নগরায়নের দাপটে এখন শহরে আসা মানুষের ভিড় বাড়ছে। একদা কৃষিনির্ভর রাজ্যের মানুষের সংখ্যাগরিষ্ঠের আয় এখন নির্ভর করছে কৃষিক্ষেত্রে নয় বরং শিল্প এবং পরিষেবা ক্ষেত্রের ওপরে। ফলে পেটের টানে বাঁচার দায়ে শহরে ভিড় বাড়ছে মানুষের ।
পুঁজির দাপট শহরের ভিড়ে
কিন্তু শহরে ভিড়ের সাথে তাল রেখে শহরের ভৌগোলিক এলাকা যখন বাড়তে পারে না ফলে তখন শহর বাড়ে উচ্চতায় ।এভাবেই উত্তরোত্তর বেড়ে চলে শহর জুড়ে জনঘনত্ব আর বাড়ির ঘনত্ব। এই প্রেক্ষিতে নির্মাণের বহর বাড়ছে শহর এবং শহরতলি জুড়ে। দোকান বাজার রাস্তাঘাট থেকে শুরু করে উড়ালপুল , সুড়ঙ্গ নির্মাণের চাহিদা যেমন বাড়ছে তেমন বেড়ে চলেছে বাস্তুতন্ত্রের ঝুঁকি । বাড়ছে নির্মাণ ক্ষেত্রে পুঁজির দাপট ফলে বাড়ছে পরিবেশের বিপদ। এমন প্রেক্ষিতে নির্মাণ ক্ষেত্রের ওপর কাঙ্খিত নিয়ন্ত্রন জরুরি শহরের নাগরিক সুরক্ষার স্বার্থেই। কারন নির্মাণ যখন পুঁজির বিনিয়োগের নতুন গন্তব্য হয় তখন তার চরিত্র হয়ে কেবল মুনাফা এবং মুনাফা। তখন নির্মাণ ক্ষেত্র জুড়ে যেমন সাদা এবং কালো টাকার অনুপ্রবেশ ঘটে তেমনি তৈরি হতে থাকে বৈধ এবং অবৈধ নির্মাণের বিভিন্ন রূপ। আর অবৈধ নির্মাণের তেমন দাপটে শহরের নাগরিকেরা যে কতোটা অরক্ষিত সেটা আবার প্রমানিত হল সম্প্রতি গার্ডেনরিচের বহুতল বিপর্যয়ের ঘটনায়।
অবৈধ নির্মাণ – নিয়ন্ত্রক পুরসভা
শহরের এমন বেআইনি নির্মাণ রোখার প্রাথমিক দায়িত্বে থাকা পুরসভার মহানাগরিক অসহায় ভঙ্গিতে শহরের বেআইনি নির্মাণকে সামাজিক ব্যাধি হিসাবে চিহ্নিত করলেও তার প্রতিকারের রূপরেখা সম্পর্কে কার্যত নীরব থেকেছেন তিনি। সাম্প্রতিক অতীতে বহুবার তিনি বেআইনি নির্মাণকে পুলিশ প্রশাসনকে কাঠগড়ায় তুললেও এমন নির্মাণ রোধে তেমন কোন কার্যকরী ব্যবস্থা দেখেনি নগরবাসী। ইতিমধ্যে রাজ্যের মানুষ ‘ সরষের মধ্যে ভুতের’ প্রয়োগ রুপ দেখেছে শিক্ষা , আবাস কিংবা রেশন দুর্নীতির মতো গুরুতর জনস্বার্থের বিষয়ে। ফলে গার্ডেনরিচের এমন বহুতল বিপর্যয়ের পর সেই অবৈধ নির্মাণের বীজ পুরসভার অন্দরে পোঁতা রয়েছে কিনা সেই প্রশ্ন সঙ্গতকারনেই জোরালো হচ্ছে। কারণ বিরোধীশূন্য পুরসভার পুরপ্রতিনিধিদের নজর এড়িয়ে যেখানে একটা চালাঘর উঠতে পারে না সেখানে আইন ভেঙে একটা আস্ত বহুতল কি করে গড়ে উঠলো গোটা পুরসভাকে মূক এবং বধির বানিয়ে সেটাই এখন জরুরি প্রশ্ন ! এমনি আরও কিছু প্রশ্ন তুলে আসছে এমন বিপর্যয়ের পর যেগুলির উত্তর খোঁজা জরুরি জনস্বার্থেই।
প্রশ্নের মুখে আইনের শাসন
