প্রাককথন
শারদোৎসবের সময়। কলকাতার রাজপথে জুনিয়র চিকিৎসকেরা অনশন করছেন। সিনিয়র চিকিৎসকেরাও তাদের সমর্থনে এগিয়ে আসছেন, অনশন মঞ্চে সক্রিয় উপস্থিতির পাশাপাশি ন্যায্য দাবীর লড়াইকে মজবুত করতে রীতিমত সোচ্চার হচ্ছেন। যদি শুধু এটুকুই কথা হত তবে সম্ভবত বিষয়টি ডাক্তারদের ব্যাপার-স্যাপারে পরিণত হত। তেমনটি আদৌ ঘটেনি, প্রথম থেকেই এ লড়াই গণআন্দোলনের চেহারা নিয়েছে। গোটা রাজ্য, দেশের বিভিন্ন প্রান্ত এমনকি বিদেশের মাটিতেও তিলোত্তমার বিচারের দাবিতে মানুষ রাস্তায় নেমেছেন। বিচার মানে কি কেবল একজন মহিলা চিকিৎসকের নৃশংস অত্যাচার ও মৃত্যুর প্রতিবাদ? যে ব্যবস্থা, যে তন্ত্র এমন পরিবেশ তৈরি করে অথচ একের পর এক ঘটনাকে একে অন্যের থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখতে, বুঝতে ও দেখাতে সমর্থ হয়েছে তাকে প্রশ্নের সামনে দাঁড় করানোই আজকের লড়াইতে অন্যতম প্রসঙ্গ।
ঠিক এখানেই শাসকের অস্বস্তি। যত বেশি করে এ লড়াই, এ আন্দোলন মানুষের মূল লড়াইের কাছাকাছি যাবে, মূল লড়াইয়ের সাথে সম্পৃক্ত হবে ততই সামনে চলে আসবে আসলে কারা দায়ী? কাদের দায়?
শাসকের বহু প্রচেষ্টার পরেও যা কিছু ঘটছে তাতে স্পষ্ট মানুষ কিছুতেই ব্যাপারটা ভুলে যেতে চাইছেন না। লড়াইটা কিছুতেই একজনের বিচ্ছিন্ন ঘটনায় পর্যবসিত হচ্ছে না। রাজপথের জনরোষ গণবিক্ষোভে রূপান্তরিত, এতে পর্দার আড়াল নেই। আড়াল যদি কোথাও থাকে তবে তা রয়েছে একে দেখার, দেখানোর কৌশলে। এ হল সেই পন্থা যাতে ধরে নেওয়া হয় জনসাধারণ অনেকটা মাটির তালের মতো, চাইলেই চাপ দিয়ে তার আকৃতি বদলে দেওয়া যায়। এর বিপরীতেই মানুষের লড়াই। এর প্রতিরোধই এ মুহূর্তের কর্তব্য।
একদিকে জনগণ, আরেকদিকে গণশত্রুরা।
এ লড়াই শেষ অবধি সকলের। উৎসবের আবহ মানুষকে ভাগ করেনি, তাদের একে অন্যকে পরস্পরের আরও পাশে এনে দাঁড় করিয়েছে।
সে কথাই তিন পর্বে প্রকাশিত হচ্ছে।
আজ দ্বিতীয় পর্ব।
সম্পূর্ণ লেখাটি প্রকাশিত হবে পর পর তিনদিন, রাজ্য ওয়েবসাইটের নিজস্ব প্রতিবেদন।
শ্যামাশীষ ঘোষ
স্বাস্থ্য ব্যবস্থার হাল
আমাদের দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা বেশ নড়বড়ে ভিত্তিতে দাঁড়িয়ে। স্বাস্থ্যের বিভিন্ন সূচকে আমরা ক্রমশই নেমে চলেছি। সাম্প্রতিক স্বাস্থ্যসূচকে বিশ্বগুরু হতে চাওয়া ভারতের স্থান ১৯৫ টি দেশের মধ্যে ৬৬ নম্বরে। স্বাস্থ্যের সঙ্গে অন্তরঙ্গ সম্পর্কযুক্ত বিশ্ব ক্ষুধা সুচকে ১২৫ টি দেশের মধ্যে আমাদের স্থান ১১১ নম্বরে। স্বাস্থ্য সূচকে যারা প্রথম সারির দেশ, তাদের একটা বড় অংশই সরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবা বা সরকারি বিমাব্যবস্থার উপর ভিত্তি করে আছে। দেশের এই নড়বড়ে স্বাস্থ্যের হাল নিয়ে অমর্ত্য সেন তিনটি মূল ব্যর্থতার কথা বলেছেন।
