রোমিলা থাপার
ভারতবর্ষের ইতিহাসে ধর্মের স্থান
আমি এই বিতর্ক উপস্থাপন করব যে, ভারতবর্ষের ধর্মের ইতিহাস বেশ জটিল। এটা কেবল সমান্তরাল হিন্দু ও মুসলমান এই দুই ভাগে বিভক্ত নয়, কারণ ধর্মীয় সম্প্রদায়গুলি এক্ষেত্রে একমুখী বৃহৎ একটি দল হিসেবে গড়ে ওঠেনি, বরং বিভিন্ন কৌমের সম্মিলনে গঠিত হয়েছিল। আমি এটাকে দুটি ধরনের সম্পর্ক হিসেবে দেখি এবং যার প্রত্যেকটিই সমাজ ও ধর্মের মধ্যে যোগাযোগ ও সম্পর্কের সম্বন্ধ অনুসন্ধানের দাবি রাখে। প্রথমটি হলো, জাতপাতের ঘনিষ্ঠ সামাজিক সংযোগের ফলে উদ্ভূত বিভিন্ন কৌমের সঙ্গে সম্পর্ক, যা ভারতীয় সমাজের প্রতিটি স্তরে বিদ্যমান। আর দ্বিতীয়টি হলো রাজনৈতিক কর্তৃত্বের সঙ্গে এবং তার মধ্যস্ততায় বেড়ে ওঠা ভাবনা, যা তৎকালীন সময়ে কৌম, জাত ও রাষ্ট্রের মধ্যে ত্রিমুখী পদ্ধতি হিসেবে বেড়ে উঠেছিল। সেখানে সমস্ত কৌমকে ঐক্যবদ্ধ করে একটি সত্তায় সংহত করার মতো চার্চ উপস্থিত ছিল না। অন্য কথায় বলতে গেলে, আমি ধর্মের বিষয়টিকে বিকেন্দ্রীকৃত দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখার পক্ষে সওয়াল করব।
অতীত কালের ভারতবর্ষে, বিভিন্ন ধর্মীয় কৌম আর বিভিন্ন জাতের মধ্যে সংযোগের ক্ষেত্রে জটিল সম্বন্ধ দেখা গিয়েছিল। কৌম দ্বারা প্রচারিত বিশ্বাস এবং জাতপাতের বিভাজন অনেক সময়ই তার সামাজিক পরিপ্রেক্ষিত নির্ধারণ করে। এই দুইয়ের পারস্পরিক নির্ভরশীলতার মধ্যে দিয়েই অবস্থান স্থির করা হতো। সব ধর্মেরই উচ্চশ্রেণির মানুষরা তারা জাতিবিভাজন কঠিনভাবে মানুক বা না মানুক – গ্রন্থনির্ভর ধর্মের নিয়মতান্ত্রিকতার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিল, আর নিম্নশ্রেণির লোকেরা, সম্ভবত তত গ্রন্থনির্ভর ছিল না, অনেক বেশি খোলামেলা ছিল। জাতপাতই সামাজিক নিয়মনীতি নির্ধারণ করত আর তা বজায় রাখত, কারণ তারা নিজেদের শিক্ষিত এবং আইন হিসাবে দাবি করত। বেশিরভাগ লোকের ক্ষেত্রে, এটা ঐতিহ্যের কথা। জাতপাত আর কৌমের নিয়মাবলি বর্তমানে সকলের জন্য প্রযোজ্য দেওয়ানি আইন দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়েছে। এর ফলে দেওয়ানি আইনগুলি নতুন করে দেখার প্রয়োজন হয়ে পড়ে যাতে সব ধর্মের ক্ষেত্রেই ধর্মনিরপেক্ষতা এবং সামাজিক ন্যায়বিচার বজায় রাখা যায়। ধর্মনিরপেক্ষতা ও সামাজিক ন্যায়বিচার মূল্যবোধ হিসেবে পরিচিতি কিন্তু সামাজিক প্রতিষ্ঠানে তা প্রয়োগের ক্ষেত্রে নতুন বিষয়। ধর্মগ্রন্থের বহু মূল্যবান ও পুঙ্খানুপুঙ্খ চর্চা এই বিষয়গুলি সম্পর্কে আমাদের ধারণাকে উন্নত থেকে উন্নততর করেছে। যদিও, সমাজ নিয়ন্ত্রণে যেসব ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান এই ধারণা প্রচার করে, তাদের পরীক্ষা-নিরীক্ষায় আমরা অনেক বেশি মনোযোগ দিয়েছি। সাধারণভাবে একমুখী বৈশিষ্ট্যহীন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলির দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করার বদলে, এটি আরো বেশি অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন কাজ হবে যদি আমাদের অতীতকে বিশ্লেষণ করার ধর্ম ও পারম্পর্য খোঁজার ক্ষেত্রে, জাতপাত ও কৌমের সংযোগ নিয়ে চর্চা করি, যে বহমানতার অভাব একমুখী ধর্মের ক্ষেত্রে দেখা যায় তারও