সীতারাম ইয়েচুরি
ভারতের ধারণা, সমৃদ্ধ আত্মিক, সাংস্কৃতিক, দার্শনিক ঐতিহ্য, প্রকৃতপক্ষে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক ভারতের ধারণা। সেই অন্তর্ভুক্তির ধারণা অর্থনৈতিক বিষয়গুলি এবং পরিচিতি – উভয় ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। অর্থনৈতিক বিষয়গুলির কথা বলতে গেলে, আপনি বেকারত্বের সমস্যা সমাধান করতে পারবেন না, যেমন আপনি আপনার নির্বাচনী ইশতেহারে বলেছেন, নিয়োগকর্তাদের ‘হায়ার অ্যান্ড ফায়ার’ করার অধিকার দেওয়ার মাধ্যমে, অথবা রাজস্থানে বিজেপি সরকারের বাস্তবায়িত পদক্ষেপের মতো, যেমন সংবাদ মাধ্যমের রিপোর্টে বলা হয়েছে। তাহলে, শ্রমজীবী মানুষের অধিকার কোথায়? এই পুরো বক্তৃতায় শ্রমিক শ্রেণী কোথায়? এই পুরো বক্তৃতায় কৃষি শ্রমিক কোথায়? এই পুরো বক্তৃতায় কৃষি শ্রমিকদের জন্য জাতীয় আইন কোথায়? তারা আমাদের সম্পদ তৈরি করে, মহাশয়। আমরা সবাই এখানে তাদের তৈরি সম্পদের উপর নির্ভর করেই টিকে রয়েছি। তাদের সম্পর্কে একটি শব্দ নেই।
আমরা কোন অন্তর্ভুক্তিমূলক ভারতের কথা বলছি তাহলে? এই কারণে, আমি মনে করি এই পুরো দৃষ্টিভঙ্গিতে কিছু খুব গুরুতর সমস্যাজনক বিষয় রয়েছে। যদি আমরা সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক এবং দার্শনিক ঐতিহ্যের কথা বলি, তাহলে আমাদের অবশ্যই সেটা মনে রাখতে হবে। ড. করণ সিংহ এখানে নেই। তিনি জম্মু ও কাশ্মীরের প্রথম সংবিধানে স্বাক্ষর করেছিলেন যখন এটি ভারতের সাথে যুক্ত হয়, যা সেই রাজ্যে এখনও কার্যকর আইন। তিনি আমাদের কক্ষের সদস্য। তিনি জানবেন যে তার শহর শ্রীনগরে একটি ছোট জায়গা ছিল যা এখন পুনরুদ্ধার করা হয়েছে। আমরা সবাই তা করতে সহায়তা করেছি, Standing Committee সহ। সেই জায়গাটি বিখ্যাত প্যারী মহল, যেখানে দারা শিকোহ সেই বিখ্যাত প্রবন্ধটি রচনা করেছিলেন যার নাম “মাজমা উল বাহরাইন”—দুই মহাসাগরের মিশ্রণ। তিনি বেদান্ত এবং ইসলামিক সুফিবাদের কথা বলেছিলেন, আমাদের দেশে কীভাবে এই সংকর সংস্কৃতি বিকশিত হয়েছিল, কীভাবে লক্ষ্যগুলি পূরণ হয়েছিল। আমরা শিখেছি, স্বামী বিবেকানন্দ বলেছিলেন, “বিভিন্ন নদী বিভিন্ন দিকে প্রবাহিত হয় কিন্তু শেষ পর্যন্ত একই মহাসাগরের জলেই মিলিত হয়।” কীভাবে সবার মিলন ঘটে এবং একটি সংকর সভ্যতার ভাবনার মধ্যে চলে আসে, সেটাই ভারত, স্যার।