এক, প্রাথমিক স্বাস্থ্য এবং জনস্বাস্থ্যের ব্যাপারে চূড়ান্ত অবহেলা।
দুই, বেসরকারি স্বাস্থ্যপরিষেবার ওপরে অত্যধিক নির্ভরতা এবং সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থাটিকে ক্রমাগত লাটে তুলে দেওয়ার প্রচেষ্টা। এই দুইয়ের মধ্যে অবশ্যই গভীর সংযোগ আছে।
তিন, স্বাস্থ্য নিয়ে সচেতন আলোচনার অভাব এবং স্বাস্থ্যকে এজেন্ডা হিসাবে তুলে আনায় অনীহা।
স্বাস্থ্য নিয়ে সচেতন আলোচনা ওপরের কথাগুলো বাদ দিয়ে চলতে পারে না। শুধুমাত্র দুর্নীতিকে দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার একটি বড় সমস্যা হিসাবে দেখাতে চাইলে, বা দুর্নীতির জন্যই আমাদের দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার এই হাল, এই ভাবনায় আচ্ছন্ন থাকলে সমস্যার প্রকৃত গভীরতায় পৌঁছতেই পারব না। অমর্ত্য সেন উল্লিখিত তিনটি বিষয়ের মধ্যে সংযোগটা দেখা দরকার, বোঝা দরকার। জনস্বাস্থ্য বা প্রাথমিক স্বাস্থ্যে বিনিয়োগে চিকিৎসাজনিত বাণিজ্যিক লাভ নেই, ফলে বেসরকারি বিনিয়োগের অভাব। চিকিৎসায় বাণিজ্যিক লাভ আসে যেখানে রোগের চিকিৎসা, সেখানে। ফলে এখানে বিনিয়োগের দায় সরকারের। কিন্তু, সরকার জনস্বাস্থ্যে নজর দিলে রোগের প্রকোপ কমে। তাতেও কর্পোরেট হাসপাতালের জন্য চাহিদা কমে। সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থায় বিনামূল্যে বা নামমাত্র মূল্যে চিকিৎসা পাওয়া গেলে, মানুষ কর্পোরেট হাসপাতালে ছুটবেন না। কাজেই, জনস্বাস্থ্য-প্রাথমিক স্বাস্থ্যে অবহেলা, সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলিকে অপটু করে রাখা একটি সচেতন রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। এই রাজনীতি, এই শ্রেণিস্বার্থ রক্ষার রাজনীতিকে লোকচক্ষুর আড়ালে রাখতে গেলে সাধারণ মানুষকে অসচেতন করে রাখা জরুরি। তাই, অহরহ আমাদের বোঝানো হচ্ছে, There is no alternative!
এই বিষবৃক্ষের চারাটি কিন্তু পোঁতা হয়েছিল আপনার আমার চোখের সামনেই, যখন স্বাস্থ্য শব্দটিকে নীতিনির্ধারকেরা বদলে দিয়েছিলেন স্বাস্থ্যপরিষেবায়। নাগরিক সমাজকে ভাবতেই হবে, আমাদের নীরবতা, সবকিছুকে মেনে নেওয়ার প্রবণতাও কি দায়ী নয়? স্বাস্থ্য নিয়ে আলোচনা করতে বসলেই হয় ডাক্তারদের আদ্যশ্রাদ্ধ বা অসাধারণ বিক্ষিপ্ত কিছু তাকলাগানো কর্মকাণ্ড বা কিছু ডাক্তারের পিশাচপনা, মেডিক্যাল কোম্পানি থেকে বা টেস্টিং হাউসগুলো থেকে নানা সুযোগসুবিধা, কমিশন খাওয়া এসবেই মগ্ন হয়ে যাই আমরা। কিন্তু কেমন করে দেশের জন্য একটা জুতসই স্বাস্থ্যব্যবস্থা বা স্বাস্থ্যকাঠামো গড়ে তোলা যায়, এমন আলোচনার কথা উঠলেই আমাদের সব উৎসাহ যেন উবে যায়।
