সৌম্যদীপ রাহা,
ওয়েবডেস্ক এর পক্ষে কৃষ্ণায়ন ঘোষ
তাঁর ৬১ বছরের জীবনে ১৭ বছরই কেটেছে স্বৈরশাসকের কারাগারে বন্দী হয়ে। অপরাধ? সাম্রাজ্যবাদী পুঁজিবাদীদের বিরুদ্ধে কবিতায় বিপ্লব আর স্বপ্নের জানান দিয়েছিলেন তিনি, লিখেছিলেন সুন্দর এক পৃথিবীর স্বপ্ন, এক মানবিক সমাজের গল্প। এক সময় দেশচ্যুতও হয়েছেন অত্যাচারে না টিকতে পেরে। চেয়েছিলেন, তার কবরটা যেন অন্তত হয় জন্মভূমি তুরস্কের মাটিতে। সেই চাওয়াটাও পূর্ণ হয়নি বিপ্লবী এই কবির। তার শেষ ঠিকানা হয়েছে রাশিয়ার মস্কোতে। তাঁর লেখনীকে স্তব্ধ করতে পারেনি ওরা।
তিনি নাজিম হিকমত।
শিল্পের জন্য, শিল্প বা কবিতার জন্য কবিতা নয়; বরং ‘মানুষের জন্য সবকিছু’ এই কমিউনিস্ট ভাবাদর্শে উজ্জীবিত হয়েছিলেন নাজিম হিকমত ছেলেবেলা থেকেই। ছেলেবেলা থেকে তিনি স্বপ্ন দেখতেন—একদিন মানুষের মুক্তি হবে। স্বপ্ন দেখতেন, দরিদ্র ও নিম্নবর্গের মানুষ একদিন রাষ্ট্রে তাদের ন্যায্য অধিকার ফিরে পাবে। স্বপ্ন থেকেই শুরু হয় সংগ্রাম। খুব অল্প বয়সেই তিনি বুঝতে পারলেন, বিপ্লব ছাড়া মুক্তি নেই। বুঝলেন, বিশ্বব্যাপী কমিউনিস্ট–ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়েই পূর্ণ হতে পারে তাঁর সেই স্বপ্ন। যুক্ত হয়ে গেলেন বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে। লেখালেখি শুরু করে দিলেন বিপ্লবী ধারার পত্রিকায়।
কিন্তু জন্মভূমি তুরস্কে তখন চলছে চরম দক্ষিণপন্থী সরকারের শাসন। যেকোনো বামপন্থী কার্যক্রম কঠোর হাতে দমন করা হচ্ছিল। নাজিম হিকমত ১৯২৪ সালে কমিউনিস্ট পার্টি তে যোগ দেন। মাত্র ২২ বছর বয়সে বন্দী হলেন প্রথমবার। কিন্তু স্বৈরশাসক বেশি দিন রাখতে পারেননি তাঁকে জেলে। তাঁর মুক্তির জন্য বিবৃতি দিলেন, মিছিল করলেন পাবলো নেরুদা, জ্যঁ পল সার্ত্র ও আরও অনেক সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবী। বিশ্বব্যাপী প্রতিবাদ হলো। মুক্তি দিতে বাধ্য হলো সরকার।
একটি কবিতায় পাবলো নেরুদা লিখলেন –
“সদ্য মুক্তি পাওয়া
বন্দীদের একজন নাজিম হিকমত
তার কবিতার মতো
লাল রং সোনার সুতায়
বোনা জামা উপহার দিয়েছে আমায়।”
মুক্তি পেয়েই নাজিম সোজা চলে গেলেন রাশিয়ায়। দীক্ষিত হলেন মার্কসীয় রাজনীতিতে। সান্নিধ্য পেলেন কালজয়ী রুশ কবি মায়াকোভস্কির। লিখতে থাকলেন একের পর এক কবিতা। ছাপা হতে লাগল একের পর এক বই। সেই বই ছড়িয়ে পড়ল দুনিয়াজুড়ে।
উনিশ বৎসর বয়সে তিনি তুরস্কের স্বাধীনতা সংগ্রামে যোগ দিয়েছিলেন। স্বীয় রাজনৈতিক মতাদর্শের বিড়ম্বনায় তাকে বারবার কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়েছে। তাঁর সারা জীবনের অর্ধেক রচনার প্রসূতিগার কারা অন্তরালের অপরিসর স্থানে ও সময়ের প্রাচুর্য্যে। তাঁর জন্ম হয়েছিল ১৯০২ সালে এবং মৃত্যু সোভিয়েত ইউনিয়নে ১৯৬৩ সালে। কখনো বলা হয়েছে তিনি “রোমান্টিক কমিউনিস্ট”, “জেলখানার কবি”; কখনো বলা হয়েছে তিনি তিনি “রোমান্টিক বিপ্লবী”। কণ্ঠে বিপ্লব ও মুক্তির গান গাইলেও নাজিম হিকমতের কবিতা গীতিময়তায় ঋদ্ধ।
