মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী। ভারতীয় জননায়কদের মধ্যে তাঁর অগ্রগণ্য স্থান জনমানসে অবিসংবাদিভাবেই স্বীকৃত। যে বিচারধারা নিয়ে তিনি তাঁর জীবন অতিবাহিত করেছেন তার সঙ্গে সকলে সব প্রশ্নে সহমত না হতে পারলেও ভারতের জনজীবনে তাঁর প্রভাবকে কোনোভাবেই অস্বীকার করা যায়না। স্বাধীনতাপূর্ব ভারতে তাঁর যে কর্মময় জীবন তা একটি জাতির জাগরণে বহু ইতিবাচক ক্ষেত্র রচনা করেছিল। এটা সমগ্র জাতির দুর্ভাগ্য যে , যে দেশের স্বাধীনতার জন্য তিনি তাঁর মত ও পথে আজীবন সচেষ্ট ছিলেন, সেই দেশ স্বাধীনতা লাভ করার বর্ষপূর্তির পূর্বেই , এক উগ্র সাম্প্রদায়িক শক্তির ঘৃণ্য চক্রান্তে তাঁকে খুন হতে হল। ফলে স্বাধীনতা উত্তর দেশ গঠনে তাঁর ভূমিকা থেকে দেশবাসীকে কার্যতঃ বঞ্চিত হতে হল।
গান্ধীজীর অনুশীলিত মত ও অনুসৃত পথ নিয়ে যেমন অনেকের বিহ্বলতা আছে আবার তা নিয়ে বহু বিতর্ক আছে , সমালোচনাও আছে। কিন্তু একজন মানুষ সম্পর্কে মূল্যায়ন করতে গিয়ে অন্ধআনুগত্যজনিত আবেগ থেকে তাঁর উপর ’দেবত্ব’ আরোপ করা বা অসহিষ্ণুতাজনিত অসূয়া থেকে তাঁকে অশালীন আক্রমণ করার কোন পদ্ধতিকেই গ্রহণ করা যায়না। খন্ড খন্ড অংশের সমাহার হিসেবে একজন মানুষকে বিচার না করে, তাঁর সমগ্রতাকে বিবেচনায় রেখে নানা সিদ্ধান্ত ও কর্মকান্ডের মূল্যয়ন করাকেই যুক্তিযুক্ত পদ্ধতি বলে মনে হয়। সামগ্রিকতার নিরিখে গান্ধীজী ছিলেন সেই মানুষ যিনি সত্য ও অহিংসাকে নিজের জীবনের ধ্রুবতারা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিলেন। মহাপণ্ডিত রাহুল সাংকৃত্যায়নের ভাষ্য অনুযায়ী–’গান্ধীজী বেঁচে ছিলেন মানুষেৰ জন্যই, তিনি সারাজীবন সর্বসাধারণের জন্য সংঘর্ষ করেছেন। …. জাতিভেদ প্রথা উচ্ছেদের জন্য এবং সহস্র মানুষের প্রাণ রক্ষার জন্য গান্ধীজী দক্ষিণ আফ্রিকায় একবার তাঁর জীবন পর্যন্ত পণ করেছিলেন। …. তাঁর ধমনী-শিরায় প্রবাহিত ছিল বহু মানবের কল্যাণ কামনা’’ (’আজকাল’, হিন্দী মাসিক পত্রিকা, বিশেষ সংখ্যা, ১৯৪৮)। এর মধ্যে কোনো অতিশয়োক্তি আছে বলে মনে হয়না |
পরাধীন ভারতে জাতীয় রাজনীতির মঞ্চে গান্ধীজীর আগমন যে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছিল তার
সাক্ষ্য তো ইতিহাসের পাতাতেই রয়েছে | ভারতীয় ঐতিহাসিকদের মধ্যে কয়েকজন তাঁর কর্মকালের উত্তুঙ্গ সময়কে জাতীয় আন্দোলনে ‘গান্ধী যুগ’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন | যদিও একথা গভীরভাবে সত্য যে ইংরেজরা এদেশের রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের অনতিকাল পর থেকেই দেশের নানা প্রান্তে বিদেশী শাসনের বিরুদ্ধে মানুষের প্রতিবাদ , বিক্ষোভ প্রদর্শিত হতে থাকে , যা কোথাও কোথাও বিদ্রোহের আকারও গ্রহণ করে | কিন্তু ১৮৫৭ – র মহাবিদ্রোহের পূর্ব পর্যন্ত , তার অধিকাংশই খুব একটা সংগঠিত রূপ পরিগ্রহণ করে দীর্ঘমেয়াদি ফসল তুলতে পারেনি | মহাবিদ্রোহের পরবর্তীকালে ১৮৮৫ সালে জাতীয় কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠা জাতীয় আন্দোলনে নতুন ধারার সৃষ্টি করে | তেমনি ১৯১৫ তে গান্ধীজীর স্বদেশে প্রত্যাবর্তন এবং রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ জাতীয় আন্দোলনের অভিমুখকে বদলাতে সমর্থ হয়েছিল | যদিও তাঁর কর্মজীবনে বেশ কিছু সিদ্ধান্ত এবং কার্যক্রম নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে এবং সেসব প্রশ্নের যৌক্তিকতাও যথেষ্ট , কিন্তু তার জন্য উপরোক্ত সত্যকে অস্বীকার করা যায়না |গান্ধীজীর জন্মদিবস উদযাপন উপলক্ষ্যে শান্তিনিকেতনে আয়োজিত সভায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষণে সেই সত্য প্রকাশিত হয়েছে এক অনির্বচনীয় সাহিত্য সুষমায় – ” কেবলমাত্র রাষ্ট্রনৈতিক প্রয়োজনসিদ্ধির মূল্য আরোপ করে তাঁকে আমরা দেখবো না , যে দৃঢ় শক্তির বলে তিনি আজ সমগ্র ভারতবর্ষকে প্রবলভাবে সচেতন করেছেন সেই শক্তির মহিমাকে আমরা উপলব্ধি করব | প্রচন্ড এই শক্তি সমস্ত দেশের বুকজোড়া জগদ্দল পাথরকে আজ নাড়িয়ে দিয়েছে | ইনি আসবার পূর্বে , দেশ ভয়ে আচ্ছন্ন , সংকোচে অভিভূত ছিল ؛ কেবল ছিল অন্যের অনুগ্রহের জন্য আবদার – আবেদন , মজ্জায় মজ্জায় আপনার ‘পরে আস্থাহীনতার দৈন্য |…….. ভারতবর্ষের স্বকীয় প্রতিভাকে অন্তরে উপলব্ধি করে তিনি অসামান্য তপস্যার তেজে নতুন যুগগঠনের কাজে নামলেন | আমাদের দেশে আত্মপ্রকাশের ভয়হীন অভিধান ততদিনে যথোপযুক্ত রূপে আরম্ভ হল ” ( ‘গান্ধীজি’, রবীন্দ্র রচনাবলী , চতুর্দশ খন্ড ) |
বর্তমান সময়ের নিরিখে , তাঁকে নিয়ে কিছু প্রসঙ্গে আলোচনা জরুরী হয়ে পড়ছে | গান্ধীজী তাঁর ব্যক্তিগত জীবনে , নিজে যে হিন্দু ধর্মের একজন প্রবল অনুরাগী ছিলেন সে কথা দ্বিধাহীন চিত্তে বহুবার, বহুস্থানে উচ্চারণ করেছেন। ১৯২৪ থেকে ১৯৩৭ সাল পর্যন্ত ’ইয়ং ইন্ডিয়া’ ও ’হরিজন’ পত্রিকায় তিনি এ’সম্পর্কে বহু প্রবন্ধ লিখেছেন। তাঁর অসংখ্য লেখা ও বক্তৃতায় হিন্দুধর্ম সম্পর্কে বহু কথা বললেও তার মধ্যে কোথাও, একবারের জন্যও ‘হিন্দুত্ব’ শব্দটির আমদানী হয়নি, যা আজকের ভারতের রাষ্ট্রশাসকদের অনুসৃত বিভেদ পন্থার মূল মন্ত্র। এই ’হিন্দুত্ব’র গরল পান করিয়ে ভেদশক্তির প্রবক্তারা ’একদেশ – একজাতি – একভাষা – একধর্ম – একভোট – একদল – একনেতা’ – র একনায়কতন্ত্রী শাসন ব্যবস্থার দিকে নিয়ে যেতে চাইছে বহুত্ববাদী সংস্কৃতির অত্যুজ্জ্বল প্রতীক আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি ভারতকে। এমনকি এই কাজে তারা ব্যবহার করতে চাইছে গান্ধীজীর মতো মানুষকেও । অথচ গান্ধীজীর বিশ্বাসের হিন্দুধর্ম –’’সকল ধর্মের মধ্যে সবচেয়ে সহনশীল। এর নীতি হল সকলকে সাগ্রহে অন্তর্ভুক্তিকরণ’’, তাঁর মতে হিন্দু ধর্ম হলো–”অহিংস উপায়ে সত্যকে অনুসন্ধান করা’’ (‘What is Hinduism’, Young India, 24 April, 1924)।
