অর্ণব রায়, বাবিন ঘোষ
আর এস এস বর্ণিত হিন্দুত্বই কি হিন্দুধর্ম?
আর.এস.এস প্রচারিত হিন্দুরের এই ধারণাকে সনাতন বা চিরাচরিত হিন্দুধর্মের সঙ্গে মিলিয়ে দিলে চলবে না। চিরাচরিত হিন্দু ধর্ম কোন একটি নির্দিষ্ট মতবান নয়। বরং অনেকগুলো মা এবং ট্র্যাডিশনের মেলবন্ধন। অনেক ধারা যেমন ব্রাহ্মণ্যবাদ, শ্রামণবাদ, তন্ত্র, কবির, তুকারাম, নানক সবারই ট্র্যাডিশন নিলে মিশে যায়। তার ফলে একই রামায়ণের আমরা তিনশো রকম কাহিনী শুনতে পাই। কেউ দুর্গার পূজা করেন তো কেউ মহাবলীর উপাসক। হিন্দু ধর্ম এমন একটি ধর্ম যার কোন আকার ধর্মগ্রন্থ নেই। একেক জায়গায় একেক ভাবে বিভিন্ন দেবদেবীর উপাসনা হয়ে থাকে। কোথাও কোন বাঁধাধরা গণ্ডির মাঝে হিন্দুধর্ম আটকে থাকেনি। তার মানে অবশ্যই এটা নয় যে হিন্দুধর্মে কোন প্রভেদ বা বিভাজন নেই, হিন্দুধর্মে সবটাই সহিঞ্চুতা। আসলে হিন্দুধর্মে সহিষ্ণুতা যেমন আছে, জাতপাত ব্যাবস্থাও আছে। ধর্ম সংস্কারের আন্দোলনও হয়েছে বারবার। মোটের ওপর হিন্দুধর্ম অনেকগুলো ট্র্যাডিশনের একটা সমাহার।
কিন্তু সঙ্ঘের হিন্দুত্ব হল একটা রাজনৈতিক মতাদর্শ যার মূল ভিত্তি হল ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দুধর্মের ট্র্যাডিশন, যেখানে একটা ধারাকেই লালন পালন করা হয়ে থাকে। অন্য সমস্ত রকম ট্র্যাডিশনকে ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দুধর্মের মোড়কে বেঁধে ফেলার একটা চেষ্টা ক্রমাগত চলছে। সব কিছুকে এক ধাঁচে তৈরি করার হিন্দুত্বের এই ব্লুপ্রিন্ট ভারতবর্ষের বৈচিত্রের ক্ষেত্রে বিপজ্জনক। বলতে দ্বিধা নেই যে ভারতবর্ষের হিন্দুত্বের এই কারবারিদের একমাত্র উদ্দেশ্য হল সব ট্র্যাডিশনকে নস্যাৎ করে একমুখী হিন্দু রাষ্ট্র গঠন করা।
স্বৈরতান্ত্রিক আর এস এস ও ফ্যাসিবাদ থেকে অনুপ্রেরণা
আর.এস.এসের মধ্যে একটা স্বৈরতান্ত্রিক ফ্যাসিবাদী প্রবণতা লক্ষ করা যায়। আর.এস.এস এর মতাদর্শের প্রধান দিক হল- ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দু ট্র্যাডিশনের ওপর ভিত্তি করে রাজনৈতিক হিন্দুত্বের ধারণাকে মজবুত করা এবং হিন্দু রাষ্ট্র গঠনের স্বপ্নকে বাস্তবে রুপ দেওয়া। হিন্দু রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য আর.এস.এস তার বিভিন্ন শাখাতে ঘৃণার রাজনীতির আমদানি করেছে। তরুণ প্রজন্মকে মুসলিম সম্প্রদায়কে ঘৃণা করতে শেখানো হচ্ছে। ফ্যাসিবাদী ঢঙেই আওড়ানো হচ্ছে হিন্দু ধর্মের পবিত্রতা রক্ষার মহান দায়িত্বের কথা। বিরাট অংশের খেটে যাওয়া হিন্দু জনগনের সামনে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিষ ছড়ানো হচ্ছে, মুসলমান সম্প্রদায়কে প্রধান বিপদ হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে। আর এক্ষেত্রে গুরু গোলওয়ালকার বারবার হিটলার এবং জার্মানির নাৎসিবাদের কথা তুলে ধরেছেন। সেরকমই এক জায়গায় ‘গুরুজির’ হিটলার/জার্মান প্রেমের কথা বেরিয়ে এসেছে:
To keep up the purity of Race and its culture, Germany shocked the world by her purging the country of Semitic races, the Jews Germany has also shown how well high impossible it is for races and cultures having differences going to the root, to be assimilated into one united whole, a good lesson for us in Hindustan to learn and profit by. (M. S Golwalkar, We or Our Nationhood Defined, 1938, Pp. 87-88)
অর্থাৎ হিটলারের শিক্ষায় অনুপ্রাণিত আর.এস.এস হিন্দুধর্মের এবং হিন্দু জাতীয়তাবাদের পবিত্রতা রক্ষার সংকল্পে মুসলমান, খ্রিস্টান ইত্যাদি ধর্মাবলম্বী মানুষদের দেশ থেকে বহিষ্কার করার কথা ঘোষণা করল। মুসোলিনি থেকে হিটলার হয়ে উঠলেন ‘গুরুজির গুরু’।
আজকের দিনে আর.এস.এস কঠোর ভাবে ফ্যাসিবাদী শিক্ষায় অনুপ্রাণিত। নয়া উদার অর্থনীতি এবং আন্তর্জাতিক লগ্নি পুঁজির চরম সমর্থক হল আর.এস.এস। নিজের প্রয়োজনের ভিত্তিতেই আজকের দিনে উদার অর্থনীতি একটা স্বৈরতান্ত্রিক রাজনীতিকে সমর্থন করে। মোটামুটি ভাবে সব দক্ষিণপন্থী রাজনৈতিক দলগুলো নয়া উদার অর্থনিতির ধারক এবং বাহক। তাই অর্থনৈতিক নীতি প্রণয়ন করার সময় এই সমস্ত বুর্জোয়া দলগুলোর মধ্যে গুণগত বিশেষ কোন ফারাক দেখা যায় না। বিভিন্ন গুরত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং বিদেশ নীতি প্রণয়য়ে রাজনৈতিক তর্কের সুযোগ কমে আসছে। দেশেও একইভাবে সংসন ব্যবস্থাকে ক্রমাগত দুর্বল করে তোলা হচ্ছে। দেশের সংসদ বিভিন্ন আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে (যেমন বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা নীতি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে স্ট্র্যাটেজিক সম্পর্ক) গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারছে না। ক্রমাগত দুর্বল হয়ে পড়ছে সংসদীয় গণতান্ত্রিক কাঠামো। আন্তর্জাতিক লগ্নি পুঁজির গভীর সমর্থক আর.এস.এস – বিজেপি দেশের সংসদকে গুরুত্ব দিতে নারাজ। এইভাবে আর.এস.এস চরম প্রতিক্রিয়াশীল আন্তর্জাতিক লগ্নি পুঁজির পক্ষে দাঁড়ায়। কিন্তু ক্রমাগত দেশের খেটে খাওয়া মানুষকে আর.এস.এস বিভিন্ন দেশপ্রেমের বাণী শোনায় এবং আচ্ছন্ন করে রাখে, বিভিন্ন ভাবে দেশের খেটে খাওয়া মানুষদেরকে চরম এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দেয়। এই প্রসঙ্গে শ্রমিক শ্রেণির অন্যতম নেতা ডিমিট্রন্ডের সাবধানবাণী। ছিলো: ফ্যাসিবাদ কাজ করে চরম সাম্রাজ্যবাদীদের স্বার্থে, কিন্তু জনগণের কাছে হাজির হয় প্রাপ্ত জাতীয় ধ্যান-ধারণা নিয়ে এবং উগ্র হিংসাকে জাতীয় চেতনাকে উস্কে দিয়ে।
