৪ ফেবঃ ২০২২ (শুক্রবার)
সাতোশি নাকামোতো। এনার জন্ম নাকি ১৯৭৫ সালের ৫ই এপ্রিল! বয়স নাকি ৪৬ বছর! ইনি নাকি জাপানের নাগরিক! কিন্তু জাপানে একে পাবেন না। ওখানে গেলে বলবে, ক্যালিফোর্নিয়ায় পাবেন। আবার যদি সেখানে যান, বলবে এখানে নেই, নিউইয়র্ক যান। আবার সেখানে গিয়ে হয়ত বা শুনতে পাবেন ইনি তো আরিজোনায় থাকতেন কিন্তু ২০১৪ সালের ২৮শে আগষ্ট প্রয়াত হয়েছেন। ইনি অনেকটা হযবরল-র ‘গেছো দাদা’র মতো।
এনার একটা আবক্ষ মূর্তি আছে বুলগেরিয়া দেশের বুদাপেস্ট শহরে, যদিও এনাকে কেউ কোনোদিন কোথাও দেখতে পায় নি। এই না দেখা অদৃশ্যবাবু গেছোদাদাটি নাকি ৪৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের মালিক। মানে ৩৪,৪০,৮৯,৪৩,০০,০০০ টাকা।
অদ্ভুত লাগছে তাই না! কিন্তু এটা সত্যি। ইনি কে, এনার কটা হাত, কটা মাথা, কটা পা কেউ জানে না। কার কার সাথে প্রেম-পিরিতি তাও অজানা। ঠিকানা? জাপান।কিন্তু পোস্টাল ঠিকানা কেউ জানে না। ইনি মহাশূন্যের কোনও কক্ষপথে ঘুরে বেড়াচ্ছেন কিনা, তাও বলা সম্ভব নয়।কেউ বলেন এনার আসল নাম ডোরিয়ান নাকামোতো। ইনি জাপানী কিন্তু এখন আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়ার বাসিন্দা। আবার কেউ বলেন প্রখ্যাত কম্পিউটার বিজ্ঞানী নিকোলাস জাবো’ই হলেন নাকামোতো। আবার অনেকে বলেন বিট কয়েনের প্রথম ক্রেতা প্রয়াত হ্যাল ফিনেই হ’লেন নাকামোতো।
রহস্য না বাড়িয়ে একটু খোলসা করে বলা যাক। আধুনিক এই গেছো দাদাটি হ’লেন বিশ্বের প্রথম ক্রিপ্টো কারেন্সি ‘বিট কয়েন’এর বেনামী মালিক। এখন এই বিট কয়েন ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৭কোটি ৯০ লক্ষ, আবার অনেকে দাবী করেন এই সংখ্যা ১১কোটি ৪০ লক্ষ। ব্যবহারকারীর সংখ্যার সত্যতা নিয়েও প্রবল সংঘাত রয়েছে।
এত ঢাকঢাক গুড়গুড় কেন? কে মালিক, কে ব্যবহারকারী, কত অর্থ বিনিয়োজিত হচ্ছে, কারা বিনিয়োগ করছে – সবটাই ধোঁয়াশায় ভরা। সবটাই রহস্যময় কেন? এসব বুঝতে গেলে কয়েকটা প্রাথমিক বিষয়ে আলোচনা করা দরকার।
ক্রিপ্টো কারেন্সি কি?
ক্রিপ্টো কারেন্সি হ’ল একটি ডিজিটাল অর্থ লেনদেন এর ব্যবস্থা, যা পৃথিবীর স্বীকৃত কোনও ব্যাঙ্কের হিসাব কিতাবে লেখা হয় না। কে দিচ্ছেন, কাকে দিচ্ছেন কিছু জানা যায় না। মোদীজি’র কোটের রঙের সাথে মিলিয়ে যেমন বিভিন্ন ভারতীয় টাকা দেখতে পাওয়া যায়, একে তেমনভাবে চোখে দেখতে পাওয়া যায় না। যিনি পাঠাচ্ছেন এবং যার উদ্দেশ্যে পাঠাচ্ছেন কেবল তারাই জানতে পারবেন এই লেনদেনের কথা। একটি পাব্লিক লেজার থাকে, যেখানে এই লেনদেনের হিসাব রাখা হয়। তবে নামেই এটা পাব্লিক লেজার, ঐ গেছোদাদা’রা ছাড়া কেউ এই লে্জার-এর হিসাব জানতে পারে না। এই গোটা বিষয়টা সারা হয়, অন লাইন ব্যবস্থায়।
কোথায় থাকে এই অর্থ?