নাজিম শেষবারের মতো দেশ ছাড়েন ১৯৫১ সালে। বসবাস শুরু করেন রাশিয়ায়। এক পার্টিতে দেখা হয় ভেরা নামের এক রুশ তরুণীর সঙ্গে, যে ছিল নাজিমের চেয়ে ৩০ বছরের ছোট। দেখামাত্রই প্রেম। কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে নাজিম লিখেছেন, ‘বন্দিজীবনে ১৭ বছর যে মেয়েটিকে আমি কল্পনায় দেখতে পেতাম, স্বপ্নে দেখতাম, তাঁর চেহারা আর ভেরার একই চেহারা, যা বিস্ময়েরও অতীত। অতএব, ভেরার প্রেমে না পড়ে উপায় ছিল না।’
হেলিসিংকি শান্তি সম্মেলনে তুরস্কের কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিনিধি হয়ে উপস্থিত হয়েছিলেন নাজিম হিকমত। তাঁর সঙ্গে দেখা করার জন্য সকলেই উদগ্রীব। কিন্তু কাজে ব্যস্ত থাকার দরুন তিনি সকলের সাথে সাক্ষাৎ করতে পারছেন না। সেই সম্মেলনে আমাদের দেশের প্রতিনিধি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন চিন্মোহন সেহানবীশ। নাজিমের তাঁবুর বাইরে তিনি একজনকে দিয়ে একটি চিরকুট পাঠালেন। তাতে তিনি লিখেছিলেন ‘For poetry ‘। কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনি তাঁবুর ভিতরে প্রবেশ করলেন । কবি সাক্ষাতেই চিন্মোহন বাবুকে বললেন -‘For poetry time is eternal!’।
১৯৫০ সালে তাঁকে নোবেল শান্তি পুরস্কার দেওয়া হয়। পৃথিবীর প্রায় ৪০টির ও বেশি ভাষায় অনূদিত হয়েছে তাঁর লেখা। তাঁর ৬১ বছরের জীবনের ১৭ বছরই কেটেছে স্বৈরশাসকের কারাগারে বন্দী হয়ে। অপরাধ? সাম্রাজ্যবাদী পুঁজিবাদীদের বিরুদ্ধে কবিতায় বিপ্লব আর স্বপ্নের জানান দিয়েছিলেন তিনি, লিখেছিলেন সুন্দর এক পৃথিবীর স্বপ্ন, এক মানবিক সমাজের গল্প। এক সময় দেশচ্যুতও হয়েছেন অত্যাচারে না টিকতে পেরে। চেয়েছিলেন, তার কবরটা যেন অন্তত হয় জন্মভূমি তুরস্কের মাটিতে। সেই চাওয়াটাও পূর্ণ হয়নি বিপ্লবী এই কবির। তার শেষ ঠিকানা হয়েছে রাশিয়ার মস্কোতে। তাঁর লেখনীকে স্তব্ধ করতে পারিনি ওরা। কারণ যে সত্য তিনি তাঁর সৃষ্টিতে তুলে ধরেছিলেন তা সময়ের সাথে সাথে আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
স্বদেশের জন্য কাজ করার মানসে নাজিম ফিরে যান ইস্তাম্বুলে। কিন্তু আবার বন্দী হলেন। এবার জেল টানা আট বছরের।
বন্দী থাকা অবস্থাতেই লিখলেন – ‘মানুষের মুন্ডুটা তো বোঁটার ফুল নয়, ইচ্ছে করলেই ছিঁড়ে নেবে’…
কবিতার নাম ‘জেলখানার চিঠি’ –
প্রিয়তমা আমার
তেমার শেষ চিঠিতে
তুমি লিখেছ ;
মাথা আমার ব্যথায় টন্ টন্ করছে
দিশেহারা আমার হৃদয়।
তুমি লিখেছ ;
যদি ওরা তেমাকে ফাঁসী দেয়
তোমাকে যদি হারাই
আমি বাঁচব না।
তুমি বেঁচে থাকবে প্রিয়তমা বধু আমার
আমার স্মৃতি কালো ধোঁয়ার মত হাওয়ায় মিলিয়ে যাবে
