২০ জানুয়ারী ২০২৩ (শুক্র বার)
বাংলা ১৯২৮ সালে ১৪ ই জুন আর্জেন্টিনার রোজারিওতে জন্ম। নানান শারীরিক অসুস্থতা সত্ত্বেও প্রচুর অধ্যাবসায়ের মাধ্যমে বুয়েনেস আইরস থেকে চিকিৎসাশাস্ত্রে স্নাতক। চাইলে খুব সহজেই এক নিশ্চিত, অর্থনৈতিকভাবে সচ্ছল জীবন যাপন করতে পারতেন। কিন্তু স্রেফ নিজের ভালো থাকার, একা বাঁচার আদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন না কোনদিনই। নিশ্চিত জীবন ছেড়ে গোটা দুনিয়ার লাখো মুক্তিকামী মানুষের পক্ষ নিয়ে নেমে পড়লেন লড়াইতে।
২০০০ সালে টাইম ম্যাগাজিন তাঁকে বিংশ শতকের অন্যতম প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব বলে চিহ্নিত করেছিল।মাথায় কালো তারকাখচিত টুপি (বেরেই)। অযত্নে বেড়ে ওঠা গোঁফ, দাড়ি, চুল। চোখ দুটো থেকে ঠিকরে বেরোচ্ছে ক্রোধের আগুন। যে অপলক দৃষ্টির দিকে তাকালে শত্রুর বুকে কাঁপন ধরে…আজও। চে— রোম্যান্টিক, সংগ্রামী,এক আপোষহীন বিপ্লবী।
গুয়াতেমালায় রাজনৈতিক কার্যকলাপের দায়ে মেক্সিকোতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। সেখানেই দেখা ফিদেল কাস্ত্রোর সাথে। এই পরিচয় তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। সেই সুযোগ এনে দেয়, যার অপেক্ষায় ছিলেন অনেকদিন ধরে। গ্রানমা জাহাজে উঠে বসেন। যুদ্ধের লক্ষ্যে, বিপ্লবের লক্ষ্যে, গোটা দুনিয়ায় নিপিড়িত, শোষিত মানুষের মুক্তির লক্ষ্যে এগিয়ে চললেন গেরিলা বাহিনীর কমান্ডার।
চে মনে করতেন, যেসব দেশে স্বৈরতান্ত্রিক সরকারের শাসন চলছে, যা কোনোভাবেই দেশের জনগণকে নাগরিক স্বাধীনতা দিতে রাজি নয়, সেইসব দেশে গেরিলা যুদ্ধই মুক্তির রাস্তা। গেরিলা যুদ্ধকে তিনি বলেছেন জনগণের যুদ্ধ। গেরিলারা নিরস্ত্র জনগণের সশস্ত্র সত্তা, তাই জনগণের সমর্থন ছাড়া গেরিলা যুদ্ধ চালাতে গেলে বিপর্যয় অনিবার্য। তবে গেরিলা যুদ্ধই মুক্তির একমাত্র উপায় নয়। চে তেমনই মনে করেন।তিনি সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, “যেখানে কোনো সরকার জনগণের ভোটের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসেছে, জালিয়াতি করে বা না করে, এবং অন্ততপক্ষে সাংবিধানিক বৈধতা বজায় রেখেছে, সেখানে গেরিলা যুদ্ধ শুরু করা অসম্ভব, যেহেতু নাগরিক সংগ্রামের সম্ভাবনা এখনও শেষ হয়নি।” কোনও দেশের স্বৈরাচারী, একাধিপত্যকামী সরকার যদি আপাত সাংবিধানিক স্বাধীনতার মুখোশ বজায় রাখে, সেখানে গেরিলা যুদ্ধের মাধ্যমে শোষণহীন সমাজ গড়ার চেষ্টা ফলপ্রসূ হওয়া কঠিন।