আর এস এস-র দৃষ্টিতে দলিত
আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, আর এস এস-র দর্শন আপাদমস্তক ব্রাহ্মণ্যবাদী। হিন্দু ধর্মের জাতপাতের ব্যবস্থাকে এরা টিকিয়ে রাখতে চায়। সামাজিক এবং ঐতিহাসিক ভাবে সবথেকে পিছিয়ে। পড়া দলিত শ্রেণিকে আর এস এস স্বাভাবিক ভাবেই চূড়ান্ত অবহেলার পাত্র হিসেবে গণ্য করে।। আসলে আর এস এস হল প্রকৃত অর্থে দলিত বিরোধী। আর এসএস ইতিহাসকে বিকৃত করার মধ্যে দিয়ে ভারতবর্ষের আদিম উপজাতিগুলির অস্তিত্বকে বাতিল করে নিতে চায়। আর্যসমাজের শ্রেষ্ঠত্বকে একমাত্র ইতিহাস বলে ব্যাখ্যা করতে চায়। খুব স্বাভাবিকভাবে দলিত, আদিবাসী ও অন্যান্য পিছিয়ে পড়া উপজাতিগুলির (আদিমতম জাতি হওয়া সত্ত্বেও) ভারতীয় হিসেবে ন্যায্য অধিকার অস্বীকার করা হয়।
ভারতীয় সমাজে প্রচলিত বর্ণব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখতে আগ্রহী আর এস এস। শুরু থেকেই আর.এস.এস এর সকলে নিম্নবর্গের সংরক্ষণেরও বিরোধী। বিভিন্ন ভাবে ঘোরা পথে বিভিন্ন সময়ে তারা একেকরকম কথা বলছেন। এই প্রসঙ্গে দেখে নেওয়া যাক গোলওলকার কি বলছেন:
Dr. Ambedkar had envisaged the special privileges for “Scheduled Castes” for only 10 years from the day we became a Republic in 1950. But it is going on. being extended. Continued special privileges on the basis of caste only, is bound to create vested interests in them in remaining as a separate entity. That would harm their integration with the rest of the society. (http://www.golwalkarguruji.. org/shri-guruji/thoughts/bunch-of-thoughts-book/the-path-to-glory/for-social- uplift/untouchability-the-curse-and-the-cure)
২০১৩ সালের মে মাসে মোদীর নেতৃত্বাধীন গুজরাটে “Impact of Caste Discrimination and Distinctions on Equal Opportunities: A study of Gujarat’ নামে একটা রিপোর্টে জাতপাত ভিত্তিক বিভাজনকে perception হিসেবে দেখানো হয়েছে। আর.এস.এস ভারতীয় সমাজের একটা কঠিন বাস্তবতাকে অস্বীকার করতে চায়।
আর.এস.এস এর দর্শনে মনু বর্ণিত জাতপাতের ভিত্তিতে কাজের ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখার জন্য জোর সওয়াল করা হয়ে থাকে। এরকমই একটি অতি নিকৃষ্ট মানের কাজ হল manual scavenging (চলতি বাংলায় মেথর)। ভারতে দলিত জনজাতির মানুষেরাই manual seavenging এর কাজে যুক্ত। কর্মযোগ নামে একটা সম্মলনে মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন মোদীর বিভিন্ন সময়ে আই এ এস আমলাদের সামনে দেওয়া ভাষণগুলো প্রকাশিত হয় ২০০৭ সালে। সেখানে মোদী ম্যানুয়াল স্ক্যাভেঞ্জিং সম্পর্কে বলেছেন:
I do not believe that they have been doing this job just to sustain their livelihood. At some point of time, somebody must have got the enlightenment that it is their (valmikis’) duty to work for the happiness of the entire society and the Gods, that they have to do this job bestowed upon them by Gods, and that this job of cleaning up should continue as an internal spiritual activity for centuries. (Rss versus India: Ideological blinkers of the RSS, CPI(M) Publication, 2015, p7)
২০১৪ সালে সুপ্রিম কোর্টের হিসেবে দেশের প্রায় ৯.৬ লক্ষ শৌচাগার পরিষ্কার করেন দলিত শ্রেণির মানুষেরাই। বেসরকারি ভাবে এই সংখ্যাটা অনেকটা বেশি। ভারতের মতো অনুন্নত দেশে সামাজিক এবং আর্থিক ভাবে পিছিয়ে পড়া মানুষগুলোই নিরুপায় হয়ে এই কাজের সঙ্গে যুক্ত হন। কিন্তু মোদীর মত আর এস এস প্রচারক এই বর্বরোচিত অনুশীলন সমাজে বহাল রাখতে চান। শূদ্ররা নিরলস পরিশ্রম করবে এবং তাদের ওপর নির্ভর করে সমাজে বেঁচে থাকবেন উচ্চ বর্ণের মানুষেরা, মূলত ব্রাহ্মণ এবং ক্ষত্রিয়রা – এমনটাই আর এস এস চায়। টিকিয়ে রাখতে চায় মনুর সেই সামন্ততান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটা ব্যবস্থাকে কাজের ভিত্তিতে আরোপিত এই বর্ণ ব্যবস্থাকে। আমরা আবার একবার দেখব গোলওলকার এই প্রসঙ্গে কী বলছেন :
Today we try to run down the Varna system through ignorance. But it was through this system that a great effort to control possessiveness could be made…In society some people are intellectuals, some are expert in production and earning of wealth and some have the capacity to labour. Our ancestors saw these four broad divisions in the society. The Varna system means nothing else but a proper co- ordination of these divisions and an enabling of the individual to serve the society to the best of his ability through a hereditary development of the functions for which he is best suited. If this system continues a means of livelihood is already reserved for every individual from his birth.”
