঁটু গেড়ে যুদ্ধে পরাজিত সৈনিকের মত তাঁরা পীচ রাস্তায় বসে আছেন সারিসারি, আসলে বসিয়ে রাখা হয়েছে। জন্মভূমি হাঁ করে দেখছে সেই দৃশ্য। এবার হবে রাসয়নিক-স্নান। শুদ্ধ হবে আধুনিক ভারতের শ্রমশক্তি।
উত্তরপ্রদেশের বরেলির স্যাটেলাইট বাসস্ট্যান্ড। লকডাউনের ভারতে গাজিয়াবাদ থেকে পায়ে হেঁটে বরেলি পর্যন্ত চলে এসেছে হাজারো শ্রমিক। ট্রাফিক পুলিশ এসে নির্দেশ দিলো, সবাই এখানে বসে পড়ুন। অুভক্ত জীর্ণ শরীর টেনে রাস্তায় বসে পড়লেন আতঙ্কিত শ্রমিকরাও।দমকলের গাড়ির পাইপ থেকে জল দিয়ে মুহুর্তে তাদের ভিজিয়ে দেওয়া হল, জলের সঙ্গে রাসয়নিক। শঙ্কায় চোখ খুলতেই হাইপোক্লোরাইড মেশানো জল ঢুকে চোখ জ্বলতে শুরু করে, চিৎকার, আর্তনাদ, আতঙ্ক। দেশজুড়ে প্রবল সমালোচনার মাঝে জেলাশাসক জানিয়েছিলেন,বাসগুলিকে জীবানুমুক্ত করার কথা বলা হয়েছিল, কিন্তু…।
দৃশ্য-২) দীর্ঘ একমাস লকডাউনে গ্রামের বাইরে আটকে পুরুলিয়ার পুঞ্চা ব্লকের কেন্দা থানা এলাকার এক নির্মান শ্রমিক। কাজের জন্যই এসেছিলেন ঝাড়গ্রামে। আটকে পড়েছেন ঠিকাদারের কাজে, জুটছে না খাবার। বাড়িতে বাবা, দাদা দুজনেই দিনমজুর, গ্রামেও কাজ নেই। তিন বছরের ছোট্ট সন্তান অভুক্ত। আর না পেরে শুরু করলেন হাঁটা। রাস্তা হারিয়ে যাওয়ার শঙ্কায় রেললাইনের ওপর দিয়েই হাঁটা শুরু করলেন পুরুলিয়ার দিকে। ভোর রাতে পন্যবাহী ট্রেনে কাটা পড়লেন। খাতায় কলমে, তা নিছকই ‘দূর্ঘটনা’!
বাক্স প্যাঁটরা নিয়ে, কোলে শিশু নিয়ে হাঁটতে শুরু করেছেন পরিযায়ী শ্রমিকরা। হাঁটছেন শত শত কিলোমিটার।একমাত্র সঙ্গী খিদে! দেশের বিভিন্ন প্রান্তে মৃত্যুকে সঙ্গে নিয়েই হাঁটছিলেন তাঁরা। হাঁটা থামিয়েছে সরকার। থাকা খাওয়ার দায়িত্ব নেয়নি সরকার। লকডাউনে বন্ধ উৎপাদন। বন্ধ নির্মাণ। হাইওয়ে ধারে, দাড়িয়ে থাকা লরির নীচে, খোলা মাঠ-ই তাঁদের এখন বসত বাড়ি। সরকার শোনাচ্ছে নৃশংসতম হুঁশিয়ারি- রাস্তা অবরোধ করতে পারেবন না শ্রমিকরা, নইলে লকডাউন আইনে ১৪দিনের কোয়ারান্টিন! করোনা ধনী-গরিবের ফারাক বোঝেনা ঠিকই। কিন্তু খিদে পেটে, সন্তানের মুখ দেখতে না পাওয়া শ্রমিকের আক্ষেপ, করোনার আগে না খেয়েই তো মরে যাবো বেমালুম!
৭০ শতাংশ পরিযায়ীর সর্বোচ্চ দুশো টাকাই সম্বল !
