Marx near Death

Here I stand, I can do no other: A Retrospect

সৌভিক ঘোষ

প্রবল ধূমপানের অভ্যাসটি শেষে ছাড়তেই হল। চিকিৎসক জবাব দিয়ে গেছেন, ফুসফুসের সংক্রমণ তার স্বাভাবিক জীবনযাপন অনেকটাই ব্যহত করে দিয়েছে। জীবনের বেশিরভাগটাই ইউরোপের এক দেশ থেকে আরেক দেশে ছুটে বেড়িয়েছেন, ‘এবার থামার সময় হয়েছে’- চিঠিতে পিতার সেই একান্ত অনুভব ঠিকই উপলব্ধি করেছিলেন কন্যা ইলিয়নর। একটা লম্বা সময় জুড়ে তিনিই ছিলেন মার্কসের প্রধান সচিব। সেই চিঠির সাথেই ছিল আরেকটি জিনিস, একটি ছবি। চুল দাড়ি কাটার আগে ক্যামেরার দিকে চেয়ে মুচকি হাসছেন মার্কস। জীবিত অবস্থায় এটাই তার শেষ ছবি।   

মার্কসের শেষ ছবি, ১৮৮২-র জানুয়ারি

মুখ ভর্তি দাড়ি ও মাথাজোড়া চুল সমেতই আমরা তাকে দেখতে অভ্যস্ত। আলজিয়ার্সের সেলুনে আয়নার সামনে বসে চুল দাড়ি কেটে ফেলার আগে মার্কস কি ভেবেছিলেন এবার তাকে কেমন দেখাবে? প্রগলভতা বলে যে তার চরিত্রে কিছু থাকতে পারে এমন সম্ভাবনায় আমাদের কিছুতেই বিশ্বাস হয় না। সারাজীবন যুক্তিকে আবেগের উর্ধে স্থান দিয়েছেন বলেই হয়ত। যকৃৎের ক্যান্সারের সাথে লড়াইতে জেনি হেরে গেলেন ১৮৮১ সালের ২রা ডিসেম্বর- লন্ডনের হাইগেট সমাধিক্ষেত্রে মাটির নিচে চাপা পড়ার সময়ও কার্ল নিজের স্ত্রীর পাশে থাকতে পারলেন না, গুরুতর অসুস্থ শরীর তাকেও কাবু করে নিয়েছিল। ফ্রেডেরিক এঙ্গেলস লিখলেন ‘জেনির সাথেই মার্কসও আজ থেকে ফুরিয়ে গেলেন’।

ছোটবেলায় পিতার জন্য মেয়েদের প্রশ্ন ছিল আরেকবার জীবন ফিরে পেলে কিভাবে বাঁচবেন? এই জীবনে যা কিছু করেছেন সেসবই আবার করতে চাইবেন, শুধু বিবাহ করবেন না। তারই জন্য জেনিকে সারাজীবন অসহ্য যন্ত্রণা সহ্য করতে হয়েছে- নিজের ভালোবাসার মানুষটিকে আরও একবার সেই যন্ত্রণা দিতে চান না কার্ল।