(M. S. Golwalkar cited in Organizer, January 2, 1961, pp. 5 & 16, https:// sabrangindia.in/article/defence-caste-and-against-cross-breeding-kerala- golwalkar)
গোলওয়ালকারের ভাষায় বর্ণাশ্রমের এই প্রথা ভারতবর্ষের হাজার বছরের গৌরবময় জাতীয় জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ (RSS versus India: Ideological blinkers of the RSS. CPI(M) Publication, 2015. p. 11)। আর সেইজনাই বর্ণাশ্রম ব্যবস্থাকে আজকের সমাজে টিকিয়ে রাখতে চায় আর এস এস।
হিন্দুত্বের অ্যাজেন্ডায় দলিতদের সামিল করানোর চেষ্টা
এটা আমাদের কাছে পরিষ্কার যে আদর্শগত ভাবে আর.এস.এস দলিত বিরোধী। কিন্তু ক্ষমতালিপ্স আর এস এস দলিতদের নিজেদের হিন্দুত্বের অ্যারোন্ডায় সামিল করতে চায়। এটা আর.এস.এস বুঝতে পারে যে ভারতবর্ষে বসবাসকারী একটা বড় অংশের মানুষ দলিত এবং তাদেরকে বাদ দিয়ে হিন্দু রাষ্ট্র বানানোর রাজনৈতিক লড়াইটা দুর্বল হয়ে পড়বে। আর সেইজন্যই আর.এস.এস ক্রমাগত মিথ্যের ওপর ভর করে দলিতদের একটা বড় অংশের মানুষদেরকে কাছে টানতে চাইছে। দলিতদের বন্ধু সাকার এই ব্যাপারটা অতটা সহজ হবেনা ভেবেই আর.এস.এস একেবারে গোয়েবলসীয় কানায় মিথ্যা বলে চলেছে।
কিন্তু কি ভাবে দলিতদের একটা বড় অংশের মানুষকে বোকা বানানো হচ্ছে আর ব্যবহার করানো হচ্ছে নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থ সিদ্ধির কাজে? এটা করতে গিয়ে আর.এস.এস আম্বেদকরকে নিজেদের বলে চালাতে চাইছে, ভীষণ ভুল এবং সংকীর্ণ দৃষ্টিকোণ থেকে আম্বেদকরকে ব্যাখা করছেন আর.এস.এস এর নেতৃত্ব। এক্ষেত্রে আম্বেদকরকে নিছকই একজন দলিত নেতা বললে ভুল ব্যাখা করা হবে। আসলে আম্বেদকর হচ্ছেন একজন আপাদমস্তক আধুনিক চিন্তাবিদ যিনি ভারতের প্রাচীন ঐতিহাসিক উপাদান থেকেই রসদ সংগ্রহ করে হিন্দু ধর্মের বিরুদ্ধে লড়াই ঘোষণা করেছিলেন এবং ভারতবর্ষের মাটিতে সামাজিক ন্যায় বিচারের কথা বলেছিলেন। এই ঐতিহাসিক উপাদানই আম্বেদকরকে বৌদ্ধ ধর্মের অনুগামী করে তুলেছিল। স্বভাবতই আম্বেদকর দেশের সমস্ত খেটে খাওয়া, প্রগতিশীল মানুষ এবং বিশেষত দলিত শ্রেণির মানুষের প্রতিনিধি হয়ে ওঠেন এবং যিনি নিরন্তর জাতপাত ভিত্তিক হিন্দু ধর্মের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করেন। হিন্দু রাষ্ট্র সম্পর্কে আম্বেদকর বলেছিলেন “If Hindu Raj does become a fact, it will no doubt, be the greatest calamity for this country. No matter what the Hindus say, Hinduism is a menace to liberty, equality and fraternity. On that account it is incompatible with democracy, Hindu Raj must be prevented at any cost (Ambedkar, Pakistan or Partition of India, p. 358). ” নিজেদের পরিকল্পিত হিন্দু রাষ্ট্রকে বাস্তবে রূপদান করতে মরিয়া আর.এস.এস আম্বেদকরের এই গভীর সাবধানবাণী ভুলিয়ে দিয়ে নিজেদের হিন্দুত্বের গৈরিক রঙে শিক্ষাকে বিকৃত করতে চায়। আম্বেদকরের অনুগামিদেরকে নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করতে আর.এস.এস আম্বেদকরকে বিকৃত করে।
আম্বেদকর হিন্দু ধর্মকে পরিত্যাগ করেছিলেন। ধর্মান্তরিত হয়েছিলেন বৌদ্ধ ধর্মে। ভারতবর্ষের দলিতদের একটা বড় অংশও বৌদ্ধ ধর্ম অবলম্বন করেছেন। আম্বেদকরকে নিজেদের বলে চালিয়ে দিয়ে, আম্বেদকরের শিক্ষাকে বিকৃত করে আসলে আর.এস.এস এর মত একটা আপাদমস্ত হিন্দুত্ববাদী সংগঠন বৌদ্ধ ধর্মকে হিন্দু ধর্ম থেকে উদ্ভূত একটা ট্র্যাডিশন বলে চালাতে চায়। বৌদ্ধ ধর্মের সঙ্গে হিন্দু ধর্মের মূলগত ঐতিহাসিক পার্থক্যকে আর.এস.এস একই ভাবে গুলিয়ে দিতে চায়। বর্তমান ব্যাপক আশের দলিত যারা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী তাদের কাছে ফিকে করে দিতে চায় জাতপাত ভিত্তিক হিন্দু ধর্ম পরিত্যাগ করে আম্বেদকরের বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করার আসল কারণটাকে। আর.এস. এস অনেক ঘুরিয়ে প্রচার করছে যে আম্বেদকরের মুসলমান বিরোধিতার অবস্থানের ফলেই তিনি। বৌদ্ধ ধর্ম (আর.এস.এস এর মতে হিন্দু ধর্মেরই আরেকটা ট্র্যাডিশন) গ্রহণ করেছিলেন। এই প্রসঙ্গে আর.