দ্বিতীয় – পর্ব
তৃণমূল, বিজেপি-র হিসাব দেখে
আজ কী বলতেন গান্ধীজী?
বাগবাজারের বাসিন্দা বাবু মনোরঞ্জন চৌধুরী না বলে কয়ে হাজির হয়েছিলেন গান্ধীর কাছে। কমিউনিস্টদের সম্পর্কে নানা নিন্দা তিনি করে এসেছিলেন গান্ধীজীর কাছে। কমিউনিস্ট পার্টির তৎকালীন সাধারন সম্পাদক পূরণ চাঁদ যোশীকে লেখা ৩০শে জুলাই, ১৯৪৪-র চিঠিতে বাবু মনোরঞ্জন চৌধুরীর সেই নিন্দার কথা গান্ধী জানিয়েছেন।
সেই চিঠিতেই কমিউনিস্ট পার্টির হিসাবপত্রর সম্পর্কে নিজের মতামত জানিয়েছেন গান্ধীজী। যোশীর কাছে কমিউনিস্ট পার্টির হিসাবপত্র সম্পর্কে গান্ধীজী জানতে চেয়েছিলেন ১৯৪৪-র ১১ই জুন। যোশী হিসাবপত্র সহ তাঁর পাঁচটি প্রশ্নের জবাব দিয়েছিলেন ১৪ই জুন। মধ্যপ্রদেশের সেবাগ্রাম থেকে ৩০শে জুলাই যোশীকে লেখা সেই চিঠিতে কমিউনিস্ট পার্টির হিসাবপত্র সংক্রান্ত বিষয়ে গান্ধীজী লেখেন,‘‘তুমি যে জবাব দিয়েছ, তা সম্পূর্ণ সন্তোষজনক। তোমাদের হিসাবপত্র সম্বন্ধে আমি আর কোনও প্রশ্ন তোমাকে জিজ্ঞাসা করব না।’’
কমিউনিস্টদের টাকার হিসাব নিয়ে আজও দেশে প্রশ্ন তোলার কোনও সুযোগ নেই।
কিন্তু গান্ধীর হত্যাকারীদের উত্তরসূরী আর তাদের বিশ্বাসযোগ্য মিত্রদের আয় নিয়ে প্রশ্ন উঠছেই।
কারন — ধান্দার ধনতন্ত্রে গোপন সূত্র থেকে বিপুল আয় করেছে নরেন্দ্র মোদী আর মমতা ব্যানার্জির দল।
প্রসঙ্গ ইলেক্টোরাল বন্ড। ২রা জানুয়ারি, ২০১৮ — এই পদ্ধতি চালু করে মোদী সরকার। রাজনৈতিক দলকে চাঁদা দেবার এই পদ্ধতিতে কোটি কোটি টাকা বেনামেই দেওয়া যায় দলগুলিকে। রাজনৈতিক অনুদানের প্রক্রিয়াকে ‘স্বচ্ছ’ করার নামে এই নির্বাচনী বন্ড চালুর কথা আরএসএস, বিজেপি-র অনুমোদন পেয়ে সংসদে ঘোষণা করেছিলেন তৎকালীন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি। বছরে চারবার— জানুয়ারি, এপ্রিল জুলাই, অক্টোবরে এই বন্ড কিনতে পাওয়া যায়। প্রথম দিন থেকে এই পদ্ধতির বিরোধিতা করেছে সিপিআই(এম)। তৃণমূল তখন চুপ করেছিল।
ফল কী হয়েছে?