এই এপ্রিলেই অক্সফ্যামের রিপোর্ট বলছে, করোনা পরিস্থিতি এবং লকডাউনে যে দ্রুত অর্থনৈতিক সঙ্কট ঘনিয়ে উঠছে তা ২০০৮’র বিশ্ব অর্থনৈতিক সঙ্কটের চেয়ের গভীর। করোনার প্রকোপে বিশ্বজুড়ে প্রায় ৫০কোটি মানুষ দারিদ্রসীমার নীচে চলে যেতে পারে আর্তনাদ অক্সফ্যামের রিপোর্টে।ঐ প্রতিবেদনের পরিসংখ্যান বলছে যদি ২০ শতাংশ আয়ও কমে, তাহলে অতি দারিদ্রসীমায় থাকা মানুষের সংখ্যা আরো প্রায় ৪৪কোটি বেড়ে যাবে। আর যদি আয়ের উর্ধ্বসীমা ধরা যায় তাহলে দারিদ্রসীমার নীচে চলে যাবে প্রায় ৫৫কোটি মানুষ!গত আট দশকে এই অধোগতি বেনিজর!
এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহে ‘দ্য হিন্দু’ পত্রিকার সমীক্ষায় পরিযায়ী শ্রমিকের নিদারুন জীর্ণ চেহারা আরো স্পষ্ট। দেশ জুড়ে মোট ১১ হাজার ১৫৯ জন পরিযায়ী শ্রমিকের উপর করা ঐ সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, শ্রমিকদের ৯৬ শতাংশই ৮ থেকে ১৩ এপ্রিল— এই পাঁচ দিন সরকারের কাছ থেকে কোনও রেশন পাননি। ২৫ মার্চ দেশ জুড়ে লকডাউন শুরু হওয়ার পর ওই শ্রমিকদের ৯০ শতাংশের বেশি মজুরি পাননি মালিকপক্ষের কাছ থেকে। অন্তত ৭০ শতাংশের শ্রমিকের পকেটে মাত্র ২০০ টাকা, সেটাই একমাত্র ভরসা! দিন গুজরানের শেষতম সম্বল!
এদেশের সরকার সুপ্রিম কোর্টে সাফ জানিয়েছে, পরিযায়ী শ্রমিকদের রাজ্যে ফিরিয়ে দিতে তারা নারাজ। সরকার নারাজ আটকে পড়া শ্রমিকদের সামান্য রেশনটুকুও দিতে।শুধু তাই নয়, লকডাউনের সময় অসংগঠিত ক্ষেত্রের সঙ্গে যুক্ত পরিযায়ী শ্রমিকদের মজুরি সরকারকেই দিতে হবে- এমন জনস্বার্থ মামলা দায়ের হতেই ক্ষুব্ধ মোদী সরকার পালটা জানিয়েছে আদালতে, অবিলম্বে এই মামলা খারিজ করে এইসব ‘পিআইএল শপ’ বন্ধ করা হোক!
ফিরতে পারছেন না শ্রমিকরা। মাইলের পর মাইল পেরিয়ে বাংলায় ফিরে আসা তো কার্যত অসম্ভব পরিযায়ী শ্রমিকদের কাছে। দায়িত্ব নেয়নি কেন্দ্র। হাত তুলে দিয়েছে রাজ্যের সরকারগুলিও। এরাজ্যে মমতা ব্যানার্জির সরকার সটান জানিয়ে দিয়েছে, তাঁরা আনতে পারবেননা ফিরিয়ে রাজ্যের শ্রমিকদের। এত লজিস্টিক সাপোর্ট মানে যানবাহনের ব্যবস্থা করতে পারবেনা। তার পরিবর্তে সরকারের নেতা,মন্ত্রীদের ফোনে জানালে কিছু টাকা পয়সা পাঠিয়ে দেওয়া হবে- নবান্নে বসে জানিয়েছেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী।ঘোষনা করে নতুন প্রকল্প ‘প্রচেষ্টা’! অসংগঠিত শ্রমিক যারা এই লকডাউনের পর্বের সময় আবেদন করবেন, তাঁদের এককালীন এক হাজার টাকা দেওয়া হবে! আবেদন শুরু হতেই আবার বন্ধ হয়ে যায় তা! ‘প্রচেষ্টার’ চেষ্টাও ব্যর্থ!