এস.এস পত্রিকা Organiser এর একটি হালফিলের সংখ্যায় বলা হয়েছে “as a spiritual leader he tried to rescue his followers from the clutches of Islam and Christianity as he tried to reorient his followers from one tradition to another within the vast and rich cultural traditions of Indian civilisation. It is therefore that he is regarded as Bodhisattva by his followers for initiating them to Buddhism. ( 27th November, 2011). কিন্তু সত্যিই কি আম্বেদকর মুসলিম বিরোধিতার জন্যই বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন? বরং উল্টোটা তিনি হিন্দু ধর্মের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ফলেই বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করার সময় আম্বেদকর বলেছিলেন “The Hindu religion does not appeal to my conscience. It does not appeal to my self-respect.” (Ram Puniyani, Ambedkar’s Ideology: Religion, Nationalism and Indian Constitution’. in Ambedkar’s Appropriation by Hindutva Ideology e digest, p. 29). এটাই আর.এস.এস গোপন করতে চায়। ঐতিহাসিক ভাবে বৈদিক ধ্যানধারণা বিরোধী বৌদ্ধ ধর্মকে এভাবেই নিজেদের রাজনৈতিক লক্ষে আর. এস. এস বিকৃত করে এবং অন্য একটা হিন্দু মোড়কে ব্যাখা করে। লক্ষ্যটা খুব পরিষ্কার যেখানে এই সব বৌদ্ধ ধর্মের বিপুল অংশের দলিত মানুষদেরকে আর.এস.এস তাদের হিন্দুত্বের রাজনীতিতে সামিল করতে চায়। হিন্দু এবং বৌদ্ধ ধর্মের মানুষের কাছে মুসলমান সম্প্রদায় বিপদ – এরকম একটা মিথ তৈরি করে আর.এস.এস হিন্দু এবং বৌদ্ধ ধর্মের মধ্যে একটা ‘ভ্রাতৃত্ব’ আরোপ করতে চায়। মিথ্যার ওপর ভর করে একটা মুসলিম বিরোধী মঞ্চ তৈরি করাই হল আর.এস.এস এর প্রধান উদ্দেশ্য। গবেষক আনন্দ তেলতুধের মতে আম্বেদকরকে বিকৃত করার পেছনে আর এস এস-এর অর্থনৈতিক অবস্থান একটা ভূমিকা পালন করে। আর এস এস ঘোরতর ভাবে নয়া উদার অর্থনীতির পক্ষে। অস্বীকার করা যায় না যে দলিতদের মধ্যে একটা অংশ মধ্যবিত্ত। এদের মধ্যে অনেকেই নয়া উদার অর্থনীতির সমর্থক। প্রচার চালানো হয় যে দলিতদের অর্থনৈতিক উন্নতি নয়া উদার অর্থনীতিতেই সম্ভব। নয়া উদার অর্থনীতির পক্ষে দলিত সমাজের সমর্থন জোগাড় করতেই আর.এস.এস খুব সুচতুর ভাবে আম্বেদকরকে উদার অর্থনীতির সমর্থক বলে প্রচার করছে (Anand Telturbde, ‘Deconstructing Ambedkar, EPW May 2, 2015. Vol I, No 18) । কিন্তু আম্বেদকর কোনভাবেই নয়া উদার অর্থনীতির পক্ষে ছিলেন না। সমাজের একেবারে নিচের তলার মানুষের উন্নতিকল্পে আম্বেদকর রাষ্ট্রের ভূমিকার কথা কখনও অধীকার করেননি। সামাজিক ভাবে পিছিয়ে থাকা মানুষের জন্য সামাজিক নিরাপত্তার কথা আম্বেদকর বারবার বলেছেন।
আর এস এস-র দৃষ্টিতে নারী
১৯২৫ সালে হেগড়েওয়ারের নেতৃত্বে আর এস এস তৈরি হওয়ার সময়ে সংগঠনটিতে মহিলাদের অন্তর্ভুক্তির কোনো প্রশ্ন ছিল না। হিন্দুত্বের আদর্শে দীক্ষিত আর.এস.এস এর দর্শনে মহিলাদের অস্তিত্ব সীমাবদ্ধ ছিল এবং এখনও আছে পরিবার, রান্নাঘর ও সন্তান পালনের মধ্যেই। এর বাইরে মহিলাদের কোনোপ্রকার অস্তিত্ব আর.এস.এস স্বীকার করে না। অথচ ১৯৩৬ সালে হেগড়ে ওয়ারের নির্দেশেই লক্ষ্মীবাঈ কেলকার রাষ্ট্রসেবিকা সমিতি তৈরি করেন এবং সমাজে নারীর ভূমিকা সম্পর্কে নতুন হিন্দুপুরাণ রচনা করতে উদ্যত হন। ১৯৩০-এর দশকে দলিত আন্দোলনে উত্তাল মহারাষ্ট্র, পুড়ছে মনুসংহিতা। সাবিত্রী ফুলে এবং তারাবাঈ শিল্পের নেতৃত্বে ঘরে ঘরে দলিত মেয়েদের স্কুলে পাঠানোর, শিক্ষিত হয়ে বাঁচতে চাওয়ার সংগ্রাম তুঙ্গে। এই উত্তাল ঢেউ ঠেকাতে, হিন্দু নারীদের রান্নাঘরের চেনা মঞ্চে আবদ্ধ রাখতে এবং এসবের মাধ্যমে মনুবাদে লিখিত ‘দেশভক্তি’ পালন করতেই একপ্রকার বাধ্য হয়ে আর এস এস তার নারী সমিতি তৈরি করে। পরে মণ্ডল কমিশন বিরোধী যাবতীয় আন্দোলনসহ, দলিত, পিছিয়ে পড়া সম্প্রদায়ের সকল আন্দোলনের বিরোধিতা করার কাজে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছে রাষ্ট্র সেবিকা সমিতি।
