ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী)-র পলিট ব্যুরো বিবৃতি
আজ ১২ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪-এ পার্টির সাধারণ সম্পাদক কমরেড সীতারাম ইয়েচুরির প্রয়াণে পলিট ব্যুরো গভীর শোক প্রকাশ করেছে। ফুসফুসে তীব্র সংক্রমণের কারনে তিনি দিল্লির এইমস (অল ইন্ডিয়া ইন্সটিটিউট অফ মেডিক্যাল সায়েন্সেস)-এ ভর্তি ছিলেন। তাঁর বয়স হয়েছিল ৭২ বছর।
বিশিস্ট মার্কসবাদী তাত্ত্বিক হিসাবে কমরেড সীতারাম ইয়েচুরির বিশেষ পরিচিতি ছিল। দেশে বাম আন্দোলনের এক অসামান্য নেতা, ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী)-রও সর্বোচ্চ নেতৃত্ব ছিলেন তিনি।
মেধাবী ছাত্র হিসাবে অর্থনীতিতে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর দুটি ক্ষেত্রেই তিনি প্রথম শ্রেণী সহ ডিগ্রি অর্জন করেছিলেন। ১৯৭৪ সালে জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন তিনি ছাত্র আন্দোলনে যুক্ত হন, পরে ভারতের ছাত্র ফেডেরেশনের নেতৃত্ব হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হন। দু’বছরের ব্যবধানে তিনি তিনবার জেএনইউ বিশ্ববিদ্যালয় স্টুডেন্টস ইউনিয়নের সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯৮৪ থেকে ১৯৮৬ সাল অবধি তিনি ভারতের ছাত্র ফেডারেশনের সর্বভারতীয় সভাপতি ছিলেন, দেশজুড়ে ছাত্র আন্দোলনকে প্রসারিত করতে তাঁর বিশেষ ভূমিকা ছিল।
১৯৭৫ সালে তিনি সিপিআই(এম) দলের সদস্যপদ লাভ করেন। জরুরী অবস্থার সময় রাজনৈতিক কারণে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। ১৯৮৫ সালে পার্টির দ্বাদশ কংগ্রেস থেকে তিনি কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন এবং আমৃত্যু তিনি কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ছিলেন। ১৯৮৯ সালে পার্টির কেন্দ্রীয় সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য এবং ১৯৯২ সালে পার্টির চতুর্দশ কংগ্রেস থেকে পলিট ব্যুরো সদস্য নির্বাচিত হন।
২০১৫ সালে সিপিআই(এম)-র একবিংশ কংগ্রেসে তিনি পার্টির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন, আজ মৃত্যুর দিন অবধি তিনি সে পদেই দায়িত্বে ছিলেন। তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে তিনি ছিলেন পার্টির নেতৃত্বের অন্যতম। বিভিন্ন সময়ে পার্টির রাজনৈতিক অবস্থান নির্ধারণে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। মতাদর্শ চর্চায় তাঁর অনন্য অবদান রয়েছে। পার্টির চতুর্দশ কংগ্রেসে ‘কয়েকটি মতাদর্শগত প্রসঙ্গে অবস্থান’শীর্ষক দলিল গৃহীত হয়। সমাজতান্ত্রিক দুনিয়ায় বিপর্যয়ের প্রেক্ষিতে এই দলিলেই সিপিআই(এম) নিজেদের মতাদর্শগত অবস্থান স্পষ্ট করে। কমরেড সীতারাম ইয়েচুরিই সেই দলিলটি পার্টি কংগ্রেসে পেশ করেছিলেন। ২০১২ সালে বিংশতিতম পার্টি কংগ্রেসে মতাদর্শগত অবস্থান প্রসঙ্গে সময়োপযোগী দলিল গৃহীত হয়, একাজেও তিনিই প্রধান ভূমিকায় ছিলেন।