শাসকের রাজনীতি-ই খালি পেটে হাটাচ্ছে পরিযায়ী শ্রমিককে
মজুরির সন্ধানে ভিন রাজ্যে পাড়ি দেওয়া পরিযায়ী শ্রমিকদের উপর কেন্দ্রের সরকার বা সিংহভাগ রাজ্য সরকারগুলির এহেন মনোভাবের কারণ কি? উত্তর রাজনীতি, পুঁজি নিয়ন্ত্রিত রাজনীতি।
পরিযায়ী শ্রমিকরা শুধু হাইওয়ে আর হাইওয়ের পাশের মাঠে খালি পেট নিয়ে আক্রান্ত হচ্ছেন না। শুধু কাশ্মীরে অকাশ্মীরি পরিযায়ী শ্রমিকরা আক্রান্ত হন তা নয়, মারাঠি পরিযায়ী শ্রমিকরা আক্রান্ত হন গুজরাটে। বিহারী পরিযায়ী শ্রমিকরা আক্রান্ত হন মহারাষ্ট্রে। বাংলাতেও কোন কোন ‘পক্ষ’ শাসক শ্রেণির ‘পক্ষ’ নিয়ে চাইছে অবাঙালি শ্রমিকদের বিরুদ্ধে আক্রমণ শানাতে।
শাসক শ্রেণি সব সময় চায় এক রাজ্যের শ্রমিকদের বিরুদ্ধে আরেক রাজ্যের শ্রমিকদের পরিচালিত করতে। ভাষা ধর্ম প্রদেশ রাজ্যের নামে বিভাজন তৈরি করতে। বুঝিয়ে দেওয়া সহজ ‘তোমার মজুরিতে ভাগ বসাচ্ছে ভিন রাজ্যের শ্রমিকরা, বহিরাগতরা’। আসলে রাজ্যের স্থায়ী শ্রমিক আর পরিযায়ী শ্রমিকদের মজুরিতে ভাগ বসায় পুঁজিবাদ। মজুরিতে ভাগ বসায় মুনাফা। মজুরিতে ভাগ বসায় শাসক। মজুরি হারালে হাইওয়েতে ভুখা পেটে বসে থাকতে বাধ্য করে আসলের শাসকের দর্শন।
১৮৮৬ সালের ১লা মে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরের হে-মার্কেটে ৮ ঘন্টা শ্রমদিনের দাবীতে আন্দোলন রত শ্রমিকের ওপর গুলি চালানো হলে ১১ জন শহীদ হন। ১৮৮৯ সালে ফ্রেডারিক এঙ্গেলস-এর নেতৃত্বে প্যারিসে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় ‘আন্তর্জাতিক শ্রম সংগঠন’-এর সম্মেলনে নেওয়া সিদ্ধান্ত অনুসারে সমগ্র দুনিয়ার শ্রমিকশ্রেণি একটি সৈন্যবাহিনী হিসেবে একই পতাকাতলে সমবেত হয়ে ১৮৯০ সাল থেকে মে দিবসকে শ্রমিক শ্রেণীর ‘আন্তর্জাতিক সংহতি দিবস’ পালন করে আসছে। ‘মে-দিবস’ দেশে দেশে শ্রমিকশ্রেণিকে কেবল তাদের ৮ ঘণ্টা কাজের দাবির মধ্যেই নয়, শোষনের কবল থেকে চূড়ান্ত মুক্তির লড়াইকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেতনার রঙেই পালিত হয়।
১৯০৪’এ লেনিন লিখছেন,‘‘কমরেড শ্রমিকশ্রেণি, আরো দ্বিগুন প্রানশক্তিতে ভরপুর হয়ে প্রস্তুতি নিন নির্ধারক সেই লড়াইয়ের জন্য। শ্রমিকের হকের দাবিতে প্রচার আন্দোলনকে আরো শক্তিশালী করুন…পুঁজিবাদী শোষন থেকে মুক্তির সংগ্রামে আরো হাজার হাজার যোদ্ধাকে সমবেত করার লড়াইয়ের মধ্য দিয়েই পালন হোক মে-দিবসের উৎসব।
আটঘন্টার শ্রম দিন দীর্ঘজীবী হোক’’।
করোনা পরিস্থিতি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে পুজিঁবাদের ব্যর্থতা, গুড়িয়ে দিয়েছে তার অহঙ্কার।
লকডাউনে দেশ জুড়ে পরিযায়ী শ্রমিকদের ছবি স্পষ্ট করেছে চলতি ব্যবস্থার নৃশংসতাইকেই। এবারের মে-দিবস তাই আন্দোলনের নতুন কৌশল,রাস্তাকেই প্রশস্ত করছে।