২০১৬-১৭ থেকে ২০২১-২২ — এই ছয় বছরে নির্বাচনী বন্ডে বিজেপি-র তহবিলে জমা হয়েছে ৫ হাজার ২৭১ কোটি টাকা। দেশে সমস্ত রাজনৈতিক দল বন্ডে যে টাকা তুলেছে তার পাঁচগুণ টাকা বিজেপি একাই তুলেছে। দ্বিতীয় স্থানে আছে কংগ্রেস। বন্ডে তারা তুলেছে ৯৫২ কোটি টাকা। তৃতীয় স্থানে রয়েছে একটি আঞ্চলিক দল — তৃণমূল। তারা বন্ডে তুলেছে ৭৬৭.৮৮ কোটি টাকা। আঞ্চলিক দলগুলির মধ্যে নির্বাচনী বন্ডে সবচেয়ে বেশি টাকা তুলেছে তৃণমূলই। তাৎপর্যপূর্ণ হলো — তৃণমূলের মোট অর্থ সংগ্রহের ৯৩%-ই নির্বাচনী বন্ডে তোলা অর্থ।
গত লোকসভা নির্বাচনের সময় কর্পোরেট থেকে নির্বাচনী বন্ডে রাজনৈতিক দলগুলি টাকা তুলেছে বেশি। এই সময়ে রাজনৈতিক দল কর্পোরেট বন্ডে তুলেছে ৪৮৬৩ কোটি টাকা। এর বেশিরভাগ গেছে বিজেপি’র তহবিলে। ২০১৮ সালে বন্ডে তোলা হয়েছে ৪০৪১ কোটি টাকা। ২০২১ সালে বন্ডে তোলা হয়েছে ৩ হাজার ৮২৬ কোটি টাকা।
এই বন্ড হলো কালো টাকা সাদা করার পথ। তাই দাতার নাম গোপন রাখার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। পাশাপাশি কারা কোন কোন কর্পোরেট কিংবা ব্যক্তির দাক্ষিণ্য পাচ্ছে, ফলে তাদের হয়ে কাজ করছে, তাও প্রকাশিত হচ্ছে না।
বিজেপি-শাসনে দেশের অন্যতম বড় দুর্নীতির আধার এই নির্বাচনী বন্ডই।
সিপিআই(এম) রাজনৈতিক দলে কর্পোরেটের টাকার এই দাপট রোধের উদ্দেশ্যে নির্বাচনী বন্ডের বিরোধী। দেশে কর্পোরেট অর্থ দাপট রোধে এই নির্বাচনী বন্ড বাতিলের আবেদন জানিয়ে বন্ড চালুর সময় সুপ্রিম কোর্টে মামলা দায়ের করেছিল সিপিআই(এম)। সেই মামলা তিনটি শুনানির পর আজও পরের শুনানির অপেক্ষায়। তার কোনও ফয়সালা হয়নি।
২০২০-২১ আর্থিক বছরে অর্থাৎ ভোটের বছরে তৃণমূলের মোট আয় দেখানো হয়েছিল ৭৪ কোটি ৪১ লক্ষ ৭৮ হাজার ৪৭২ টাকা। ভোটে ফের জয়ী হয়ে তৃতীয়বার সরকার গড়লেন মমতা ব্যানার্জি। ততদিনে গোরু, কয়লা পাচারের তদন্ত শুরু হয়ে গিয়েছে। একাধিক জেলায় বাড়তে শুরু করে ভুয়ো সংস্থা। ভুয়ো সংস্থার মাধ্যমেই টাকা পাচারের নেটওয়ার্ক। আর ঠিক সেই সময়তেই ২০২১-২২ আর্থিক বছরে তৃণমূলের আয় ৭৩৬% বেড়ে দাঁড়ালো ৫৪৫ কোটির বেশি! বিধানসভা নির্বাচন হয়েছিল ২০২১-র মে-তে। অর্থাৎ যে আর্থিক বছরে ৭৩৬% আয় বেড়েছে, যার প্রায় পুরোটাই সেই বিজেপি সরকারের চালু করা নির্বাচনী বন্ড মারফত, সেই বছরেই বিধানসভা নির্বাচন হয়েছে।
বিজেপি প্রশ্ন করবে এই বিপুল আয় নিয়ে তৃণমূলকে? সম্ভব? একদমই না। কর্পোরেটের কালো টাকা এই দুই দলই পাচ্ছে দেদার। আর তাৎপর্যপূর্ণ হলো, এই কর্পোরেটই হিন্দুত্বর প্রচারে, উগ্র সাম্প্রদায়িক বাতাবরণ সৃষ্টিতে নানা ভাবে সহায়তা করছে। নির্বাচনী বন্ডই বলে দিচ্ছে তাদের পছন্দের তালিকায় রয়েছে বিজেপি এবং তৃণমূল। রাজ্যে সাম্প্রদায়িক বিভাজনে বিজেপি-কে কৌশলে মদত দিচ্ছে তৃণমূল।
অঙ্ক স্পষ্ট — দেশের ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ, সাংবিধানিক কাঠামো ভাঙতে দুই দলই মদত পাচ্ছে কর্পোরেটদের কালো টাকার।
আক্রান্ত সেই গান্ধীর আদর্শই। তবে গান্ধীজী যাঁদের উত্তরে সন্তুষ্ট হয়েছিলেন, সেই কমিউনিস্টরা এখনও লড়ছেন সেই পথেই।
ক্রমশ…