খোঁজ করি। তাহলে অবশ্যই এ প্রশ্ন আমাদের সামনে আসবে—এর মূল ধর্মের থেকে জাতপাতের বিভাজনের মধ্যেই বেশি বেশি করে আছে। সেক্ষেত্রে, ভারতীয় ধর্মের উপনিবেশবাদী কাঠামো, যা আমরা অতি সহজেই গ্রহণ করেছি, তাকে আবার করে পরীক্ষা করার দরকার আছে। সম্ভবত, আমাদের এ বিষয়ে আরো বেশি যত্নবান হতে হবে যে, কীভাবে অতীতে জাতপাত, আর এখনকার সময়ে তার বদলে শ্রেণি সমাজ আর ধর্মের সম্পর্ককে আকার দিয়েছে ও পরিবর্তিত করছে। কোন গোষ্ঠী সমাজের রাজনৈতিক ধর্মীয় অবস্থানকে সমর্থন জানাচ্ছে এবং কেন ।
মুসলমান যুগের আগের পর্যায়ের ইতিহাসে কোনো একমুখী হিন্দুত্বের উল্লেখ পাওয়া যায় না। বিস্ময়করভাবে, যেভাবে আমরা চিহ্নিত করি ধর্মকে, যেমন হিন্দু ধর্ম বা বৌদ্ধ ধর্ম, এভাবে কোথাও উল্লেখ পাওয়া যায় না। বরং দুটি পৃথক কৌমের সন্ধান পাওয়া যায়, যারা দু’রকমের আলাদা ধরনের ভাবনা প্রচার করত। এগুলি হলো ব্রাহ্মণ। এবং শ্রমণ। এদের মূল পার্থক্য ছিল দেবকল্পনায় আর পরজীবনের ভাবনায়, তার স্বীকৃতি বা অস্বীকৃতিতে। ব্রাহ্মণরা ব্রাহ্মণ্য বিশ্বাস ও আচারের কথা বলত, আর শ্রমণরা শ্রমণদের ভাবনা অথবা বুদ্ধিষ্ট, জৈন ইত্যাদি নানা ভাবনার কথা বলত, এমনকি নাস্তিক বা অবিশ্বাসীরা পরবর্তীকালে ঈশ্বর ও বেদের অস্তিত্ব, আত্মার অস্তিত্বকে অস্বীকার করত। ফলাফল হিসেবে, নাস্তিকরা পৃথিবী আর মানবজীবন সম্পর্কে আরো যুক্তিসংগত ভাবনার দিকে অগ্রসর হলো। যার মধ্যে দুটি আলাদা আলাদা কৌম পৃথক পৃথক বিশ্বাসের স্বীকৃতি লাভ করল।
এদের কোনোটাই একমুখী গোষ্ঠী ছিল না। এরা ছিল বিবিধ কৌমের সমাহার। ব্রাহ্মণ আর শ্রমণের এই দ্বৈত চরিত্র ধর্মগ্রন্থ নামে বিভিন্ন পাঠ্যপুস্তকে ব্যবহৃত হয়েছে উল্লেখ করার মতো বিষয় হিসেবে, ব্যবহৃত হয়েছে ১৫০০ বছর ধরে অশোকের শিলালিপিতে, মেগাস্থিনিসের বিবরণে, চিনা বৌদ্ধ তীর্থযাত্রীদের বয়ানে, একাদশ শতাব্দীতে আল বিরুণীর ভ্রমণবৃত্তান্তে। ব্রাহ্মণের উল্লেখ করা হয়েছে বিষ্ণুপুরাণে, বৌদ্ধদের পাঠ্যপুস্তকে, কখনও কখনও এদের পারস্পরিক বৈরিতার কথাও বলা হয়েছে। বিস্ময়করভাবে, তারা একই ধরনের গালাগালি পরস্পরের বিরুদ্ধে করেছে। বৈয়াকরণ পতঞ্জলি প্রথম শতাব্দীর পুরোভাগে উল্লেখ করেছেন এই দুটি বিষয় এবং যোগ করেছেন। এদের সম্পর্ককে অহি-নকুল সম্বন্ধের সাথে তুলনা করা যেতে পারে।
তৃতীয় যে অংশের কথা উল্লেখ করা হয়নি তারা হলো সমাজের সেই অংশ যাদের জাতপাতের কারণে বঞ্চনা করা হয়েছিল। এর ফলে তাদের কিছু নিজস্ব বিশ্বাস এবং পূজার্চনা পদ্ধতি গড়ে উঠেছিল। এরা ছিল সেই অংশ যাদের জাতের সাথে সম্পৃক্ত করে দেখা হতো। আজকের দিনে যাদের আমরা দলিত নামে অভিহিত করি। সেই সমপর্যায়ের মানুষদের সব ধর্মের মধ্যেই পাওয়া যায়, যেমন পাষণ্ড, মজহবী ইত্যাদি; এমনকি ঈশ্বরের কাছে সব মানুষ সমান একথা যে ধর্মীয় কৌম বলে থাকে তাদের মধ্যে এই দলিতদের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। নিয়মতান্ত্রিকভাবে সমস্ত দলিতই সমস্ত ধর্মের ক্ষেত্রে সমান সুযোগ পাওয়া উচিত, কিন্তু তা বাস্তবের সঙ্গে মেলে না।
কৌমের গুরুত্ব
