উন্নত জিন বিন্যাস পদ্ধতির জন্য প্রয়াস
পাবো প্রথমে ভেবেছিলেন, প্রচলিত জিন পদ্ধতিগুলো ব্যবহার করে নিয়ান্ডারথালদের ডিএনএ অনুধাবন করবেন। পরবর্তী সময়ে বুঝলেন, এটা অত্যন্ত দুরূহ কৌশলগত(technical) চ্যালেঞ্জ। কারণ, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে রাসায়নিকভাবে ডিএনএ পরিবর্তিত হয়ে যায়,আবার যেটুকু থাকে তা অনুজীব(bacteria) এবং সমসাময়িক সমাধিস্থ মানুষ থেকে বিশেষভাবে সংক্রমিত হয় পড়ে। তাই পাবো বিবর্তনীয় জীববিজ্ঞানের (Evolutionary Biology) বিশিষ্ট এ্যালান উইলসনের তত্ত্বাবধানে কাজ শুরু করেন – কিভাবে ডিএনএ বিশ্লেষণ পদ্ধতি তৈরি করা যায়। এই উদ্যোগ কয়েক দশক ধরে চলেছিল।

প্রথম অবলুপ্ত আত্মীয়ের ডিএনএ বিন্যাস
১৯৯০ সালে পাবো মিউনিখ বিশ্ববিদ্যালয়ে যুক্ত হন। এখানে মাইটোকন্ড্রিয়ার (দেহস্থ কোষের একটি অংশ) ডিএনএ বিশ্লেষণ করতে শুরু করেন। মাইটোকন্ড্রিয়ার জিনোম ক্ষুদ্রাকার এবং কোষের জীনগত তথ্যের ভগ্নাংশ এতে থাকে। কিন্তু এর হাজার হাজার প্রতিলিপি পাওয়া যায়। ফলে গবেষণাতে সাফল্যের সম্ভাবনা থাকে। ইতিমধ্যে গবেষণালব্ধ পদ্ধতি ব্যবহার করে ৮৬ হাজার বছরের প্রাচীন জীবাশ্ম মানবের অস্থি থেকে মাইটোকন্ড্রিয়ার ডিএনএ বের করতে সফল হন এবং এর একটি অংশের ডিএনএ বিন্যাস নির্ধারণ করতে সক্ষম হন। বলা যায় , এই প্রথম আমাদের অবলুপ্ত আত্মীয়দের(নিয়ান্ডারথাল) ডিএনএ বিন্যাস সম্পাদিত হল। সমসাময়িক মানুষ ও শিম্পাঞ্জিদের সঙ্গে তুলনা করে দেখা গেছে, নিয়ান্ডারথালরা জিনগতভাবে সম্পূর্ণ পৃথক।

নিয়ান্ডারথালদের পূর্ণাঙ্গ ডিএনএ বিন্যাস প্রকাশ
ছোট মাইটোকন্ড্রিয়ার জিনোমের বিশ্লষণ খুব বেশি তথ্য দিতে পারেনি। তখন পাবো নিয়ান্ডারথালের নিউক্লিয়াস থেকে আহৃত জিনোমের বিন্যাস জানতে অগ্রসর হন(কোষের একটি বড় অংশ হল নিউক্লিয়াস বা কোষকেন্দ্র, যার মধ্যে ডিএনএ পূর্ণ কোষগুলি থাকে)। পাবো ও তাঁর সহযোগীরা প্রাচীন জীবাশ্ম অস্থির ভগ্নাবশেষ থেকে ডিএনএ নিষ্কাশন ও বিশ্লেষণ করার পদ্ধতির ক্রমাগত উন্নতিসাধন ঘটিয়েছিলেন। প্রচেষ্টা সাফল্যমন্ডিত হয়। ২০১০ সালে প্রথম নিয়ান্ডারথাল জিনোমের পূর্ণাঙ্গ বিন্যাস প্রকাশিত হয়। তুলনামূলক আলোচনার দ্বারা প্রতিভাত হয়েছে, নিয়ান্ডারথাল ও হোমো স্যাপিয়েন্সের সাধারণ পূর্বপুরুষ (common ancestor) ৮ লক্ষ বছর আগে বাস করেছিল।

