অলকেশ দাস
চাই ইংরেজ শাসন থেকে মুক্তি। চাই স্বাধীনতা। চাই জমির উপর একচ্ছত্র অধিকার। চাই যত ধরনের শোষণ, অবিচার, অত্যাচারের অবসান। এইসব কথা বলতে বলতেই রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে অগুনতি মানুষ। শুধু মিছিল নয় যেন চলমান জনসভা। ‘ আকাশে প্রকাণ্ড পূর্ণিমার চাঁদ পাহাড়-অরণ্যের শীর্ষে , নিচে জ্যোৎস্নার ঝিলিমিলি খেলা-ভগনাডিহি থেকে ত্রিশ হাজারের এক সাঁওতাল দল’। পশ্চাতে থাকার যন্ত্রণা যারা অনুভব করেছিল তাদের সেই যন্ত্রণার বাঁধ ভেঙেছিল ১৯৫৫-এর ৩০ জুন। সাঁওতাল বিদ্রোহ। হুল। আজ হুল দিবস।
উনবিংশ শতাব্দীর প্রথমদিকে সাঁওতালরা আসতে শুরু করে ভাগলপুরে। দামিন-ই-কোহ । পাহাড়ের ওড়না। বীরভূম, মুর্শিদাবাদ, ভাগলপুরের বিস্তীর্ণ পাহাড়, জঙ্গলবেষ্টিত প্রান্তর ওই নামেই পরিচিত ছিল। ২৫ বছরের মধ্যে সাঁওতালদের সংখ্যা হয়ে দাঁড়ালো এক লাখ। শরীরের তাকত দিয়ে চাষের উপযোগী করে তুললো পাঁচ লাখ বিঘা জমি। জঙ্গলের জমি চাষের উপযোগী করানোর স্বার্থে ইংরেজ কোম্পানি সরকার ঘোষণা করেছিল যে যারা জমি চাষের উপযোগী করবে তাদের জমির ওপর কর ধার্য করা হবে না। যে কোনও কৃষক যত খুশি জমি চাষ করতে পারবে। সাঁওতালরা সরকারের কথা বিশ্বাস করলেও কাজ হাসিল হয়ে গেলে সরকার আর কথা রাখেনি। ১৮৩৮ সালে ইংরেজ সরকারের জমিতে যে বাৎসরিক কর ছিল ১৩ বছরের মধ্যে তা বেড়ে হলো ২২ গুণ। দামিন ই কোহ’ র জমি ছিল সরকারের খাস। জমিদাররা কোম্পানি থেকে মহল কিনে বা ইজারা নিয়ে যেমন খুশি জমির খাজনা বাড়াতে সিদ্ধহস্ত ছিল। বাড়তি খাজনা আদায়ের জন্য অনাবাসী জমিদারদের নিযুক্ত নায়েব, গোমস্তারা সীমাহীন অত্যাচার চালাতো সাঁওতালদের উপর। সাঁওতালরা যখন ব্যাপক চাষের মধ্যে দিয়ে তাদের অর্থনীতিকে খানিকটা প্রসারিত করেছিল তখন তার লোভে অনেক বাঙালি, পাঞ্জাবি ,ভাটিয়া ও মহাজন ওই এলাকায় এসে তাদের ব্যবসা শুরু করে। ধান ,সর্ষে ও বিভিন্ন প্রকারের তৈলবীজ সাঁওতালদের থেকে কিনে এরা ভাগীরথীর তীরবর্তী জঙ্গীপুরে নিয়ে গিয়ে সেখান থেকে প্রথমে মুশিদাবাদ, তারপরে কলকাতায়, তারপরে ইংল্যান্ডে রপ্তানি করত। এর বিনিময়ে সাঁওতালরা পেতো খুবই সামান্য অর্থ, লবণ, কাপড় ইত্যাদি। একটা বিশাল পাথরের ওপর সিঁদুর লেপে সেইটা দিয়ে মেপে সাঁওতালদের ঠকাতো মহাজন ব্যবসায়ীরা। কেনার বাটখারা ছিল বড়। কেনারাম বা বড় বৌ। বড় দেও। বিক্রির বাটখারা ছিল ছোট। বেচারাম বা ছোট বউ। ছোট দেও। এসবের বিরুদ্ধে সাঁওতালদের প্রাথমিক ধাপের লড়াই ছিল অর্থনৈতিক বিক্ষোভ।
