সুকান্ত কোঙার
আজ থেকে ৫৩ বছর আগে ১৯৭১ সালের ২ জুলাই কমরেড মহাদেব ব্যানার্জি কালনা স্টেশনে কংগ্রেসের ঘাতক বাহিনীর হাতে নিশংসভাবে খুন হন। তাঁর দেহে ৩৫ টি ছুরির আঘাত ছিল। পুঁজিপতি- জমিদারদের ঘৃণার প্রকাশ ছিল প্রতিটি ছুরির আঘাতে। স্বাধীনতার পরে কমিউনিস্ট পার্টি সমাজের সমস্ত অংশের মানুষের দাবী দাওয়া নিয়ে ধারাবাহিকভাবে আন্দোলন করেছে। সেই আন্দোলনের ফলে কমিউনিস্ট পার্টির প্রভাব ও জনপ্রিয়তা বাড়ে। কিন্তু ১৯৬৭ সাল ও তারপর থেকে ১৯৭০ এর দশকে আমাদের রাজ্যে দুর্বার কৃষক আন্দোলন গড়ে উঠেছিল মূলত গ্রামের হতদরিদ্র মেহনতি মানুষদের উপর ভিত্তি করে। খাস জমি এবং বেনাম জমি দখলের লড়াই-এ গ্রামের গরিব মানুষ অংশগ্রহণ করেছিলেন নিজেদের জীবনকে বাজি রেখে। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী)-র তদানিন্তন নেতৃত্ব শ্রমজীবী মানুষকে বোঝাতে সমর্থ্য হয়েছিলেন যে, একা বাঁচা যায় না- বাঁচতে গেলে ঐক্যবদ্ধ হতে হয়। কমরেড গফুর শেখ নিশ্চিত জীবনের সরকারি চাকরি ছেড়ে মেহনতি মানুষের মুক্তির লড়াইয়ে যুক্ত হন। তিনিও কংগ্রেসী ঘাতক বাহিনীর হাতে খুন হন। সব মিলিয়ে কালনা এবং তৎসংলগ্ন এলাকায় ৫২ জন কমরেড শহীদ হয়েছেন। সেই সময়ে আমাদের জেলা ও সারা রাজ্যে প্রায় ১১০০ এর বেশি কমরেড শহীদ হয়েছেন। সমাজ বদলের লড়াই কোন ফুল বিছানো পথে হয় না। কাঁটা বিছানোর পথেই এগোতে হয়। শহীদেরা এই শিক্ষাই আমাদের দিয়েছেন। তদানীন্তন সময়ে অবিভক্ত বর্ধমান জেলার কমিউনিস্ট আন্দোলনে যাঁরা নেতৃত্ব দিয়েছেন, কমরেড মহাদেব ব্যানার্জি ছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম।
কংগ্রেসের এই খুনে বাহিনীর কেউই পুঁজিপতি- জমিদার- জোতদারদের পরিবার থেকে আসেনি। তারা এসেছিল সাধারণ পরিবার থেকে। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় বৈষম্য বাড়ে, দারিদ্র বাড়ে, বেকারি বাড়ে। এই বেকার বাহিনীর একটা অংশকে বিপথগামী করে মেহনতি মানুষের আন্দোলনের নেতৃত্বকে খুন করার কাজে ব্যবহার করা হয়। চেতনা দিতে না পারলে যাদের নীতির জন্য তারা বেকার হয়, তাদের স্বার্থেই এরা ব্যবহৃত হয়।
বামফ্রন্ট সরকার আকাশ থেকে পড়েনি। এর পেছনে আছে অসংখ্য লড়াই, সংগ্রাম, আত্মত্যাগ ও অসংখ্য শহীদের জীবন। শ্রেণী সংগ্রাম, শ্রেণী সচেতনতা গড়ে তোলা ছাড়া যে কোন মার্কসবাদী পার্টির অগ্রগতির রাস্তা অবরুদ্ধ। এই শিক্ষা চিরকালীন। মেহনতি মানুষকে ভিত করেই পার্টিকে এগিয়ে যেতে হবে। পেশার ক্ষেত্রে দ্রুত পরিবর্তন ঘটছে। কৃষি ক্ষেত্রে কাজ দ্রুত কমছে। কৃষি থেকে উৎখাত হয়ে ব্যাপক মানুষ তাদের জীবিকা হিসেবে অসংগঠিত শ্রমিকের কাজকে বেছে নিচ্ছেন। তাই গ্রাম- শহরের খেতমজুর, গরিব কৃষক এবং অসংগঠিত শ্রমিকদের সংগঠিত করার ক্ষেত্রেই আমাদের মননিবেশ করতে হবে। যারা উৎপাদন করে তাদের সংগঠিত করার ক্ষেত্রেই আমাদের অগ্রাধিকার দিতে হবে।