নতুন জাতীয় স্বাস্থ্যনীতি, ২০১৭
২০১৭ সালের মার্চ মাসে পাস হয়েছে, তথাকথিত ‘ঐতিহাসিক’ নয়া জাতীয় স্বাস্থ্যনীতি। কিন্তু মিডিয়াতে সে খবর তেমনভাবে আসে নি। নানাবিধ খবর আলোচিত হতে থেকেছে দিনের পর দিন। কিন্তু, দেশের স্বাস্থ্যনীতি ঘোষিত হল, যে-নীতির পথ ধরে অনেকগুলো বছর ধরে এগোবে (বা পিছোবে) দেশের স্বাস্থ্য – সেটা নিয়ে তেমন আলোচনা হল কই! জাতীয় স্বাস্থ্যনীতি খায় না মাথায় দেয় সেই নিয়ে এই ধরণের মানুষদের কোনো মাথাব্যথা নেই। এর ফাঁকেই ঘটিয়ে ফেলা হচ্ছে জাতীয় স্বাস্থ্যনীতির মত বড় বড় ঘটনাগুলো।
সেই অনেক আগে, জনস্বাস্থ্য আন্দোলনের প্রাণপুরুষ, ক্রোয়েশিয়ান, আন্দ্রিজা স্ট্যাম্পারের প্রদত্ত সংজ্ঞাটি গ্রহণ করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলল, ‘অসুখ বা অসুস্থতাহীন থাকাটাই শুধু নয়, সুস্থ থাকার অর্থ শারীরিক, মানসিক এবং সামাজিকভাবে ভালো থাকা’। এবং এই ব্যাপক অর্থে ভালো থাকায় সংজ্ঞায়িত যে স্বাস্থ্য – সেই স্বাস্থ্য, বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থা প্রতিশ্রুত হল, সকলের কাছে পৌঁছে দেবে ২০০০ সালের মধ্যেই – Health for all by 2000 (HFA2000)। সালটা ছিল ১৯৭৮।
আমাদের দেশেও সেই একই লক্ষ্যে প্রণীত হল প্রথম জাতীয় স্বাস্থ্যনীতি – ১৯৮৩ সালে। এর আগে পর্যন্ত মোটামুটি কয়েকটি কমিশনের রিপোর্ট বা সামগ্রিক পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার অঙ্গ হয়েই চলছিল স্বাস্থ্যের বিষয়টি। প্রথম জাতীয় স্বাস্থ্যনীতিতে স্বাস্থ্যের সামাজিক প্রেক্ষিতটি – সাম্য, স্বাধীনতা ও সামাজিক ন্যায় – মেনে নেওয়া হল। মেনে নেওয়া হল স্বাস্থ্যব্যবস্থার খামতির দিকগুলি – শুধুমাত্র পশ্চিমি চিন্তার অনুকরণ, দেশের মানুষের দারিদ্র বা অপুষ্টির দিকে নজর না-দেওয়া ইত্যাদি। এখনকার মত স্রেফ জিডিপি, আর্থিক বৃদ্ধি আর চুঁইয়ে পড়ার অঙ্কেই সব কঠিন সমস্যার সরল সমাধান হয়ে যাবে, এমন স্বপ্ন দেখানো হয়নি। তিরাশি সালের সেই স্বাস্থ্যনীতিতে মেনে নেওয়া হল, স্বাস্থ্যবাজেটের সিংহভাগ চলে যায় চিকিৎসার পেছনে, জনস্বাস্থ্যের বিষয়টি অবহেলিত। সমস্যানিরূপণের পাশাপাশি করা হল সমাধানের দিকনির্দেশ। সরকার চাইলেন, সকলের জন্য প্রাথমিক স্বাস্থ্য। গুরুত্ব দিতে চাইলেন পুষ্টি, পানীয় জল, স্বাস্থ্যবিধান, দূষণমুক্ত পরিবেশে; ঠেকাতে চাইলেন খাদ্য বা ওষুধে ভেজাল; অগ্রাধিকার দিতে চাইলেন