প্রত্যেক ব্যবহারকারীর জন্য বরাদ্দ থাকে একটি টাকার থলে বা ওয়ালেট। এইখানে ব্যবহারকারীর কেনা ক্রিপ্টো কারেন্সির হিসাব থাকে। কার কত অর্থ আছে এটা গেছোদাদা আর ব্যবহারকারী বাদ দিয়ে আয়কর দপ্তর, ইডি, সিবিআই কেউ জানতে পারে না। ব্যবহারকারীর নাম জটিল কম্পিউটার পদ্ধতি (এনক্রিপশন) ব্যবহার করে আড়ালে রাখা হয়।
ইসসসস, আগে এসব জানলে কত সুবিধা হ’তো কতজনের ! প্যানিক অ্যাটাকের রোগীদের ঊডবার্ন ওয়ার্ডে দৌড়াদৌড়ি, পিসীর ধর্না, ভাইপোর জেরায় জেরায় জেরবার হওয়া, পুলিশ কর্তার শিলং যাত্রা এসব কিছুই হ’তনা এইসব গেছোদাদাদের সাথে যোগাযোগ থাকলে। ২০০৯ সাল থেকে তো এই কারবার খুলেছে গেছোদাদারা প্রথম ক্রিপ্টোকারেন্সি বিট কয়েন এনে – এটাও ওদের কোচ জানেন না! কে জানে! জেনেশুনেই ক্লায়েন্টকে চাপে রাখার কৌশল নিয়েছেন কি না ভোট কুশলী কোচ, তা অবশ্য বলা মুস্কিল।
কতরকমের ক্রিপ্টো কারেন্সি আছে?
বিটকয়েন – এটাই বিশ্বের প্রথম ক্রিপ্টো কারেন্সি। ২০০৯ সালে এটা বাজারে ছাড়া হয়। কে ছেড়েছেন কেউ জানে না। এটির ব্যবহারকারীর সংখ্যা এবং সম্পদের পরিমাণ আগেই উল্লেখ করা হয়েছে।
লাইটকয়েন – এরা ২০১১ সালের ১৩ই অক্টোবর বাজারে আত্মপ্রকাশ করে। ৮কোটি ৪০ লক্ষ ব্যবহারকারী আছে এই ক্রিপ্টো কারেন্সির।
ইথিরিয়াম – এটা ২০১৫ সালের ৩০শে জুলাই গজিয়েছে। এটা ইথার বা ইথেরিয়াম নামে ক্রিপ্টো কারেন্সি বাজারে ছেড়েছে। ১১কোটি ৯২লক্ষ ইথিরিয়াম বাজারে ঘুরছে তবে মাত্র ৩৭৬টি ওয়ালেটের মালিক এর ১/৩ ভাগের অংশীদার।
টিদার (USDT), বাইন্যান্স কয়েন (BNB), ইউএসডি কয়েন (USDC), কার্দানো (ADA), সোলানা (SOL), এক্সআরপি (XRP), টেররা (LUNA), ডগে কয়েন (DOGE), পোলকাডট (DOT), এভালান্সে (AVAX) ইত্যাদি কোম্পানীর নামে অনেক ক্রিপ্টো কারেন্সি (বন্ধনীর নাম) এখন বাজারে ঘুরছে। যে কোনও দেশ থেকেই এগুলো অন লাইনে কিনতে পারা যায়।
সতর্কবানী
এই লেখার ভিত্তিতে কেউ যদি ক্রিপ্টো কারেন্সি কিনতে চান, তবে দায়ভার একান্তভাবেই তার, লেখকের কোনও দায় নেই।
ব্যাঙ্করেট নামে একটি ওয়েবসাইট যারা বিনিয়োগ সংক্রান্ত পরামর্শ দিয়ে থাকে, তাদের পরামর্শটি একবার দেখে নেওয়া ভালো।
“সার কথা – ক্রিপ্টো কারেন্সির বাজার একেবারেই একটি পশ্চিমী ব্যবস্থা, তাই যারা এই ডিজিটাল সম্পদ কিনবেন, তাদের হারানোর সামর্থ্যের চেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করা উচিত নয়।“