যদিও উগ্র সাম্প্রদায়িক শক্তির প্রতিভূ বর্তমান রাষ্ট্রপরিচালকদের পূর্বসূরীরা তাদের সংকীর্ণ সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গী থেকে গান্ধীজীর সঙ্গে বিরোধ করতে, এমনকি তাঁকে হত্যা করতেও কুণ্ঠিত হননি, তথাপি ভারতীয় সমাজে গান্ধীজীর গ্রহণযোগ্যতাকে অস্বীকার করতে না পেরে , নিজেদের দুষ্কর্মের সাফাই দিতে তাদের উত্তরসূরীরা তাঁকে ব্যবহারের চেষ্টা করে। তাদের পক্ষ থেকে একথা প্রচার করা হচ্ছে যে ’রামরাজ্য’র ভাবনা তো গান্ধীজীই করেছিলেন। তাহলে এখন তার পক্ষে প্রচার করলে আপত্তি কোথায়? হ্যাঁ , একথা ঠিক যে রাজনীতির ক্ষেত্রে ’রামরাজ্য’ শব্দবন্ধটি প্রথম উত্থাপন করেছিলেন মোহনদাস গান্ধী। কিন্তু তাঁর বিচারধারা সম্পর্কে যাঁরা সম্যকভাবে অবহিত তাঁরা নিশ্চয়ই জানেন যে গন্ধীজী এই শব্দটিকে ব্যবহার করেছিলেন প্রতীকি অর্থে। তাঁর ধারণার ’রামরাজ্য’ মানে, পতিত মানুষের দুঃখ-দুর্দশা মোচন করে এমন একটি রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা যেখানে ’ঈশ্বর’ ও ‘’আল্লাহ’ অভিন্ন এবং তাঁরা সকলকেই সমান দৃষ্টিতে দেখেন, যেখানে জাতিভেদ, অস্পৃশ্যতা, অসাম্য নেই, সত্য ও অহিংসার ভিত্তিতে যে ব্যবস্থা পরিচালিত হবে। এটা অনেকটাই যে কাল্পনিক প্রস্তাবনা সে বিষয়ে সন্দেহ না থাকলেও, এই ’রামরাজ্য’-র সঙ্গে যে সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গীর কোন সম্পর্ক নেই, তা অত্যন্ত জোরের সঙ্গেই বলা যায়। প্রকৃতপ্রস্তাবে গান্ধীজীর বিচারধারার ’পরিত্রাতা রাম’ আর মোদীবাহিনীর ’ভোটক্রেতা রাম’-এর মধ্যে কোন সামঞ্জস্য, সাযুজ্যই নেই।
‘Equality of Religions’ প্রবন্ধে গান্ধীজী লিখেছেন – “আমার কাছে বিভিন্ন ধর্ম হলো একই বাগানের বিভিন্ন ফুল অথবা একই মহিমময় বৃক্ষের শাখাসমূহ “
( Harijan , 30 January 1937 ) | আর বিজেপি নেতাদের পবিত্র ‘গুরুজী’, সাভারকরের ভাবশিষ্য , মাধব সদাশিবরাও গোলওয়ালকর তার ‘Bunch of Thoughts’ বইতে লিখেছেন – ” আজকাল ‘ভারতীয়’ শব্দটি বিষয়ে অনেকের ভুল ধারণা রয়েছে | যে ‘Indian’ শব্দটির মধ্যে এ দেশে বসবাসকারী বিভিন্ন সম্প্রদায় যেমন মুসলিম , খ্রিস্টান , পার্শি ইত্যাদি সকলকেই অন্তর্ভুক্ত করা হয় , সাধারণভাবে এই শব্দটির অনুবাদ হিসেবে ‘ভারতীয়’ শব্দটি ব্যবহার করা হয় | কাজেই আমরা যখন আমাদের বিশেষ সমাজের কথা বলতে চাই তখন ‘জাতীয়’ শব্দটি সম্ভবত আমাদের বিভ্রান্ত করে | এর যে অর্থটি আমরা সর্বসমক্ষে জ্ঞাপন করতে চাই , তার সম্পূর্ণ এবং সঠিক ব্যঞ্জনা ‘হিন্দু’ শব্দের মধ্যেই রয়েছে “( পৃষ্ঠা ৯৮ ) | বর্তমান রাষ্ট্রপরিচালকদের কাছে এই সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির ভেদবুদ্ধির প্রচারক এম এস গোলওয়ালকর হলেন পূজ্যপাদ পুরুষ আর গান্ধীজী পরিত্যাজ্য ব্যক্তি | বুঝতে কোন অসুবিধা হয় কাদের হাতে রয়েছে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব ?