আম্বেদকার তার লেখায় বলছেন গোঁড়া হিন্দুর কীভাবে একজন নারীকে দুর্বল, অধীনস্থ করে রাখে। বর্ণ ব্যবস্থায় উদ্বৃত্ত নারীর স্বামীর চিতায় দহন বা তার থেকেও বেশি জ্বালাময় বৈধব্যে তাঁকে পুড়িয়ে মারার কথাও আম্বেদকারের ব্যাখ্যায় উঠে এসছে। বহির্জগত থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হিন্দু নারীর জন্য মনুর বিধান- সে সন্তান লালন পালনে মা, স্বামীর আদেশ পালনে স্ত্রী এবং দাম্পত্যে রম্ভা বা আকর্ষণীয় প্রেমিকা (মনুস্মৃতি, ৩৫৬)। মনু বর্ণিত নারীদের অবস্থাকেই সমাজে ফিরিয়ে আনতে চায় আর এস এস।
গুজরাট বা মুজফ্ফরনগর দাঙ্গাতে অসংখ্য নারীদের ওপর অকথ্য অত্যাচার চালিয়েছিল আর, এম, এস এর গুন্ডা বাহিনী। এই প্রসঙ্গে ফিরে দেখা যাক শুরু সাভারকারের ভাবনাকে। সাভারকার ঘোষণা করেছিলেন: “ধর্ষন একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক উপকরণ”;
Let these sultans and their peers take a pledge that in the event of a Hindu Victory our molestation and detestable lot shall be avenged on the Muslim Women. Once they are haunted with this dreadful apprehension that the Muslim women too, stand in the same predicament in case the Hindus win, the future Muslim conquerors will never dare to think of such molestation of Hindu women
Reading Savarkar How a Hindutva icon justified the idea of rape as a political tool
গুজরাট থেকে কালামাল সর্বত্রই আর এস এস-এর গুন্ডাবাহিনী অক্ষরে অক্ষরে সাভারকারের কথা মেনে চলেছে। একেবারে পরিকল্পনা করে সাংগঠনিক ভাবে আর এস এস ধর্ষণকে ব্যবহার করেছে। সখ্যালঘুদের মধ্যে ভয়ের একটা বাতাবরণ তৈরি করা হয়েছে। মনুর শিক্ষাকে আধুনিক সমাজে প্রচলন করানোর জন্য আর.এস.এস এবং তাদের সহযোগী সেবিকা সমিতির চেষ্টার কোন ত্রুটি নেই। ভারতীয় নারীদের মনুর বিধান হিসেবে সহবত শিক্ষা। দেওয়াটাই সেবিকা সমিতির একটা প্রধান উদ্দেশ্য। সেবিকার বোঝাপড়ায় নারীকেই সমঝোতা করতে বলা হয়েছে। এই প্রসঙ্গে দেখে নেওয়া যাক সেবিকা সমিতি কি বলছে?
After marriage, a girl will have many responsibilities in her new home. It is not advisable for her to bring disquiet by refusing to compromise. If ordained by fate, her husband will permit her to study. (RSS versus India: Ideological blinkers of the RSS, CPI(M) Publication, 2015. p. 19)
আজকের আধুনিক যুগে যেখানে মহিলাদের একটা অংশ শিক্ষা দীক্ষায় অনেক এগিয়ে, যেখানে প্রতিদিন একেবারে সবথেকে পিছিয়ে পড়া নারী সমাজও তাদের মেয়ে সন্তানকে বিদ্যালয়ে পাঠান, সেখানে আর এস এস এবং সেবিকা সমিতির শিক্ষা অপ্রাসঙ্গিক। আনতে নারী বিদ্বেষী হিন্দুত্বের রাজনীতিকেই এরা এগিয়ে নিয়ে যাবার লক্ষে অবিচল। নারী পুরুষের সমানাধিকার আর এস এস চায়না। লিঙ্গ বৈষম্যের প্রতি আর এস এস-এর কোন দৃষ্টি নেই। আসলে এরা মনুবাদী সংস্কৃতিকেই ফিরিয়ে আনতে চায়।
আর এস এস এবং ভারতীয় আধুনিকতা
স্বান্দ্বিক ভাবে এগিয়ে চলা উৎপাদন সম্পর্ক এবং উৎপাদিকা শক্তির সম্পর্কের ইতিহাসের ধারাবাহিক বিবর্তন হল আধুনিকতা। সামন্ততান্ত্রিক উৎপাদন সম্পর্কের থেকেই ইতিহাসের স্বান্দ্বিকতার সুত্র ধরেই ধনতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা তৈরি হয়েছে। যা কিছু পুরনো তা কালের নিয়মে ভেঙে যাবে- তৈরি হবে নতুন সমাজ ব্যবস্থা। নতুন থেকে নতুনতর, উন্নত থেকে উন্নততর সমাজ ভেঙে যাবে পুরনো উৎপাদন সম্পর্ক, ব্যাপক প্রসার ঘটে উৎপাদিকা শক্তির এবং গড়ে ওঠে নতুন উৎপাদন সম্পর্ক। একই সঙ্গে পরিবর্তন আসে চিন্তা জগতে সমগ্র মানব জাতির বিশ্বদর্শন পরিবর্তিত হতে থাকে। মানুষের এগিয়ে চলার এই ইতিহাসই হল আধুনিকতা, যেখানে প্রত্যেক সমাজে উৎপাদিকা সম্পর্কের গুণগত পরিবর্তন হয়।