অষ্টাদশ লোকসভা নির্বাচন শেষ হয়েছে। মন্দের ভালো যে বিজেপি একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি। বিভিন্ন ভাবনায় ভাবিত বিজেপি বিরোধী দলগুলিকে ঐক্যবদ্ধ করার ক্ষেত্রে সি পি আই (এম) একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এই নির্বাচনে এনডিএ জোট (৪৩.৩১%) এবং ইন্ডিয়া জোটের (৪১.৬৯%) ভোটের ব্যবধান মাত্র ১.৬২%। আসনের ক্ষেত্রে ফারাক ৫৮ টি। সাম্প্রদায়িক শক্তি নিশ্চিতভাবেই বিপদজনক, কিন্তু এরা অপরাজেয় নয়। যে লোকসভা কেন্দ্রের মধ্যে রামমন্দির নির্মিত হয়েছে, সেই লোকসভা কেন্দ্র ফয়জাবাদে বিজেপি পরাস্ত হয়েছে। ধর্মীয় উন্মাদনা অপেক্ষা রুটি রুজির বিষয়টি সামনে এসেছে। মন্দির নির্মাণকে কেন্দ্র করে তথাকথিত উন্নয়নের জন্য বিনা ক্ষতিপূরণে ব্যাপকতর মানুষের ঘরবাড়ি, দোকান ঘর ভেঙে দেওয়া হয়েছে। মানুষ তার যোগ্য জবাব দিয়েছেন। বিজেপি একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পেলেও বিজেপির বিপদকে ছোট করে দেখার কোনো অবকাশ নাই।
সারা দেশ জুড়ে বামপন্থীরা বিভিন্ন আন্দোলনে নেতৃত্ব দিলেও নির্বাচনী ফলাফলে তার প্রতিফলন ঘটছে না। যুক্তফ্রন্টের রাজনীতির সময়ে বামপন্থীদের জনসমর্থন বৃদ্ধির পরিবর্তে জনসমর্থন কমছে কেন, আশা করা যায় সেই বিষয়ে আমাদের পার্টির সর্বভারতীয় নেতৃত্ব সুনির্দিষ্টভাবে মূল্যায়ন করে প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন। ২০০২ সালে আমাদের পার্টির ১৭ তম পার্টি কংগ্রেসে পর্যালোচনা করে বলা হয়েছিল, “বুর্জোয়া দলগুলির পেছনে পেছনে হাঁটার প্রবণতা আমাদের পার্টি বা বামপন্থীদের শক্তি বৃদ্ধি না করে তাদেরই শক্তি বৃদ্ধিতে সাহায্য করে।” —“কমিউনিস্ট পার্টির ক্ষেত্রে এটি স্বতঃসিদ্ধ যে, যুক্তফ্রন্টীয় কৌশল চালাতে হবে পার্টির স্বাধীন কার্যক্রমের পাশাপাশি। বিশেষ করে বুর্জোয়া পার্টিগুলির সঙ্গে যুক্ত থাকার সময় পার্টি আন্তরিকতার সাথে স্বীয় স্বাধীন নীতিগুলি ও দৃষ্টিভঙ্গি জনগণের সামনে তুলে ধরবে নিজের মঞ্চ থেকে, এমনকি যখন সর্বজনীন মঞ্চ বা যৌথ নির্বাচনী মঞ্চ গড়ে উঠবে, তখনও। এই দলগুলির সঙ্গে যুক্তফ্রন্টীয় তৎপরতা চলাকালীন ও উত্থিত বিভিন্ন রাজনৈতিক ও মতাদর্শগত প্রশ্নে বুর্জোয়া দলগুলির সঙ্গে পার্টির অবস্থানে পার্থক্য টেনে দেওয়া জরুরী।