গান্ধীজী জাতিভেদ প্রথা ও অস্পৃশ্যতার এতটাই বিরোধী ছিলেন যে দ্বিধাহীনভাবেই তিনি বলতে পেরেছিলেন – “অস্পৃশ্যতা হিন্দু ধর্মের কোনো অংশ নয় , এবং যদি তা (অংশ ) হয় , তাহলে সেই হিন্দুধর্ম আমার জন্য নয়” | কিন্তু ‘ভাগবত’ কিংবা ‘মনুস্মৃতি’ তে তো অস্পৃশ্যতার অনুমোদন আছে এবং এগুলি তো হিন্দুধর্মেরই অংশ , তাহলে কি করে বলা যাবে যে হিন্দুধর্মের ক্ষেত্রে এসবের অনুমোদন নেই ? এ’প্রশ্নে গান্ধীজী কড়া সমালোচনা করে বলেছেন – ” আমি হিন্দুধর্মের মূলভাবকে অনুধাবন করতে পেরেছি বলে দাবী করি | অস্পৃশ্যতাকে অনুমোদন দিয়ে হিন্দুধর্ম পাপ করেছে “( Young India , 27 April 1921 ) | এখানে একটি প্রসঙ্গ উত্থাপন করা জরুরী যে , সাধারণভাবে ‘হিন্দুধর্ম’ বলতে যা বোঝায় তার সঙ্গে আরএসএস বা মোদী-শাহ বাহিনী প্রচারিত ‘হিন্দুত্ব’ -র কোনো সম্পর্কই নেই | ‘হিন্দুধর্ম’ কোন বিধিবদ্ধ ধর্ম নয় , এই ধর্মে না আছে একক ধর্মগ্রন্থ , না আছে একক দেবতা | দেবতা তো তেত্রিশ কোটি ! আর মত যত পথও তত | সুতরাং যুক্তিহীন, বোধহীন ভাষ্যে ভরা ‘মনুস্মৃতি’র নির্দেশ যেমন আরএসএস , বিশ্ব হিন্দু পরিষদের কাছে অবশ্য পালনীয় , তেমনি কোটি কোটি সাধারণ, এমনকি ধর্মপ্রাণ হিন্দুর কাছে তা একেবারেই পরিত্যাজ্য | এই প্রশ্নে গান্ধীজীর উদার মনোভাব এবং দৃঢ় অবস্থান, তাঁকে হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরাগভাজন করে তুলেছিল |
যে মানুষ ধর্মানুরাগী হওয়া সত্বেও ” নিজের বিবেকযন্ত্রণা মোচনের রাস্তা হিসেবে ” কুসংস্কারাচ্ছন্ন , পশ্চাদপদ ধর্মীয় অনুশাসনকে না বেছে নিয়ে বরং বেছে নেন “নিজের দেশ ও তার মধ্য দিয়ে মানবতার সেবায় বিরামহীন পরিশ্রমকে”, সেই মানুষটি জাতির কাছে সম্যকভাবে সমাদৃত ও গ্রহণীয় হলেও , ভেদবাদী রাজনীতিকদের কাছে , আত্মস্বার্থচরিতার্থকামী রাষ্ট্র পরিচালকদের কাছে গ্রহণযোগ্য হবেন কেন ? তাই তাদের পূর্বসূরীরা সেই মানুষটিকে খুন করে আর তাদের বর্তমান প্রজন্ম সেই খুনের ষড়যন্ত্রকারী , এমনকি খুনিদের নামে পর্যন্ত জয়ধ্বনি দেয় , তাদের মহিমাকীর্তন করে |
আজ যখন প্রচারবাজ প্রধানমন্ত্রী সংসদকক্ষে দাঁড়িয়ে আত্মগরিমার কুৎসিত মগ্নতায় নিজেকে ’ঈশ্বরের বরপুত্র’ বলে জাহির করেন এবং সেই সংসদকক্ষেই তাঁর অনুগত সাংসদ অন্যদলের এক সাংসদকে জাত তুলে কাঁচা ভাষায় আক্রমণ করে, তখন এই ঘনায়মান তমসাবৃত পরিস্থিতির মধ্যে দাঁড়িয়ে আমরা স্মরণ করি জাতপাত আর অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধে সম্মুখসমরে অবতীর্ণ হওয়ার সাহসসম্পন্ন যোদ্ধা, জননায়ক মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীকে।