জেনির মৃত্যুর পরে কার্ল মার্কসের শরীর আর কখনোই আগের অবস্থায় ফেরেনি, গোটা দুনিয়াটা বদলে দেওয়ার রূপরেখা এঁকে ফেলা মানুষটি অবশ্য শেষ অবধি লড়েছিলেন। তাই ১৮৮২ নাগাদ শেষবারের মতো বেরিয়ে পড়েন। মার্শিলি, মন্টি কার্লো হয়ে পৌঁছেছিলেন নাইস অবধি, সেখান থেকে সোজা প্যারিস। হঠাৎ প্যারিস কেন? প্যারিসের উপকণ্ঠেই ছোট্ট শহর আর্জেন্ট্যুইল। সেখানেই তখন থাকেন তার কন্যা জেনি লঙ্গুয়েট (ফরাসী শ্রমিক আন্দোলনের বিশিষ্ট নেতা চার্লস লঙ্গুয়েটকে বিবাহ করেন জেনি)। নাতি নাতনিদের বরাবর কাছে পেতে চাইতেন মার্কস, সবচাইতে পছন্দের ক্ষুদেটির নাম ছিল জনি। জেনির লেখাজোখা থেকে জানা যায় আসলে জনি’র মধ্যে কার্ল নিজের মৃত পুত্রসন্তান এডগার’কে খুঁজে পেয়েছিলেন। মাত্র আট বছর বয়সে এডগার মারা যায়। সঠিক চিকিৎসা কিংবা পরিচর্যা, সন্তানকে বাঁচাতে মার্কস পরিবারের তখন কোনটারই সংস্থান নেই- এমনই ভয়ানক অভাব। মৃত সন্তানকে বুকে জড়িয়ে ধরে জেনি সারা রাত কাটিয়ে দিয়েছিলেন, সকাল হলে কফিনের টাকাটুকু জোগাড় করতে যাবেন পিতা মার্কস- এই আশায়। সারা দুনিয়ার সকলের মুক্তির পথ খুঁজতে পুঁজি’র রহস্যভেদ করেছেন যিনি, তার নিজের পুঁজি কবরে গেছিল পরের দিন। সন্তানকে কবরে শুইয়ে এসে ঘরে ফিরে ম্যাঞ্চেস্টারে চিঠি লিখে এঙ্গেলসকে জানিয়েছিলেন ‘দুঃখ কাকে বলে এখন এই মুহূর্তে উপলব্ধি করছি। এইবার সত্যিই ভেঙ্গে পড়েছি’। তবু জেনি কিংবা কার্ল কেউই নিজেদের আদর্শ কিংবা লক্ষ্য হতে বিচ্যুত হননি- একদিন আমার স্বামীর এই কাজের জন্যই ভবিষ্যতের কোনও মায়ের কোল শুধুমাত্র অভাবের তাড়নায় খালি হবে না, এই ছিল জেনির প্রত্যয়। সেই পিতা মার্কসই নাতি জনির মধ্যে এডগারের ছায়া দেখতে পেতেন- আমাদের মনে রাখতে হয় মার্কসও রক্তমাংসের মানুষই ছিলেন, বিপ্লবী ছিলেন বলেই সেই সত্ত্বাটুকু চিরকাল চাপা দিয়ে রেখেছিলেন, বিপ্লবী ছিলেন বলেই সেই কাজে সফল হয়েছিলেন।

প্যারিসে থাকাকালীন মার্কস নিজেকে আরেকবার খুঁজে পেতে চেয়েছিলেন। ইতিপূর্বে জেনি (কন্যা)-কে চার্লস লঙ্গুয়েটের সাথে বিবাহে প্রবল আপত্তি জানিয়েছিলেন। একসময় যার বিরুদ্ধে প্রবল যুদ্ধ করতে হয়েছে সেই পেটি বুর্জোয়া তাত্ত্বিক পিয়ের জোসেফ প্রুধোঁ’রই ভক্ত ছিলেন চার্লস লঙ্গুয়েট ও তৎকালীন ফরাসী সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের আরও প্রমুখ কয়েকজন- তাই জন্যই কি? অথচ এরাই উঠতে বসতে নিজেদের মার্কসবাদী বলে চিহ্নিত করতেন। একসময় চার্লস’রা মিশরে সেনা অভিযানের সমর্থনে প্রকাশ্যে বিবৃতি অবধি দিলেন- এমন কাজকর্মে অস্থির হয়েই মার্কস বললেন ‘আর যাই হোক, এটুকু অন্তত নিশ্চিত যে আমি মার্কস- মার্কসবাদী নই’। জেনি জানতেন স্বামীর রাজনৈতিক অবস্থানের প্রতি পিতা ভয়ানক হতাশ, তাই বোধহয় তার নিজের শরীরেও যে মায়ের মতোই ঘাতক ক্যান্সার হানা দিয়েছে সেকথাটুকু লুকিয়ে রাখলেন।