আর এস এস এই ঐতিহাসিক অগ্রগতিকে অস্বীকার করতে চায়। আধুনিকতার একটা সর্বজনীন সত্ত্বাকে অস্বীকার করে আর এস এস আজকের দিনে এক বিকল্প হিন্দু আধুনিকতার তত্ত্ব খাড়া করার জন্য মরিয়া। জেফরি হার্ভের মতই মীরা নন্দা একে চিহ্নিত করেছেন প্রতিক্রিয়াশীল আধুনিকতা হিসেবে। এই প্রতিক্রিয়াশীল আধুনিকতা যুক্তির ধারণাকে পরিত্যাগ করে অথচ গ্রহণ করে আধুনিক প্রযুক্তিকে। অর্থাৎ একদিকে ডিজিটাল ভারত আর অন্যদিকে সমাজে অযুক্তি কুযুক্তির জাল বোনা হয়। একদিকে আমরা আকাশে রকেট পাঠাবো কিন্তু আর একদিকে চরম প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির মত গরুর মাংস খাওয়ার গ্রেফ সন্দেহের অবকাশে কিছু মানুষকে মেরে ফেলবো। একদিকে আধুনিক জ্ঞান এগোলেও বিশ্বদর্শন থেকে যাচ্ছে সেই পুরাতন সমাজের মোড়কেই। হিন্দু জাতীয়তাবাদীরা কিন্তু আধুনিক বিজ্ঞানের ফসলকে উপেক্ষা করে না। বরং তারা চেষ্টা করে আধুনিক বিজ্ঞানকে হিন্দু ধর্মের পরিভাষার অন্তর্ভুক্ত করতে। এভাবে তারা আসলে প্রাচীন ভারতীয় হিন্দু সংস্কৃতির শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করতে চান। ১৯৯৮ সালের পোরানের পক্ষে যুক্তি নিতে গিয়ে আর এস এস বলেছিল গীতায় আটম বোমা সম্পর্কে ভবিষ্যৎ বাণী রয়েছে। আমরা শুনতে পাই যে প্লাস্টিক সার্জারি গণেশের সময় হয়েছিল। অর্থাৎ প্রচার করা হয় যে আধুনিক বিজ্ঞানের জন্ম বৈদিক বিজ্ঞান থেকে। হিন্দুত্বের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করতেই ইতিহাসের ও বিজ্ঞানের এমন একটা ধারণা আর, এস এস পরিবেশন করে। আসলে যা দাঁড়ায় সেটা হল আর.এস.এস আধুনিক সমাজের ধ্যান ধারণাকে নস্যাৎ করে এবং একটা প্রতিক্রিয়াশীল আধুনিকতার আমদানি করে (Meera Nanda. Prophets facing Backward: Postmodern Critiques of Science and Hindu Nationalism in India, 2003)।
এরই সঙ্গে বাজারে চলতি উত্তর আধুনিকতার একটা অদ্ভুত মিল খুঁজে পাওয়া যায়। উত্তর আধুনিক চিন্তা ভাবনা আধুনিকতার, জ্ঞান-বিজ্ঞানের অগ্রগতির এনলাইটেনমেন্টকে অস্বীকার করে। উত্তর আধুনিকতার প্রবক্তারা শেষ বিচারে উৎপাদিকা সম্পর্কের গুণগতভাবে পরিবর্তনের ঘটনাক্রমকে ইউরোপকেন্দ্রিক ইতিহাসের ফসল হিসেবেই দেখেন। ধ্বংস হয়ে যায় প্রগতিগত আধুনিকতার ধারণা। স্বাভাবিকভাবেই উত্তর আধুনিক প্রবক্তারা ভারতীয় সংস্কৃতির আদপে একটা বিকল্প ভারতীয় আধুনিকতার জ্ঞানতত্ত্ব পরিবেশন করেন, যা আধুনিকতার সর্বজনীন সত্ত্বার থেকে পৃথক। সেইজন্যই মীরা নন্দা বলছেন, উত্তর আধুনিকতা একটি মতবাদ হিসেবে হিন্দুত্বের জ্ঞান- বিজ্ঞান-সমাজ সম্পর্কিত বিকল্প জ্ঞানতত্ত্বকে দার্শনিকভাবে সমৃদ্ধই করে।
লক্ষণীয় যে হিন্দুত্বের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করতে গিয়ে আর.এস.এস ইতিহাসের একটা বিকৃত ধারণা পরিবেশন করে। দক্ষিণপন্থী হিন্দুত্ব সর্বপ্রথম নস্যাৎ করে ইতিহাসের বস্তুনিষ্ঠতা, ইতিহাসের ঘটনাক্রম; নৃতাত্ত্বিক প্রমাণ। ফলত যেকোনো নতুন, উন্নত ও অগ্রগামী বিশ্লেষণের নাম দেওয়া হয়- ‘পশ্চিমী’ বা ‘মার্কসবাদী’ অথবা ‘সাম্রাজ্যবাদী’ (Romila Thapar ‘Hindutva and history’.. Frontline, 2000) । ইতিহাস বোধ তৈরির চেষ্টার কাজ শুরু হয় বিদ্যালয় পাঠ্যক্রম পরিবর্তন করার মধ্যে নিয়েই। পরিকল্পিত হিন্দু রাষ্ট্রের আদর্শগত এবং রাজনৈতিক অ্যাজেন্ডাকে অনেক বেশি শক্তিশালী করতেই আর এস এস ইতিহাসের পাতায় জোর করে, কিছু মনগড়া গল্পের ওপর ভিত্তি করে একটা পরম শক্তিশালী, জ্ঞানে-বিজ্ঞানে অতুলনীয় আদর্শ হিন্দু রাষ্ট্রর ভাবমূর্তি তৈরি করার লাগাতার চেষ্টা করে।
হিন্দুত্বের রাজনৈতিক অর্থনীতি
সঙ্ঘের মতাদর্শগত এবং সাংগঠনিক ইতিহাস থেকে দেখা যায় যে তার প্রতিষ্ঠা এবং প্রারম্ভিক সময়ে সামাজিক ভিত্তি ছিল মূলত ভূস্বামী শ্রেণী এবং তদানীন্তন মধ্যবিত্তের একাংশের। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ এবং জনসম উভয়েরই অর্থনৈতিক অ্যাজেন্ডায় ‘স্বদেশী’ শিল্পের বিকাশের পক্ষে সহায়ক রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ স্থান পায়। কৃষির ক্ষেত্রে কখনও জমিদারি ব্যবস্থা বিলোপের পক্ষে, কখনও বা বিপক্ষে জনসদের দোদুল্যমান অবস্থান লক্ষ্য করা যায়। পাঁচের দশকের শুরুর দিকে সঙ্ঘ জমিদারি বিলোপের বিরোধিতা করে। আবার পাঁচের দশকের শেষ দিকে জনসম জমিদারি প্রথা বিলোপের পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করে। এই পটভূমিতে জমিদারী প্রথার স্বপক্ষে থাকা ভৌম অভিজাত শ্রেণীর নেতৃত্বে স্বপ্নায়ু স্বতন্ত্র পার্টি’র জন্ম হয়। ছয়ের দশকের শেষ দিকে যখন ইন্দিরা গান্ধীর নেতৃত্বে ব্যাঙ্ক এবং বিবিধ শিল্প জাতীয়করণের প্রক্রিয়া শুরু হয়, তার বিরোধিতা করা হয় জনসজ্জের তরফে। আবার, ১৯৭৭ সালের লোকসভা নির্বাচনের প্রাক্কালে জনসভা তার নির্বাচনী ইশতেহারে রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত এবং পরিকল্পিত অর্থনীতির সপক্ষে কথা বলে। ১৯৭১ সালে স্বয়ংসেবক সঙ্গের তৎকালীন সরসচালক মধুকর দত্তাত্রেয় দেওরস (বালাসাহেব দেওরস) স্বীকার করেন যে সঙ্গের কোন নির্দিষ্ট আর্থিক নীতি নেই। ১৯৯১ সালের নির্বাচনের সময় বিজেপি অর্থনৈতিক উদারীকরণ এবং বিনিয়ন্ত্রণের পক্ষে অবস্থান নেয়। এই সময়ে লক্ষণীয় যে বিজেপি বিনিয়ন্ত্রণের পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করা সত্ত্বেও স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ তার “স্বদেশী”র এজেন্ডাকে ধরে রাখে। অর্থনৈতিক নীতির প্রশ্নে নয়ের দশকের শেষ দিক থেকে বিজেপি কংগ্রেসের চেয়েও অধিকতর দক্ষিণপন্থী অবস্থান গ্রহণ করেছে। বিজেপি-র গঠনতন্ত্রের ৪ নং ধারায় বলা হয়েছে যে তারা আর্থ- সামাজিক ইস্যুতে গান্ধীবাদী দৃষ্টিভঙ্গিকে সমর্থন করে সাম্যের ভিত্তিতে সমাজলগঠনের উদ্দেশ্যে! অর্থাৎ নয়ের দশক থেকে বিজেপি র গৃহীত আর্থিক নীতি তাদের নিজেদের গঠনতন্ত্রের সঙ্গেই সামজসাহীন। বাজপেণী জমানায়, ভারতের ইতিহাসে প্রথমবার লাভজনক রাষ্ট্রায়ার শিল্প জলের দরে বিক্রি করে দেওয়ার উদ্দেশ্যে একটি আস্ত “বিলগ্নীকরণ মন্ত্রক” গঠিত হল অরুণ শৌরিকে মন্ত্রী করে। এই সময়কালে প্রথমবার রাষ্ট্রায়ত্ত্ব শিল্পে সরকারের অংশীদারী বিক্রি করার ক্ষেত্রে ‘স্ট্যাটেজিক সেলা, অর্থাৎ রাষ্ট্রায়ত্ব শিল্পের সরাসরি বেসরকারীকরণের পদ্ধতি গ্রহণ করা হয়। ছত্তিশগড়ে অবস্থিত ভারত অ্যালামিনিয়াম কোম্পানি বা বালকো”-কে একই পদ্ধতিতে তুলে নেওয়া হয় বেসরকারি পুঁজির হাতে, শ্রমিক কর্মচারীদের প্রবল বিরোধীতা সত্ত্বেও। এই সময়েই ভারতের অর্থনীতিকে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ কমিয়ে সবচেয়ে বেশি উন্মুক্ত করা হয় বিদেশী পুজির জন্য। আর্থিক দায়িত্ব ও বাজেট পরিচালন আইন, ২০০০ প্রণয়ন করে রাজ্যগুলির সামাজিক ক্ষেত্রে ব্যয়বরাদ্দের স্বাধীনতা খর্ব করা হয়। শিক্ষা, স্বাস্থ্য সহ বিবিধ ক্ষেত্রে বায়বরান্স সংকোচন সবচেয়ে জোরালো ভাবে প্রয়োগ করা হয় বাজপেয়ী আমলে।
স্বাধীনতা পরবর্তী ভারতে ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনে নিজেদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে সঙ্ঘ জন্ম দেয় ভারতীয় মজদুর সঙ্গের। মূলত শ্রমিকদের ধর্মীয় পরিচিতিসত্তার ভিত্তিতে গড়ে তোলা হয় এই সংগঠন। বিগত কয়েক বছরে যখন সর্বভারতীয় স্তরে ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনে দলীয় অনুমোদন নির্বিশেষে ঐক্য স্থাপন হচ্ছে, সেই সময় দেখা যাচ্ছে যে কেন্দ্রে বিজেপি নেতৃত্বাধীন সরকার থাকলে বিএমএস শিল্প ধর্মঘট বা যে কোনো সরকার বিরোধী সংগঠিত কর্মসূচীতে অংশগ্রহণ করে না।
উদারীকরণের আড়াই দশকে বিজেপি নিজেকে বৃহৎ পুঁজির কাছে গ্রহণযোগ্য করে তুলেছে। সোভিয়েত তথা পূর্ব ইউরোপে সমাজতন্ত্রের পতন এবং এক মেরুর বিশ্ব পুঁজিকে আরো হিংস্র করে তুলেছে। এই পুঁজির প্রয়োজন হয় তার বিরুদ্ধে সম্ভাব্য যাবতীয় প্রতিরোধকে পর্যুদস্ত করতে পারে, এমন রাষ্ট্র ব্যবস্থার। একচেটিয়া পুঁজির এই পর্যায়ে সরাসরি বিরোধ তাই গণতান্ত্রিক যাবতীয় কাঠামোর সাথে। এই বিরোধে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ এবং বিজেপি’র একনায়কতান্ত্রিক রক্ষনশীল মতাদর্শ স্বাভাবিকভাবেই পুঁজির সহায়ক। গোলওয়ালকার থেকে লালকৃষ্ণ আদবানি, প্রত্যেকেই কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে রাষ্ট্র ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ এবং রাজ্যের ক্ষমতা খর্ব করা’র পক্ষে। যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর প্রতি অনীহা, সংসদীয় ব্যবস্থার পরিবর্তে প্রেসিডেন্সিয়াল শাসন ব্যবস্থার প্রতি সমর্থন বিভিন্ন সময়ে ব্যক্ত করেছে বিজেপির বহু নেতা।