“১৯৯৮ সালে কেন্দ্রীয় কমিটিতে গৃহীত শুদ্ধিকরণ অভিযানের দলিল বুর্জোয়া দলগুলির সঙ্গে সম্পর্কের প্রশ্নে আরেকটি সমস্যার কথা উল্লেখ করেছিল। “১৯৯৭-পূর্ব বিগত দু’টি দশক ধরে উদ্ভূত পরিস্থিতির প্রয়োজনে, কৌশল হিসাবে বুর্জোয়া দলগুলির সঙ্গে এক ধরণের সমঝোতা, বিশেষত নির্বাচনী সমঝোতা করতে হয়েছে। এর ফলে পার্টিতে বুর্জোয়া কর্মপদ্ধতির অনুপ্রবেশের আশঙ্কা সৃষ্টি হয়। এইসব দলে টাকার জোর ও নানা অপকর্মের সাহায্যে যে সব কর্মকান্ড চলে তার দ্বারা আমাদের কর্মীরাও প্রভাবিত হয়ে পড়তে পারেন।”
ইতিমধ্যে বিজেপি-র নেতৃত্বে কেন্দ্রে জোট সরকার চলছে। ভারতীয় জনতা পার্টি ঘোষণা করেছে যে, পূর্বেকার মতই তারা ১৯৯০ এর দশকে কংগ্রেসের চালু করা ভয়ংকর জনবিরোধী নয়া উদারনীতির ভিত্তিতেই দেশের অর্থনীতিকে পরিচালনা করবে। সেইমতো কাজও এগিয়ে চলেছে। স্বৈরাচারী প্রবণতাও থাকছে। আমাদের মনে রাখতে হবে যে, ফ্যাসিবাদী চরিত্রের আরএসএস দ্বারা পরিচালিত বিজেপি কংগ্রেস সহ আর পাঁচটা পুঁজিপতিদের দলের মত নয়। তারা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে ভারতবর্ষকে হিন্দু রাষ্ট্রে পরিণত করতে চায়, যার সঙ্গে সাধারণ হিন্দুদের কোন স্বার্থ নাই। তাই আত্মতুষ্টির কোন অবকাশ নাই। প্রথম থেকেই বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকারের জনবিরোধী নীতির বিরুদ্ধে ধাক্কা দেওয়ার মতো আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।
পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থীদের বিপর্যয়কর ফলাফল অব্যাহত। সমস্ত স্তরেই গুরুত্ব সহকারে এই বিপর্যয়ের কারণ খুঁজতে হবে।
অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে। সেগুলি সম্পর্কে রাজ্য এবং কেন্দ্রীয় স্তরে পর্যালোচনা করতে হবে এবং কোন ত্রুটি থাকলে তা সংশোধন করতে হবে।
আমাদের রাজ্যে তৃণমূল কংগ্রেস বিগত ১৩ বছর ধরে রাজ্য সরকার পরিচালনা করছে। এই সময়ের মধ্যে রাজ্যে স্থায়ীভাবে গুন্ডাতন্ত্র চলছে, মূল্যবোধকে ধ্বংস করা হচ্ছে, বেকারের সংখ্যা ভয়ঙ্করভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। রাজ্যে সরকারের সমস্ত অঙ্গ প্রত্যঙ্গে দুর্নীতি। সাম্প্রদায়িক শক্তিকে মদত দিচ্ছে রাজ্যের তৃণমূল কংগ্রেস। এবারের লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেসের আসন ২২ থেকে বেড়ে ২৯ হয়েছে, বিজেপির আসন ১৮ থেকে কমে ১২ হয়েছে। কংগ্রেসের আসন ২ থেকে কমে ১ হয়েছে। তৃণমূল কংগ্রেসের ভোট ৪৩.২৭% থেকে বেড়ে ৪৫.৭৬% হয়েছে, অর্থাৎ বেড়েছে ২.৪৯%। অন্যদিকে বিজেপির ভোট ৪০.২৫% থেকে কমে ৩৮.৭৩% হয়েছে, অর্থাৎ কমেছে ১.৫২%। বাম এবং কংগ্রেসের মিলিত ভোট ২০১৯ সালে ছিল ১৩.০২%, ২০২৪ সালে হয়েছে ১১.০৩%, অর্থাৎ কমেছে প্রায় ২%।