আলোচনায় ইতি টানবো রাহুল সাংকৃত্যায়নের একটি লেখার অংশবিশেষ উদ্ধৃত করে | ১৯৪৮ – এর ৩০ জানুয়ারি , গান্ধীহত্যার পরিপ্রেক্ষিতে রাহুল লিখলেন – “আমরা ধীরেসুস্থে হলে (মথুরা সাহিত্য সভা ) ভাষণ দেবার জন্য বেরোতে যাচ্ছি , এমন সময় যে খবর শুনতে পেলাম তাতে কানকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না | ….. কয়েক মিনিট পরে পরে রেডিও সমানে পুনরাবৃত্তি করে যাচ্ছে — কোনো হিন্দু আততায়ী আজ দিল্লীতে গান্ধীজীকে মেরে ফেলেছে | — এ কি একটা বিশ্বাস করার মতো কথা ? গান্ধীজী অজাতশত্রু ছিলেন | কারো অনিষ্ট তিনি চাননি | তাঁরও শত্রু জন্মাতে পারে ? তাও হিন্দু সভ্যতা এবং সংস্কৃতি নিয়ে গর্ব করার মতো মানুষদের মধ্যে ? ….. মানুষ মতের বিরোধ মত দিয়ে করেছে , তলোয়ার আর গুলির সাহায্য কখনো নেয়নি | অধম গডসে কে জানে কি ভেবে এমন কাজ করল | কিন্তু, গডসেকে ভাল-মন্দ কিছু বলাটা ঠিকও নয় , যখন আমরা জানি যে , ক্ষমতা হস্তগত করার জন্য অধীর উঁচুজাতির বহু লোক গডসের পিছনে ছিল | তারা পুনরায় পেশোয়ারাজত্ব স্থাপন করার স্বপ্ন দেখছিলো | কিন্তু এই স্বপ্ন কখনই সফল হবে না | ইংরেজদের থাবার থেকে বেরিয়ে এসে ভারত নিজের ভবিষ্যৎ কিছু উচ্চজাতির স্বেচ্ছাচারী শাসকদের হাতে তুলে দিতে পারেনা | …. বহুজন হিত যেদিকে , সেদিকেই ভারতীয় জনগণ আর তার দেশ যাবে | নদীর স্রোত সরলরেখায় প্রবাহিত হয়না , সেইভাবেই জনতার স্রোতও সরলরেখায় তার গন্তব্যে পৌঁছতে পারে না, কিন্তু তার একটা দিক থাকে , যেদিকে তাকে যেতে হয়” ( ‘আমার জীবনযাত্রা’, চতুর্থ খন্ড ) |
দীর্ঘ উদ্ধৃতি , অনেক কাল আগের লেখা, কিন্তু সময়ের প্রেক্ষিতে আজও খুবই প্রয়োজনীয় | লেখার মধ্যে ইঙ্গিত স্পষ্ট এবং তার সঙ্গে এক প্রত্যয়ী আশাবাদ | এই আশাবাদকে বাস্তবায়িত করার কারিগর সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী এ’দেশের শতকোটি মানুষ | প্রয়োজন এক তীব্র লড়াইয়ের | তার ক্ষেত্র প্রস্তুত করে , মহাভারতের জনতাকে তাতে সামিল করে , লড়াইয়ে জয়লাভ করার মধ্য দিয়েই শ্রেষ্ট শ্রদ্ধা নিবেদিত হতে পারে জননায়ক মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর প্রতি |