তুমি বেঁচে থাকবে, আমার হৃদয়ের রক্তকেশী ভগিনী,
বিংশ শতাব্দীতে
মানুষের শোকের আয়ূ
বড় জোর এক বছর।
মৃত্যু…
দড়ির এক প্রান্তে দোদুল্যমান শবদেহ
আমার কাম্য নয় সেই মৃত্যু।
কিন্তু প্রিয়তমা আমার, তুমি জেনো
জল্লাদের লোমশ হাত
যদি আমার গলায়
ফাসীর দড়ি পরায়
নাজিমের নীল চোখে
ওরা বৃথাই খুঁজে ফিরবে
ভয়।
অন্তিম ঊষার অস্ফুট আলোয়
আমি দেখব আমার বন্ধুদের, তোমাকে দেখব
আমার সঙ্গে কবরে যাবে
শুধু আমার
এক অসমাপ্ত গানের বেদনা।
বধু আমার
তুমি আমার কোমলপ্রাণ মৌমাছি
চোখ তোমার মধুর চেয়েও মিষ্টি।
কেন তোমাকে আমি লিখতে গেলাম
ওরা আমাকে ফাঁসী দিতে চায়
বিচার সবে মাত্র শুরু হয়েছে
আর মানুষের মুন্ডুটা তো বোঁটার ফুল নয়
ইচ্ছে করলেই ছিঁড়ে নেবে ।
ও নিয়ে ভেবনা
ওসব বহু দূরের ভাবনা
হাতে যদি টাকা থাকে
আমার জন্যে কিনে পাঠিও গরম একটা পাজামা
পায়ে আমার বাত ধরেছে।
ভুলে যেও না
স্বামী যার জেলখানায়
তার মনে যেন সব সময় ফুর্তি থাকে।
বাতাস আসে, বাতাস যায়
চেরির একই ডাল একই ঝড়ে
দুবার দোলে না।
গাছে গাছে পাখির কাকলি
পাখাগুলো উড়তে চায়।
জানলা বন্ধ:
টান মেরে খুলতে হবে।
আমি তোমাকে চাই ;তোমার মত রমনীয় হোক জীবন
আমার বন্ধু,আমার প্রিয়তমার মত…..।।।
আমি জানি, দুঃখের ডালি
আজও উজাড় হয়নি
কিন্তু একদিন হবে।
নতজানু হয়ে আমি চেয়ে আছি মাটির দিকে
উজ্জল নীল ফুলের মঞ্জরিত শাখার দিকে আমি তাকিয়ে
তুমি যেন মৃন্ময়ী বসন্ত, আমার প্রিয়তমা
আমি তোমার দিকে তাকিয়ে।
মাটিতে পিঠ রেখে আমি দেখি আকাশকে
তুমি যেন মধুমাস, তুমি আকাশ
আমি তোমাকে দেখছি প্রিয়তমা।
রাত্রির অন্ধকারে, গ্রামদেশে শুকনো পাতায় আমি জ্বালিয়েছিলাম আগুন
আমি স্পর্শ করছি সেই আগুন
নক্ষত্রের নিচে জ্বালা অগ্নিকুন্ডের মত তুমি
আমার প্রিয়তমা, তোমাকে স্পর্শ করছি।
আমি আছি মানুষের মাঝখানে,ভালবাসি আমি মানুষকে
ভালবাসি আন্দোলন,
ভালবাসি চিন্তা করতে,
আমার সংগ্রামকে আমি ভালবাসি
আমার সংগ্রামের অন্তস্থলে মানুষের আসনে তুমি আসীন
প্রিয়তমা আমার আমি তোমাকে ভালবাসি।
রাত এখন ন’টা
ঘন্টা বেজে গেছে গুমটিতে
সেলের দরোজা তালা বন্ধ হবে এক্ষুনি।
এবার জেলখানায় একটু বেশি দিন কাঁটল
আটটা বছর।
বেঁচে থাকায় অনেক আশা,প্রিয়তমা
তোমাকে ভালবাসার মতই একাগ্র বেঁচে থাকা।
কী মধুর কী আশায় রঙ্গীন তোমার স্মৃতি….।
কিন্তু আর আমি আশায় তুষ্ট নই,
আমি আর শুনতে চাই না গান।
আমার নিজের গান এবার আমি গাইব।
আমাদের ছেলেটা বিছানায় শয্যাগত
বাপ তার জেলখানায়
তোমার ভারাক্রান্ত মাথাটা ক্লান্ত হাতের ওপর এলানো
আমরা আর আমাদের এই পৃথিবী একই সুচ্যগ্রে দাঁড়িয়ে।
দুঃসময় থেকে সুসময়ে
মানুষ পৌঁছে দেবে মানুষকে
আমাদের ছেলেটা নিরাময় হয়ে উঠবে
তার বাপ খালাস পাবে জেল থেকে
তোমার সোনালী চোখে উপচে পড়বে হাসি
আমার আর আমাদের এই পৃথিবী একই সুচ্যগ্রে দাঁড়িয়ে !