মহাজনদের আরেক ফাঁদ ছিল সুদের কারবার। সাঁওতালরা যখন অর্থনৈতিকভাবে দুর্দশাগ্রস্ত হতো বিশেষ করে বর্ষাকালে তখন মহাজনেরা সাঁওতালদের কিছু টাকা, কিছু চাল, কিছু সামগ্রিক দিতো সুদের বিনিময়ে। সে সুদের হার ছিল অবিশ্বাস্য রকম চড়া। চক্রবৃদ্ধি হারে সুদ আসল বেড়েই চলত। শেষ পরিণতি ছিল সাঁওতালদের বংশানুক্রমে সমগ্র পরিবারকে দাসে রূপান্তরিত করা। তার জন্য জোর করে এদের থেকে মুচলেকা লিখিয়ে নেওয়া হতো। এসবের বিরুদ্ধে আদালতে যাওয়ার পরামর্শ অনেকে দিলেও মুর্শিদাবাদ বা দূরবর্তী ভাগলপুরে আদালতে অভিযোগ দাখিল করার সঙ্গতি গরিব সাঁওতালদের ছিল না। এর সঙ্গে যুক্ত হলো রেললাইন পাতার জন্য সাঁওতালদের বসতি থেকে উচ্ছেদ করা। লাইন বসানোর কাজে মজুর হিসাবে যুক্ত করে তাদের মজুরি না দেওয়া। সহজ ,সরল সাঁওতালরা অনুভব করতে লাগলো প্রথমত: মহাজনদের লুণ্ঠনের প্রবৃত্তি, দ্বিতীয়ত: ঋণ ফাঁদে ফেলে ব্যক্তিগত ও বংশগত দাসত্বের বন্ধন, তৃতীয়ত: মহাজনদের মদত দেওয়া পুলিশের দুর্নীতি, চতুর্থত: নায়েব, গোমস্তাদের জমিদারের চড়া কর আদায়ের জন্য সীমাহীন অত্যাচার। এই সবগুলো কারণের পিছনে ছিল ইংরেজের শাসন ব্যবস্থা। কারণ জমিদার- মহাজন এই উভয় প্রথাই এই শাসনব্যবস্থা সৃষ্ট যা তাদের শোষণের শিকারে পরিণত করেছিল।
পুঞ্জীভূত ক্ষোভ ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়তে থাকে চতুর্দিকে। ক্ষোভ শুধু সাঁওতালদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না। সাঁওতাল, আদিবাসী, অনাদিবাসী সবাই অংশগ্রহণ করতে থাকে বিক্ষোভ আন্দোলনে। ১৮৫৪ সালেই আগুন ধিকি ধিকি জ্বলতে থাকে। ১৮৫৫ সালে বিদ্রোহের পূর্ণ আত্মপ্রকাশ হয়। এই বহুমুখী শোষণ এবং অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিহিংসার আবহাওয়া ছড়িয়ে পড়ে। বীর সিং মাঝি নামে একজন সাঁওতাল সরদার বদলা নেওয়ার জন্য এক বাহিনী গড়ে তোলে। মহাজনেরা এদের দমন করার জন্য দীঘি থানায়, পাকুরের জমিদারের কাছে দরবার করে। পাকুরের জমিদারের দেওয়ান বীর সিংকে প্রথমে ফাইন করে , তারপর সেটা না দিলে তাকে তার অনুচরদের সম্মুখে জুতোপেটা করে। মহাজনেরা দিঘী থানার দারোগা মহেশ লাল দত্তকে দিয়ে অবস্থাপন্ন সাঁওতাল গোচ্চোকে গালাগাল করে এবং তাকে কোমরে দড়ি বেঁধে রাস্তা দিয়ে ঘোরায়। একের পর এক এইসব ঘটনায় আগুনে ঘৃতাহুতি হয়। সম্মুখে চলে আসে সিধু,কানু, চাঁদ,ভৈরব। তারপরে আসে সেই বিশেষ দিন। ১৮৫৫-এর ৩০ জুন। ভগনাদিহি। সিধু কানুর গ্রাম। ৪০০ গ্রামের ১০ হাজার সাঁওতাল মিলিত হয় এক সভায়। শুরু করে সিধু ,তারপর কানু। অত্যাচার আর দাসত্বের বর্ণনায় রক্ত গরম হয় সকলের। প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয় সকলে। নিজ ভূমে পরবাসী হয়ে কেউ থাকবে না। সকল শোষককে বিতাড়িত করে সাঁওতালরা নিজেদের জমির দখল রাখবে। তারপর সাঁওতালদের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করবে। জমির খাজনা কেউ দেবে না। কোনও ঋণ কেউ পরিশোধ করবে না। হয় এই মর্মে চিঠি যা আসলে চরমপত্র যাবে কমিশনার ,কালেক্টর, থানার দারোগা, জমিদারদের কাছে। দাসত্বের বিরুদ্ধে