এখন, কোনও বিষয়ে বিভাজন মূলক দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে করা সেটা সম্ভব নয়। যখন আমরা সমৃদ্ধ বৈচিত্র্যের কথা বলছি, আমি ফিরাক গোরাখপুরির কথা মনে রাখি। ফিরাক সাহেব, যেমন আমরা সবাই জানি, একটি উচ্চ বর্ণের হিন্দু হিসেবে জন্মগ্রহণ করেছিলেন, যার নাম ছিল রাঘুপতি সহায়। তিনি ইংরেজি পড়াতেন; এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজির অধ্যাপক ছিলেন। অসাধারণ উর্দু কবিতা লিখতেন। একদিন, আমাদের দেশে খুব খারাপ সাম্প্রদায়িক পরিবেশ ছিল কিন্তু আলাহাবাদে শের-শায়ারী চলছিল। আমাকে এটি বলার অনুমতি দিন, স্যার; আপনিও এটি উপভোগ করবেন। আলাহাবাদে শের-শায়ারী চলছিল এবং তাকে যোগ দিতে বলা হয়েছিল। তাকে বলা হয়েছিল, “কীভাবে হতে পারে যে আপনার শহরে শের-শায়ারী চলছে এবং আপনি এতে অংশ নিচ্ছেন না?” তিনি বলেছিলেন, “না, দেশের পরিবেশ খারাপ; আমি আজ কিছু বলতে চাই না। এটি আপনার যে ধরনের কবিতার লেখেন সেরকম সময় নয়।” মানুষ জোর করেছিল বলে তিনি বললেন, “ঠিক আছে, আমি সেখানে যাব এবং কেবল একটি শের পাঠ করব।” তিনি সেই পরিবেশে উর্দু কবিতার সম্পর্কে দুটি কথা বলেছিলেন—কবিতার একটি বড় সম্পর্ক ছিল উপভোগের সাথে, জীবনের সাথে, ইত্যাদি। তারপর উর্দুতে বলেছিলেন:
যদি আমরা ধর্ম, বর্ণ, বর্ণনা বা যাই হোক না কেন, অন্য ব্যক্তিকে মানব হিসেবে স্বীকৃতি না দিই, তাহলে ভারতই থাকবে না। যদি আপনি আমাদের দেশের বিভিন্ন ধর্ম, বর্ণ, শ্রমিক শ্রেণী বা কোটিপতি থেকে আসা লোকদের সমান হিসেবে স্বীকৃতি না দেন, তবে ভারতের কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না। তাই, যখন আপনি এই সাংস্কৃতিক, দার্শনিক ঐতিহ্য ইত্যাদির কথা বলেন, হ্যাঁ, গঙ্গা আপনি পরিষ্কার করেন, কিন্তু আপনি সেই গোদাবরীও পরিষ্কার করুন যেখানে আমি জন্মেছি এবং বড় হয়েছি, এবং পাশাপাশি কাবেরি ও পেরিয়ারও। দয়া করে সবকটাই পরিষ্কার করুন। গঙ্গা পরিষ্কার করা কিন্তু রাষ্ট্রপতির ভাষণের একটি অংশ। আপনার কাছে বেনারসের একজন সংসদ সদস্য ছিলেন।
গত দুই দশক ধরে, আপনার বেনারসের সংসদ সদস্য ছিলেন, বিজেপির প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট। শহরের মেয়রও বিজেপি থেকেই। কিন্তু হঠাৎ করে, এখন আপনি নতুন করে ভাবছেন যে গঙ্গা পরিষ্কার করা সম্ভব। যাই হোক, যদি আপনি এখন এটি করেন তবে খুবই ভাল। অবশেষে, স্যার, আমি তিনটি ডি’র কথায় আসছি। শেষ প্যারাগ্রাফে সেগুলোর কথা বলা হয়েছে। তিনটি ডি হল গণতন্ত্র(ডেমোক্রেসি), জনবিন্যাস (ডেমোগ্রাফি)এবং আমাদের পক্ষ থেকে চাহিদা (ডিমান্ড)। প্রথমে, আমি গণতন্ত্রের কথা বলব। প্রথমে, আপনি নির্বাচন সংস্কারের বিষয়ে চিন্তা করুন। আপনি জানেন এবং আমি জানি, আপনি এমন একটি রাজ্য থেকে আসেন যেখানে এই ধরনের অর্থ সাধারণত ব্যয় হয় না। তবে আপনি দেখেছেন যে এই নির্বাচনে কীভাবে বিষয়গুলি হ্রাস পেয়েছে। আমার মানে, আমাদের মতো দলের জন্য, এই নির্বাচনে কাজ করা অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে, কারণ আপনরা আমাদের দেওয়াল লিখন করতে দেন না; আমাদের পোস্টার লাগাতে দেন না। অথচ বৈদ্যুতিন মিডিয়ায় যাওয়ায় কোনও বিধিনিষেধ নেই; বিমান ভাড়া করে দেশে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় করার উপর কোনও বিধিনিষেধ নেই এবং তারপরে মানচিত্র এফোঁড়ওফোঁড় করে স্থানে স্থানে ঘুরে বেড়ানো চলবে।