২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে লোকসভায় বিজেপি’র একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা এ দেশের রাজনীতিতে বৃহৎ কর্পোরেট পুঁজির আধিপত্যের এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে। বল্গাহীন কর্পোরেট স্বার্থবাহী ‘গুজরাট মডেল’-এর প্রয়োগ ঘটানোর চেষ্টা চলছে গোটা দেশ জুড়ে। নামমাত্র ক্ষতিপূরণ/ পুনর্বাসন দিয়ে গরিব কৃষকের জমি কেড়ে নিয়ে কর্পোরেটদের হাতে তুলে দেওয়া, পুঁজিপতিদের বিরাট অংকের কর ছাড়, পরিবেশ সংক্রান্ত যাবতীয় আইনকে নস্যাৎ করে কর্পোরেটনের হাতে প্রাকৃতিক সম্পদ তুলে দেওয়া, শিক্ষা/ স্বাস্থ্য খাতে ব্যায়বরাদ্দ সংকোচন- এ সবই মোদী’র ‘গুজরাট মডেলের’ বৈশিষ্ট্য। এই শ্রেণী দৃষ্টিভঙ্গির কারণেই অভূতপূর্ব কর্পোরেট সাহায্য পায় বিজেপি ২০১৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে।
সরকার গঠনের অনতিকাল পরেই মোদী সরকার পরিবেশগত দিক থেকে বহু স্পর্শকাতর অঞ্চলে বিবিধ ব্যাক্তিমালিকানাধীন শিল্প প্রকল্পে অনুমোদন দেয় যাবতীয় আইনকে শিথিল করে। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সংশ্লিষ্ট গ্রাম সভার যে অনুমোদন নেওয়ার প্রয়জনীয়তা আইনে রাখা হয়েছিল, তা প্রায় খারিজ করে দেওয়া হয় এই সরকারের আমলে এবং গ্রে জেলাশাসকের অনুমোদনসাপেক্ষ করা হয়। পরিবেশদূষণের কারণে আন্তর্জাতিক নিয়ম মেনে যে সকল কলকারখানার উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছিল বিগত সরকারের আমলে, তা রাতারাতি তুলে নেওয়া হয় সরকারে আসীন হওয়ার পরে। প্রতিরক্ষা খাতে বিদেশী বিনিয়োগ, আর্থিক পরিষেবা, নির্মাণশিল্পে ১০০% বিদেশী বিনিয়োগ, প্রতিটি ক্ষেত্রেই একচেটিয়া পুঁজির প্রবেশ ত্বরান্বিত করা হয়েছে এই সরকারের আমলে। বিরাষ্ট্রীয়করণের বিপুল কর্মসূচী গ্রহণ করা হয়েছে। পরিকল্পনা কমিশনকে তুলে দিয়ে নীতি আয়োগ গঠন করা হয়েছে গণতান্ত্রিক নজরদারির পরিসরটিকে কমিয়ে আনতেই। বস্তুত, মোদী সরকারের আড়াই বছর সময়কালে সর্বোচ্চ বিত্তশালী এক শতাংশের হাতে সম্পদের কেন্দ্রীভবন ৪৯ শতাংশ থেকে বেড়ে ৫৮ শতাংশের বেশি হয়ে গেছে।
একই সঙ্গে শ্রমজীবী মানুষ ও ট্রেড ইউনিয়নের ওপরে ধারাবাহিক আক্রমণ চালানো হচ্ছে। সরকারে আসার অনতিকাল পরেই Small Factories (Regulation of Employment and Other Conditions of Service) Act, 2014 প্রণয়ন করা হয় যার ফলে ১৬টি শ্রম আইনের তুলনামূলক নিরাপত্তার আওতার বাইরে চলে যায় মোট শ্রমিক সংখ্যার প্রায় ৫%। Industrial Disputes Act অনুযায়ী যে সকল কারখানায় ১০০র অধিক শ্রমিক সংখ্যা, সেখানে ছাঁটাই করার আগে সরকারী অনুমতির প্রয়োজন ছিল। সেই শ্রমিক সংখ্যা এই সরকারের আমলে বাড়িয়ে ৩০০ করা হয়েছে। এর ফলে এ দেশের প্রায় ৯৩% কারখানায় বসাহীন ছাঁটাইয়ের রাস্তা করা হচ্ছে। এর পাশাপাশি সরকারে আসার পর প্রথম আর্থিক বছরেই প্রায় ৬০০০০ কোটি টাকা কর ছাড় দেওয়া হয়েছে ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলিকে। অথচ গণবন্টন ব্যবস্থাকে ক্রমাগত দুর্বল করা হচ্ছে “টার্গেটেড সাবসিডি’র নামে। অনৈতিকভাবে সুবিধা পাইয়ে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে আদানি গোষ্ঠী/ রিলায়েন্স গোষ্ঠীর ক্ষেত্রে।
হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক শক্তি ও কর্পোরেটের পারস্পরিক সম্পর্ক ভারতীয় রাজনীতির সবচেয়ে গুরুতর ও দীর্ঘস্থায়ী বিপদ। একদিকে বড় পুঁজিকে যাবতীয় সমর্থন যোগানো এবং উন্নয়নের একমাত্র রাস্তা হিসাবে তাকে প্রতিপন্ন করা, অন্যদিকে বিরুদ্ধমত, গণতান্ত্রিক যাবতীয় ব্যবস্থার কণ্ঠরোধ করার যৌথ অভিযানে অনেক দূর পর্যন্তই এগিয়েছে সঙ্ঘ ও তার শাখা-প্রশাখা। ভারতীয় সমাজে তার মতাদর্শগত ভিত্তি আরো গভীর করার কর্মসূচী ও অব্যাহত।
মার্কসবাদী পথ পত্রিকার ফেব্রুয়ারি-মার্চ,২০১৭ সংখ্যায় প্রকাশিত প্রবন্ধ