একটা বিষয় প্রচার করা হচ্ছে যে, পশ্চিমবঙ্গে এবারের নির্বাচন অবাধ এবং সুষ্ঠু হয়েছে। এটা সর্বৈব মিথ্যা। তৃণমূল কংগ্রেসের সরকার থাকলে পশ্চিমবঙ্গে কোনদিনই অবাধ এবং সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। ভোটের দিনে বুথের ভেতরে ইভিএম এ নিজে বোতাম টেপাটাই যথেষ্ট নয়। এবারের নির্বাচনে এই অধিকারও অনেক ভোটার পাননি। কোন পরিবেশের মধ্যে মানুষ ভোট দিতে যাচ্ছে তা বিবেচনার মধ্যে রাখতে হবে। পশ্চিমবাংলায় ৩৬৫ দিন ২৪ ঘন্টা সন্ত্রাসের পরিমণ্ডলের মধ্যে মানুষকে বাস করতে হচ্ছে। ব্যাপক সংখ্যক বুথে বিরোধীরা কোন এজেন্ট দিতে পারেনি। এর মূল কারণ সন্ত্রাস। হুমকি দেওয়া হয়েছে যে, এলাকায় তৃণমূল কংগ্রেস না জিতলে বিভিন্ন ভাতা বন্ধ করে দেওয়া হবে। বিরোধী রাজনীতি করার জন্য বা বুথে বিরোধীদের হয়ে পোলিং এজেন্ট বসার জন্য রেশন কার্ড, জব কার্ড কেড়ে নেওয়া হচ্ছে, জমি চাষ বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে, ব্যবসা বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। ন্যায্য সার্টিফিকেট দেওয়া হচ্ছে না। কারখানায় শ্রমিকদের কাজে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। বাড়ির জল ও বিদ্যুৎ সংযোগ কেটে দেওয়া হচ্ছে। বিপুল পরিমাণ জরিমানা করা হচ্ছে। নির্বাচনের পরে অনেক বিরোধী কর্মী আক্রান্ত, ঘর ছাড়া। শারীরিক আক্রমণের থেকে ভাতে মারার আক্রমণ অনেকটাই বেশী। এই পরিমণ্ডলের মধ্যে অবাধ এবং সুস্থ নির্বাচন সম্ভব নয়। তৃণমূল কংগ্রেসের গুন্ডাতন্ত্রের বিরুদ্ধে ঝান্ডাবিহীনভাবে দলমত নির্বিশেষে সমস্ত মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। মনে রাখতে হবে, যে গরীব মানুষ তৃণমূলকে হটাবার জন্য বিজেপির হয়ে কাজ করেছে বা বিজেপিকে ভোট দিয়েছে তারা আমাদের শ্রেণীশত্রু হতে পারে না। তাদের পাশে আমাদের দাঁড়াতে হবে। পাশাপাশি সাধারণ সংখ্যালঘু পরিবার, যারা বিজেপিকে আটকাতে তৃণমূল কংগ্রেসকে ভোট দিয়েছে তারাও আমাদের শত্রু হতে পারে না। ধৈর্য সহকারে তাদের বোঝাতে হবে যে, তৃণমূল কংগ্রেস বিজেপিকে প্রতিষ্ঠিত করতে সাহায্য করেছে এবং এই কাজ তারা করে চলেছে।
পশ্চিমবাংলায় হিন্দু সম্প্রদায়িক শক্তি যেমন সক্রিয়, একইভাবে মুসলিম সাম্প্রদায়িক শক্তিও সমানভাবে সক্রিয়। মুসলিম মৌলবাদীরা বিভিন্নভাবে তৃণমূল কংগ্রেসকে মদত দিচ্ছে। তৃণমূল কংগ্রেসও সাম্প্রদায়িকতাকে ব্যবহার করছে। হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে প্রচারের সঙ্গে সঙ্গে মুসলিম সম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধেও আমাদের প্রচার গড়ে তুলতে হবে। পশ্চিমবাংলায় মুসলিম সাম্প্রদায়িক শক্তি আর এস এস এর হাতকে শক্তিশালী করছে। এদের উভয়ের আসল উদ্দেশ্য হলো বামপন্থীদের বিচ্ছিন্ন করা এবং মেহনতি মানুষের ঐক্যকে দুরমুস করে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার লুঠকে টিকিয়ে রাখা। শ্রেণী দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে এদের উভয়ের মুখোশকে খুলে দিতে হবে। সাম্প্রদায়িকতার দর্শনে আক্রান্ত মানুষজনের দিকে মুখ ফিরিয়ে থাকলে তাদের জিতে আনা যাবে না। তাদের বিষমুক্ত করতে হলে নিবিড় সম্পর্ক গড়ে তুলে তাদের চেতনা বৃদ্ধি করেই এই কাজ করতে হবে। এটাই কমিউনিস্টদের কাজ।