অর্থাৎ যাদের নষ্ট করার মতো অতিরিক্ত অর্থ আছে অথবা ইডি, আয়কর বিভাগ ইত্যাদির ভয়ে তোলাবাজির অর্থ ব্যাঙ্কে বা বাড়িতে মজুত করে রাখতে পারে না, তাদেরই এই ঝুঁকিপূর্ণ বিনিয়োগে যাওয়া উচিত। তাই কেমনভাবে বিনিয়োগ করতে হবে, সেই আলোচনা ক’রে কাউকে বিপদে ফেলার ইচ্ছে নেই বলেই বিনিয়োগের পদ্ধতি সম্পর্কে কিছু উল্লেখ করলাম না।
শুধু এইটুকু বলতে পারি এখনও পৃথিবীর বেশীরভাগ ব্যাঙ্ক, বীমা কোম্পানি, ই-কমার্স সাইট, ডেবিট/ক্রেডিট কার্ড এই বিকল্প মুদ্রা ব্যবস্থাকে বিশ্বাস করে না এবং এদের লেনদেনকে স্বীকৃতি দেয়না। তবে কিছু বিলাসবহুল দ্রব্য, অত্যন্ত দামী গাড়ি, দামী ঘড়ি ইত্যাদি প্রস্তুতকারক কিছু কোম্পানী এগুলো ব্যবহার করে।
ক্রিপ্টোকারেন্সি ও দুর্নীতি
এত গোপন গোপন ভাব যাদের, তাদেরকে সন্দেহ করাটাই স্বাভাবিক। আর সন্দেহটা নেহাতই অমূলক নয়। অসংখ্য ভুয়ো ওয়েবসাইট চালিয়ে ক্রিপ্টো কারেন্সি বিক্রির নামে ভুরি ভুরি প্রতারনা চলছে পৃথিবী জুড়েই।
পনজি স্কীমের অভিজ্ঞতা বাংলার মানুষের ভালোই আছে সারদা, রোজ ভ্যালি, তৃণমূলের নেতা-নেত্রীদের দৌলতে। একই প্রতারনা চলছে এই ভার্চুয়াল বিকল্প মুদ্রা ব্যবস্থাতেও। ২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসে বিটক্লাব নামে একটা ক্রিপ্টো কারেন্সি নেটওয়ার্ক ৭০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার তছরূপ করে ধরা পরে। এরা বিভিন্ন সেলিব্রিটি ও রাজনৈতিক নেতাদের নাম করে অর্থ সংগ্রহ করেছিল। শুধু বাংলাতেই নয়, ভার্চুয়াল জগতেও একই কায়দায় চিটিংবাজি চলছে। তবে ধরা পরার ভয়ে ওদের কারোর প্যানিক অ্যাটাক হয়েছিল কি না, সেটা জানা নেই।
প্রেমের ফাঁদ পেতে ক্রিপ্টো কারেন্সি জালিয়াতিতে শুধুমাত্র আমেরিকাতেই ২০২১ সালের জানুয়ারী থেকে জুলাই মাসের মধ্যে ১৩৩মিলিয়ন মার্কিন ডলার খুইয়েছেন ১৮০০ জন – এফবিআই এর রিপোর্ট।
শুধু জালিয়াতি নয়, ক্রিপ্টো কারেন্সি জমিয়ে রাখা ওয়ালেটও হ্যাক হতে পারে। জটিল ও প্রায় দুর্ভেদ্য প্রক্রিয়া অবলম্বন করে এই মুদ্রা জগত চলে বলে যারা দাবি করেন, তাঁদের এই দাবিকে অসাড় প্রমান করে ২০১৮ সালে কয়েন চেক এবং বিট গ্রিল নামে দুটি ক্রিপ্টো কারেন্সি সংস্থার ৫৩৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং ১৯৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার হ্যাকাররা সরিয়ে নেয়।
সবচেয়ে বড় কথা যেহেতু এই ডিজিটাল মুদ্রার বাজার পুরোটাই অনুমান নির্ভর (Speculative) এবং সরকার, রাষ্ট্র বা প্রচলিত বাজারের কোনও নিয়মই এরা মানে না বা এদের ওপর বিভিন্ন দেশের সরকার, ফেডেরাল ব্যাঙ্ক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান সংক্রান্ত নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলির ( Regulatory Authorities) কোনও নিয়ন্ত্রন থাকে না তাই এই বিনিয়োজিত অর্থ কতটা নিরাপদ সেটা সহজেই অনুমান করা যায়।