হোমো স্যাপিয়েন্স ও নিয়ান্ডারথালের সহাবস্থান
এরপর পাবো ও তাঁর সহযোগীগণ পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের আধুনিক মানুষ এবং নিয়ান্ডারথালদের মধ্যে যে সম্পর্ক তা অনুসন্ধান করার চেষ্টা চালিয়ে যান। তুলনামূলক আলোচনা থেকে বোঝা যায়, ইউরোপ অথবা এশিয়ার বর্তমান জনগোষ্ঠীর ডিএনএ বিন্যাস এবং নিয়ান্ডারথালদের অনুরূপ বিন্যাসের মধ্যে যথেষ্ট সাদৃশ্য আছে। সেক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য হল, আফ্রিকা থেকে উদ্ভূত সমসাময়িক মানুষের সঙ্গে নিয়ান্ডারথালদের সাদৃশ্য অপেক্ষাকৃত কম। এর তাৎপর্য হল, নিয়ান্ডারথাল ও হোমো স্যাপিয়েন্সদের সহাবস্থান ছিল। ইউরোপ বা এশিয়াবাসীদের মধ্যে শতকরা এক ভাগ থেকে চার ভাগ জিনোম নিয়ান্ডারথাল থেকে এসেছে।

ডেনিসোভা গুহা মানবের জিন বিন্যাস
২০০৮ সালে সাইবেরিয়ার দক্ষিণ অংশে ডেনিসোভা গুহায় (Denisova) ৪০ হাজার বছর প্রাচীন আঙ্গুলাস্থির একটা ভগ্নাবশেষ পাওয়া যায়। এই অস্থির মধ্যে বিশেষভাবে সংরক্ষিত ডিএনএ-এর বিন্যাস, পাবো ও তার সহযোগীরা নির্ধারণ করেন। নিয়ান্ডারথাল ও বর্তমান মানবগোষ্ঠীর সঙ্গে তুলনা করলে এই লব্ধ বিন্যাস (sequence) অনন্য। বিশ্বের বিভিন্ন এলাকার আধুনিক মানুষের সঙ্গে মিলিয়ে দেখলে স্পষ্ট হয় যে, ডেনিসোভা ও হোমো স্যাপিয়েন্সের মধ্যে জিন বিনিময় সম্ভব হয়েছিল। এই সম্পর্ক প্রথম চোখে পরে মেলানেশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার জনগোষ্ঠীর মধ্যে। এখানকার অধিবাসীরা শতকরা ৬ ভাগ ডেনিসোভা ডিএনএ বহন করছে।

বিবর্তনীয় ইতিহাসে পাবোর গবেষণার প্রভাব
পাবোর আবিষ্কার মানবের বিবর্তনীয় ইতিহাস সম্পর্কে নতুন নতুন ধারণার জন্ম দিয়েছে। যে সময়ে হোমো স্যাপিয়েন্স আফ্রিকার বাইরে পরিযায়ী হয়, তখন অন্তত দুটি মানব সম্প্রদায় ইউরেশিয়ার অধিবাসী ছিল। নিয়ান্ডারথালদের বসতি ছিল পশ্চিম ইউরেশিয়ায় আর ডেনিসোভানরা মহাদেশের পূর্বদিকে বিস্তার লাভ করেছিল। আফ্রিকার বাইরে যখন হোমো স্যাপিয়েন্সেরা ছড়িয়ে পরছিল এবং পূর্বদিকে তাদের অভিপ্রয়াণ(migration) হচ্ছিল, তখন তারা শুধু নিয়ান্ডারথালদের সঙ্গে মেলেনি, তারা ডেনিসোভানদের সঙ্গেও মিলিত হয়েছিল।
পাবোর গবেষণা মানবের উৎপত্তি সম্পর্কে চার্লস রবার্ট ডারউইনের প্রাথমিক অনুমান (অর্থাৎ আফ্রিকাই মানবের আদি বাসভূমি) দৃঢ়ভাবে সমর্থন করছে। ‘Out of Africa’ মডেলটিও অনুরূপ সমর্থন লাভ করছে। প্রাচীন সময় কালের কোন একটি অংশে হোমো স্যাপিয়েন্স ও প্রাক্-মানবের কয়েকটি গোষ্ঠীর (নিয়ান্ডারথাল, ডেনিসোভা প্রভৃতি) মধ্যে আদানপ্রদান ঘটেছিল। বর্তমান বিশ্বের মানুষরা যে প্রাক্-মানব গোষ্ঠীগুলির মধ্যে এই ঐতিহাসিক মিশ্রণের প্রজন্মসমূ্হ তাতে কোন সন্দেহ নেই।