দেশ , রাজ্য কিংবা স্থানীয় স্তরে পুরসভার মতো নির্বাচিত সাংবিধানিক সংস্থাগুলির প্রাথমিক লক্ষ্য আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা। কিন্তু পরিবর্তে শাসকের আইন প্রতিষ্ঠিত হলে সেই প্রাতিষ্ঠানিক দায়বদ্ধতা যে ক্ষুণ্ণ হয় সেটা ক্রমশ স্পষ্ট হচ্ছে নির্মাণ ক্ষেত্রে অবৈধ নির্মাণের দাপটে। ফলে আইন ভঙ্গের হোতারা এক্ষেত্রে যে শাসকের ছত্র ছায়ায় নিরপদে আছে সেটাও প্রমানিত হচ্ছে। ফলে নির্মাণের ক্ষেত্রে সুস্পষ্ট আইন থাকা স্বত্বেও সেগুলির প্রয়োগ না হলে কাঠগড়ায় উঠবে পুরসভা এবং প্রশাসন। যে কোন দেশেই নির্মাণ ক্ষেত্র সেদেশের পরিকাঠামো এবং পরিষেবার বিকাশে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই প্রেক্ষিতে পরিষেবা কেন্দ্রিক অর্থনীতিতে সরকার রিয়েল এস্টেট প্রমোটার এবং ডেভলপারদের সাথে আইনের আপোষ করলে নাগরিকদের নিরাপত্তা সবচেয়ে বেশি বিপন্ন হয় । গত বছর তুরস্কের ভুমিকম্পে পঞ্চাশ হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছিল কনক্রিটের বাড়ি ভেঙে ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে । এমন ভেঙে পড়া বাড়ির সিংহভাগ ছিল বেআইনি ভাবে নির্মিত বাড়ি। বেআইনি নির্মাণ কোন সময়েই রাতের অন্ধকারে চুপি সারে ঘটেনা বরং প্রকাশ্যে দিবালোকে চলে। সেই নির্মাণ আটকানো সাইবার হানা প্রতিহত করার মতো মেধা নির্ভর নয়। কিন্তু প্রশাসনিক সদিচ্ছার অভাব ঘটলে অবৈধ নির্মাণ হানাও যে রোখা যায় না সেটা প্রমান হল গার্ডেনরিচের বহুতল বিপর্যয়ে। ইতিমধ্যে উত্তরপ্রদেশের নয়ডা শহরে দুটো বত্রিশ তলা বেআইনি বহুতল সেখানকার পুর প্রশাসন ভাঙতে বাধ্য হয়েছিল সুপ্রিম কোর্টের আদেশে। এই ঘটনার পর দেশের আম জনতার মনে হয়েছিল যে অবৈধ নির্মাণ রুখতে ‘ অচ্ছে দিন ‘ এলো বলে কিন্তু গার্ডেনরিচের ঘটনা সে গুড়ে বালি প্রমান করে দিল।
অবৈধ নির্মাণ- মরণ ফাঁদ
বেআইনি নির্মাণের ক্ষেত্রে সবচেয়ে ভয়ের কথা হল নির্মাণের মানের সাথে আপোষ । বাড়তি লাভের লোভে সিমেন্ট কিংবা ইস্পাতের মানের সাথে আপোষ কিংবা পর্যায়ক্রমিক নির্মাণের সময়সীমার সাথে আপোষ নির্মাণ চলাকালীন কিংবা নির্মাণ পরবর্তী সময়ে ডেকে আনতে আনতে পারে বিপর্যয়। এমনকি তেমন বাড়িগুলির সার্বিক বিপর্যয় না ঘটলেও নির্মাণের অব্যবহিত পর থেকেই নানা রোগ ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে দ্রুত ঘটে সেগুলির আয়ু ক্ষয়। ফলে গাঁটের কড়ি খরচ করে অবৈধ বাড়ি কিনে প্রতারিত হয় ক্রেতারা এমনকি মরণ কুপের মধ্যে বাস করতে থাকেন নিজেদের অজান্তেই। এর পাশাপাশি পুর নির্মাণ বিধি উপেক্ষা করে দুটি বাড়ির মধ্যেকার কাঙ্খিত ছাড়ের জমি না রাখলে সেই বাড়িগুলিতে কেবল প্রকৃতির আলো বাতাসের পথ অবরুদ্ধ হওয়ার বিপদ নয় বরং সেই বাড়ির বিপদ বহুগুনে বেড়ে যায় অগ্নি কাণ্ড কিংবা ভুমিকম্পের সময় । একেবারে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে দাঁড়িয়ে থাকা বাড়িগুলির ভিতের মাটিতে প্রবল চাপ তৈরি হওয়ার কারনে সেই সমস্ত বাড়ি প্রাথমিকভাবে হেলে পড়া এমনকি পরবর্তীতে ভেঙে পড়ার সম্ভাবনা প্রবল।
