India Tour of Ho Chi Minh

বিমান বসু

হো চি মিন, যিনি পরবর্তীকালে চাচা হো বা uncle Ho নামে বিশ্ববিখ্যাত হয়েছিলেন, তাঁর ভারত সফর, যদি ক্যালেন্ডার দেখা যায় তাহলে দেখা যাবে, উনি প্রথম আসেন ১৯১১ সালে। উনি যেহেতু প্যারিসে পড়াশোনা করেছিলেন, তাই সেই ভারতসফর ছিল তার সাথে সম্পর্কযুক্ত। দ্বিতীয়বার উনি আসেন ভিয়েতনামের পার্টির এক নেতা হিসাবে, ১৯৪৬ সালে। তখন তাঁর বয়স ছিল ৫২ বছর। বলাবাহুল্য প্রথমবার এসেছিলেন যখন, তখন তাঁর বয়স ছিল ১৭ বছর। তার পর রাষ্ট্রপ্রধান হয়ে যখন আসেন ১৯৫৮ সালে, তখন তাঁর বয়স ছিল ৬৪ বছর।

আমি যে বিষয়ের উপর গুরুত্ব আরোপ করতে চাই, তা হলো ওনার ১৯৪৬ সালের ভারত সফর। সেসময় কলকাতাতে উনি পার্টির আতিথেয়তা গ্রহন করেছিলেন। তখন অবিভক্ত পার্টির দফতর ছিল ডেকার্স লেনে। উনি ডেকার্স লেনে রাত্রিবাস করেছেন। তখন উনি বলেছিলেন ‘আমি হোটেলে বা অন্য কোথাও থাকবো না, পার্টি অফিসেই থাকবো’। পরের দিন যাঁরা ওনার সাথে দেখা করতে যান, তাঁরা এই দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিলেন যে হো চি মিন স্নান সেরে নিজের জামাকাপড় ধুয়ে একটি ছোট বারান্দা মতো অংশে টাঙানো দড়িতে সেই জামাকাপড় শুকোতে দিয়েছেন। সেটা দেখে অনেকেই অবাক হয়ে গিয়েছিলো। এ নিয়ে হো চি মিন কে প্রশ্ন করা হলে তিনি উত্তরে বলেন ‘This is my habit’. উনি প্রকারান্তরে বুঝিয়ে দেন ওনার জীবনচর্চা কেমন ছিল।

১৯৫৮ সালে উনি তৃতীয়বার যখন আসেন, তখন উনি প্যারিসে একটি সভা সেরে এসে দিল্লি তে নামেন, এবং সেবার উনি বেশ কিছুদিন (১০ দিন) ছিলেন। ১০ দিন উনি যে ছিলেন তার মধ্যে দিল্লি থেকে ঠিক কোথাও কোথায় গিয়েছিলেন তার সবটা আমার মনে পড়ছে না। আমার যেটুকু মনে পড়ে, উনি ব্যাঙ্গালোর গিয়েছিলেন এবং সেখান থেকে কলকাতা এসেছিলেন।

সেবারে কিন্তু উনি রাষ্ট্রপ্রধান হিসাবে এসেছিলেন। ওনাকে অভ্যার্থনা জানানোর জন্য দমদম বিমানবন্দরে ব্যাপক মানুষের সমাবেশ হয়েছিল। ‘চাচা হো’ রবে ধ্বনিত হয় চারদিক। দমদম বিমানবন্দর থেকে উনি রাষ্ট্রীয় আতিথেয়তা গ্রহণ করে রাজভবনে গিয়েছিলেন। তখনকার সময়ের আমাদের যিনি গভর্নর ছিলেন, শ্রীমতি পদ্মজা নাইডু, ওনাকে রাজভবনে নিয়ে যাওয়ার জন্য নিজেই এসেছিলেন। বিমানবন্দর থেকে ওনাকে আনার জন্য তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী ডক্টর বিধানচন্দ্র রায় গিয়েছিলেন। আরও বিভিন্ন বিশিষ্ট ব্যক্তিরা উপস্থিত ছিলেন। রাজভবনে যাওয়ার পর তিনি অনেকের সাথেই কথাবার্তা বলেন, দেখা-সাক্ষাৎ করেন। অবশ্যই এই দেখা সাক্ষাতের মধ্যে তৎকালীন বিরোধী দলনেতা কমরেড জ্যোতি বসুও ছিলেন, তিনিও দেখা করতে গিয়েছিলেন। তাঁদের কথাবার্তা হয়েছিল এবং আমরা যা দেখতে পাই যে ওনাকে ক্যালকাটা মিউনিসিপাল কর্পোরেশন এর পক্ষ থেকে নাগরিক সম্বর্ধনা জানানো হয়েছিল।