ভারত সরকার ও ক্রিপ্টো কারেন্সি
২০১৩ সালে, ভারতের রিজার্ভ ব্যাঙ্ক ভার্চুয়াল মুদ্রা ব্যবহারের বিরুদ্ধে জনসাধারণকে সতর্ক করে একটি সার্কুলার জারি করে বলেছিল, যে সব ব্যাঙ্ক এবং তাদের গ্রাহকরা ভার্চুয়াল মুদ্রা ব্যবহারকারী, মুদ্রার মালিক এবং ব্যবসায়ী তাদের এই মুদ্রার সম্ভাব্য আর্থিক, আইনি, গ্রাহক সুরক্ষা, এবং নিরাপত্তা-সম্পর্কিত ঝুঁকি সম্পর্কে সতর্ক করছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক আরও উল্লেখ করে যে, তারা বিটকয়েন, লাইটকয়েন এবং অন্যান্য বিকল্প মুদ্রা সহ ভার্চুয়াল মুদ্রা জগতের গতি প্রকৃতির ওপর তীক্ষ্ণ নজর রাখছে।
কিন্তু যেহেতু বিভিন্ন বানিজ্যিক ব্যাঙ্কগুলি ক্রিপ্টো কারেন্সি এক্সচেঞ্জে লেনদেনের অনুমতি দেওয়া শুরু করেছে ২০১৭ সালের ১লা ফেব্রুয়ারি, তাই আরবিআই ভার্চুয়াল মুদ্রা নিয়ে তার উদ্বেগ জানিয়ে আবারও একটি সার্কুলার প্রকাশ করে। এছাড়াও ২০১৭ সালের শেষ নাগাদ, আরবিআই এবং অর্থ মন্ত্রক আরও একটি সতর্কতা জারি করে, যাতে স্পষ্ট বলা হয় যে, ভার্চুয়াল মুদ্রাগুলি কোনও আইনি মুদ্রা ব্যবস্থা নয়।
২০১৪ সালে বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর থেকে ক্রমাণ্বয়ে ভার্চুয়াল মুদ্রা ব্যবস্থাকে আমাদের দেশে আইনি করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ২০১৮ সালের বিশ্ব আইন গ্রন্থাগারের প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী ৯টি দেশে ভার্চুয়াল মুদ্রার লেনদেন সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ এবং আরও ৪৩ টি দেশে এই মুদ্রা ব্যবস্থা সম্পর্কে উদ্বেগ জারি করে এইগুলি ব্যবহারে তাদের নাগরিকদের সতর্ক করেছে।
২০১৮ সালের মার্চ মাসে, সেন্ট্রাল বোর্ড অফ ডাইরেক্ট ট্যাক্স (CBDT) ভার্চুয়াল মুদ্রা নিষিদ্ধ করার জন্য অর্থ মন্ত্রকের কাছে একটি খসড়া প্রকল্প জমা দিয়েছিল। এর এক মাস পরে আরবিআই একটি সার্কুলার জারি করে জানায় যে, সব বানিজ্যিক ব্যাঙ্ক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলি যেন ভার্চুয়াল কারেন্সি লেনদেন এবং এই মুদ্রার আর্থিক পরিষেবা প্রদান থেকে নিজেদের বিরত রাখে।