কন্যা, নাতি নাতনীদের সাথে আনন্দের কটা দিন কাটিয়েই তিনি আলজিয়ার্সে এসে পৌঁছান। প্রকৃতির সৌন্দর্য তাকে চিরকাল প্রেরণা দিয়েছে- সেকথা আর কেউ না জানলেও জেনি (স্ত্রী) জানতেন। সেই মানুষটি আর নেই- তবু মার্কস রাতের আকাশ দেখতে বসে কলম ধরেছিলেন। ‘গতকাল সন্ধ্যায় চমৎকার চাঁদের আলো উপভোগ করতে পেরেছি, সমুদ্রের ধারে বইতে থাকা হাওয়ার বেগ আমাদের কনসার্ট শুনিয়েছে… ব্যালকনিতে বসে থেকে আমি একটানা সমুদ্রের দিকেই তাকিয়ে ছিলাম, অন্য কিছুই দেখতে চাইনি’।

ছাত্র থাকাকালীন যার চেতনায় রুশো, ভলতেয়ার থেকে শুরু করে হেগেল ও ফয়েরবাখ অবধি দর্শন, বিজ্ঞান, আইন, ইতিহাস এবং সাহিত্য অবধি জ্ঞানের এক বিপুল সংশ্লেষ নির্মিত হয়েছিল, যিনি আত্মস্থ করেছিলেন ইংরেজদের অর্থনীতির সারকথাটুকু- ফরাসী বিপ্লবের বিশ্বজনীন মূল্যবোধ যার মধ্যে দিয়ে সর্বোচ্চরূপে প্রকাশিত  হয়েছিল সেই মার্কস ব্যালকনিতে বসে প্রকৃতির শোভা উপভোগ করছেন, চিঠি লিখে সেকথা জানাচ্ছেন। জেনি আর বেঁচে নেই তাই চিঠিতে ম্যাঞ্চেস্টারের ঠিকানা লিখে দিলেন। সেখানে মার্কসের অপেক্ষায় রয়েছেন তারই কমরেড ইন আর্মস। জেনির পরে যাকে সব কথা খুলে বলতেন, না বললেও যিনি প্রায় সবটা বুঝতেন সেই মানুষটিই ফ্রেডেরিক এঙ্গেলস।

তাই মার্কসের কবরের পাশে দাঁড়িয়ে তার প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করতে গিয়ে এঙ্গেলস বলেছিলেন ‘একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্যের দিকে এগোনোর কাজে এমন কেউই নেই যিনি অজাতশত্রু। এমনই কতিপয় শত্রুকে মার্কস পৃথিবীতে রেখে গেলেন। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড তাকে ইউরোপের এমন একজনে পরিণত করেছে যার নামে সবচেয়ে বেশি ঘৃণা এবং কুৎসা প্রচার করা হয়েছে। কদাচিৎ কখনো কেউ তার নামে অপবাদ দেবার সাহস দেখিয়েছে। মৃত্যুর পূর্বে সেইসব অপবাদের সম্মুখে জবাব হিসাবে তিনি দেখে গেলেন পৃথিবী জূড়ে তার লক্ষ লক্ষ সমর্থক- সাইবেরিয়ার খনি থেকে ইউরোপ এবং আমেরিকার কারখানা অবধি যারা বিস্তৃত, ব্যাপ্ত। তিনি নিশ্চিত ছিলেন পৃথিবীজূড়ে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় তাঁর আবিষ্কৃত অর্থনৈতিক তত্ত্বই হবে বুনিয়াদি শক্তি। অত্যন্ত জোর দিয়েই বলা যায় মার্কস ছিলেন এমন একজন যার মতের বিরোধী হয়ত অনেকেই কিন্তু ব্যাক্তিগত শত্রু একজনও নেই’।  