মা-শিশুর স্বাস্থ্যে, বিদ্যালয়-ভিত্তিক স্বাস্থ্যপরীক্ষা বা সচেতনতায়, কর্মক্ষেত্রে স্বাস্থ্যনিরাপত্তার মত বিষয়ে। এখন তো এসব বিষয় নিয়ে কথাই বলা হয়না। পুষ্টি বলতে আমরা বুঝি আপেল না পেয়ারা কোনটা বেশি উপকারি, পানীয় জল বলতে ভাবি ঠিক কোন কোম্পানির আর-ও সিস্টেম বেশি উপযুক্ত, মা ও শিশুর স্বাস্থ্য বলতে বুঝি মাদার্স হরলিক্স আর ন্যান প্রো, সচেতনতা বলতে অ্যানুয়াল হেলথ চেক আপ।
অবশ্য, উদ্দেশ্য মহৎ হলেও সব সময় লক্ষ্যপূরণ হয় না। সমগ্র বিশ্বের প্রেক্ষিতেই, HFA-2000 ছিল একটা উজ্জ্বল সম্ভাবনা, এগোনো যাচ্ছিল ভালোই। কিন্তু, তার পরেই বিশ্বব্যাঙ্ক আর আই এম এফ তাঁদের আর্থিক সংস্কারের নীতি নিয়ে হাজির হলেন, শুরু হল গণহারে বেসরকারিকরণ, ‘সবার জন্য স্বাস্থ্য’ এই নীতির সার্থকতা নিয়েই শুরু হল প্রশ্ন। এদেশে অর্থনীতির দরজা খুলে দেওয়া হল নব্বইয়ের দশকে – নব্য ভগীরথ হিসাবে স্বীকৃত হলেন মনমোহন সিং। আমরা জানলাম, এতদিন এঁদো গলির মধ্যে অন্ধকারে দিন কাটাচ্ছিলাম – এইবার আলোকপ্রাপ্ত হওয়া গেল।
দু-হাজার দুই সালে এল নতুন স্বাস্থ্যনীতি। ‘সকলের জন্য স্বাস্থ্য’ থেকে সরকার কিছুটা সরে গেলেন। দু-হাজার দশ সালের মধ্যেই স্বাস্থ্যখাতে ব্যয়বরাদ্দ বাড়িয়ে দ্বিগুণেরও বেশি করতে সরকার প্রতিশ্রুত হলেন – জিডিপির তৎকালীন ০.৯% থেকে ২.০%। লক্ষণীয়, স্বাস্থ্যপরিষেবা রাজ্যের বিষয় ও দায়িত্ব, এমনটি বারবার উল্লেখিত হলেও নীতিপ্রণয়ন সীমাবদ্ধ রইল কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রকের কয়েকজনের মধ্যেই – বৃহত্তর অংশের, বিশেষত রাজ্যের, মতগ্রহণের চেষ্টাই করা হল না।
সেই প্রথম স্বাস্থ্যক্ষেত্রে সংস্কারের বিষয়টি খতিয়ে দেখলেন প্রধানমন্ত্রীর শিল্পবাণিজ্য-উপদেষ্টা কমিটি – নেতৃত্বে মুকেশ আম্বানি এবং কুমারমঙ্গলম বিড়লা – স্বাস্থ্যক্ষেত্রে পরামর্শদানের পক্ষে যে আম্বানিজী প্রমুখ বিশেষভাবে দক্ষ ও উপযুক্ত, এমন উচ্চ বিচার ইতিপূর্বে কোনো সরকারের মাথায় তেমনভাবে আসেনি, অন্তত প্রকাশিত হয়নি। হেলথ ট্যুরিজম এবং সেই বাবদ করছাড়, স্বাস্থ্যক্ষেত্রে বেসরকারি লগ্নিবিষয়ে ঢালাও উৎসাহপ্রদান, উন্নত চিকিৎসাক্ষেত্রে বেসরকারি বিমাসংস্থার আবশ্যিকতা – বেসরকারি লগ্নির মুনাফার কথা মাথায় রেখে স্বাস্থ্যনীতি প্রণয়নের সেই শুরু। হ্যাঁ, স্বাস্থ্য যে মুনাফা অর্জনের ক্ষেত্র, স্বাস্থ্যচিকিৎসাকে যে ব্যবসা হিসাবে দেখা যেতে পারে, তার সরকারি স্বীকৃতি সেই প্রথম – স্বাস্থ্যব্যবসা, শিক্ষাব্যবসা, বিমাব্যবসা, সাথে বিজ্ঞাপনব্যবসা।