শহরে পুরসভা বয়সের ভারে দুর্বল কয়েক হাজার বিপজ্জনক বাড়ি চিহ্নিত করলেও সেগুলি যেমন ভেঙে ফেলা যায়নি ঠিক তেমনি যায়নি চিহ্নিত বহু অবৈধ নির্মাণ ভাঙার কাজ । এমন ক্ষেত্রে মানবিকতার দোহাই দিয়ে সেই নির্মাণ গুলিকে টিকিয়ে রাখার অর্থ মানুষের প্রানের ঝুঁকি বাড়িয়ে তোলা। ফলে এমন বিপজ্জনক এবং অবৈধ নির্মাণ ভাঙার পাশাপাশি বিকল্প পুনর্বাসন ভাবনার রূপরেখাও তৈরি করা উচিৎ পুর প্রশাসনের। এই প্রেক্ষিতে এমন বহুস্তরীয় বেআইনি নির্মাণ চিহ্নিত করতে উন্নত প্রযুক্তি নির্ভর ব্যবস্থার কথা বিশেষ গুরুত্ব দিয়েই আজ ভাবতে হবে। শহরের মহানাগরিকের দাবী মেনে এমন সংক্রামক ব্যাধি দূর করতে এলাকার মানুষকে সামিল করতে হবে । বাম আমলে এই লক্ষ্যে ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে নাগরিকদের নিয়ে তৈরি হওয়া নাগরিক কমিটি কিংবা যে মঞ্চ ছিল হাল আমলে তার পাট তুলে দিয়েছে বর্তমান পুরবোর্ড । ফলে সামাজিক ব্যাধি নিরসনে সমাজ রয়ে গেছে ব্রাত্য। আর দুষ্কৃতীরা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে সিন্ডিকেটের জাল বেঁধে শহরের এই প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে ।
পুকুর ধরো -পুকুর ভরো
অবৈধ নির্মাণের সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে গেছে অবৈধ জমিতে নির্মাণ । বলাই বাহুল্য শহরে বাসের জমি , জলাজমি , শিল্পের জমি , ব্যবসার জমি , রাস্তার জমি এভাবেই চিহ্নিত হয় সরকারি নথিতে । কিন্তু হাল আমলে শহরের জলাভুমি ভরাট করে অবৈধ নির্মাণ কার্যত এক সংক্রামক ব্যাধির চেহারা নিয়েছে। একদিকে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মুখে জেলায় জেলায় জল সঞ্চয়ের লক্ষ্যে ‘ জল ধরো জল ভরার ‘ ডাক দিচ্ছেন আর তাঁরই দলের প্রশ্রয়ে শহর-শহরতলি জুড়ে জমির দালাল জমি হাঙরেরা ‘ পুকুর ধরো পুকুর ভরো ‘ প্রকল্প বাস্তবায়িত করে চলেছে প্রশাসনকে পকেটে পুরে। জমির এমন চরিত্র বদলে রাজ্যের শাসক দলের কেরামতি দেখেছে রাজ্যের মানুষ সন্দেশখালি কাণ্ডে । উপকুলজুড়ে সেখ সাজাহানেরা লোভ লালসা আর লুটের নেশায় যেভাবে চাষের জমিতে নোনা জল ঢুকিয়ে ভেড়ি বানিয়ে চলেছে তেমনই শহর এলাকায় জলাভুমি , পুকুর , নালা , খাল বুজিয়ে জমির চরিত্র বদলে তার ওপরে অবৈধ নির্মাণ চলছে রম রমিয়ে। সম্প্রতি কলকাতার এক পাঁচতারা বিশ্ববিদ্যালয় এবং রাজ্য সরকারের তথ্য প্রযুক্তি দপ্তরের যৌথ উদ্যোগে কলকাতা শহরের পুকুর সমীক্ষার রিপোর্টে বেরিয়ে এসেছে যে ২০০৪ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত গার্ডেনরিচ মেতিয়াবুরুজ বিপর্যয় সংলগ্ন এলাকার পাঁচটি ওয়ার্ডে ২৭০ টি পুকুর ভরাট করা হয়েছে । এক্ষেত্রেও জলাভুমি পুকুর ভরাটের বিরুদ্ধে রাজ্যে কড়া আইনি ব্যবস্থার কথা থাকলেও প্রশাসন ব্যর্থ হয়েছে এই জলাভুমি ভরাট রুখতে । ফলে বেআইনি নির্মাণের বৃহত্তর প্রেক্ষিতে আজ স্পষ্ট হচ্ছে যে প্রশাসন আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা প্রতিষ্ঠা করতে ব্যর্থ হওয়ার কারনেই বাড়ছে এমন বিপর্যয় ।
ছবিঃ সোশ্যাল মিডিয়া থেকে প্রাপ্ত