কানের গোড়ায় প্রতিনিয়ত শূন্যের ঢাক বাজানো হচ্ছে। ফলাফল খারাপ হলে কমিউনিস্টদের দুঃখ হবে- এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু হতাশ হবো কেন? কমিউনিস্ট পার্টিটা কি ভোটের পার্টি নাকি? কমরেড ইএমএস নামমুদ্রিপাদ বলেছেন, “বুর্জোয়া ও পেটি বুর্জোয়া পার্টিগুলির পক্ষে নির্বাচনে জয়ী হওয়া, সরকার গঠন করা প্রভৃতি হল তাদের রাজনীতির একমাত্র লক্ষ্য, আমাদের ক্ষেত্রে কিন্তু তা নয়। আমাদের পার্টির প্রধান কাজ হলো জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের জন্য জনসাধারণকে প্রস্তুত করা, এ কাজের অধীনস্থ হিসাবেই (সরকার গঠন সমেত) নির্বাচনের রাজনীতিকে আমাদের পার্টি দেখে থাকে।” কমরেড মুজাফফর আহমেদের শিক্ষা হচ্ছে, “সাধারণ মানুষের চেতনাতে যদি পরিবর্তন আনতে হয়, যদি আমরা চাই যে দেশের জনসাধারণ আমাদের মত ও পথ কি তা বুঝে নিয়ে আমাদের ভোট দিতে এগিয়ে আসুন, তবে আমাদের নির্বাচনের প্রচারও বিশেষ ধারায় চালাতে হবে। মুখে কেবল কথার খই ফোটালে হয়তো আমরা কিছু লোককে আমাদের দিকে টানতে পারবো, হয়তো কিছু লোক আমাদের কথার তোড়ে ভেসে এসে আমাদের পার্টিকে ভোটও দিয়ে যাবেন, কিন্তু সে ভোট সচেতন লোকের ভোট হবে না। ভোট পাওয়ার পরও আমরা জোর করে বলতে পারব না যে, আমাদের পক্ষের লোক আমাদের পার্টিকে ভোট দিয়ে গেলেন। এই যদি অবস্থা হয় তবে একথা স্বীকার করতে হবে সে ভোট পেয়েও আমাদের পার্টি লাভবান হলো না। যাঁরা না বুঝে আমাদের ভোট দিয়ে গেলেন তাঁরা আবার না বুঝে পরের দিন অন্যের পক্ষে চলে যেতে পারেন।” নেতৃত্বের উপরোক্ত বক্তব্য আমরা ভুলে যেতে পারি না। এই দৃষ্টিভঙ্গি নিয়েই আমাদের নির্বাচনী সংগ্রাম পরিচালনা করতে হবে। এই লক্ষ্যকে সামনে রেখেই কমিউনিস্ট পার্টিকে এগিয়ে যেতে হবে। যাঁরা হতাশ হচ্ছেন তাঁদের মনে করিয়ে দিতে হবে যে- কমিউনিস্ট পার্টির মূল লক্ষ্য ভোটে জেতা নয়, সমাজ ব্যবস্থার পরিবর্তন করা। এই লক্ষ্যকে সামনে রেখে যদি কমিউনিস্ট পার্টি এগোয়, তাহলে সেখানে হতাশার কোন স্থান নেই।
লড়াইয়ের ময়দানে জয় পরাজয় থাকবে। তার মধ্য দিয়েই কমিউনিস্টদের এগোতে হবে। পুঁজিবাদ তার সংকট থেকে বেরোতে পারবে না। মেহনতী মানুষের দুর্ভোগ বাড়বে, মেহনতী মানুষের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক গড়ে তুলে তাদের সমস্যাগুলিকে চিহ্নিত করে তাদের সঙ্গে নিয়ে আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। রাজ্যে শিল্প নাই, কাজ নাই। হাজার হাজার বেকার ছেলে পরিবার পরিজন ছেড়ে সামান্য আয়ের জন্য অন্য রাজ্যে চলে যেতে বাধ্য হচ্ছে। রাজ্যে সরকারি শিক্ষা ব্যবস্থা লাটে উঠেছে। গুন্ডাতন্ত্র ও দুর্নীতিরাজ চলছে। এটা আরও বাড়বে। যে ক্ষোভ তৈরি হবে, সেই ক্ষোভকে কিছু ভাতা দিয়ে প্রশমিত করতে পারবে না।