সেদিনই শুরু হয় কলকাতার দিকে বিপুল অভিযান। কারণ লাট সাহেবের কাছে দরবার করতে হবে। শুরুতেই ছিল প্রায় ৩০ হাজার। মিছিল যত এগোয় ততই লোক বাড়তে থাকে। পাঁচখেতিয়ার বাজারে প্রথমে পাঁচজন অত্যাচারী মহাজনকে হাতের কাছে পেয়ে গেলে বাহিনী তাদের হত্যা করে এবং প্রতিশোধ গ্রহণ করে। এদিকে দারোগা মহেশলাল দত্ত সদল বলে সিধু, কানুকে গ্রেপ্তার করার জন্য পাঁচখেতিয়ার বাজারে উপস্থিত হয়ে প্রথমে সিধুকে আর কানুকে জিজ্ঞাসা করে কে তোরা? কানু বলে-আমি কানু, এ আমার দেশ। সিধু বলে-আমি সিধু, এ আমার দেশ। দারোগা হুঙ্কার চড়ানোর চেষ্টা করলে সিধু তাকে হত্যা করে। শুরু হয়ে যায় সাঁওতাল বিদ্রোহ। হুল।
মাদল ,করতাল, বাজাতে বাজাতে সশস্ত্র বাহিনী চলে। হাতে তাদের কুঠার ,তির ধনুক, তরবারি। মাঝে মাঝে ইংরেজদের বাহিনী আসে আর পরাজিত হয়। রাস্তায় মহাজনদের বাড়ি পড়লে তা লুট হয়। ইংরেজ কর্মচারী রোষানলে পড়ে খুন হয়ে যায়। বিদ্রোহীরা রাস্তায় নীলকুঠি ধ্বংস করে, ইংরেজদের বহু ঘাঁটি ভস্মীভূত করে। বিদ্রোহীরা ঘোষণা করে যে কোম্পানির শাসন শেষ হয়েছে, সাঁওতাল স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠা হয়েছে। গদ্দা মহকুমার কুড়হুড়িয়া থানার বড় দারোগা প্রতাপ নারায়ণকে বিদ্রোহীরা ঠাকুরের নামে বলি দেয়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, এই বিদ্রোহের সঙ্গে কার্যকারণে ধর্মকেন্দ্রিকতা ,পশ্চাৎপদ তথাকথিত অলৌকিকতার বিষয়গুলিও জড়িয়ে থাকে অসহায় সাঁওতাল সমাজের কাছে সঙ্কটমুক্তির কাজে তা ক্রিয়াশীল হয়। বিভিন্ন জায়গা থেকে সেনা ও হস্তী বিদ্রোহীদের দমন করতে পাঠানো হয়। কিন্তু ভাগলপুর জেলার পেয়ালাপুরের নিকটবর্তী পীরপাইতীর ময়দানে মেজর বাহিনী ব্যাপকভাবে পরাস্ত হয়। ক্রমশ তাদের সামরিক শক্তির সমাবেশ বাড়াতে থাকে এবং অবর্ণনীয় অত্যাচার ও ধ্বংসকার্য চালাতে থাকে। ইংরেজ সরকার কৌশল করে আত্মসমর্পণ করার কথা বলে। বলে যে বড় নেতাদের ছাড়া অন্য সকলকে মার্জনা করে দেওয়া হবে । কিন্তু এতে একজন সাঁওতালও আত্মসমর্পণ করে না। সাঁওতালদের উদ্যম বাড়তে থাকে। বাংলার বীরভূম থেকে বিহারের ভাগলপুর জেলা পর্যন্ত কোম্পানি শাসনের চিহ্ন উঠে যায়। যোগাযোগ ব্যবস্থা স্তব্ধ হয়ে যায়। নীলকর, জমিদার আতঙ্কিত হয়ে ওঠে। এরপরেই ইংরেজ সামরিক আইন প্রয়োগ করে। পনের হাজার সেনা আর ৫০ হাতির দাপটে অত্যাচার অবর্ণনীয় হয়। বিদ্রোহীরা পশ্চাদপসরণ করে। ১৮৫৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সিধুর গোপন আস্তানার খবর ইংরেজদের কাছে দিয়ে দিলে তারা তাকে খুন করে। বারহেটেতে এক বিশাল জনতার সামনে তার ফাঁসি দেওয়া হয় আতঙ্ক ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য। কানুকে ফাঁসি দেওয়া হয় তার নিজের গ্রাম ভগনাডিহিতে। তার