আর্থিক উদারীকরণের হাত ধরে বেসরকারি লগ্নি এল স্বাস্থ্যক্ষেত্রে। চিকিৎসার উৎকর্ষের কেন্দ্র হিসাবে জনসাধারণের চোখে স্বীকৃত হল পাঁচতারা বেসরকারি হাসপাতালগুলি। সেই স্বীকৃতির পিছনে সত্যতা কতখানি – যাচাই করে দেখার বা খতিয়ে ভাবার প্রয়োজন হল না, কেননা বিজ্ঞাপন আমাদের চোখ ধাঁধিয়ে দিল – শুধু মুখই নয়, আমাদের বিচারশক্তিকেই ঢেকে দিল। এর আগে স্বাস্থ্যক্ষেত্রে বিজ্ঞাপন বলতে ছিল, বিভিন্ন জনকল্যাণমুখী সরকারি প্রকল্পের বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির প্রয়াস।
আর্থিক উদারবাদ ও কর্পোরেট মুনাফালোভিদের স্বাস্থ্যক্ষেত্রে বেপরোয়া ও লাগামহীন খেলতে দিলে যা হয় তা-ই হল। চিকিৎসার খরচ হল লাগামছাড়া। চিকিৎসার জন্য ঘটিবাটি বেচতে বাধ্য হতে শুরু করলেন মানুষ। প্রতিবছর এদেশে নতুন করে কয়েক লক্ষ মানুষ নতুন করে দারিদ্রসীমার নীচে চলে যান। আর দিকে দিকে নতুন করে গড়ে উঠতে থাকে নতুন নতুন কর্পোরেট হাসপাতাল – যাদের নামের শেষে করছাড়ের জন্য রিসার্চ ইনস্টিটিউট, জমি দেন সরকার বিনামূল্যে – কিন্তু, মুনাফাবৃদ্ধির নতুন নতুন স্ট্র্যাটেজি উদ্ভাবন বাদ দিয়ে অন্য কী রিসার্চ হয়, খোঁজ মেলে না। বড় রাস্তার দু-পাশ ভরে উঠল বিজ্ঞাপনী হোর্ডিং-এ। ধুঁকতে শুরু করল সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থা – প্রাথমিক স্বাস্থ্য, জনস্বাস্থ্যে বিনিয়োগ এসে দাঁড়াল নামমাত্রে। একদিকে বিশ্বমানের হাইটেক হেলথকেয়ারের বিজ্ঞাপন – আর একদিকে সমস্ত স্বাস্থ্যসূচকে দেশের অধোগমন। না, এই সবকিছুরই মূলে এক ও একমাত্র কারণ দু-হাজার দুইয়ের জাতীয় স্বাস্থ্যনীতি নয় – কিন্তু, অন্যতম ও গুরুত্বপূর্ণ অনুঘটক তো বটেই।
দু-হাজার দুইয়ের পর এখন এই দু-হাজার সতেরোর নতুন জাতীয় স্বাস্থ্যনীতি। কিছুদিন আগে, দু-হাজার পনেরো সালে প্রকাশিত হয়েছিল খসড়াটি। সেখানে স্বাস্থ্যকে মৌলিক অধিকার হিসাবে স্বীকৃতিপ্রদানের কথাটি ছিল। কিন্তু, সরকার, নতুন মৌলিক অধিকার যোগ করে খামখা নিজেদের বিপদ বাড়াতে চাইলেন না। খসড়া যখন নীতি হল, তখন স্বাস্থ্য নেমে এল মৌলিক অধিকার থেকে স্বাস্থ্যের আশ্বাসে (Health Assurance)। কেমন যেন ‘বিশ্বাসে মিলায় বস্তু, তর্কে বহুদূর’ গোছের; অলৌকিকে ভরসা না থাকলে অনুধাবন করাই মুশকিল। যেমন ধরুন, স্বাস্থ্যনীতিতে সরকার বলেছেন, দেশে একটি কার্যকরী, দক্ষ, নিরাপদ, সকলের সাধ্যায়ত্ত, নীতিনিষ্ঠ, যুক্তিনির্ভর চিকিৎসাব্যবস্থা গড়ে তুলবেন বেসরকারি সহযোগিতায়। অথচ, বেসরকারি উদ্যোগ, যাদের এক এবং একমাত্র লক্ষ্য মানুষের অসুস্থতাজনিত অসহায়তা কাজে লাগিয়ে মুনাফা অর্জন – তাদের সহযোগিতায় গড়ে উঠবে নীতিনিষ্ঠ ও সকলের সাধ্যায়ত্ত চিকিৎসাব্যবস্থা!