যে সমুদ্র সব থেকে সুন্দর
তা আজও আমরা দেখিনি।
সব থেকে সুন্দর শিশু
আজও বেড়ে ওঠে নি
আমাদের সব থেকে সুন্দর দিনগুলো
আজও আমরা পাইনি।
মধুরতম যে-কথা আমি বলতে চাই।
সে কথা আজও আমি বলি নি।
কাল রাতে তোমাকে আমি স্বপ্ন দেখলাম
মাথা উঁচু করে
ধুসর চোখে তুমি আছো আমার দিকে তাকিয়ে
তোমার আদ্র ওষ্ঠাধর কম্পমান
কিন্তু তোমার কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম না।
কৃষ্ণপক্ষ রাত্রে কোথাও আনন্দ সংবাদের মত ঘড়ির টিক্ টিক্ আওয়াজ
বাতাসে গুন্ গুন্ করছে মহাকাল
আমার ক্যানারীর লাল খাঁচায়
গানের একটি কলি,
লাঙ্গল-চষা ভূঁইতে
মাটির বুক ফুঁড়ে উদগত অঙ্কুরের দুরন্ত কলরব
আর এক মহিমান্বিত জনতার বজ্রকণ্ঠে উচ্চারিত ন্যায্য অধিকার
তোমার আদ্র ওষ্ঠোধর কম্পমান
কিন্তু তোমার কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম না।
আশাভঙ্গে অভিশাপ নিয়ে জেগে উঠলাম।
ঘুমিয়ে পড়েছিলাম বইতে মুখ রেখে।
অতগুলো কণ্ঠস্বরের মধ্যে
তোমার স্বরও কি আমি শুনতে পাই নি ?
দেশে দেশে খোলা আকাশের নিচে, সড়ক দ্বীপে, মিছিলে আজও ধ্বনিত হয় ‘জেলখানার চিঠি’। কিন্তু সবচেয়ে বিস্ময়কর হলো ‘জেলখানার চিঠি’র নায়িকা শুধুই কাল্পনিক। মেয়েটির অস্তিত্ব ছিল কেবলই স্বপ্নে, যেন মার্ক্সীয় ভাবধারার কবি বিষ্ণু দের ‘ঘোড় সওয়ার’ কবিতার মতো, যা তিনি পেয়েছিলেন স্বপ্নে। হিকমত লিখেছেন, ‘আমি কল্পনায় নির্দিষ্ট চেহারার একটি মেয়েকে দেখতে পেতাম। তাঁকে স্বপ্নে দেখতাম। তাঁকে ঘিরেই কেটেছে আমার বন্দিজীবন। তাঁকে নিয়েই লিখেছি সব কবিতা। সে-ই ছিল আমার ভালোবাসা ও প্রেরণা। এ কাল্পনিক ভালোবাসা আর প্রেরণাই আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছে জেলখানার নির্জন প্রকোষ্ঠে।’
আজ সেই কবির প্রয়ান দিবস।
তারই লেখার আধারে আমরা আজও তাকে মনে রেখে চলি –
‘যে সমুদ্র সব থেকে সুন্দর
তা আজও আমরা দেখিনি।
সব থেকে সুন্দর শিশু
আজও বেড়ে ওঠে নি
আমাদের সব থেকে সুন্দর দিনগুলো
আজও আমরা পাইনি’