সহজ, সরল কোন রাস্তা নেই। কিন্তু রাস্তা আছে। রাস্তা একটাই। সে রাস্তা হল শ্রেণী সংগ্রাম, শ্রেণী সচেতনতা এবং নিরবিচ্ছিন্ন লড়াই। নিজের শ্রেণীর কাছে যেতে হবে। তাদের দাবি নিয়ে লড়াই করে এগোতে হবে। বিভিন্ন পাড়ায়, বিভিন্ন এলাকায় মানুষের অসংখ্য সমস্যা আছে। সমস্যাগুলিকে চিহ্নিত করে এলাকার মানুষকে সঙ্গে নিয়ে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। শোষণের সমাজব্যবস্থাই যে মেহনতি মানুষের দুঃখের কারণ, নিরবিচ্ছিন্নভাবে তা বলে যেতে হবে। এই সমাজ ব্যবস্থায় যারা উৎপাদন করে তারাই সব কিছু থেকে বঞ্চিত। এর বিরুদ্ধে লড়াই আর প্রতিবাদই একমাত্র রাস্তা।
জনগণের চেতনা বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজন চেতনা সম্পন্ন রাজনৈতিক কর্মী, বিশেষত শ্রমজীবী পরিবার থেকে আসা কর্মী। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা দরকার যে ২৭-৩১ ডিসেম্বর ২০১৫ কলকাতায় অনুষ্ঠিত সংগঠন সম্পর্কিত সর্বভারতীয় প্লেনামে যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় তার ১.৭৪ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, “যদি দৃঢ়তার সঙ্গে শ্রেণী ও গণ সংগ্রাম পরিচালনা করতে হয় তাহলে মৌলিক শ্রেণী ও নিপীড়িত অংশের মধ্যে থেকে যথেষ্ট কর্মী সংগঠনে থাকা দরকার।” এই বিষয়ে পরিকল্পিত উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। গভীর আত্মবিশ্বাস এবং আত্মপ্রত্যয় নিয়েই আমাদের এগোতে হবে। কমরেড বিনয় কোঙারের ভাষায়, “সংকট ও প্রতিআক্রমনেই বিপ্লবীদের পরীক্ষা। মার্কসবাদ লেনিনবাদের বিজ্ঞানের উপর বিশ্বাসের ভিতকে দৃঢ় করেই বিপ্লবীদের বুক টান করে দাঁড়াতে হবে।” বাস্তব পরিস্থিতি আজ আমাদের কাছে এই দাবিই করছে।
প্রতি বছর আমরা ২ জুলাই পালন করি কোন ব্যক্তিপূজা করার জন্য নয়। কিভাবে শ্রমজীবী মানুষের মুক্তির জন্য, শোষনের সমাজ ব্যবস্থার পরিবর্তনের জন্য এই শহীদেরা জীবন দিয়েছেন, তা আমরা স্মরণ করি। এই আদর্শকে অবলম্বন করেই আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। লাল ঝান্ডাই একমাত্র রাস্তা। জয় আমাদের হবেই। কমরেড স্তালিনের কবিতা দিয়ে শেষ করছি। “অন্তহীন মেহনতে বেঁকে গেছে যাদের জীবন, আমি জানি একদিন তারা মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে।” শহীদেরা জীবন দিয়েছেন এদের জন্য।
অমর শহীদ লাল সেলাম।