২০১৮ সালের এপ্রিল মাসে অর্থ মন্ত্রক নিযুক্ত-কমিটি ভার্চুয়াল মুদ্রার নিয়ন্ত্রণের জন্য একটি খসড়া বিল তৈরির প্রস্তাব করেছিল কিন্তু নিষেধাজ্ঞার সুপারিশ করেনি। আবার ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ঐ কমিটি একটি নতুন খসড়া বিলের প্রস্তাব করেছিল যা সব ধরণের ডিজিটাল মুদ্রার ওপর পূর্ণ নিষেধাজ্ঞার সুপারিশ করেছিল।
এর মধ্যেই ২০২০ সালের মার্চ মাসে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট RBI আরোপিত ক্রিপ্টো কারেন্সির উপর নিষেধাজ্ঞা বাতিল করে। ক্রিপ্টো সম্পদে লেনদেনে নিযুক্ত ব্যক্তিদের ব্যাঙ্কিং পরিষেবাগুলি প্রদান থেকে ব্যাঙ্ক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলিকে বিরত থাকার নিষেধাজ্ঞা তুলে দেয় দেশের সর্বোচ্চ আদালত।
দেশের অর্থমন্ত্রী সীতারামন ৯ই ফেব্রুয়ারি, ২০২১ রাজ্যসভায় জানান –
“ভার্চুয়াল মুদ্রা সম্পর্কিত সমস্যাগুলি অধ্যয়ন করার জন্য সচিবের (অর্থনীতি বিষয়ক) সভাপতিত্বে গঠিত একটি উচ্চ-পর্যায়ের আন্তঃমন্ত্রণালয় কমিটি (IMC) তার প্রতিবেদনে সুপারিশ করেছে, যে সমস্ত ব্যক্তিগত ক্রিপ্টোকারেন্সি ছাড়াও যে কোনো রাষ্ট্রের দ্বারা জারি করা যে কোনও ভার্চুয়াল মুদ্রা ভারতে নিষিদ্ধ করা হবে।”
এর পরেই ২০২১ সালের নভেম্বরে, সংসদের অর্থ সংক্রান্ত স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান বিজেপি’র সাংসদ জয়ন্ত সিনহা’র সাথে ক্রিপ্টো এক্সচেঞ্জ, ব্লকচেইন এবং ক্রিপ্টো অ্যাসেট কাউন্সিল (BACC)-এর প্রতিনিধিরা দেখা করে এবং দাবী জানায় যে ক্রিপ্টো কারেন্সি নিষিদ্ধ করা উচিত নয়, কিন্তু নিয়ন্ত্রিত করার জন্য আইন প্রণয়ন করা যেতে পারে।
এই মাসের শুরুর দিকে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি অর্থ মন্ত্রকের শীর্ষ কর্তাদের সাথে ক্রিপ্টো কারেন্সি নিয়ে একটি বৈঠক ডেকেছিলেন। তিনি সভায় ইঙ্গিত দেন যে, সমস্যাটি মোকাবিলা করার জন্য একটি শক্তিশালী নিয়ন্ত্রক ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
এই সময়েই আরবিআই প্রধান শক্তিকান্ত দাস ক্রিপ্টো কারেন্সির বিরোধিতা করে আবার বলেন যে, ক্রিপ্টো কারেন্সি কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কগুলির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত নয়, তাই যে কোনও আর্থিক ব্যবস্থার জন্য এটি একটি গুরুতর বিপদ। ক্রিপ্টো কারেন্সির প্রসারের সময়ে আরবিআই একটি সরকারী ডিজিটাল মুদ্রা নিয়ে আসার অভিপ্রায় পোষণ করছে, যদিও এটা নিয়েও কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের খুবই উদ্বেগ রয়েছে।