নাগরিক সম্বর্ধনায় উপস্থিতদের মধ্যে ছিলেন রণমিত্র সেন, যিনি গুলিবিদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলেন, গুলি শরীর থেকে বার করে দেওয়া গিয়েছিলো তাঁর। দেখা গেলো, হো চি মিন প্রোটোকল ভেঙে স্টেজ থেকে নেমে দর্শকআসনে বসে থাকা রণমিত্র সেনের সাথে সাক্ষাৎ করেন। তিনি ব্যাখ্যা করছিলেন কীভাবে ইন্দো-চীন যুদ্ধের প্রতিবাদে কলকাতায় যে মিছিল হয়েছিল, তাতে গুলিচালনায় দুজন medical college এর ছাত্র মারা গিয়েছিলেন এবং রণমিত্র সেন গুলিবিদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও বেঁচে গিয়েছিলেন। হো চি মিন তাঁকে জড়িয়ে ধরেন।

আমি এই ব্যাপারে সংক্ষেপে আরও কিছু কথা বলতে চাই। হো চি মিন সম্বর্ধনা পাওয়ার পরে নিজের দেশে ফিরে গিয়েছেন। উনি তখন উত্তর ভিয়েতনামের রাষ্ট্রপতি। যে কথা উনি ফেয়ারওয়েল এর সময় বলেছেন, তা ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সেই কথা আমি উল্লেখ করতে চাইছি। উনি বলেছিলেন, “I’m leaving your country but I would never leave you for such a warm welcome and hospitality, I offer my sincere thanks to the president Dr. Rajendra Prasad, prime minister Jawaharlal Nehru and all the members of the Government of India. I’m also thankful to the Governors, Chief ministers, ministers, mayor, officials of various states and also the crew members of the aircraft who took such a good care of our service. I bid of you a goodbye. Goodbye my dear brothers and sisters of the great Indian republic. My dear children, nephews and nieces of India, lot’s of love from Uncle Ho for you. Long live the friendship of the people of Vietnam and India. Long live the Asian-African solidarity. Long live world peace. Jai Hind.”

এই যে কথাগুলি উনি বলেছেন, এ থেকে বোঝা যায় ভারতীয় জনগণের ব্যাপারে ওনার কি দৃষ্টিভঙ্গি ছিল, ভারত বিশ্বশান্তির ক্ষেত্রে যে ভূমিকা পালন করেছে, সে সম্পর্কেও তাঁর কি ধারণা ছিল। এটাও দেখা গেছে যে যখন তিনি বাইরে থেকে আমাদের অতিথি হিসাবে এসে পালাম বিমানবন্দরে নামছেন, তখন তাঁকে red carpet welcome দেওয়ার পরিকল্পনা ছিল। সে বিষয়ে হো চি মিন জানতে চান red carpet একান্ত প্রয়োজন কিনা। তিনি বলেন, তাঁর দেশ গরীব এবং ভারতের মানুষেরও অর্থনৈতিক অবস্থা এমন নয় যে সকলের সব কিছু মিটছে। তাই রেড কার্পেট বাদ দিতে পারলে ভালো হয়। সাথে সাথে জওহরলাল নেহেরু রেড কার্পেট গুটিয়ে নিতে বলেন। Red Carpet অভ্যার্থনা থেকে বিরত থাকেন নেহেরু জী।

এই যে একটা সম্পর্ক, ভারতের সাথে ভিয়েতনামের আত্মিক সম্পর্কের একটি ভিত তৈরী করে দিয়েছিলো। ১৯৫৪ সালের ২০ জুলাই শান্তির পক্ষে রায় ঘোষিত হয়েছিল এবং উত্তর ভিয়েতনাম মুক্ত হলো। মুক্তির পর ডক্টর হো চি মিন প্রথমে প্রধানমন্ত্রী এবং পরে রাষ্ট্রপতি হন। রাষ্ট্রপতি হওয়ার ৪ বছর পর উনি ভারতে আসেন। যে সম্বর্ধনা তিনি পেয়েছেন, যে সৌহার্দের সম্পর্ক গড়ে উঠেছে, তা দক্ষিণ ভিতনামের মুক্তির লড়াই সংগ্রামের ক্ষেত্রে অভাবনীয় ভূমিকা নেয়। ভারতীয় জনগন ব্যাপকভাবে আত্মিক সম্পর্কের ভিত্তিতেই সেই আন্দোলন সংগ্রামকে সমর্থন করে।

আজকে ৪ঠা ফেব্রুয়ারী। ১৯৫৮ সালে এই ৪ঠা ফেব্রুয়ারী উনি আমাদের কলকাতা শহরে এসেছিলেন। আজকের দিনটি স্মরণে রেখে, যারা ভিয়েতনাম অনুরাগী, যারা হো চি মিন অনুরাগী, যারা লড়াই সংগ্রামকে যারা সমর্থন করেন, লড়াই সংগ্রামে যারা শহীদ হয়েছেন আমি তাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে, ভিতনামের মানুষের সাথে ঐক্য, সম্প্রীতির মেলবন্ধন অটুট থাকুক, এই প্রত্যাশায় সবাইকে অভিনন্দন জানিয়ে আজকের দিনটিকে স্মরণ করছি।

Spread the word

Leave a Reply