কমরেড ইয়েচুরি কেন্দ্রীয় কমিটির পক্ষে আন্তর্জাতিক বিভাগের প্রধান ছিলেন। কমিউনিস্ট ও প্রগতিশীল রাজনৈতিক শক্তিগুলির পক্ষে আহূত বহু আন্তর্জাতিক আলোচনা, মঞ্চে তিনি পার্টির প্রতিনিধিত্ব করেন। সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী বিভিন্ন আন্দোলন ও বিভিন্ন সমাজতান্ত্রিক দেশের সাথে পার্টির যোগাযোগকে আরও দৃঢ় করার কাজে তিনি একনিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেছেন।
দু’দশকেরও বেশি সময় সীতারাম ইয়েচুরি পার্টি প্রকাশিত সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘পিপলস ডেমক্র্যাসি’র সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন। সুলেখক হিসাবেও তাঁর খ্যাতি ছিল। মতাদর্শগত প্রশ্নে বিশেষ করে হিন্দুত্ববাদের রাজনীতির সমালোচনায় তাঁর বিশেষ অবদান রয়েছে। এই প্রসঙ্গে ‘হিন্দু রাষ্ট্র কি?’ ও ‘সাম্প্রদায়িকতা বনাম ধর্মনিরপেক্ষতা’শিরোনামে নামে তাঁর লেখা দুটি বইও ইতিমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে ।
২০০৫ থেকে ২০১৭ সাল অবধি দু’বার কমরেড সীতারাম ইয়েচুরি রাজ্যসভার সদস্য নির্বাচিত হন। রাজ্যসভায় সিপিআই(এম)-র পরিষদীয় নেতা ও এক দক্ষ সাংসদ হিসাবে তিনি কাজ করেছেন। ২০১৭ সালে তাঁকে সেরা সাংসদ হিসাবে পুরস্কৃত করা হয়।
শেষ কয়েক বছর যাবত তিনি দেশজুড়ে বিজেপি বিরোধী ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলির সাথে এক বৃহত্তর ঐক্য নির্মাণের জন্য পরিশ্রম করেছেন, ইন্ডিয়া ব্লক সেই কাজেরই ফসল। প্রথমে ইউনাইটেড ফ্রন্ট সরকার এবং পরে ইউপিএ সরকার, এই দুই আমলেই সরকার গড়ে তুলতে জরুরী সমঝোতা ও সমর্থনের ক্ষেত্রে পার্টির পক্ষে তিনি অন্যতম প্রধান ভূমিকা পালন করেন।
অমায়িক আচরণের সুবাদে রাজনীতির বৃহত্তর বৃত্তে তাঁর ব্যাপক পরিচিতি ছিল, রাজনীতির বাইরেও বহু মানুষের সাথে তাঁর বন্ধুত্বের সম্পর্ক ছিল। রাজনীতির জগতে তাঁর সততা ও একনিষ্ঠতার জন্য তিনি সকলের কাছেই সমাদৃত ছিলেন।
জাতীয় রাজনীতির এক জটিল ও কঠিন সময়ে তাঁর মৃত্যু সিপিআই(এম)-র জন্য বড় ধাক্কা। দেশজুড়ে বাম, ধর্মনিরপেক্ষ, গনতান্ত্রিক শক্তিগুলির জন্য তাঁর অকস্মাৎ মৃত্যু এক বিরাট ক্ষতি বিশেষ।
কমরেড সীতারাম ইয়েচুরির মৃত্যুতে পলিট ব্যুরো গভীর শোক প্রকাশ করছে, তাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে রক্তপতাকা অর্ধনমিত রাখা হচ্ছে। শোষণমুক্ত সমাজ নির্মাণের সংগ্রামকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যেতে পার্টির সর্বঅংশকে আরও ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানাচ্ছে পলিট ব্যুরো। তাঁর প্রতি এটাই হবে উপযুক্ত শ্রদ্ধাঞ্জলি।
কমরেড সীতারাম ইয়েচুরির স্ত্রী সীমা, কন্যা অখিলা ও পুত্র দানিশ ও ভ্রাতা শংকর সহ তাঁর পরিবারের সকলের প্রতি পলিট ব্যুরো গভীর সমবেদনা জানাচ্ছে।