বিভিন্ন কৌম বা জনগোষ্ঠী যারা সময়ের গতিতে জন্ম নিয়েছে, তাদের কোনো কোনোটি মৌলবাদী আবার কোনো কোনোটি সর্বজনীন সহজধর্মে বিশ্বাস করে। একমুখী ধর্মের সুবিধা হলো এই যে, সেক্ষেত্রে এইসব কৌম বা জনগোষ্ঠী মূলত কম-বেশি মৌলবাদী হয়ে থাকে। এর ফলে অপেক্ষাকৃত কম মৌলবাদীরা নতুন ধর্মকে গ্রহণ করে, এটা শুধু কথার কথা নয়। সর্বজনীন ধর্মে বিশ্বাসী তাদের নিজস্ব ধারায় পথ খুঁজে নেয়।
ধর্ম পরিবর্তন সম্পর্কে আমাদের ধারণা আরেকটু স্পষ্ট হবে, যদি তা যেটুকু প্রমাণ বা সূত্র পাওয়া যায়, তার ভিত্তিতে আমরা জাতপাত ও কৌমের দিকে নজর ফেরাই। এর থেকে এককথায় ‘হিন্দুরা মুসলমান হয় গেলো’ না বলে আরেকটু ভালো ব্যাখ্যা পাওয়া যাবে। আমরা অতীতের ছাঁচকে বর্তমান সময়ের পারস্পরিক সম্পর্কের ভিত্তিতে আলোচনা করে থাকি। ফলে, আমাদের আরো বেশি বিশ্লেষণাত্মক এবং নির্দিষ্ট ঐতিহাসিক অনুসন্ধান ও ব্যাখ্যার দায়িত্ব নিতে হবে। আমরা কখনই ইতিহাসকে বিভিন্ন রাজনৈতিক স্লোগানে নামিয়ে আনতে পারি না, বা, এইভাবে সেই আলোচনায় দাড়ি টানতে পারি না।
কৌমের জন্মের বিষয়টা ছিল মুক্ত আর উদার এবং তা বহুত্ববাদের দিকে ছিল তার স্বাভাবিক গতি, যা ভারতবর্ষের প্রতিটি ধর্মেরই বৈশিষ্ট্য হয়ে উঠেছিল। এটা ধর্ম ও সমাজের মধ্যেকার সম্পর্ককে বোঝার ক্ষেত্রে একটি মূল দিক, আর এই সম্পর্ক এক সমাজ থেকে অন্য সমাজে পরিবর্তিত চেহারা নেয়। কাজেই আমরা এটা ভেবে নিতে পারি না যে, ইউরোপে ধর্ম ও সমাজের মধ্যে যে সম্পর্ক তা স্বাচ্ছন্দভাবে ভারতের ক্ষেত্রে মিলিয়ে নেওয়া যাবে ইউরোপের পণ্ডিতরা এই ভুলটা করেছিলেন। এর থেকে এটা বোঝা যায় না যে ধর্ম নিরপেক্ষতার মানে পালটে যাবে, কিন্তু তার প্রয়োগ ভিন্ন ভিন্ন সমাজে বিভিন্ন হবে।
যেহেতু শ্রমণ-ধারণার মূল ভিত্তি ছিল ঐতিহাসিক, তাই এটা কেন্দ্রীয় শিক্ষার মধ্যে দিয়ে একটি সমান্তরাল আকার নিয়েছিল। ব্রাহ্মণ্য ধর্মের ইতিহাস ছিল অনেক জটিল। প্রথম যুগের ব্রাহ্মণ্য ধর্মের ক্ষেত্রে ত্যাগ-তিতিক্ষার আচার পালনের মধ্য দিয়ে ধরে, যা উচ্চ শ্রেণির ব্রাহ্মণরা বিভিন্ন দেবতা বিশেষ করে, ইন্দ্র ও অগ্নিকে আবাহনের জন্য করত, সেটাই ছিল নজরকাড়া বিষয়। অনেক সর্বজনীন ধর্মে বিশ্বাসী জনগোষ্ঠী, প্রধানত বৌদ্ধ, জৈন এবং আজীবিকরা এই ধারণাকে প্রশ্ন করত। এইসব সর্বজনীন ধর্মে বিশ্বাসী জনগোষ্ঠী সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলি সম্পর্কে যৌক্তিক ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করেছিল এবং একটি সমালোচনাত্মক ঐতিহ্য তৈরি করেছিল, যা মৌলবাদকে প্রশ্নচিহ্নের সামনে দাঁড় করিয়েছিল, যদিও তারাও শেষপর্যন্ত তাদের নিজস্ব মৌলবাদকে প্রতিষ্ঠা দিয়েছিল।
প্রথম শতাব্দীর শুরু থেকে ব্রাহ্মাণ্য আচার বেশি বেশি করে ব্যক্তিনির্ভর হতে শুরু করে শিব আর বিষ্ণু অর্চনার মধ্যে দিয়ে। আলাদা দেবতার পূজা করা জনগোষ্ঠী নিজেদের আলাদা জনগোষ্ঠী হিসেবে নিজেদের মধ্যে পার্থক্য রচনা করে, বৈষ্ণবরা ভাগবত এবং শৈবরা পাশুপতি নামে নিজেদের ঘোষণা করে। সপ্তম শতাব্দী থেকে, ধর্মীয় বিশ্বাস ও পুজার্চনার রীতি একটি নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর জন্ম দেয়—যাদেরকে আমরা ভক্তিবাদী বলে থাকি। তারা বিভিন্ন সময়ে উপমহাদেশের বিভিন্ন অংশে আবির্ভূত হয়। প্রথম যেগুলিকে চিহ্নিত করা যায় তার মধ্যে আছে দক্ষিণের আলতার ও নায়ানার গোষ্ঠী যা পরবর্তীকালে উত্তরেও ছড়িয়ে পড়ে। তাদের মধ্যে কোনো কোনোটা নতুন সহজ ধর্মকেও প্রকাশ করেছিল।