২০১৭-এ এসে সরকার বলেছেন, স্বাস্থ্যখাতে ব্যয়বরাদ্দ তারা একেবারে আড়াইগুণ করে দেবেন – জিডিপির ১.১৫% থেকে ২.৫% – দু-হাজার পঁচিশ সালের মধ্যেই। যদিও খসড়ায় এই লক্ষ্য নির্ধারিত হয়েছিল দু-হাজার কুড়ি সালের কথা ভেবে এবং এই বরাদ্দ বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থার ন্যুনতম লক্ষ্যমাত্রা পাঁচ শতাংশ থেকে বহু দূরে। এই বাড়তি অর্থের সংস্থান কোথা থেকে হবে, অনুমান করা কঠিন, বিশেষত বাজেটে যখন বরাদ্দ বাড়ানোর কথা তেমনভাবে আসেইনি। আসলে যা ঘটল, ২০১০ এ ১.১২%, তারপরে কমতে কমতে আবার ২০১৭ এ এসে ১.১৭%, ২০২০ তে ১.৩৫%, ২০২৩ এ ১.৪%, ২০২৪ সালে ১.৯%। এখানে আরেকটা বিষয়ের উল্লেখ জরুরি। ২০১৮ সালে শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যক্ষেত্রে আরো বিনিয়োগ বাড়ানোর উদ্দেশ্য নিয়ে চালু হয়েছিল শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সেস। এই সেস থেকে আদায়ীকৃত অর্থ বিশেষ ফান্ডে জমা রেখে নির্দিষ্ট খাতে খরচ করাই নিয়ম। কিন্তু সরকার এই সেসের টাকাটাও বাজেটবরাদ্দের ভিতর ঢুকিয়ে দেয়। সেসের টাকা বাদ দিলে, প্রকৃত অর্থে সরকারের স্বাস্থ্যখাতে বাজেট বরাদ্দ, উপরে দেখানো হিসাব থেকে, আরো কম।
এই ‘ঐতিহাসিক’ স্বাস্থ্যনীতি পড়ে আমরা জানতে পারি, চিকিৎসা এবং আনুষঙ্গিক বাণিজ্যের – যেমন ওষুধ, চিকিৎসাসামগ্রী ইত্যাদি – বৃদ্ধির হার চমৎকার। জাতীয় স্বাস্থ্যনীতি ঘোষণার একেবারে সূচনাতেই, অগ্রাধিকার নির্বাচনের প্রসঙ্গে, বেসরকারি বাণিজ্যিক স্বার্থের কথা মাথায় রাখা – বোঝা যায় সরকার চক্ষুলজ্জার দুর্বলতাটি কাটিয়ে উঠেছেন! নীতির ছত্রে ছত্রে, সরকার স্বাস্থ্যক্ষেত্রে বেসরকারি লগ্নির স্বার্থের কথা মাথায় রেখেছেন; অর্গলহীন করেছেন নিজের অন্দরমহল, নিঃসংকোচে। জানিয়েছেন, প্রাথমিক স্বাস্থ্যটুকুই, তাও শুধুমাত্র গরীব মানুষের জন্য, সরকার সম্পূর্ণরূপে নিজের হাতে রাখবেন। কাজেই, প্রাথমিক স্বাস্থ্য জনস্বাস্থ্যের ব্যাপারগুলো সরকার নমো নমো করেই দেখবেন, যাতে চিকিৎসাব্যবসার চমকপ্রদ বৃদ্ধি বজায় থাকে। আর, বাকি সমস্ত ক্ষেত্রেই সরকার, স্বাস্থ্যনীতিতে জানানো হয়েছে, বেসরকারি পরিকাঠামো থেকে প্রয়োজন অনুসারে পরিকল্পনামাফিক পরিষেবা কিনে নেবেন। অবশ্য, বলা হয়েছে, এই ব্যবস্থা স্বল্পমেয়াদি; দীর্ঘ মেয়াদে, সরকার আশা রাখেন, তারা সমস্ত পরিষেবা নিজেরাই দিতে পারবেন। কিন্তু, একদিকে, পরিষেবা কিনতে কিনতে, হঠাতই, সরকার কীভাবে স্বনির্ভর হয়ে উঠবেন, আর অন্যদিকে, এই স্বনির্ভরতার স্বপ্ন যদি কোনোভাবে সফলও হয়, সরকার যাদের কথা নীতি প্রণয়নের শুরুতেই বলেছেন, সেই স্বাস্থ্যশিল্পের চমকপ্রদ বৃদ্ধিহার কেমন করে বহাল থাকবে – আর স্বাস্থ্যবাণিজ্যের বৃদ্ধি কেমন করেই বা পৌঁছবে জনস্বাস্থ্যের কল্যানে, যেমনটি নীতিপ্রণেতাদের আশা – অলৌকিক ‘মেলাবেন তিনি মেলাবেন’ ছাড়া যুক্তিতে এর ব্যাখ্যা মেলে না।