সর্বহারার আন্তর্জাতিকতার আদর্শে উদ্বুদ্ধ ছিলেন চে। সফল বিপ্লবের পর ফিদেলের নেতৃত্বে তৈরি হওয়া নতুন বিপ্লবী সরকারে জাতীয় ব্যাংকের প্রধান ও শিল্পমন্ত্রীর দায়িত্ব সামলেছেন। খ্যাতির শীর্ষে থাকা অবস্থায় ২৯৬৫ সালের এপ্রিল মাসে চিঠি দিয়ে কমান্ডারের পদ সহ সমস্ত দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নিয়ে, কিউবার নাগরিকত্ব ছেড়ে দিয়ে ছদ্মনামে বাণিজ্যিক বিমানে পৌঁছে যান কঙ্গো। কঙ্গোতে ১৯৬৫ সালের এপ্রিল থেকে ডিসেম্বর মাস অব্দি ছিলেন। শুধু গেরিলা যোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া নয়, তাদের পাশে থেকে লড়াইও করেছিলেন। পরে তিনি বলিভিয়া পাড়ি দেন একই উদ্দেশ্যে। বিপ্লবের প্রয়োজনে, এই পচা গলা সমাজব্যবস্থাকে বদলে এক নতুন উন্নত সমাজ ব্যবস্থা গঠনের লড়াইয়ে সামনের সারিতে থাকার জন্য মন্ত্রিত্ব ছেড়ে প্রথমে কঙ্গো ও পরে বলিভিয়ার যাত্রা চে কে এক অনন্য রোমান্টিকতায় পর্যবসিত করেছে। তবে এটা জেনে রাখা ভালো যে রোমান্টিকতার উপাদানের থেকেও বেশী গুরুত্বপূর্ণ ছিল সাম্রাজ্যবাদ বিরোধীতার ভাবনা।সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে বিপ্লবীদের ঐক্য গড়তে প্রলেতারীয় আন্তর্জাতিকতাবাদের আহ্বান জানিয়েছিলেন চে। মনে করতেন সাম্রাজ্যবাদকে নির্মূল করার যুদ্ধ হবে দীর্ঘ ও রক্তাক্ত। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সম্মেলনে প্রদত্ত ভাষণ থেকে তিনি তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলির সাধারণ বিপদ হিসাবে চিহ্নিত করেছেন সাম্রাজ্যবাদ ও নয়া-উপনিবেশবাদকে। এই দেশগুলিকে একইসাথে সাম্রাজ্যবাদ ও পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ডাক দিয়েছেন। প্রতিটি অনুন্নত দেশকে সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সাহায্য করা সমাজতান্ত্রিক দেশগুলির কর্তব্য হিসাবে চিহ্নিত করেছেন। ফিদেল কাস্ত্রোর মতে, “মার্কসবাদী-লেনিনবাদী চিন্তাধারার সবচাইতে বিপ্লবী প্রকাশ ঘটিয়েছেন চেয়ে সর্বহারার আন্তর্জাতিকতার আদর্শকে যে যেভাবেই উন্নীত করেছেন আমাদের সময়কালে আর কেউ তা করেনি।”
নীতির প্রশ্নে অবিচল। নিজে যা বিশ্বাস করতেন তার জন্য বেপরোয়া হতে দুবার ভাবেন নি। “হাঁটুমুড়ে বেঁচে থাকার থেকে শহীদ হওয়া” – চে তার জীবন দিয়ে এই সত্য বহন করে চলেছেন। কতখানি অকুতোভয় হলে বলিভিয়ার ভালেগ্রানদের স্কুলে সি আই এ’র এজেন্টের উদ্যত বন্দুকের সামনে সামনে বলতে পারেন, ” ভয় পেয়ো না। গুলি করো। তোমরা শুধুই হত্যা করতে চলেছ একজন মানুষকে।” একজন মানুষকে স্রেফ খুন করে তার মতাদর্শ কে হত্যা করা যায় না।
আজকের যুব সমাজ তার জীবন থেকে এই শিক্ষা যদি নিতে পারে তাহলে সমাজবদলের লড়াইতে আমরা অনেক দূর এগিয়ে যেতে পারবো।