ব্রাহ্মণ্য ও শ্রমণধর্ম উভয়েই বেশ ভালো পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছিল এবং ধনী, ক্ষমতাবানদের ধর্ম হয়ে উঠেছিল। এটা তাদের প্রতিপত্তি দিয়েছিল আর সামাজিক আইনগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতাও দিয়েছিল। যে অর্থ দান হিসেবে সংগৃহীত হতো, তা কোনো একক একমুখী ধর্মীয় সত্তাকে দেওয়া হতো না, দেওয়া হতো ঐ নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠী বা কৌমকে, তেমন কোনো ধর্মীয় সত্তার অস্তিত্বই তখন ছিল না। পরবর্তীকালেও এই নিয়ম চালু ছিল।
ধনী জনগোষ্ঠীর এই কেন্দ্রগুলি শিক্ষা ব্যবস্থার উৎসভূমি হয়ে উঠেছিল। এটা তাদের কর্তৃত্বকে বাড়িয়ে তুলেছিল এবং তারা অভিজাতদের এর অন্তর্ভুক্ত করতে পারত। প্রায়শই, যেসব জনগোষ্ঠী বা কৌমের বেশি বেশি ক্ষমতা ও সমর্থক ছিল, তারা আলাদা জাতের মতো করে কাজ করতে শুরু করল, উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে কর্নাটকের লিঙ্গায়েত এবং দেশের অন্যান্য প্রান্তে অন্য অন্য দল। তারা সবসময় নিজেদের স্বীকৃত ধর্মের অংশ বলে মনে করত না, বরং তার বিরোধিতা করত।
ইসলামের উদ্ভব
ইসলাম ধর্মের আগমনের সঙ্গে সঙ্গে, বিশেষ সুফিদের উপস্থিতিতে— মৌলবাদী ও সর্বজনীন ধর্মীয় ভাবনার দিকে অভিযান ও কৌমের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছিল। কেউ কেউ মৌলবাদী অবস্থান নিয়েছিল, অন্যেরা মিশ্র বিশ্বাস ও পূজার্চনা বেছে নিয়েছিল। বেশিরভাগ সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রে পরবর্তী বিষয়টাই পছন্দসই হয়েছিল।
এই নতুন আবির্ভাব ধনী ও রাজা-রাজড়াদের আর্থিক আনুকুল্যে বিস্তৃত মসজিদ ও খানকার প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে প্রকাশ পেয়েছিল। যেমন, বড়ো বড়ো পৃষ্ঠপোষকতার মধ্যে দিয়ে হয়, তেমনই এমন ধনী থেকে আরও ধনী হয়ে উঠেছিল এদের ভাণ্ডার। বৌদ্ধ উপাসনাস্থল বা হিন্দু মন্দির এবং মঠ যেমনভাবে নিজেদের যুক্ত করত পাণ্ডিত্য ও রাজনীতির চর্চায় তেমনই ইসলামিক কেন্দ্রগুলোও শুরু করল। হিন্দু, মুসলমান, শিখ ইত্যাদি ধর্মীয় কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণাধীন সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলি সম্পর্কে পুঙ্খানুপুঙ্খ চর্চা এই বিষয়টিকে স্পষ্ট করে তুলবে।
প্রথম যুগে, কৌম বা জনগোষ্ঠী ছিল অধিকাংশ মানুষের ধর্মীয় পরিচিতি। এটি আরো স্পষ্ট হয়ে উঠবে যদি ইসলাম ধর্মের আগমনের দুটি পদ্ধতি – পওনি ও পরিবর্তন, লক্ষ্য করি। বর্তমানে এই ঘটনাকে ব্যাখ্যা করার জনপ্রিয় রীতি হলো এই যে, বহিরাক্রমণ তার অবশ্যম্ভাবী রাজনৈতিক পরিণতি হিসেবেই ঘটনাগুলি ঘটেছিল। কিন্তু বিভিন্ন চেহারায় আরো বিভিন্ন আকার ছিল ইসলামের আগমনের, যেমন ব্যবসায়ী, অন্য দেশ থেকে আসা মানুষের বাসভূমি খুঁজে নেওয়া, সুফিদের প্রভাব ইত্যাদি।