সম্প্রতি বাজেটে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী রিজার্ভ ব্যাঙ্কের নিজস্ব ক্রিপ্টো কারেন্সি বাজারে আনার কথা ঘোষনা করেছেন, যদিও এর বিশদ ব্যাখ্যা জানা যায়নি। বেসরকারী ক্রিপ্টো কয়েন নিষিদ্ধ ঘোষনা করার জন্য একটা আইন তৈরির খসড়া বেশ অনেকদিন হ’ল আলোচনা হচ্ছে। কিন্তু এখনও তা সংসদে পেশ হয় নি। এক্ষেত্রে একটি গুরুতর ফাঁক বিজেপি সরকার রেখে দিতে পারে বলে অনেক বিশেষজ্ঞই আশঙ্কা প্রকাশ করছেন।
অর্থ সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান জয়ন্ত সিনহা ২৪শে নভেম্বর, ২০২১ ইকোনমিক টাইমস পত্রিকাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন যে, কমিটি ক্রিপ্টোকারেন্সিগুলির বিষয়ে কোনও স্থির দৃষ্টিভঙ্গি এখনো গ্রহন করেনি, তবে এদেশে ১কোটি ৫০লক্ষ নিবন্ধীকৃত ক্রিপ্টো ব্যবহারকারীর মোট বিনিয়োগের পরিমান ৬০০কোটি টাকা। এদের নিয়েও ভাবতে হবে।
আবার ক্রিপ্টো কারেন্সির পক্ষে থাকা অনেক বিশেষজ্ঞরা দাবি করছেন যে, বিট কয়েন বা ইথেরিয়ামের মতো ক্রিপ্টো কারেন্সিগুলোকে বেসরকারি বা অসরকারি বলা যায় না, কারন এগুলির লেনদেন সংক্রান্ত সব তথ্যই পাব্লিক লেজার এ রাখা হয়। কিন্তু এরা এক বারও বলছেন না যে, এই পাব্লিক লেজার, গেছোদাদা এবং এর ব্যবহারকারী ছাড়া কেউ দেখতে পায় না। ফলে সব আর্থিক লেনদেন ধোঁয়াশার আড়ালেই থেকে যায়।
Cambridge Centre for Alternative Finance-এর তথ্য অনুসারে, চীন দেশে ২০২১সালের গোড়ার দিকে সমস্ত নতুন বিটকয়েনের অর্ধেকেরও বেশি তৈরি করা হয়েছিল। কিন্তু বর্তমানে চীনের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মাধ্যমে চীনা মুদ্রা ইউয়ানের ডিজিটাল মুদ্রা বাজারে নিয়ে আসার পরিকল্পনা করছে সেই দেশের সরকার এবং একই সাথে অন্যান্য সমস্ত ক্রিপ্টো কারেন্সির লেনদেন নিষিদ্ধ ঘোষনা করেছে।
রিজার্ভ ব্যাঙ্ক ভারতীয় মুদ্রা ‘টাকা’র ক্রিপ্টো কারেন্সি বাজারে আনলেও, সব ধরনের বেসরকারি বা অসরকারি ক্রিপ্টো কারেন্সির লেনদেনের ওপর সম্পূর্ণ নিষেধাজ্ঞা জারি না করলে, কালো টাকার বাড় বাড়ন্ত কোনও ভাবেই আটকানো সম্ভব নয়।
নিষিদ্ধ জগতের সব ধরনের লেনদেনই হয় পর্দার আড়ালে থাকা এই ডিজিটাল মুদ্রার মাধ্যমেই। যত এই অনিয়ন্ত্রিত মুদ্রার ব্যবহার বাড়বে ততই নিষিদ্ধ অন্ধকার জগতের লেনদেনও বাড়বে আর ধান্দার ধনতন্ত্র এই ধরনের ফাটকা কারবারের রমরমাই চায়। তাই ধান্দার ধনতন্ত্রের ঘোষিত প্রতিনিধি বিজেপি’র মতিগতি এখনও অস্পষ্ট।
ঋণ – ইকোনমিক টাইমস, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, ওয়াল স্ট্রীট জার্নাল, ওয়াশিংটন পোস্ট পত্রিকা সমূহ এবং ব্যাঙ্করেট ওয়েবসাইট।