এছাড়া, আইনটিতে অসঙ্গতি রয়েছে যে রাজনৈতিক দলের ব্যয়ের কোনও সীমা নেই। প্রার্থীদের জন্য বিধিনিষেধ রয়েছে, কিন্তু রাজনৈতিক দলের জন্য নেই। এই অসঙ্গতির মানে কী? এটি একটি খুব অস্বাভাবিক পরিস্থিতি। আপনি যদি এই বিষয়গুলি সংশোধন না করেন, তবে শুধুমাত্র অর্থশক্তি আপনার গণতন্ত্রকে বিকৃত করবে। আমরা এ সম্পর্কে আগেও বলেছি।
আমরা এত বছর ধরে নির্বাচনী সংস্কারের কথা বলছি, এর কিন্তু প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। সম্মানিত রাষ্ট্রপতিকে স্মরণ করিয়ে দিতে হবে যখন আমরা ধন্যবাদ জানিয়ে এ প্রস্তাবটি ফেরত পাঠাবো যে, আপনি নির্বাচনী সংস্কার নিয়ে আসুন এবং আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব প্রতিষ্ঠা করুন — ত্রিশ শতাংশ ভোট পেলে, আপনি সংখ্যাগরিষ্ঠ। চার বা পাঁচ শতাংশ ভোট পেলেও, আপনি কোনও আসন পান না। এটি পুরোপুরি অসঙ্গতিপূর্ণ। আমরা কী গণতন্ত্র? স্বাধীনতার পর থেকে একবারও আমাদের কেন্দ্রীয় সরকার ৫০ শতাংশের বেশি ভোটারদের সমর্থন পায়নি। ৫০ শতাংশ ভারতীয়দের ছেড়ে দিন, ৫০ শতাংশ মানুষেরও সমর্থন নেই যারা সরকারকে ভোট দিয়েছে। ভারতের যে কোনও সরকারকে সমর্থন করার চেয়ে বেশি মানুষ সরকারের বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছেন। এটা কী গণতন্ত্র?
গুরুতর চিন্তা করার প্রয়োজন। যদি আপনি গণতন্ত্র চান, যদি আপনি আমাদের পাশে জনসংখ্যাকে চান, আমাদের যুবকদের শক্তি দিন, যেমন আমি আগেই বলেছিলাম। তাঁদের স্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং কর্মসংস্থান দিন। হ্যাঁ, যদি আপনি যদি আমাদের দাবি জানতে চান, তাহলে জানাই যে মানুষের হাতে ক্রয়ক্ষমতা বাড়ান। আপনি সেটা শুধুমাত্র তখনই করতে পারবেন যখন আপনি
শ্রমিক শ্রেণী, কৃষি শ্রমিক এবং কর্মীদের যত্ন নেবেন। যখন সরকার পরিকাঠামোতে বিনিয়োগ করবে, তখন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে এবং সেই কাজ মানুষকে অর্থ দেবে।
অতএব, স্যার, যদি এইগুলি করা না হয়, তবে এই তিনটি ডি দেশের সেবা করতে পারবে না। তাই আমি আশা করি, এই গৌরবময় সংসদ, রাষ্ট্রপতির ভাষণের জন্য ধন্যবাদ জানিয়ে প্রস্তাবটি ফেরত পাঠানোর সময়, অত্যন্ত বিনীতভাবে তাঁকে এই বিষয়গুলির স্মরণ করিয়ে দেবে, যাতে তাঁর সরকার আগামী দিনে এই বিষয়গুলির সমাধানে উদ্বুদ্ধ হয়। আমি আশা করি, আমরা তা করবো, এবং এই আশা নিয়ে, আপনাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
ভাষান্তরঃ নবারুণ চক্রবর্তী