মহম্মদ বিন কাসেমের সিন্ধুজয়ের ঘটনা সকলেরই জানা। কিন্তু তার থেকেও বেশি রোমাঞ্চকর ঘটনা হলো আরব ব্যবসায়ীদের পশ্চিম উপকূল থেকে এসে সিন্ধু ও কেরালায় বসতি স্থাপন। অষ্টম অথবা নবম শতাব্দীতে কিছু আরব দেশের মানুষ দক্ষিণে রাষ্ট্রকূট রাজাদের কাজে যোগ দিয়েছিল। তাদের মধ্যে যারা বয়োবৃদ্ধ ছিল, তৎকালীন রীতি অনুযায়ী মন্দির ও ব্রাহ্মণদের জন্য ভূমিদানও করেছিল। আরব ব্যবসায়ী স্থানীয় মানুষদের সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্কেও যুক্ত হয়েছিল আর ধর্মকে থাক মোড় দিয়েছিল। অনিবার্যভাবে এর ফলে নতুন নতুন কৌম বা জনগোষ্ঠীর জন্ম হয়েছিল—যেমন কেহরা, নবায়ন খোজা, মাপিলা আর অন্য অনেক – যেখানে বিশ্বাস, রীতিনীতি, দেওয়ানি আইন রচনা করার ক্ষেত্রে বর্তমানে অভ্যস্ত বিষয়গুলি নিয়ে আসার ক্ষেত্রে কোনো দ্বিধা ছিল না। সেজন্য দুটো বিষয় কখনই একরকম ছিল না। গুজরাটি বোহরা ও মালয়ালি মাপিলা কখনই এক ছিল না। এইরকম বহু জনগোষ্ঠী বা কৌম দেখা দিয়েছিল, কিন্তু সমাজ ও ধর্মের ইতিহাস হিসেবে তার চর্চা বিশেষ হয়নি।
এই নকশা পরবর্তী শতাব্দীতেও চালু ছিল বৃহত্তর সমাজের অংশ হিসেবে। এটিই ছিল অন্য নকশাগুলি, যেগুলি রাজনৈতিক ক্ষমতা ও শাসনের উৎস থেকে গড়ে উঠেছিল, তার সঙ্গে মূল দ্বন্দ্বের এলাকা। এই দ্বৈত ব্যবস্থা সামগ্রিক ইতিহাসের প্রেক্ষাপট জুড়েই বর্তমান ছিল, কেবলমাত্র তা সৃষ্টি হওয়ার উপাদানগুলি ছিল পৃথক। বিভিন্ন মতামতের নতুন নতুন শিক্ষকরা তাদের পক্ষে বেশ কিছু সমর্থকও সংগ্রহ করে ফেলেছিল। আজ পর্যন্ত এটিই ছিল জরুরি বিষয় যার প্রেক্ষিতে কীভাবে অধিকাংশ ভারতীয়ের ধর্ম সম্পর্কে অভিজ্ঞতা গড়ে উঠত, যদিও তারা উপনিবেশবাদী নিয়মানুগ ধর্মের অংশ হিসেবে নিজেকে ঘোষণা করেছিল। এটা ছিল হিন্দুত্ব ও ঐশ্লামিক ভাবনার আগ্রাসনের আগেকার ঘটনা, যা এই ফারাককে সীমানাকে আরো শক্তপোক্ত করে তুলেছিল, এমনকি, পালটে দিয়েছিল। বহু মানুষ যারা আজকের দিনে একমুখী ধর্মের সঙ্গে নিজেদের যুক্ত করেছে, সেটা যে ধর্মই হোক না কেন, জোর করলে তারা হয় কোনো কাম বা জনগোষ্ঠীর নাম বলবে, অথবা কোনো বাবা, গুরু অথবা সম্ভের অনুগামী হিসেবে নিজেদের পরিচয় দেবে। তারা যে দৈনন্দিন জীবনযাপন করে তার মধ্যে এই যোগাযোগটা আরো স্পষ্টভাবে লক্ষ্য করা যায়। আশ্চর্যজনকভাবে, এই জনগোষ্ঠীগুলি যে কৌমের সঙ্গে নিজেদের মিলিয়ে পরিচিতি করায় সাধারণভাবে সেগুলি বিগত হাজার বছর ধরে গড়ে উঠেছে।
মধ্যযুগের ইতিহাস সম্পর্কে মিথ তৈরি করা
ভারতবর্ষের ইতিহাসে মধ্যযুগের ইতিহাস, যাকে উপনিবেশবাদী ঐতিহাসিকরা মুসলমান যুগ নামে অভিহিত করেছেন, তা বিগত হাজার বছর ধরে গড়ে উঠেছে। এই ইতিহাস ধর্মীয় মৌলবাদী আর রাজনীতিকরা এই কাঁচাভাষায় ব্যাখ্যা করেছেন এই স্লোগানের মধ্যে দিয়ে যে, ‘আমরা দাস ছিলাম’—এই ধারণা থেকে যে, মুসলমান শাসন হিন্দু জনতার উপর অত্যাচার চালাত। এটা ছিল সেই ধর্মীয় জাতীয়বাদের ক্রমবিকাশ যা ইতিহাসের উপনিবেশবাদী ব্যাখ্যাকে অতি সহজেই গ্রহণ করেছিল। যদি ঐতিহাসিকভাবে দেখা যায়, তাহলে বিষয়টা অন্যভাবে প্রতিফলিত হবে।