দেহকে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। বিদ্রোহের অন্যতম দুই নায়ক চাঁদ বৈরব ভাগলপুর এর কাছে এক ভয়ঙ্কর যুদ্ধে বীরের প্রাণ দেয়। বিদ্রোহীদের ৫০ শতাংশকে ইংরেজরা খুন করে। জনশ্রুতি যে ১৫ থেকে ২৫ হাজার সাঁওতাল এই বিদ্রোহে নিহত হয়েছিল। সাঁওতালদের ঐতিহ্য অনুসারী পাতা সমেত ছোট শালের ডাল পাঠিয়ে গ্রামে গ্রামে যে বিদ্রোহের আহ্বান করা হয়েছিল তা যে এক বছরেই ইংরেজ শাসনের ভিত্তিমূলকে নাড়িয়ে দেবে তা ইংরেজরা বুঝে উঠতে পারেনি।
সাঁওতাল বিদ্রোহ স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসের এক উজ্জ্বল পৃষ্ঠা। কৃষক বিদ্রোহের ইতিহাসে অতুলনীয়, তুলনীয় মহাবিদ্রোহের সঙ্গে। এটা ছিল স্বাধীনতা সংগ্রামের মহাবিদ্রোহের প্রেরণা। শুরু হয়েছিল সামন্ততন্ত্র বিরোধী বিদ্রোহ হিসাবে কিন্তু তা উত্তীর্ণ হয় সামন্ততন্ত্র ও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী বিদ্রোহে। শ্রমজীবী ও শোষিতের এক শ্রেণিবোধ তৈরি করেছিল এই বিদ্রোহ। সাঁওতালদের সঙ্গে সমাজের তথাকথিত নিম্নবর্গের মানুষরা যুক্ত হয়েছিল এই বিদ্রোহে। গোয়ালা,তিলি, অন্যান্য শ্রেণিগুলি সাঁওতালদের সাহায্য করত। প্রয়োজনে ড্রাম বাজিয়ে তাদের সতর্ক করে দিত। এই অংশের মানুষই বিদ্রোহের অস্ত্র তৈরি করে দিত। বীরভূম জেলা, ভাগলপুর জেলার বিস্তীর্ণ অংশ এবং মুশিদাবাদ জেলার কিছু অংশের বিদ্রোহ ব্যাপকভাবে বিস্তৃত হয়েছিল। কোনোরকম সামরিক শিক্ষা না থাকা সত্ত্বেও, কোনোরকম সংগঠন না থাকলেও জীবনপণ সংগ্রাম করেছে বিদ্রোহীরা। জমি আর স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষায়। হাজার হাজার সাঁওতাল কৃষক সমস্ত কাজ ফেলে চাষের মরশুমে চাষের পরোয়া না করে ছুটে গেছে বিদ্রোহে। প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে। বিদ্রোহীরা ছিল শৃঙ্খলাবদ্ধ। যুদ্ধের নাগরার শব্দ অনুযায়ী তারা ভূমিকা গ্রহণ করত। বিদ্রোহের বিভিন্ন পর্বে সাঁওতাল, সাধারণ, নিম্নবর্গ ইত্যাদিদের মধ্যে দ্বন্দ্ব বানিয়ে দেওয়ার চেষ্টা থাকলেও তা সফল হয়নি। বিদ্রোহের পরিণতি হিসাবে সাঁওতালদের অনেক দাবি সরকার মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিল। বিদ্রোহের পর সাঁওতালদের জাতীয় মাইনোরিটি বা সংখ্যালঘু জাতি হিসাবে ঘোষণা করা হয়। সাঁওতাল পরগনা নামে নতুন জেলা ঘোষণা করা হয়। সাঁওতালদের মধ্যে অনেকেই কৃষি জমি পায় । কিন্তু সাঁওতালদের উত্থাপিত জমি ও মুক্তির দাবি আজও অধরা হয়ে আছে।