সরকার যেহেতু প্রাথমিক স্বাস্থ্য বাদ দিয়ে, বাকিগুলোর জন্য বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে হাত মেলাবেন, অতএব, স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দের একটা বড় অংশ পৌঁছবে বেসরকারি স্বাস্থ্যব্যবসায়ীদের হাতেই। সরকার ক্রমশ গরীব মানুষের চিকিৎসার খরচ নিজেরা বহন না-করে ছেড়ে দিচ্ছেন বিমা কোম্পানির হাতে – সেখানেও বেসরকারি বিমা কোম্পানিদেরই রমরমা। তাহলে কী দাঁড়ালো? বেসরকারি স্বাস্থ্যব্যবসায়ী, বীমাব্যবসায়ীদের মুনাফার রাস্তা খুলে গেল। এই কর্পোরেট স্বাস্থ্যব্যবসায়ী, বীমাব্যবসায়ীদের চক্করে পড়ে আমাদের যে নাভিশ্বাস উঠছে বা আরো উঠবে, তাও আমরা মেনে নিয়ে চলছি, কারণ, বোধহয়, There is no alternative! এই আয়ুষ্মান ভারত প্রকল্প যার অধীনে এদেশের প্রায় সত্তর কি আশি শতাংশ মানুষকে আনার চেষ্টা চলছে, মুনাফার পরিমাণটা আন্দাজ করতেই পারবেন।
পরিষ্কার বুঝে নেওয়া যাক, নয়া স্বাস্থ্যনীতির পথ সার্বিক উন্নতির নয়, এই নীতি নেহাতই বাজার অর্থনীতি-বর্ণিত চুঁইয়ে আসা উন্নয়নের আশা দেখানোর। এইপথে চলে, অন্তত সাধারণ নাগরিকের, চমকপ্রদ ফলের প্রত্যাশা না করাই ভালো। গাছ লাগানো হয়েছে আমড়ার, হিমসাগর আম কেন পেলাম না সেই নিয়ে হা-হুতাশ অবান্তর।
রাষ্ট্র যতদিন না সব নাগরিকের স্বাস্থ্যের দায়িত্ব নিচ্ছেন, বা সবার সামর্থ্যের মধ্যে একটি স্বাস্থ্যপরিষেবার ব্যবস্থা করছেন, ততদিন সুরাহা মিলবে না। ঠিক কেমন করে সেই জায়গাটায় পৌঁছনো যায়, সেই নিয়ে আলোচনা হোক। সব ‘নাগরিক’ মিলে আলোচনা করলে একটা সমাধানের পথ কি মিলবে না? অন্তত আলোচনা, কথোপকথন তো শুরু হোক। সান্ধ্য টিভিতে কত বিষয় নিয়ে আলোচনা তো হয়, দেশের সব নাগরিকের সামর্থ্যের মধ্যে স্বাস্থ্য পরিষেবা কোন পথে আসতে পারে, সেই নিয়েই একদিন বিতর্ক বা আলোচনা হতে বাধা কোথায়? বাধ্য করতে হবে রাজনৈতিক দলকে তাদের ইস্তেহারে স্বাস্থ্যের বিষয়টিকে স্থান দিতে। প্রশ্ন করতেই হবে, আমাদের জাতীয় স্বাস্থ্যের এই নড়বড়ে হাল কেন উঠে আসে না মিডিয়ায়? ঠিক কোন কায়েমি স্বার্থে এই জরুরী বিষয়টা রয়ে যাচ্ছে নজরের বাইরে? আমরা যদি সত্যসত্যই ‘নাগরিক’ হয়ে উঠতে চাই, এই জরুরী প্রশ্নগুলো করতে ভুলে গেলে তো চলবে না!
ব্যবহৃত ছবি- সোশ্যাল মিডিয়া সুত্রে সংগৃহীত