হিন্দুত্বে ও ঐন্নামিক ভাবনার এই পারস্পরিক সম্পর্ক প্রত্যক্ষত দুটি পরস্পর বিরোধী রাজনৈতিক শক্তির প্রতিদ্বন্দ্বিতার প্রকাশ, যা উভয়ের মধ্যে সংঘর্ষ ও দ্বন্দ্বের মুহূর্ত হিসেবে দেখা দিত। প্রায়শই তা ধর্মীয় সংগঠনগুলির মধ্যে দিয়ে প্রতিভাত হতো। যা মূলত রাজনৈতিক কার্যক্রম ছিল সেই সময়কালে তা এখনকার সময়ে ধর্মীয় আচরণ হিসেবে ব্যাখ্যা করা হয় আর রাজনীতি আড়ালে চলে যায়। কিছু সংঘর্ষ ছিল প্রত্যাশিত। এই সংঘর্ষ ভারতবর্ষে নতুন ছিল না, যদি ব্রাহ্মণ আর ভ্রমণের সম্পর্ককে অহিনকুল সম্পর্ক হিসেবে বর্ণনা করা হয়ে থাকে যা সম্ভবত সঠিক ধারণা, কারণ আমরা জানি, কোনো কোনো এলাকায় বৌদ্ধ শ্রমণদের হত্যা করা হয়েছিল এবং জৈনদের বিতাড়িত করা হয়েছে। পরবর্তী শতাব্দীতে, শেষ হাজার বছরে, বিষয়গুলি লক্ষণীয়ভাবে পরিবর্তিত হয়নি। যেমনভাবে উপনিবেশবাদী পণ্ডিতরা জারি রেখেছেন, তেমনভাবেই না সংস্কৃতিকে ধর্মের উপরে স্থান দেওয়া হয়েছে, না একে সম্পূর্ণ আগ্রাসনমুক্ত করা হয়েছে। এটা প্রকৃতপক্ষে এখনকার বিশ্বে অন্যান্যদের মতই স্বাভাবিক সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে।
কিন্তু পূর্ববর্তী সময়কালের মতো, মধ্যযুগেও অনন্য সৃজনশীলতার ভারতীয় সংস্কৃতিকে উজ্জ্বল করে তুলেছিল, যা নিয়ে আমরা আজও বেঁচে আছি। সেই সময়কালের সংস্কৃত ও ফারসি ভাষায়, অন্যান্য আঞ্চলিক ভাষায় সেই বুদ্ধিবৃত্তির বিকাশ লক্ষ্য করা যায় আগেকার মতো, যদিও তা বিভিন্ন ভদ্রসমাজে প্রচলিত ছিল। এটা হচ্ছে নির্দিষ্টভাবে সেই সময়, যখন বিভিন্ন আকার ও প্রকারে আমরা হিন্দু বলে বর্তমানে অভিহিত করি, তার প্রকাশ ঘটেছিল, যদিও এটা সার্বিক সত্য ছিল না বা সকলের ক্ষেত্রে ঘটেনি।
বিভিন্ন সংস্কৃতির চর্চার ক্ষেত্রে পারস্পরিক সম্পর্ক বিচারকে মুহূর্তের জন্য একপাশে সরিয়ে রেখে একথা বলা যেতেই পারে যে, ব্রাহ্মণ্য ঐতিহ্যকে কেন্দ্র করে যে কার্যক্রম দানা বেঁধেছিল তা ছিল সবচেয়ে মনোগ্রাহী। সারা দ্বিতীয় শতাব্দী জুড়ে অর্থাৎ শেষতম হাজার বছরে, কাশ্মীর থেকে কেরালা ও তার মধ্যবর্তী অঞ্চলে ব্রাহ্মণ্য তত্ত্ব ও ধর্মীয় আচরণের পাণ্ডিত্যপূর্ণ বিকাশ ঘটেছিল। সায়নের ঋগ্বেদের ব্যাখ্যা চতুর্দশ শতাব্দীর এক পণ্ডিতের বাস্তব ও কল্পনার মিশেলে এক অনন্যসাধারণ অভিজ্ঞতা। সামাজিক পরিবর্তন সেই সময়কালে বর্তমান সামাজিক রীতিনীতির অন্যতম ব্যাখ্যা উপস্থিত করে। মনু ধর্মশাস্ত্র সম্পর্কে কুন্নুকার বক্তব্য সেই সময়কার সামাজিক পরিবর্তনের প্রতিক্রিয়াকে লিপিবন্ধ করেছে, যেমন, তা সেই বিতর্ককে উপস্থাপিত করেছে যেখানে ইসলামের অভ্যুত্থানের সমসময়ে মন্দিরের পুরোহিতদের সঙ্গে সমাজের অন্যান্য ব্রাহ্মণদের পারস্পরিক অবস্থানের দ্বন্দ্ব প্রকাশিত হয়েছে। এটা আশঙ্কার কারণ হয়ে উঠেছিল যেহেতু মন্দিরগুলি শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিল। কিছু মন্দিরকে লুঠ পাঠ করে অন্যান্য অর্থবান মন্দিরগুলির অনন্য স্থাপত্য নির্মাণ বন্ধ করা যায়নি।
ক্লাসিকাল সংস্কৃত কবিতা ও সাহিত্যের বহুবিধ ব্যাখ্যা, সংক্ষিপ্তসার ও আলোচনা সে সময় প্রচলিত ছিল। আঞ্চলিক ভাষায় তার রূপবদলের সঙ্গে সঙ্গে ব্যাকরণের ব্যাখ্যাও প্রয়োজন ছিল। নতুন এবং আগেকার দর্শনতত্ত্ব পাঠ্য হিসেবে আলোচনা করা হতো, যেমন, চতুর্দশ শতাব্দীর মাধবাচার্য প্রণীত সর্ব-দর্শন-সংগ্রহ। অদ্বৈত বেদান্ত ও মীমাংসাসূত্রের আলোচনায়ও এই বিষয় পাওয়া যায়, যা সমসাময়িক। অঙ্ক এবং মহাকাশবিজ্ঞানের আলোচনা উজ্জয়িনী থেকে বাগদাদ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল, ভারতীয় মেধার ক্ষুরধার পরিচয় সেখানে বিস্তৃত। ক্লাসিকাল হিন্দুস্থানী ও কর্নাটকী সঙ্গীত মহারাজা ও মুঘলদের সভায় এবং ধনীগৃহে পৃষ্ঠপোষকতা পেত।