মেজর জয়পাল সিং বলেছিলেন আদিবাসীরাই দুনিয়ার সবচেয়ে গণতান্ত্রিক লোকসমাজ। কিন্তু আদিবাসীদের সেই গণতন্ত্র থাকছে কোথায়? সবাই জানে প্রকৃতি ও আদিবাসী অবিচ্ছেদ্য। সেই প্রকৃতির কোল থেকে তাকে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়ার জাল বিছোচ্ছে কারা? জল ,জমি, জঙ্গল থেকে আদিবাসীদের বিচ্ছেদ ঘটানোর বড় পরিকল্পনা হয়ে গেছে। বলা হচ্ছে নতুন বনাঞ্চল সংরক্ষণ আইন। বেসরকারি সংস্থা বনবাসীদের অনুমতি ছাড়াই বন কেটে ফেলতে পারবে। এদের তোয়াক্কা না করেই ঐ জায়গায় বেসরকারি প্রকল্পের অনুমোদন দেবে কেন্দ্রীয় সরকার। গ্রামের সভায় আদিবাসীদের অধিকার অস্বীকার করছে সরকার। বনাঞ্চলের এখন বাণিজ্যিকীকরণ বেসরকারি করণ, এমনকি সামরিকীকরণও চলছে। সেবক থেকে সিকিম রেললাইন ,পুরুলিয়ায় পাম্প স্টোরেজ প্রকল্প, দেওচা পাঁচামি কয়লা খনি প্রকল্প, আদানি গোষ্ঠীর বিদ্যুৎ পরিবহণের জন্য হাইটেনশন লাইনের টাওয়ার বসানো -আমাদের রাজ্যের সরকারও পিছিয়ে নেই কর্পোরেটের পদসেবায়। আদিবাসীদের স্বার্থের কথা ভোট ছাড়া অন্য সময় না ভাবলেও চলবে! মিনারেল করিডোর, আদিম অরণ্য ,পাহাড় দখল করে কর্পোরেটের হাতে হাতে তুলে দেওয়ার জন্য দলিত আদিবাসীদের বিরুদ্ধে দিল্লি আর রাজ্য সরকার উভয়েই এক। আদিবাসীদের আস্তানায় বুলডোজার, আর্থ মুভার, পে লোডার, বৈদ্যুতিক করাত। আর সামনে উন্নয়নের মুখোশ। দুই সরকারের কাজে কোনও ফারাক নেই। জলবিদ্যুৎ প্রকল্প কিংবা জাতীয় সড়ক, কিংবা রেলওয়ে লাইন ইত্যাদি অবলীলাক্রমে পাহাড় কেটে, জঙ্গল কেটে, আদিবাসীদের ছাউনি উড়িয়ে জীব বৈচিত্র নষ্ট করে চলছে কর্পোরেটের উদরপূর্তি আয়োজন। প্রকৃতিকে ব্যক্তি সম্পত্তিতে পরিণত করার ,বন থেকে পুঁজি আহরণ করার ইতিহাস সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত করছে আদিবাসীদের। আদিবাসীদের দুটি পরিবারের মধ্যে একটি দারিদ্র সীমার নিচে। প্রতি ১০ জন আদিবাসী চার জন নিরক্ষর। আদিবাসীদের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়া দুটো শব্দ। দারিদ্র ও ক্ষুধা। দিনে দু’বার ভাত— শুধুমাত্র ভাত পাওয়া মানে খাবার জুটেছে। কেবলমাত্র ২৭ ভাগ পরিবার ভাতের সঙ্গে ডাল জোটাতে পারে। আদিবাসী যদি পেট ভরে খাবার না পায় তাহলে তার ভাষা ,সংস্কৃতি, সমাজ, রীতিনীতি, ধর্মীয় অনুষ্ঠান ইত্যাদি এক জায়গায় থাকবে না। আদিবাসীদের জীবন ও সংস্কৃতি ও থেকে যাচ্ছে বহু মানুষের কাছে অপরিচিত। সামাজিক এই সংহতির ব্যবধানে পরিসর তৈরি করছে বিচ্ছিন্নতাবাদ। সঙ্ঘ পরিবার আদিবাসীদের হিন্দুত্বের পরিচয়ে জড়িয়ে নিতে চাইছে। অথচ এই সঙ্ঘ পরিবার আদিবাসীদের এদেশের আদি বাসিন্দা হিসাবে না মেনে তাদের বনবাসী হিসাবে দেখাতে চায়। যে আদিবাসীর মহান মানসিক সম্প্রীতি এক উজ্জ্বল শিক্ষাধারা তাকে ধ্বংস করতে উদ্যত সঙ্ঘ পরিবার। জনজাতি জীবনের বিপন্নতা বহুবিধ। সাঁওতাল বিদ্রোহ শিখিয়েছে প্রতিবাদ ,প্রতিরোধ। সাময়িক ব্যর্থতা-ভবিষ্যতের রসদ। আদিবাসীদের সঙ্গে পারস্পরিকতার অনুশীলন, সমানুভূতির অনুশীলন আমাদের বাড়াতে হবে। হুল শিখিয়েছে লড়াই থেমে থাকে না।
৩০শে জুন, ২০২৪-র গনশক্তি পত্রিকায় প্রকাশিত