এর কিছুদিন বাদেই লিখেছিলেন- ‘আলজিয়ার্স’কে বিদায় জানানোর সময় হয়েছে’। জরুরী অনেক কিছুই লিখে যাওয়া বাকি থেকে গেছে অনুভব করছিলেন হয়ত, সময় কম উপলব্ধি করছিলেন- তাই লরা’কে (লরা লাফার্গ) চিঠিতে লিখে জানিয়ে গেলেন ইদানিং ইউরোপীয় বোদ্ধাসমাজ আরব সভ্যতা সম্পর্কে তাচ্ছিল্য প্রকাশকে অভ্যাসে পরিণত করেছে। তারা ভুলে গেছে একসময় তারা এদের থেকেই অনেক কিছু শিখেছে… বীজগণিত, হিসাবরক্ষণ এমনকি বাণিজ্য অবধি। যে দার্শনিক অভীক্ষার অহংকারে ইউরোপ নিজেকে শ্রেষ্ঠ প্রমাণে ব্যাস্ত সেই জ্ঞান আসলে কেমন?

অকেজো, বুকনিসর্বস্ব জ্ঞানের মুখোমুখি বিপ্লবী মেধা কেমন হয়?

লরা লাফার্গকে লেখা চিঠিতে এক কাল্পনিক কথোপকথনের মাধ্যমে কার্ল মার্কস সেই প্রমাণ রেখে গেছেন-  

নৌকা সমেত এক মাঝি নদীর ধারে যাত্রীর জন্য অপেক্ষারত।

যাত্রী হিসাবে এক দার্শনিক উপস্থিত হলেন।

নৌকা যখন কিছুটা এগিয়েছে তখন দার্শনিক জানতে চাইলেন- ‘মাঝি! তুমি ইতিহাস জানো?’

না সাহেব!

সেকি কথা! তাহলে তো তোমার জীবনের অর্ধেকটাই ফাঁকি রয়ে গেল হে!

তা হবে সাহেব!

আরও কিছুক্ষণ পরে দার্শনিক আবার জানতে চাইলেন- ‘বলি হে মাঝি! গনিত-টনিত কিছু জানো নিশ্চই?’

না সাহেব, জানিনে!

বল কি! তাহলে তো তোমার জীবনের অর্ধেকেরও বেশি গোল্লায় গেল হে!

এমন সময় সমুদ্রে ঝড় এল। নৌকা সেই ধাক্কায় দল খাচ্ছে- উল্টে যায় যায় অবস্থা!

এবার মাঝি জানতে চাইল- ‘সাহেব একটা কথা বলি, বলি সাঁতার জানেন তো?’

না হে! ওটা তো শিখিনি!

তাহলে সাহেব! আপনার যে গোটা জীবনটাই জলে গেল!

মার্কস। কার্ল হাইনরিখ মার্কস। আজকের দুনিয়ায় আরেকবার প্রমাণ করার চেষ্টা চলছে তিনি আসলে জ্ঞানী, মেধাবী- অসাধারণ পণ্ডিত- আর কিছু নন। মার্কসের বিপ্লবী সত্ত্বাটিকে চেপে রাখার উদ্দেশ্যেই তারা যারা এসব করছেন। সেই সত্বাই পরে লেনিন’কে নির্মাণ করেছিল, বিপ্লব সম্পন্ন করেছিল।

সেইসব কথা যাতে সবাই ভুলে যায় তাই এমন জঘন্য প্রচেষ্টা।

আজ কার্ল মার্কসের মৃত্যুদিবসে অন্য অনেক কিছুর মতো সেকথাও মনে রাখতে হয়।

সুত্রঃ

লাভ অ্যান্ড ক্যাপিটাল – মেরি গ্যাব্রিয়েল, ব্যাক বে বুকস, ২০১২

ইলিয়েনর মার্কসঃ আ লাইফ – র‍্যাচেল হোমস, ব্ল্যুমসবিউরি,২০১৬

মার্কসঃ জ্যুরগেন নেফে (ইংরেজি অনুবাদ- শেলি ফ্রিশ্‌) – সি বার্তলসম্যান ভার্ল্যাগ, ২০১৭

অ্যানাদার মার্কস – মার্সেলো মুস্তো, ব্ল্যুমসবিউরি আকাদেমিক,২০১৮

Spread the word

Leave a Reply