এর সঙ্গে সঙ্গে সংস্কৃত, ফারসি উচ্চস্তরের সাহিত্য আঞ্চলিক ভাষায় রচিত হতে থাকে এবং রাজসভা ও বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর ধর্মীয় সভায় সমাদৃত হয়। এইসব রচনা সেই সময়কালের চিন্তা ও সৃজনশীলতাকে প্রতিফলিত করে, যেমন যথাক্রমে হিন্দি ও বাংলায় রামচরিতমানস ও কৃত্তিবাসী, বাল্মীকির রামায়ণ থেকে ছিল একেবারেই আলাদা। এমনকি, একটি বিকল্প ইতিহাসের একটি ধারা কথকতা বা গাথা হিসেবে গাওয়া হতো, সে গান গাইতেন লোকগায়ক ও চারণেরা, যারা সভাগায়কদের থেকে, বা সভাকবিদের থেকে ছিলেন একেবারেই আলাদা। এই হচ্ছে সেই অগণিত মানুষের কণ্ঠস্বর, যা আমরা মীরা আর সুরদাসের ভজনে এবং ত্যাগরাজের রচনায় প্রত্যক্ষ করেছি। আমরা আজকাল যারা আমাদের ঔপনিবেশিক শাসনে রেখেছিল আর তাদের যারা অনুগত সেবক ছিল, তাদের বাইরে আর কিছুকেই দেখতে পাই না।
ধর্মনিরপেক্ষতার কাজ
এটি আসলে অতীতের কতগুলি বিষয়ের উপর আলোকপাতের একটি বিক্ষিপ্ত প্রয়াস মাত্র। আমি ভারতবর্ষের ধর্মের প্রকাশে বহুত্বকে বিশেষ দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে চেয়েছি, যা বিভিন্নরকম জনগোষ্ঠীর আকারে এবং জাতপাতের পারস্পরিক সম্পর্কের মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হয়েছে। শেষ পর্যন্ত নাগরিক সমাজের উপর ধর্মীয় সংগঠনগুলির নিয়ন্ত্রণ বাতিল করা আমাদের সমাজকে সমতার দিকে নিয়ে যাবে। ধর্মনিরপেক্ষ সমাজ তৈরির পদ্ধতি সবসময়ই ধর্ম ও জাতপাতের দিকে নজর দেবে যাতে ধর্মের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যাখ্যার থেকে অন্যতর বিশ্লেষণ উপস্থিত করা যায়। আমরা আমাদের ধর্মের সঙ্গে আমাদের সমাজের সম্পর্কের বিষয়ে উপনিবেশবাদী তত্ত্বকে আন্তর্জাতিক পরিচিতি দিয়েছি এবং বিভিন্ন ধর্মীয় সংগঠনের কঠোরতার বাড়াবাড়ির মধ্যে দিয়ে তার ফলাফল ভোগ করছি। আমরা এগুলির মধ্যে কোনো কোনোটিকে রাজনৈতিক জমায়েতের হাতিয়ার করে তুলেছি। অতএব ধর্ম নিরপেক্ষতাকে আমাদের যথেষ্ট সংবেদনশীলতা, যত্ন ও চিন্তাশীল ভাবনার মধ্যে দিয়ে লালন করতে হবে। যদিও এটি কখনই একটি দ্রুত পরিবর্তন ঘটাবে না, কিন্তু ধর্মনিরপেক্ষ মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার জন্য মানসিক দৃঢ়তা তৈরি তো হবে চিত্তনসমৃদ্ধ ধর্মনিরপেক্ষ সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এবং গণতন্ত্রের সঙ্গে তার সংযোগসূত্রকে ব্যাখ্যা করতে হবে। ধর্মনিরপেক্ষ মানুষদের হত্যায় নিশ্চুপ থাকা কখনই জয়ী হতে পারে না— এটি কেবলমাত্র সন্ত্রাসকেই ছড়িয়ে দেবে এবং একদিন আজকে যারা সন্ত্রাস ছড়াচ্ছে তাদের দিকেই ফেরত আসবে। যদি ইতিহাস আমাদের একটি শিক্ষাও দিয়ে থাকে, তা হলো এই।
ধর্মনিরপেক্ষ সমাজ ও রাজনীতি মানে ধর্মকে ত্যাগ করা নয়। এর মানে হলো, যে কোনো ভারতীয়ের ধর্মীয় পরিচিতি, তা যে কোনো ধর্মের হোক না কেন, তার উপরে, ভারতীয় নাগরিক হিসেবে তার প্রাথমিক পরিচিতিকে প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আর রাষ্ট্রকে এই পরিচিতির সঙ্গে সঙ্গে আসা অধিকার, নাগরিকত্বের অধিকারকে গ্যারান্টি করতে হবে। এটা দাবি করে যে, এই মুহূর্তের যা জরুরি প্রয়োজন রাষ্ট্র সেই মানবাধিকার দেয় ও তা রক্ষা করে, এই ভাবনাকে সহজলভ্য করে তোলা যাবে না। এই পরিচিতি যখন মানবাধিকার এবং সামাজিক ন্যায়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত, তখন এটিকে সকলের জন্য প্রযোজ্য ধর্মনিরপেক্ষ রীতিনিয়মের শাসনে আনতে হবে।
সূচনাপর্ব দু’ভাবে শুরু হতে পারে। একটি শিক্ষার মধ্যে ধর্মনিরপেক্ষতাকে নিশ্চিত করা, অন্যটি হলো, দেওয়ানি আইনকে ধর্মনিরপেক্ষ করে তোলা। শিক্ষা মানে জ্ঞানের সমস্ত শাখায় প্রবেশে সমস্ত নাগরিকদের বিভাজন ব্যতিরেকে অধিকার। জ্ঞান মানে সময়োপযোগী আধুনিক তথ্য আর নবীনদের সেই শিক্ষায় শিক্ষিত করা যাতে তারা এইসব তথ্যকে গভীর জিজ্ঞাসু অনুসন্ধিৎসার মাধ্যমে যাচাই করে নিতে পারে। আমি এর সঙ্গে যোগ করতে চাইব নবীনেরা একথা জানুক মিলনের ইতিহাস বলতে কী বোঝায়। আমরা যেহেতু আমাদের দেশকে গণতান্ত্রিক বলে থাকি, আমরা নিশ্চয়ই এটি কত ভালোভাবে কার্যকর করা যায়, তা দেখব।
আমাদের দেওয়ানি আইনগুলি ঔপনিবেশিক আমলে তৈরি হয়েছিল, যদিও স্বাধীনতা পরবর্তীকালে তাতে কিছু কিছু পরিবর্তন আমরা এনেছি। ধর্মনিরপেক্ষতার দিকে মুখ ফেরাতে গেলে আমাদের খুঁজে দেখতে হবে যাতে বর্তমান আইনগুলিতে সেই নিশ্চয়তা আছে তো, যাতে সমস্ত নাগরিকের সমানাধিকার রক্ষিত হয়। দেওয়ানি আইন ও প্রত্যেক জাতিধর্মের আইনের মধ্যে বিরোধ নিষ্পত্তিতে আমাদের সেইসব জনগোষ্ঠীর সকলের সঙ্গে আলোচনা করতে হবে, শুধুমাত্র বর্তমানে প্রচলিত নিয়ন্ত্রক জাতি ও ধর্মের আইনগুলি দেখলে হবে না। একটি সর্বজনীন দেওয়ানি আইন মানে শুধুমাত্র কিছু ধর্মীয় আইনের বাইরে থাকা নয়। এর মানে হলো যৌথভাবে সব সামাজিক ও ধর্মীয় নিয়মের পুনর্বিবেচনা এবং একটি সাধারণ ধর্মনিরপেক্ষ রীতিনীতিতে উপনীত হওয়া। এই পদ্ধতিতে সংখ্যালঘু ও সুযোগ-সুবিধা কম পাওয়া মানুষ যারা জাতি, লিঙ্গ বা ধর্ম যে কোনো ধরনেরই হোক না কেন, তাদের বিরুদ্ধে চলা অসাম্য ও বঞ্চনার অবসান ঘটবে। আইন তখন আইন থাকে না, যখন পক্ষপাতমূলক বঞ্চনার সুযোগ তাতে থাকে। ধর্মনিরপেক্ষ সমাজের পথে যাত্রায় এটা সবচেয়ে বড়ো সমস্যা। আমাদের কি এখনই এ বিষয়ে কাজ শুরু করা উচিত নয়?
অতিরিক্ত ধার্মিকতার আবহ তৈরি করা— ধর্ম নয়, অতি ধার্মিকতার প্রদর্শনী— যা আমাদের চারপাশের জগতে চলছে, তা আমাদের কখনও কখনও আচ্ছন্ন করে তোলে আর বাস্তবজীবনের সমস্যার থেকে নজর সরিয়ে দেয় অথবা আমাদের সমাজ যেহেতু প্রতিযোগিতামূলক এবং নানা অনিশ্চয়তায় ভরা সেহেতু আমরা আচ্ছন্ন হয়ে পড়ি। এর বদলে আমরা কি এভাবে ভাবতে পারি যে, নাগরিকত্বের বাস্তবতা আমাদের সামাজিক কল্যাণ, আমাদের ভালো থাকা, আমাদের পৃথিবীকে বোঝা এবং আমাদের সকলের উন্নত জীবনের ইচ্ছাকে কার্যকরী করুক। ধর্মনিরপেক্ষ সমাজ রচনা এক রাত্রির বিপ্লব নয়। এটি একটি ঐতিহাসিক পদ্ধতি আর তার জন্য সময়ের প্রয়োজন। কিন্তু আশা করা যায়, রাষ্ট্র ও সমাজ এই নতুন পথে চলাকে স্বীকৃতি দেবে। ঔচিত্যবোধে সমৃদ্ধ মানবিক কাজ গণতন্ত্রের জন্য দরকার। ধর্মনিরপেক্ষ সমাজ গড়ে তোলা মানেই ঔচিত্যবোধের অগ্রগতি।
রোমিলা থাপার, গত ১৯শে আগস্ট ২০১৫ জামিয়া মিলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে
আসগর আলি ইঞ্জিনিয়ার স্মৃতি বক্তৃতা প্রদত্ত ভাষণ
অনুবাদ : মন্দিরা ঘোষাল